(JAMES W. FESLER’S DEFINITION OF PUBLIC ADMINISTRATION)
অথবা, “লোক প্রশাসন হচ্ছে নীতি বাস্তবায়ন এবং নীতি প্রণয়ন”- বিশ্লেষণ কর।
(“Public Administration is Policy Execution and Policy Formulation.”)
অথবা, “লোক প্রশাসন হচ্ছে ‘গণ’ বা ‘সরকারি’”- ব্যাখ্যা কর।
(“Public Administration is Public.”)
ভূমিকাঃ বিশিষ্ট আমেরিকান লেখক জেমস ডব্লিউ. ফেসলার বলেন, “লোক প্রশাসন হচ্ছে নীতি বাস্তবায়ন এবং নীতি প্রণয়ন” (“Public Administration is Policy Execution and Policy Formulation.”) এবং “লোক প্রশাসন হচ্ছে ‘গণ’ বা ‘সরকারি’” (“Public Administration is Public.”)।
লোক প্রশাসন হচ্ছে নীতি বাস্তবায়ন এবং নীতি প্রণয়নঃ কালের বিবর্তনে মানুষের আচার-আচরণ, কৃষ্টি-সভ্যতা, বিবেক-বুদ্ধি, জীবনযাত্রার প্রণালী যেমন পরিবর্তিত হয়েছে ঠিক তেমনি সে সাথে মানুষের প্রয়োজন, চাহিদা ও নতুন নতুন কর্মকাণ্ডের সুব্যবস্থিত প্রকৃতি ও প্রয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে লোক প্রশাসনের ধারণার ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অর্থাৎ পরিবর্তনশীল সমাজের সাথে খাপ খাওয়াবার লক্ষ্যে লোক প্রশাসনের প্রকৃতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বিশিষ্ট আমেরিকান লেখক জেমস ডব্লিউ. ফেসলার (James W. Fesler) লোক প্রশাসনের উপর গবেষণাধর্মী অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে লোক প্রশাসনের প্রকৃতি নির্ধারণের প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি বিষয়ের কোনরূপ সংজ্ঞা প্রদান না করে বরং এর প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন; আর এ প্রকৃতি হতেই লোক প্রশাসন সম্পর্কে যথাযথ ধারণা লাভ করা যায়৷
প্রথমত, ফেসলার বলেন, লোক প্রশাসন হচ্ছে নীতি বাস্তবায়ন এবং নীতি প্রণয়ন। নীতি বাস্তবায়ন এবং নীতি প্রণয়ন উভয়ই লোক প্রশাসনের কর্মকাণ্ড নির্দেশ করে। প্রকৃতপক্ষে লোক প্রশাসনের অন্যতম কাজ হল লোক-নীতি বাস্তবায়ন করা। এ কাজটি লোক প্রশাসনের সংজ্ঞার সাথে অধিক পরিমাণে সংশ্লিষ্ট। লোক প্রশাসন সরকার কর্তৃক প্রণীত কিংবা আইন সভা কর্তৃক প্রণীত ও গৃহীত নীতিমালা বাস্তবায়ন করে থাকে। কারণ, সরকার কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল কিংবা আইন সভা কোন আইন প্রণয়ন করল, এরূপ যদি বলা হয় তাহলে বুঝা যাবে যে, এটি মুদ্রিত কাগজ, ফাইল বা পুঁথিতে আবদ্ধ নীতিমালার সমাহার বৈ আর কিছুই নয়। একে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত এর কোন মূল্য নেই। আর এ বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বর্তায় লোক প্রশাসনের উপর। প্রশাসকগণ বিভিন্নভাবে সরকারি সিদ্ধান্তসমূহ কার্যকর করে থাকেন।কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে নীতি বাস্তবায়ন ও সিদ্ধান্ত কার্যকর করার কাজটি অত্যন্ত জটিল। এটি যথেষ্ট শ্রমসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ। এর কারণও একাধিকঃ
(ক) নীতি বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর উপর সরকারি নীতি প্রয়োগের দ্বারা চাপ সৃষ্টি হয়৷
(খ) নীতি বাস্তবায়নের ফলে অনেকের ব্যক্তিগত স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটানো হয়ে থাকে।
(গ) কর, খাজনা, বিভিন্ন প্রকার লেভী ইত্যাদি প্রয়োগ ও কার্যকর করতে গিয়ে সরকারি কর্মকর্তাগণ জনগণের বিরক্তির উদ্রেক করেন।
(ঘ) গর্হিত ও আইন–বহির্ভূত কাজে বাধা পড়ে বলে জনগণে সরকারি কর্মকর্তাদের উপর নারাজ হন।
(ঙ) সরকার অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ন্যায় প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিভিন্ন কাজ করে থাকেন; যেমন— সরকারি স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা, বাস ও ট্রাম সার্ভিস, ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা ইত্যাদি অত্যন্ত শ্রমসাপেক্ষ বিষয়৷
(চ) সরকারি কর্মকর্তাগণ জটিল বিষয়াদি; যেমন- পররাষ্ট্র, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, জননিরাপত্তা প্রভৃতি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
(ছ) সরকারি কর্মকর্তাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এমনকি দেশের বাইরেও চাকরি গ্রহণ করতে হয় যা যথেষ্ট জটিল ও দুরূহ কাজ৷
দ্বিতীয়ত, শুধু লোক—নীতি বাস্তবায়নই নয়, লোক—নীতি প্রণয়ন করাও লোক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত আইন সভা কোন আইন প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে লোক প্রশাসকদের উপর নির্ভর করে। আইন সভার সদস্যগণ অনেক সময় আইন সংক্রান্ত নীতিমালার খুঁটিনাটি কার্যাবলির প্রকৃতি সম্পর্কে অবগত না থাকার দরুন প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ আইনের খসড়া প্রণয়ন করে তা আইন সভা কর্তৃক গ্রহণ করার জন্য প্রেরণ করে থাকেন। সরকারি বিশেষজ্ঞগণ, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোকগণ লোক প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং তাদের মাধ্যমে নীতি প্রণয়ন অপেক্ষাকৃত নির্ভুল হবে এ ধারণা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এসব আইন যেহেতু লোক প্রশাসকদের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়ে থাকে সেহেতু তাদের কার্যকারিতা ও সম্ভাব্য প্ৰতিক্ৰিয়া সম্পর্কে তারাই অধিক পরিমাণে অবগত বিধায় প্রচ্ছন্নভাবে সরকারি কর্মকর্তাগণ আইন প্ৰণয়নে পরোক্ষভাবে হলেও অংশগ্রহণ করেন।
এছাড়াও বর্তমানকালে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী আইন পরিষদকে অগ্রাহ্য করে তার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নীতিমালা প্রণয়ন করেন। সুতরাং এ দিক হতে সরকারি কর্মকর্তাগণ প্রত্যক্ষভাবেই নীতি নির্ধারণে অংশগ্রহণ করেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সরকারি কর্মকর্তাগণ শুধু নীতিমালার বাস্তবায়নই করেন না বরং নীতি নির্ধারণেও তাদের ব্যাপক ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়।
লোক প্রশাসন হচ্ছে ‘গণ’ বা ‘সরকারিঃ ফেসলার (Fesler) বলেন, লোক প্রশাসনের অপর একটি বিশেষ প্রকৃতি হচ্ছে এই যে, এটি ‘গণ’ বা ‘সরকারি’। সুতরাং তাত্ত্বিক অর্থে এটি বেসরকারি প্রশাসন হতে স্বতন্ত্র। কার্যাবলি, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যের দিক হতে লোক প্রশাসন হল ‘সরকারি’ বা ‘গণ’। ফেসলারের মতে, লোক প্রশাসন বেসরকারি প্রশাসনের মত নয়। তিনি এ দু’টির মধ্যে কতিপয় পার্থক্যও উল্লেখ করেছেনঃ
(ক) লাভ বা মুনাফাঃ লোক প্রশাসন মুনাফা অর্জনকে মুখ্য বলে মনে করে না। কারণ সরকারি কার্যক্রমে মুনাফা প্রাধান্য পায় না। জনগণের সেবা করা ও সরকারি সুবিধাসমূহ তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই লোক প্রশাসনের অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু বেসরকারি প্রশাসনে মুনাফা অর্জনই মূল লক্ষ্য; এটি জনসেবার উপর খুব জোর প্রদান করে না।
(খ) রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিঃ লোক প্রশাসন মূলত রাজনৈতিক। এটি প্রধানত রাজনৈতিক কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট। রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধানকে বাস্তবায়িত করেন মূলত প্রশাসকগণ। পক্ষান্তরে, বেসরকারি প্রশাসন রাজনৈতিক নীতিমালার সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নয়।
(গ) জবাবদিহিতাঃ লোক প্রশাসন জনগণের স্বার্থে কাজ করে বিধায় এসব কাজ জনগণের প্রত্যক্ষ করার অধিকার রয়েছে। তাই লোক প্রশাসন ব্যাপক অর্থে জনগণের জন্য নিবেদিত; জনগণ তাদের কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন, প্রতিবাদ ও সমালোচনা করতে সক্ষম। কিন্তু বেসরকারি প্রশাসন সেভাবে জনগণের সমালোচনার উপর নির্ভর করে না।
উপসংহারঃ সুতরাং উপরের আলোচনা হতে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, লোক প্রশাসন সরকারি কার্যাবলির সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন যেমন করে থাকে ঠিক তেমনি এটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আইন প্রণয়ন কাজে অংশগ্রহণ করে। আবার লোক প্রশাসন বেসরকারি প্রশাসন হতে পৃথক প্রকৃতির। আর এখানেই জেমস ডব্লিউ. ফেসলারের লোক প্রশাসন সম্পর্কিত ধারণার যথার্থতা।
Leave a comment