লোক প্রশাসন বিজ্ঞান, নাকি কলা?


প্রশ্নঃ লোক প্রশাসন বিজ্ঞান, নাকি কলা? 

ভূমিকাঃ লোক প্রশাসনকে বিজ্ঞান বলে অভিহিত করা যায় কি-না, সে বিষয়ে যথেষ্ট মতভেদ বর্তমান। কেউ কেউ লোক প্রশাসনকে ‘বিজ্ঞান’ বলে অভিহিত করেন। আবার কেউ কেউ এর বিরুদ্ধে মতামত পেশ করেন । তাই লোক প্রশাসন ‘বিজ্ঞান’ না ‘কলা’ এ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ সম্পর্কে জানার পূর্বে আমাদের বিজ্ঞান ও কলা সম্পর্কে ধারণা থাকা আবশ্যক।

(ক) বিজ্ঞানের সংজ্ঞা (Definition of Science): বিজ্ঞানের সাধারণ অর্থ হচ্ছে বিশেষ জ্ঞান। কোন কিছুর বিশেষরূপ জ্ঞানকেই বিজ্ঞান বলে। পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও শ্রেণীবিভাগের সাহায্যে কোন এক বিশেষ বস্তুর উপর আমরা যে সুসংবদ্ধ জ্ঞান লাভ করি, তাই বিজ্ঞান। এ সুসংবদ্ধ জ্ঞানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এ জ্ঞান থেকে প্রাপ্ত সাধারণ সূত্র বা নিয়ম প্রয়োগ করে বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর সত্যাসত্য নির্ণয় করা যায়। তাই বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত ও সর্বক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। ১৯৫০ সালে ইউনেস্কো (UNESCO)-র এক আলোচনা চক্রে সিদ্ধান্ত হয় যে, “The sum of co-ordinated knowledge related to a determined subject.” অর্থাৎ বিজ্ঞান হলো একটি বিষয় সম্বন্ধে সুনিয়ন্ত্রিত চিন্তা, অভিজ্ঞতা, ভূয়োদর্শন ও গবেষণাপ্রসূত জ্ঞানভাণ্ডার। সুতরাং বলা যায়, বিজ্ঞান হলো কোন এক শ্রেণীভুক্ত বিষয়সমূহ সম্বন্ধে শৃঙ্খলিত জ্ঞান। পোন্সকি বলেন যে, “বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসরণই হলো বিজ্ঞানের সর্বপ্রধান মানদণ্ড।” রসায়ন, পদার্থবিদ্যা জীববিদ্যা প্রভৃতিকে বিজ্ঞান পর্যায়ভুক্ত করা যায়৷

(খ) কলার সংজ্ঞা (Definition of Arts): যে বিদ্যা কোন বিশেষ উদ্দেশ্য লাভের জন্য বাস্তব ক্ষেত্রে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার নিয়মকানুন শিক্ষা দেয়, তাকে কলা বলা হয়। কলা বিজ্ঞানের ন্যায় সুসংবদ্ধ জ্ঞান নাও হতে পারে।

লোক প্রশাসনকে বিজ্ঞান বলার পক্ষে যুক্তিসমূহঃ

যেসব লেখক লোক প্রশাসনকে ‘বিজ্ঞান’ হিসেবে গণ্য করেন, তাদের মধ্যে উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson), চার্লস বিয়ার্ড (Charles Beard), ওয়ালাস বি. ডনহাম (Wallace B. Donham), ক্লীউন নেসলি (Cleun Necley), ডব্লিউ. এফ. উইলোবি (W. F. Willoughby), আরউইক (Urwick), মরস্টেইন মার্কস (Morstein Marx) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

• লোক প্রশাসন শাস্ত্রের অগ্রদূত উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson) ১৮৮৭ সালে প্রশাসনকে ‘লোক প্রশাসনের বিজ্ঞান’ (Science of Public Administration) বলে গণ্য করেছেন।

• লোক প্রশাসনকে যারা বিজ্ঞান বলে দাবি করেন, তাদের মধ্যে এক শ্রেণীর লেখক দাবি করেন যে, লোক প্রশাসনের নীতিসমূহ যথেষ্ট মাত্রায় নির্ভুল, সঠিক ও সুনিশ্চিত। অধ্যাপক চার্লস বিয়ার্ড (Prof. Charles Beard) – এ মতবাদের একজন বড় সমর্থক। তিনি তাঁর “Philosophy, Science and Art of Administration’ প্রবন্ধে বলেছেন, “If … we may rightly use the term, science, i.. connection with a body of exact knowledge, derived from experience and observation and a body of rules or axioms which experience has demonstrated to be applicable in concrete practice and to work out in practice approximately as forecast, then we may, if we please, appropriately and for convenience, speak of a science of administration.” অর্থাৎ অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান-সমষ্টির ক্ষেত্রে এবং বাস্তব কার্যক্ষেত্রে প্রযোজ্য ও প্রায় ভবিষ্যদ্বাণীর ন্যায় কাজ করে বলে অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রমাণিত এমন বিধি বা স্বতঃসিদ্ধসমূহের ক্ষেত্রে যদি আমরা বিজ্ঞান কথাটি যথার্থভাবে প্রয়োগ করতে পারি, তাহলে আমরা ইচ্ছা করলে প্রশাসনকেও যুক্তিসঙ্গতভাবে এবং সুবিধাজনকরূপেই বিজ্ঞান বলতে পারি।

• ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্লীউন নেসলি (Cleun Necley) বলেন, “প্রশাসন হলো এমন কতকগুলো তৎপরতা যার সঠিক বিশ্লেষণ দরকার এবং অপরাপর বিজ্ঞানের সাথে তার সঠিক ও সম্যক পরিচয় থাকা দরকার। বিশ্লেষণ, বিশ্লেষণ থেকে সম্যক উপলব্ধি এবং উপলব্ধির মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত যুক্তিনিষ্ঠ ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যাওয়া সম্ভবপর। মানুষ এর চেয়ে উচ্চতর কিছু কামনা করতে পারে না।”

• ওয়ালাস বি. ডনহাম (Wallace B. Donham) লিখেছেন, “প্রশাসন হচ্ছে স্বকীয় কলাকৌশলসম্পন্ন এক বিমূর্ত সামাজিক বিজ্ঞান যাকে জড়িয়ে রয়েছে মানবিক সংগঠনের মাধ্যমে কর্মসাধনের ধারণা ও স্বকীয় তত্ত্বের সমস্যা রয়েছে। প্রশাসনের সাথে বাস্তব কর্মক্ষেত্রে অন্যান্য বিজ্ঞান যথাঃ পদার্থ, জীববিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান সম্পৃক্ত রয়েছে।

• ১৯২৬ সালে ডব্লিউ এফ. উইলোবি ( W. F. Willoughby) বলেছেন যে, “In administration there are certain fundamental principles of general application analogous to those characterizing any science which must be observed if the end of administration, efficiency in operation, is to be secured and that these principles are to be determined… only by the rigid application of the scientific method to their investigation.” অর্থাৎ প্রশাসনে বিজ্ঞানের মত সাধারণভাবে প্রযোজ্য কতকগুলো মৌলিক নীতি রয়েছে, প্রশাসনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সেগুলোকে অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করা উচিত এবং এদের অনুসন্ধান কেবল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির যথার্থ প্রয়োগের মাধ্যমেই এ সকল নীতি নির্ধারণ করতে হবে।

• আরউইক (Urwick) সম্প্রতি বলেছেন যে, একটি সেতু তৈরি করতে হলে যেরূপ প্রশাসন সংক্রান্ত নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়, মানব সংগঠন বা সমিতি পরিচালনার জন্যও অনুরূপ নিয়মকানুন পালন করতে হয়। মরস্টেইন মার্কস (Morstein Marx)-এর মতে, নাগরিক ও কর্মচারীর যৌথ প্রচেষ্টায় সরকারি নীতি পরীক্ষা করা সম্ভব এবং যোগ্য নেতৃত্ব ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তার পরিবর্তন করা যায়। এদের মতে, প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে যুগ যুগ ধরে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সমস্যা সম্পর্কে মানব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ফলে প্রশাসন সম্পর্কে কতকগুলো নির্দিষ্ট মানবিক জ্ঞানের উদ্ভব হয়েছে। খুব সতর্কতার সাথে অনুধাবন করলে লক্ষ্য করা যায় যে, একই রকম সংগঠন ও ব্যবস্থাপনায় মানুষের প্রতিক্রিয়া অনুযায়ী কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। এ সিদ্ধান্ত মৌলিক সমস্যা বিশ্লেষণ ও প্রতিকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

লোক প্রশাসনকে বিজ্ঞান বলার বিপক্ষে যুক্তিসমূহঃ 

যেসব লেখক লোক প্রশাসনকে বিজ্ঞান পদবাচ্য বলে মেনে নিতে রাজি নন, তাদের মধ্যে রয়েছেন জ্যাকব ওয়েনার (Jacob Weiner), অধ্যাপক ফাইনার ( Prof. Finer), রবার্ট এ. ডাল (Robert A. Dahl), ডুয়েট ওয়াল্ডো (Dwight Waldo), এল. ডি. হোয়াইট (L. D. White), মারসন (Merson), মার্শাল ই. ডিমোক (Marshall E. Dimock) প্রমুখ চিন্তাবিদ।

• জ্যাকব ওয়েনার (Jacob Weiner) বলেছেন, “প্রত্যেকে ভালভাবে অবগত আছেন যে, লোক প্রশাসনের নীতিমালা কত ত্রুটিপূর্ণ, ভঙ্গুর ও অনিশ্চিত। আর সে জন্য একে গায়ের জোরে বিজ্ঞান নামে অভিহিত করা নিতান্তই হাস্যাস্পদ ব্যাপার।”

• মারসন (Merson) এবং এল. ডি. হোয়াইট (L. D. White) বলেন, লোক প্ৰশাসন নিখুঁত বিজ্ঞান কখনোই হতে পারবে না। অর্থাৎ লোক প্রশাসন যে কোন ধরনের নির্ভুল বিজ্ঞান বা কখনও সেরূপ বিজ্ঞান হতে পারবে, এ কথা তারা অস্বীকার করেন। কিন্তু তারা জোর মত ব্যক্ত করেন যে, অন্য যে কোন সমাজবিজ্ঞানের ন্যায় লোক প্রশাসনও একটি বিজ্ঞান। অর্থাৎ তারা মত ব্যক্ত করেন যে, লোক প্রশাসনের কমবেশি সুনির্দিষ্ট কার্যক্ষেত্র রয়েছে এবং এ সম্পর্কে বিরাট পরিমাণ তথ্য উপাত্ত (Data) সংগৃহীত হয়েছে, যেগুলোর ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধান পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। সুতরাং বলা যায়, উভয়ে লোক প্রশাসনকে সামাজিক বিজ্ঞানের মর্যাদা দিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে বিষয়টি বিজ্ঞানে পরিণত হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।

• অধ্যাপক ফাইনার (Prof. Finer)-এর মতে, “প্রশাসনের নীতি কোনটি এবং কোনটি নয়, তা স্পষ্ট করে বলা মুশকিল । কাজেই লোক প্রশাসন বিজ্ঞান নয়।”

• লোক প্রশাসন বিজ্ঞান কি না এ সম্পর্কে আচরণবাদী লেখকগণ একটু ভিন্ন ধারণা পোষণ করেছেন। আচরণবাদী লেখক অধ্যাপক হার্বাট এ. সাইমন (Herbert A. Simon) লোক প্রশাসনকে যদিও বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন, কিন্তু সাইমন যে দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞান বলে আখ্যায়িত করেছেন তা অন্যান্য লেখকের অভিমত থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তিনি বিজ্ঞান বলতে কোন অবস্থার নৈতিক দিক নয় বরং তথ্যগত দিকের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়কেই বুঝাচ্ছেন এবং তিনি বিজ্ঞানকে ব্যবহারিক এবং তত্ত্বগত বিজ্ঞান হিসেবে শ্রেণীবিভাগ করেন। একটি তত্ত্বগত বিজ্ঞান হিসেবে লোক প্রশাসন প্রশাসনিক বিষয়াদির মধ্যে কার্যকারণগত সম্পর্ক (Causal relationship) স্থাপন করতে গিয়ে সাধারণভাবে তথ্যগত বিষয়াদির সাথে সংশ্লিষ্ট হয়, তাৎক্ষণিক ব্যবহারের কথা বিবেচনা না করে দৃষ্টান্তস্বরূপ, এরূপ অবস্থার পর এরূপ এরূপ পরিস্থিতি অপরিহার্যরূপেই উদ্ভূত হবে— এ বিষয়ের কথাই বিবেচনা করে। একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান হিসেবে লোক প্রশাসন তাত্ত্বিক প্রশাসন বিজ্ঞানের নিয়মগুলোকে প্রয়োগ করতে যায়; যেমনঃ এরূপ এরূপ অবস্থার সৃষ্টি করতে হলে এরূপ কাজগুলো অবশ্যই করতে হবে। যদিও এ ক্ষেত্রে ‘উচিত-অনুচিতের’ প্রশ্ন উদ্ভূত হয়, তথাপি সেখানে মূল্যবোধের বিষয়টি বিবেচনা করা হয় না।

যেমনঃ সাইমন (Simon) বলেন, “The terms ‘good’ and ‘bad’ when they occur in a study of administration are seldom employed in a purely ethical sense. Procedures are termed ‘good’ when they are conducive to the attainment of special objectives, ‘bad’ when they are not conducive to such attainment. That they are, or are not, so conducive is purely a matter of fact and it is this factual element which makes up the real substance of a administrative science.” অর্থাৎ প্রশাসন সম্পর্কে অধ্যয়ন প্রসংগে যখন ‘ভাল-মন্দ’ কথাগুলো উদ্ভূত হয়, তখন সেগুলো কদাচিৎই সম্পূর্ণ নৈতিক অর্থে ব্যবহৃত হয় । কার্যপদ্ধতিগুলোকে তখনই ‘উত্তম’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, যখন সেগুলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পক্ষে অনুকূল হয়; সেগুলো তখনই ‘মন্দ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, যখন সেগুলো এরূপ লক্ষ্য অর্জনের পক্ষে অনুকূল নয়। এ সকল কার্যপদ্ধতি এরূপ অনুকূল কি না, তা সম্পূর্ণভাবেই একটি তথ্যগত বিষয় এবং এ তথ্যগত দিকই কোন প্রশাসন বিজ্ঞানের প্রকৃত বিষয়বস্তু।

কিন্তু মার্শাল ই. ডিমোক (Marshall E. Dimock), ডুয়েট ওয়াল্ডো (Dwight- Waldo), রবার্ট এ. ডাল (Robert A. Dahl) প্রমুখ চিন্তাবিদ সাইমনের দৃষ্টিভঙ্গিকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন। তারা মনে করেন যে, মানবিক আচরণকে কখনও নির্ভুল বৈজ্ঞানিক নীতিতে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে না এবং এমন কি যদি প্রশাসনিক আচরণের কমবেশি সুনির্দিষ্ট নীতিসমূহ উদ্ভাবন করা হয়ও, তথাপি এ সকল নীতি লোক প্রশাসনের জ্ঞানের ক্ষেত্রে অনমনীয়তা আনয়ন এবং এর ফলে লোক প্রশাসন বিষয়ের বিকাশের ক্ষেত্রে মঙ্গলের চেয়ে অধিকতরভাবে অমঙ্গলেরই সৃষ্টি করবে।

• ডুয়েট ওয়াল্ডো (Dwight Waldo) বলেন, “সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে প্রশাসনিক অনুশীলনের প্রাথমিক বিষয়বস্তু হলো মানুষ, যে মানুষ চিন্তা করে এবং যার মধ্যে মূল্যবোধ আছে । চিন্তাশীলতার অর্থ হলো সৃজনশীলতা ও মুক্ত মন ও স্বাধীন চিন্তাভাবনা। মূল্যবোধ বলতে নীতিবোধ নৈতিকতাবোধ ভাল ও মন্দের বোধশক্তি। এটা বোঝা গেছে যে মানুষের চিন্তা ও মূল্যবোধ নিরূপণে বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুনসমূহ প্রযোজ্য নয়।”

• রবার্ট এ. ডাল (Robert A. Dahl) লিখেছেন, “আমরা লোক প্রশাসন বিজ্ঞান থেকে অনেক দূরে। যতক্ষণ পর্যন্ত না (ক) আদর্শগত মূল্যবোধের অবস্থান সুষ্ঠুভাবে নির্দেশিত না হবে, (খ) লোক প্রশাসনের পরিমণ্ডলে মানুষের প্রকৃতিকে ভালভাবে বোঝা না যাবে এবং তার আচরণের সঠিক বিশ্লেষণ সম্ভব না হবে, (গ) তুলনামূলক পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটা ছবি সামনে না থাকবে যার মধ্য থেকে ইতিহাসের বিচিত্র অভিজ্ঞতালব্ধ ও বিবেচনা নিরপেক্ষ নীতিমালা সাধারণসূত্র বের করা সম্ভব ততক্ষণ পর্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত লোক প্রশাসন সম্ভব নয়।” ডাল (Dahl) মন্তব্য করেন, লোক প্রশাসন মানব আচরণ আলোচনা করে বলেই একে প্রকৃত বিজ্ঞান বলা যায় না।

• মার্শাল ই. ডিমোক (Marshall E. Dimock) যুক্তি দেখান যে, “সাইমনের পদ্ধতি এক আমলাশাহী দৈত্যের জন্ম দেবে। সেখানে স্বাধীন চিন্তাধারার জন্য ব্যক্তি দণ্ডিত হবে এবং সেখানে পৃথক খণ্ড সত্ত্বা কৃত্রিম প্রকৃতির জন্যই প্রশাসন ভেঙ্গে পড়বে।”

উপরোক্ত লেখকগণের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, লোক প্রশাসনের বিষয়বস্তু এত ব্যাপক, জটিল ও অনিশ্চয়তাপূর্ণ যে, একে পশ্চাৎপদ বিষয়ই মনে করতে হয়। তারা মোটামুটি নিম্নবর্ণিত যুক্তিসমূহের অবতারণা করে ‘লোক প্রশাসন যে বিজ্ঞান নয়’– এ কথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। যুক্তিসমূহ নিম্নরূপঃ

১। লোক প্রশাসনের শাশ্বতনীতি, প্রণালী ও উপসংহারে বিজ্ঞানীরা কখনও একমত হতে পারেন না। 

২। সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন কোন নীতি এখনও পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয় নি। সকলেই যার যার ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে বক্তব্য হাজির করতে প্রয়াস পান। এর ফলে লোক প্রশাসনের কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়।

৩। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ন্যায় লোক প্রশাসনের প্রতিপাদ্য বিষয়ে প্রকৃতি ও স্বভাবের নিশ্চয়তা নেই। কারণ মানুষের আচরণ ব্যক্তি বিশেষের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন। এ সর্বজনীন প্রবণতার ফলে লোক প্রশাসনের অধীন ঘটনাকে বিচার-বিশ্লেষণ করা সঠিকভাবে সম্ভব নয় । সে ক্ষেত্রে যে কোন সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত হতে বাধ্য।

৪ । লোক প্রশাসনের বিরামহীন ক্রমবিকাশ ঘটে নি।

৫। লোক প্রশাসনে এমন কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে না যার উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষাকার্য সম্ভব নয় বলে এটা বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত নয়।

৬। লোক প্রশাসনের আচরণ সম্পূর্ণভাবে বিচার-বুদ্ধি দ্বারা পরীক্ষিত নয়। সেখানে ভয়-ভীতি, পছন্দ, আশা-আকাঙ্খা প্রভাব বিস্তার করে।

৭ । এ শাস্ত্রের কোন একটি নির্দিষ্ট অনুশীলন পদ্ধতি নেই। বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন পদ্ধতিতে এর আলোচনা করেছেন।

৮। এটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি শাখা। এ শাস্ত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মত অবাস্তব ও কল্পনার প্রাধান্য দেয়া হয়।

সুতরাং এ শাস্ত্রকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দেয়া মোটেই সমীচীন নয়।