প্রায় সর্বক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, রবীন্দ্রনাথ নামকরণ করতেন নামীর স্বভাব ব্যক্ত করে। সে পদ্ধতি শুধু তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি নামকরণ করতেন গাছপালার, ফুলেরও এবং বলাবাহুল্য, সর্বক্ষেত্রেই তাঁর নামকরণ আদর্শ রূপেই বিবেচিত হয়েছিল। কোনো মানব শিশুর নামকরণের সঙ্গে, সাহিত্যের সামগ্রীর নামকরণের কিছু পার্থক্য আছে। শিশুর নাম শ্রুতিমধুর এবং সহজ আহ্বান যোগ্য হলেই চলে, কিন্তু সাহিত্যের সামগ্রীর নামকরণের মধ্যে নিহিত থাকে নামকৃত উপাদানটির মর্মকথা বা উদ্দেশ্য বা কোনো বিশেষ বক্তব্য। আবার কখনো বা গল্প বা উপন্যাসের পটভূমিই হয়ে থাকে শিল্পসামগ্রীর নামকরণ। আমাদের আলোচ্য ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের নামকরণ প্রসঙ্গেও এই একই কথা বলা চলে। এখানে পাত্রপাত্রীর পরিণতির চেয়ে সবিশেষ কৌতূহল জেগে উঠেছে নন্দকিশোর নির্মিত ল্যাবরেটরিকে কেন্দ্র করে।

বিদেশি ডিগ্রিধারী এহিনিয়ার নন্দকিশোরের মৃত্যুর পর, নন্দকিশোরের স্বোপার্জিত টাকায় নির্মিত ল্যাবরেটরি, তার স্ত্রী সোহিনী রক্ষণাবেক্ষণ করছিল। সে ল্যাবরেটরির দায়িত্ব অর্পণ করার মতো যোগ্য ব্যক্তির সন্ধান করে অবশেষে রেবর্তী ভট্টাচার্য নামে এক অত্যন্ত মেধাবী ও সনিষ্ঠ বিজ্ঞান গবেষককে খুঁজে বার করে ছিল। সকলেই এ ব্যাপারে একমত ছিল যে রেবর্তীই এই ল্যাবরেটরি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে একমাত্র যোগ্যতম ব্যক্তি।

সোহিনীর মেয়ে নীলা। নীলা সুন্দরী এবং সোহিনীর মতোই স্বেচ্ছাচারী। মায়ের গণ্ডির নির্দেশ অমান্য করাতেই যেন তার প্রধান আনন্দ। সেই জন্যে সে নানা ধরনের বন্ধু জুটিয়ে আনন্দে মগ্ন থাকতে চায়। বাইরের লোকেরাও সোহিনীর ল্যাবরেটরি ও টাকার থলি দেখে নীলার সাহচর্য পেয়ে ধন্য হতে চায়। কিন্তু সোহিনীর পরিষ্কার কথা, সে নীলার হাতে ল্যাবরেটরির ভার বা টাকা কিছুই দিতে রাজি নয়। তাই জাগনী ক্লাব নামে নীলাদের এক সংস্থায় রেবতীকে প্রেসিডেন্ট করে ল্যাবরেটরির টাকা আত্মসাৎ করার জন্যে নীলারা রেবতীকে হলে ভুলিয়ে নিয়ে আসে। রেবতীও প্রথম নারী সান্নিধ্য পেয়ে মোহের ঘোরে বিবেচনা শক্তি রহিত হয়ে ল্যাবরেটরির খরচের জন্যে টাকা চেয়ে ব্যয়বহুল রেস্তোরাঁয় নীলাদের জন্যে ভোজের ব্যবস্থা করে। সেই রেস্তোরাঁয় সোহিনী এসে বুঝতে পারে যে, রেবর্তী মেধাবী হলেও তরুণীদের পাশ কাটিয়ে চলার মতো ব্যক্তিত্ব তার নেই, তাই এই পথ বেয়ে তার ল্যাবরেটরির সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে পারে। সেই মুহূর্তে সে রেবতীকে ল্যাবরেটরির অধ্যক্ষের পদ থেকে বহিষ্কার করে দেয়।

আলোচ্য গল্পের মধ্যে কখনো কখনো সোহিনী, নীলা, রেবতীদের প্রতি এবং বিশেষ করে নীলা ও রেবতীর প্রেমের পরিণতির প্রতি পাঠকের কৌতূহল সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে সোহিনীর মতো একটি ঋজু নারী চরিত্র দেখে তার নামানুযায়ী গল্পের নামকরণ না দেখে কিছুটা অবাক হতেই হয়। কিন্তু সোহিনীর নামে নামকরণ না করে যখন তিনি আখ্যান বস্তুর প্রাসঙ্গিক বিষয় ল্যাবরেটরি-র নামেই নামকরণ করেন তখন কিছু ভাববার অবকাশ থেকেই যায়।

বস্তুত, সোহিনীর নামে গল্পের নামকরণ করা হলে, সোহিনীর স্বেচ্ছাচারিতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়ে যেতে পারতো। তা ছাড়া সোহিনীকে আদর্শ রূপে দাঁড় করালে সমাজে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কাও দেখা দিতে পারতো। তাই সে পথ গল্পকার পরিত্যাগ করেছেন। তা ছাড়া, গল্পের সোহিনী বা তার মেয়ে নীলার পরিণতির চেয়ে ল্যাবরেটরির অস্তিত্ব রক্ষার প্রতিই পাঠকদের মূল কৌতূহল কেন্দ্রীভূত হয়। সোহিনীও ল্যাবরেটরিকে রক্ষা করার জন্যে নিজের মেয়ের জন্মবৃত্তান্ত অকপটে সর্বসমক্ষে জানাতে দ্বিধা করে না। এই পরিণতির কেন্দ্রেও রয়ে গেছে ল্যাবরেটরিকে রক্ষা করার প্রয়াস। এ ছাড়াও সমগ্র কাহিনির মধ্যেই বারে বারে ল্যাবরেটরির প্রসঙ্গই উত্থাপিত ও ভাবিত হয়েছে। তাই আলোচ্য গল্পের ‘ল্যাবরেটরি’ নাম যে সার্থক হয়েছে এ বিষয়ে কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই।