রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ল্যাবরেটরি কবির উনআশি বছর বয়সে লেখা অনবদ্য গল্প, যা পড়ে চমকে উঠতে হয়। সেই গল্পের অন্যতম চরিত্র নন্দকিশোর মল্লিক—যাকে নায়ক বলা না গেলেও অন্যতম প্রধান চরিত্রের মর্যাদা দিতে হয়। এই নন্দকিশোর ছিলেন বিদেশি ডিগ্রিধারী এখিনিয়ার। রেলের ব্রিজ বানানোর কাজে ঢুকে দু হাতে অর্থ রোজগার করে চলেছিলেন তিনি। সাধু অসাধু দু দিক দিয়ে অর্জিত সেই অর্থ তিনি নিজের বিলাস ব্যসনে ব্যয় করতেন না। পরে বড়ো সাহেবদের সঙ্গে তার কোনো অশান্তির কারণে চাকরি চলে যায়। কিন্তু বুদ্ধি বিচক্ষণতার জোরে চাকরি চলে যাবার পরে তিনি লোহার ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। সেই টাকা দিয়ে তৈরি করেছিলেন বিজ্ঞান গবেষণার জন্যে একটি অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি। তিনি বুঝেছিলেন, ‘ক্ষমতা আছে আমাদের মগজে, অক্ষমতা আমাদের পকেটে।” তাই এদেশের ছেলেদের জন্যে বিজ্ঞানের বড়ো রাস্তাটা খুলে দিয়েছিলেন তিনি তাঁর অর্জিত টাকা দিয়ে। এ থেকে বোঝা যায় নিজের জীবন দিয়ে তিনি পরাধীনতার গ্লানিকে অনুভব করে তা থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। কেন না, যতদিন তিনি চাকরি করেছিলেন, ততদিন তাঁর মেধা ও বুদ্ধির ওপর নির্ভর করে মাঝারি মাপের সাহেবরা নাম ও অর্থ উপার্জন করে গেছেন। তাঁরা অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নন্দকিশোরের পিঠ চাপড়ে বদান্যতা দেখাবার চেষ্টা করতেন। স্বদেশের মাটিতে তাঁর মেধার জোরে বিদেশির মানমর্যাদা বাড়তো অথচ তাঁকে থাকতে হতো অনেকটাই আড়ালে। এই দুঃসহ অবদমন থেকে তিনি স্বদেশবাসীকে মুক্ত করার ব্রত নিয়েছিলেন ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করে। এইখানে ফুটে উঠেছে তাঁর একজন বড়ো দেশপ্রেমিকের রূপ।
নন্দকিশোর ছিলেন সংস্কার মুক্ত মানুষ। প্রচলিত ধ্যানধারণায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সোহিনীকে জীবনসঙ্গিনী করে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ‘নন্দকিশোর ওকে যে-দশা থেকে নিয়ে এসেছিলেন সেটা খুব নির্মল নয়, নিভৃতও নয়।’ নিয়ে এসে তাকে অবহেলায় ফেলে রাখেননি। নিজের কাজ শিখিয়েছেন সোহিনীকে। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে বলেছেন, ব্রতের মিল করিয়ে তিনি সোহিনীকে পতিব্রতা স্ত্রী করে তুলতে চান। অসবর্ণ বিয়ে বলতে তিনি জাতের ভিন্নতা বুঝতেন না, বুঝতেন কর্মের ও মনের ভিন্নতা। এই রকম আধুনিক মনস্ক নন্দকিশোর তাঁর ল্যাবরেটরির যোগ্য ছাত্র নির্বাচনের জন্যে এক অদ্ভুত উপায় অন্বেষণ করেছিলেন। তিনি ছাত্রদের পড়ানোর সময় সোহিনীকেও সঙ্গে নিতেন। তাদের মধ্যে যেসব ছেলেদের ধ্যান জ্ঞান ছিল বিজ্ঞান সাধনা, তারা সোহিনীর দিকে ফিরেও তাকাতো না, কিন্তু বিজ্ঞানের চেয়ে সোহিনীর প্রতি মনোযোগকারী ছাত্রদের সহজেই বহিষ্কার করে দিতে পারতেন। এ থেকে বোঝা যায়, নন্দকিশোরের বাস্তব বুদ্ধি ছিল প্রখর।
নিতান্ত সংস্কার মুক্ত মানুষ ছিলেন বলেই সোহিনীকে এবং তার মেয়ে নীলাকে মেনে নিতে কোনো দ্বিধা হয়নি তাঁর। লোক চিনতে পারতেন সহজেই, সেই চেনাতেই চিনেছিলেন সোহিনীর মধ্যে লুকানো আগুনকে —যে আগুনের তেজ কখনো বেইমানি করতে পারবে না। নিজেকে সোহিনীর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখেননি নন্দকিশোর। যখন যেখানে গেছেন তাকেও সঙ্গে নিয়ে গেছেন। কারণ তিনি বিশ্বাসী ছিলেন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ব্রতের মিলন সাধনে। কেবল সোহিনীর সন্দেহ প্রবণ মনের জন্যে মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতেন নন্দকিশোর।
সব মিলিয়ে নন্দকিশোর চরিত্রের মধ্যে যে বিশেষত্বটি লক্ষ করা যায়, তা হল নন্দকিশোর ছিলেন সংস্কারমুক্ত উন্নত মনের মানুষ। কর্ম, জ্ঞানচর্চা যাঁর মধ্যে ছিল একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। বিদ্যার ওপর ছিল তাঁর নিষ্কাম ভক্তি। সোহিনীর কথায় তিনি যথার্থই ছিলেন পুজোর আলোর মতো নির্মল তেজবান পুরুষ।
Leave a comment