রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর ল্যাবরেটরি গল্পের মেরুদণ্ড সোহিনীর সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন, “সোহিনীকে সকলে হয়তো বুঝতে পারবে না, সে একেবারে এখনকার যুগের সাদায়-কালোয় মিশানো খাঁটি রিয়ালিজম, অথচ তলায়-তলায় অন্তঃসলিলার মতো আইডিয়ালিজম্ই হল সোহিনীর প্রকৃত স্বরূপ।”
এই মন্তব্য থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে সোহিনী কোনো সাধারণ মেয়ে নয়, যাকে আর পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা যায়। সে সম্পূর্ণতা স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। সোহিনীকে পাঠক প্রথম দেখে অপ্রত্যাশিত এবং অযাচিতভাবে অসঙ্কোচে পাঞ্জাবে নন্দকিশোরের সামনে এসে নিজেকে নিবেদন করার প্রস্তাব দেবার সময়। সেখান থেকে নন্দকিশোর তাকে নিজের সহধর্মিনী রূপে নিয়ে আসে। সেই সঙ্গে এ কথাও জানা যায় যে, ‘নন্দকিশোর ওকে যে-দশা থেকে নিয়ে এসেছিলেন সেটা খুব নির্মল নয়, নিভৃতও নয়।’
সেহিনীকে পাঠক যতই দেখতে থাকে ততই বিস্মিত হয়। অদ্ভুত এক নারী ব্যক্তিত্ব সোহিনী। যৌবনের প্রারম্ভে সে যে অনেক পুরুষ-সঙ্গ লাভ করেছিল সে কথা নন্দকিশোরের কাছে সে গোপন করেনি। সেই সঙ্গে সে নন্দকিশোরকে কথা দিয়েছিল যে সে নন্দকিশোরকে ঠকাবে না। এই বাকদানের মর্যাদা সে বরাবর দিয়ে এসেছে। এমনকি নন্দকিশোরের সঙ্গে বিয়ের পরেও ল্যাবরেটরিতে যেসব ছাত্রেরা আসতো, তাদের সঙ্গেও তার মন দেওয়া-নেওয়ার পালা চললেও যখনই দেখতো সেই সব যুবকরা তার টাকার থলির দিকে হাত বাড়াচ্ছে তখনই তাদের সরিয়ে দিয়েছে ল্যাবরেটরি থেকে।
বারে বারে নতুন নতুন ছেলের সঙ্গে প্রেমাভিনয় দেখে মনে হতে পারে সোহিনীর মনে কোনো দয়া মায়া নেই। সে কেবলমাত্র ক্ষণিকের সুখ ভোগ করতেই উৎসাহী। কিন্তু চরিত্রটির যদি এইটুকু বিশিষ্টতাই প্রকাশ পেত তা হলে তাকে সম্পূর্ণ রূপে জানা হত না। সোহিনীর মনে যে দয়া মায়া যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়, একটি অপঘাতে মরমর প্রায় রোঁয়া ওঠা কুকুরকে বাঁচিয়ে তোলার দৃষ্টান্তে।
নন্দকিশোরের মৃত্যুর পর ল্যাবরেটরির অধিকার নিয়ে আইনি জটিলতা সৃষ্টি হলে, সোহিনী প্রয়োজনে তার মোহজাল বিস্তার করেও আইনকে তার পক্ষে এনেছিল। বস্তুত তার কাছে শরীরের তথাকথিত পবিত্রতার চেয়ে বড় ছিল সত্যরক্ষার দায়। সতীত্ব, মাতৃত্বর চেয়ে নারীত্বে তাই সে অধিক উজ্জ্বল রূপে প্রতিভাত।
ল্যাবরেটরির উপযুক্ত রক্ষক হিসেবে যখন সে রেবতীকে রাজি করাতে গিয়েছিল, তখন নানা কৌশলে তাকে রাজি করানোর জন্যে নিজেকে নিষ্ঠাবতী ধর্মপ্রাণা বিধবার মতো সাজিয়ে যেমন সে রেবতীর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, তেমনি পাশাপাশি তার মেয়ে নীলাকে আরও একটা তির রূপে রেবতীর দিকে সন্ধান করে রেখেছিল—যাতে নীলার রূপের প্রতি আকৃষ্ট হয়েও রেবর্তী তাদের বাড়িতে আসে। অর্থাৎ অভীষ্ট সিদ্ধির উদ্দেশ্যে কোনো কিছুতেই কোনো দ্বিধা তার মধ্যে ছিল না। কিন্তু এরপর ঘটনাচক্রে যখন রেবতী ল্যাবরেটরির কাজ ফেলে নীলার সঙ্গ লাভে ব্যাকুল হয়ে উঠে ল্যাবরেটবির খরচের টাকা ব্যয় করল, তখনই সোহিনী রেবতীকে ল্যাবরেটরি থেকে বহিষ্কার করে দিল।
সোহিনীর প্রাণ ছিল ল্যাবরেটরি। কেন না, সে নন্দকিশোরকে কথা দিয়েছিল যে তার সাথে সে বেইমানি করবে না। তাই তার মেয়ে নীলা যখন রেবর্তীকে হাত করে ল্যাবরেটরির ও নন্দকিশোরের সঞ্চিত অর্থের ভাগীদার হতে চাইল, তখন সর্বসমক্ষে সোহিনী তার মেয়ে যে নন্দকিশোরের মেয়ে নয় সে কথা জানাতে দ্বিধা করেনি।
সব মিলিয়ে সোহিনীর মধ্যে পাওয়া যায় একটি উজ্জ্বল নারী ব্যক্তিত্ব। যে নারী বিধাতার দোহাই দিয়ে নিজের জীবনকে বিপন্ন করে না, যে নারী ক্রন্দনময়ী নয়, যে নারী নিজের ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন, নিজের ব্রতের ওপর নিষ্ঠাশীলা। যার মধ্যে সন্তানের প্রতি মমতা থাকা সত্ত্বেও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না। যে নারী মুক্ত কণ্ঠে বলতে পারে, “আমি সমাজের আইন-কানুন ভাসিয়ে দিতে পারি দেহের টান পড়ে, কিন্তু প্রাণ গেলেও বেইমানি করতে পারবো না।”—এই ইমানদারির মধ্যেই রয়ে গেছে সোহিনীর নারীব্যক্তিত্বের চরম প্রকাশ।
Leave a comment