নামকরণের যাথার্থ্য বিচার প্রথাগত সাহিত্যালোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপাতভাবে সাহিত্যের শিরোনাম অপেক্ষা সাহিত্য বস্তুরই প্রাধান্য স্বীকৃত হওয়া উচিত। কেননা কবি তথা সাহিত্যিকের অনুভব বা অভিজ্ঞতার মর্মবাণী নিহিত থাকে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য কর্মটিরই ভিতরে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে নামকরণটি অবান্তর, অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয়। প্রবন্ধ বা কথাসাহিত্যে নামকরণের কিছুটা যৌক্তিকতা থাকলেও কবিতার ক্ষেত্রে নামকরণকে অবান্তর মনে করা যেতেই পারে। যেন কেবল অভ্যাসবশতই কবিতায় একটি নামচিহ্ন বহন করা।
কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখতে গেলে, অন্যান্য সাহিত্য শাখার মতো কবিতারও নামচিহ্নের একটি বিশেষ ভূমিকা থাকেই। কবিতার গূঢ় রহস্যময় ভাববস্তুর সূত্রটি অনেক সময় ধরিয়ে দেয় কবিতার নামকরণ। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় আপাতসারল্যের ভিতরে থাকে রহস্যময় শব্দ-ব্যঞ্জনা, অপ্রথাগত শব্দ প্রয়োগের নিগূঢ় অভিঘাত। ফলে কবির বক্তব্যের তাৎপর্য নিয়ে পাঠক কিছুটা বিমূঢ় বিভ্রাপ্ত বোধ করতে থাকেন। সেক্ষেত্রে কবিতার নামকরণ পাঠককে কিছুটা ইঙ্গিত দান করতে পারে।
অবশ্য শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?’ কবিতার ভাববস্তুতে তেমন কোনো নিগূঢ় জটিলতা নেই। কবির বক্তব্য তাঁর এই কবিতার ভাষার মতোই ঋজু। মৃত্যুশাসিত জীবনের মাঝে বসেই কবি মৃত্যুকে অস্বীকার করে জীবনঘনিষ্ঠ হবার তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করেছেন এই কবিতায়।
আত্মভোগপ্রবণ স্বেচ্ছাচারী মানসিকতা নিয়ে কবি এতকাল জীবন অতিবাহিত করেছেন। ফলে স্বজন পরিজন, সমাজ-সংসারকে নির্বিচারে উপেক্ষা করেছেন কবি। এই আত্মভোগবাদের পথ থেকে ঘুরে দাঁড়াবার একটি বিপরীত মানস-প্রবণতা জন্ম নিয়েছে কবির জীবন-গোধূলিতে।
জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় স্বাভাবিক নিয়মেই কবির মধ্যে জেগেছে আসন্ন মৃত্যুর উপলব্ধি। মৃত্যু তো মানবজীবনে অলঙ্ঘনীয়। যৌবনের সুতীব্র উন্মাদনায় এতদিন কবি মাতালের মতো জীবন নিয়ে স্বেচ্ছাচারী খেলা খেলেছেন। প্রকারান্তরে ভোগের যজ্ঞে তিনি স্বহস্তেই একটু একটু করে সমর্পণ ও দগ্ধ করেছেন তাঁর আয়ুর সমিধ। ফলে একটু একটু করে নিকটবর্তী হয়েছে মৃত্যু। সেই নিকট মৃত্যুর শীতল অনুভবই কবির মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে এযাবৎকালের জীবনাচরণের ভ্রান্তি ও অপরাধের জন্য অনুশোচনাবোধ। কবির সেই সন্তপ্ত উচ্চারণ—”এত কালো মেখেছি দুহাতে/ এতকাল ধরে। কখনো তোমার ক’রে, তোমাকে ভাবিনি।” ফলে অসমাপ্ত অসম্পূর্ণ দায়িত্ব কর্তব্যগুলি, জীবন ও সংসারের আবশ্যিক দায়গুলি সুসম্পন্ন ও সুসম্পূর্ণ করে যাবার একটি আন্তরিক তাগিদও স্বাভাবিকভাবেই জড়িয়ে গেছে আত্মঅনুশোচনার সঙ্গে। তাই কবি একবার ঘুরে দাঁড়াবার কথা ভাবেন।
জীবনের উপান্তে দাঁড়িয়ে কবির চেতনার সামনে আজও হাতছানি দেয় জীবন থেকে পলায়নের দুটি পথ। একটি পথ ভোগের দ্বারা, স্বেচ্ছাচারের দ্বারা, আত্মসুখ সন্ধানের ক্রমাগত তাড়নার দ্বারা অতি-রোম্যান্টিক আত্মবিনাশের পথ। কবি বলেন—
“এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে: আয় আয় আয়”
এই খাদের প্রতীকে সম্ভবত প্রকাশিত হয় সেই আত্মহননের স্বেচ্ছাগৃহীত পথ। চাঁদ সেই রোম্যান্টিসিজমেরই দ্যোতনা আনে। অন্যদিকে জীবন-গঙ্গার তীরে কবি শোনেন মৃত্যুর আহ্বানও—
“এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয়।”
এই দ্বিধাবিভক্ত পথের প্রান্তে দাঁড়িয়ে হয়তো দোলাচলতা জাগে কবির মনে। কবির উদ্দাম বল্গাহীন স্বভাব-স্বেচ্ছাচারী হৃদয় উভয় পথের প্রতিই সমান আকর্ষণ অনুভব করেন। কবি সতর্ক বিবেচনার অপেক্ষা না করে একান্ত উদাসীন বোহেমিয়ানের মতো যে-কোনো পথেই চলে যেতে পারেন। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তেই কবির মনে জেগে ওঠে বিকল্প এক জীবনবোধ। বাস্তব স্নেহবুভুক্ষু জীবন থেকে নার্সিসাসের মতো আত্মরতিমগ্ন রোম্যান্টিকতায় অথবা মৃত্যুর নিস্তব্ধ শীতলতায় তিনি আর পালিয়ে যেতে চান না এখন। তিনি অনুভব করেন স্নেহ-প্রীতি-মমতামাখা জীবন ও সংসারের প্রতি এক অদম্য টান। তাই কবি বলেন—
“যেতে পারি
যে-কোনো দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু কেন যাবো?
সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো।”
অর্থাৎ জীবন থেকে যে-কোনো স্বেচ্ছাচারী পথে কিংবা অমোঘ মৃত্যুর ডাকে চলে যাবার বদলে কবি পরম মমতায় মর্ত্যসংসারকে দুহাতে আঁকড়ে ধরার তীব্র বাসনা প্রকাশ করেন। অতি আধুনিক লক্ষ্যবিচ্যুত বিভ্রান্তির পথ থেকে কবি যেন ফিরে আসতে চান মায়াময় সংসার সীমানায়। মুকুন্দরামের সেই ঈশ্বরী পাটনী কিংবা রামপ্রসাদ-কমলাকান্তের অঙ্কিত উমা-জননী মেনকার সঙ্গে হাংরি জেনারেশনের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় যেন মানসিকতার দিক থেকে একই সমতলে এসে দাঁড়ান। আর এজনা কবি যেন অমোঘ অলঙঘ্যনীয় মৃত্যুর শাসনকেও অনন্য স্পর্যায় উপেক্ষা করতে চান—
“যাবো
কিন্তু, এখনি যাবো না
তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবো,
একাকী যাবো না অসময়ে।”
অর্থাৎ মৃত্যুকে পুরোপুরি অস্বীকার হয়তো করছেন না কবি, কিন্তু সেই মৃত্যুর শীতলতায় হারিয়ে যাবার আগে কবি সংসারের প্রতি সমস্ত দায়িত্ব কর্তব্য সুসম্পূর্ণ করে যেতে চান।
কবিতার নামকরণে কবির এই সুতীব্র জীবন সংরাগটিই প্রকাশিত। যে মৃত্যু অবধারিত, যে পথে উদাসীন কবি অনায়াসেই চলে যেতে পারেন, সেই চলে যাবার হাতছানিকে প্রায় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কবি উচ্চারণ করেন ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?’ কবিতার এই পঙক্তিটিই যখন অবিকৃতভাবে কবিতার শিরোনাম হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যায়, তখন বলাবাহুল্য সেই শিরোনাম সমগ্র কবিতার বক্তব্যকেই সুস্পষ্টভাবে ব্যঞ্জিত করে তোলে।
Leave a comment