দ্বিতীয় প্রজাপতি স্বরূপ কবির লেখনীতে সৃষ্ট অনেক উজ্জ্বল চরিত্রই বর্ণিত ঘটনার টানা-পোড়েনের মধ্যেই সাবলীল হয়ে উঠে, কিন্তু তাদের পদসঞ্চার বর্ণিত ঘটনার চৌহদ্দিতেই থাকে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ চমৎকার, উজ্জ্বল ও সাবলীল হয়েও চরিত্রগুলি গ্রন্থের মাপে মাপে তৈরি। আর এক জাতীয় চরিত্র আছে, যা গ্রন্থের প্রয়োজনে সৃষ্ট হলেও গ্রন্থের চৌহদ্দিকে ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। গ্রন্থে তার নির্দিষ্ট আসনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক-দর্শকের মনে সে চিরস্থায়ী আসন গ্রহণ করে। এমনকি মূল গ্রন্থের সঙ্গে কোনো পরিচয় না থাকলেও, গ্রন্থ নিরপেক্ষ হয়েও চরিত্রটি সাধারণ মানুষের মনের মন্দিরে দেদীপ্যমান হয়ে ওঠে। এই গ্রন্থ-সাপেক্ষ ও গ্রন্থ নিরপেক্ষ – দু’জাতীয় চরিত্রের মধ্যে দ্বিতীয়টি মহত্তর সৃষ্টি, এবং এই জাতীয় চরিত্রের স্রষ্টা কবিও বিরল প্রতিভার উত্তরাধিকারী। কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ নাটকের শকুন্তলা চরিত্র এমনই এক মহত্তর সৃষ্টি। কালের কপোলতলে এক শুভ্র সমুজ্জ্বল অক্ষয় তিলক।

অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ নাটকের নায়িকা শকুন্তলা। এই-ই চরিত্রটির একমাত্র পরিচয় নয়। মহাভারতের আদি পর্বের সামান্য চরিত্রটিকে মহাকবি কালিদাস তাঁর মনের মাধুরী মিশিয়ে অসামান্য করে গড়ে তুলেছেন। তপোবনে ঋষি পালিতা সুন্দরী বনলতা শকুন্তলা। লতার সঙ্গে ফুলের যেরূপ সম্বন্ধ, তপোবনের সঙ্গে শকুন্তলার তেমনি স্বাভাবিক সম্বন্ধ, মহর্ষি কণ্ঠের মালিনী তীরবর্তী আশ্রমে বন্ধল পরিহিতা শকুন্তলা ক্ষুদ্র কলসী হস্তে জল সিঞ্চন করে দিনপাত করছে না। তপোবনের বনভূমি তাঁর কাছে জীবন্ত। শকুন্তলার কথোপকথন এই বনভূমির সঙ্গে। কোনো বৃক্ষের সঙ্গে ব্যঙ্গ, কোনো বৃক্ষকে আদর, কোনো লতার পরিণয় সম্পাদন করে শকুন্তলা সুখী। সীমিত আশ্রমে বালক, বালিকা নিয়েই তাঁর জগৎ। বৃহত্তর নগর জীবনের অভিজ্ঞতা ও জটিলতা তাঁর চরিত্রে নেই। কিন্তু সরলা হলেও শকুন্তলা অশিক্ষিতা নন। তাঁর শিক্ষার চিহ্ন তাঁর লজ্জা।

বনমধ্যে এই অরক্ষিত তপোবনে, তপোবন বাসিনী শকুন্তলাও অরক্ষিত হৃদয়। মৃগশিকারী রাজা দুষ্মন্ত এই অরক্ষিত অঞ্চল থেকেই শিকার করলেন শকুন্তলাকে। উভয়ের দৃষ্টি বিনিময় হল। দুষ্মন্ত মুগ্ধ, শকুন্তলা মোহিত। বনকলিকা শকুন্তলার জীবনে নতুন পর্ব সূচিত হল। দুষ্মন্তের উপস্থিতিতে সখী অনসূয়া-প্রিয়ম্বদার সাহচর্যে নব সঞ্জাত প্রেম শকুন্তলাকে প্রণয়ীরূপে রূপায়িত করল। কিন্তু শকুন্তলার বালিকাহৃদয় সম্পূর্ণ উন্মোচিত হল না। একে সে লজ্জাবনতমুখী, তারপর এ খেলা অসম খেলা। সসাগরা পৃথিবীপতি দুষ্মন্ত হচ্ছেন যেন এক মহাবৃক্ষ আর সেই মহাবৃক্ষের বৃহচ্ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছে শকুন্তলা। ফুটি ফুটি করেও ফুটে উঠতে পারছে কই? শকুন্তলার মানসিক পরিবর্তনের এই মহেন্দ্র লগ্নটিকে কবি কালিদাস সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন।

শকুন্তলা তার মানসিক অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করতে না পারলেও, তার প্রেমে, প্রেমের গভীরতায় কিন্তু কোনো খাদ ছিল না। রাজধানীতে দুষ্মন্তের প্রত্যাবর্তনের পর প্রত্যাশিত কাল পূর্ণ হলেও শকুন্তলাকে নিতে কোনো দূত না আসায় এবং দুষ্মত্তের বিরহে ও চিন্তায় তন্ময় শকুন্তলা তপোবনে সমাগত ঋষি দুর্বাসা কর্তৃক শাপগ্রস্ত হলেন। শকুন্তলার এই দুষ্মন্ত মন্ময়তা এবং ভারতন্ময়তাই প্রমাণ করে যে প্রথম আলাপের কৌতূহলী প্রেম প্রেম-তন্ময়তায় রূপান্তরিত হয়েছে। “Part of the life’ নয়, হয়ে উঠেছে ‘whole existence”। বালিকা শকুন্তলা হয়ে উঠেছে কিশোরী শকুন্তলা।

কিন্তু সুন্দরী, সরলা, কিশোরী, লজ্জাবনতমুখী, সংসার সম্বন্ধে প্রায় অনভিজ্ঞা শকুন্তলা চরিত্রটি ব্যক্তিত্বহীন নয়। লতা মণ্ডপের এই বালিকাই কয়মাস পরে যাত্রা করলেন স্বামীগৃহে। সঙ্গে আছেন মাতা গৌতমী এবং দুই আশ্রমিক। শকুন্তলা চরিত্রের নব-পর্বান্তর আরম্ভ হল। দুষ্মন্তের রাজসভায় রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে চিনতেই পারলেন না। স্ত্রীরূপে শকুন্তলাকে অস্বীকার করলেন। সেই সঙ্কটকালে, সেই প্রত্যাখ্যানের মুহূর্তে এই বালিকাই রাজসভাতলে দাঁড়িয়ে সবার সম্মুখে রাজা দুষ্মন্তকে তিরস্কার করতেও ছিলেন অকুণ্ঠ। আপন চরিত্রের প্রতি রাজার এই কটাক্ষপাতে দলিত ফণা সাপের মতো মস্তক উন্নত করে তিনি দুষ্মন্তকে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন, “অনার্য! আপন হৃদয়ের অনুমানে সকলকে দেখ?” এখানে শকুন্তলা আত্মসচেতন ব্যক্তিত্বে বিকশিতা রমণী।

এইভাবে নাট্যকার কোরকের এক একটা দল উন্মোচিত করে চরিত্রটিকে প্রস্ফুটিত করে তুলেছেন। নানা বর্ণের আলিম্পনে চরিত্রটি করেছেন পরিণততর।

দুষ্মন্তের রাজসভা থেকে প্রত্যাখ্যাত শকুন্তলা ফিরলেন। কখমুনির আশ্রম থেকে দুষ্মন্তের রাজসভা হয়ে চলতে চলতে উপনীত হলেন মহামুনি মারীচের আশ্রমে। শকুন্তলা জীবনের তৃতীয় অধ্যায়ে প্রবেশ করলেন। আশ্রম বালিকা রাজবধূ হতে গিয়ে হয়ে উঠলেন তপস্বিনী শকুন্তলা। জীবনের কণ্টকময় পথে তাঁর পদচারণা আরম্ভ হল। বাল্য ও কৈশোরের অনভিজ্ঞা বালিকা এখন সংসার অভিজ্ঞা রমণী। মহামুনি মারীচের দিব্য আশ্রমে মদনের মাদকতা গ্লানিকে দুঃখ তাপে দগ্ধ করে কল্যাণী তাপসীর বেশে সার্থক প্রেমের প্রতীক্ষা তাঁর আরম্ভ হল। এই আশ্রমে তিনি জন্ম দিলেন দুষ্মন্ত পুত্র ভরতের। শকুন্তলা হলেন ভরত-জননী।

শকুন্তলা নাটকে প্রথম অঙ্কে প্রেয়সী শকুন্তলার সঙ্গে দুষ্মন্তের ব্যর্থ প্রণয় এবং শেষ অঙ্কে ভরত-জননীর সঙ্গে দুষ্মন্তের সার্থক মিলন কবি অঙ্কিত করেছেন। জননী রূপ নিয়েই শকুন্তলা সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছেন। দেবতাদের যুদ্ধে সহায়তা করে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তনের পথে মহামুনি মারীচের আশ্রমে এই পরিপূর্ণা শকুন্তলার সঙ্গেই দুষ্মন্তের নব-পরিচয় হল। এই মিলন কামনাপুরিত দৈহিক মিলন নয়, ভরত-জননী শকুন্তলার সঙ্গে দুষ্মন্তের এই মিলন ভাব-সম্মিলন। রতির আরতিতে যথার্থ প্রেমের উদ্ঘাটন। দুষ্মন্ত শকুন্তলার বাইরের মিলনকে কবি দুঃখে কণ্টকিত পথ দিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্তরের মিলনে সার্থক করে তুলেছেন। এইভাবেই প্রথম প্রণয়ের পূর্ব মেঘকে কবি কালিদাস মঙ্গলের আলোকে দীপ্ত অলকাপুরীর পথে চালিত করে উত্তর মেঘে পরিণতি দান করেছেন। ‘তরুণ বৎসরের ফুল ও পরিণত বৎসরের ফল, মর্ত্য এবং স্বর্গী একাধারে আশ্রয় গ্রহণ করেছে শকুন্তলা নাটকে। আর শকুন্তলা হয়ে উঠেছে মহাকবির এই মহাভাবের যথার্থ অবলম্বন-বিভাব।