লোক প্রশাসন ও রাজনীতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক |
প্রশ্নঃ লোক প্রশাসন ও রাজনীতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ প্রশাসন ও রাজনীতির সম্পর্ক নির্ধারণ আধুনিককালের একটি জটিল ব্যাপার। প্রশাসন ও রাজনীতির পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে দু’টি পরস্পর বিরোধী মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। প্রথমত, প্রশাসন ও রাজনীতি একে অপরের নিকট হতে সম্পূর্ণ পৃথক। দ্বিতীয়ত, প্রশাসন ও রাজনীতি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। উভয়ের মধ্যকার সম্পর্কের পরস্পর বিরোধী মতবাদ দু’টি নিচে আলোচনা করা হলোঃ
প্রথম মতবাদঃ প্রশাসন ও রাজনীতি সম্পূর্ণ পৃথক-
প্রশাসন তথা লোক প্রশাসনকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে গড়ে তোলার উৎসাহ থেকে কোন কোন প্রশাসন বিষয়ক চিন্তাবিদ লোক প্রশাসন ও রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃবর্গ লোক প্রশাসন ও রাজনীতিকে দু’টি পৃথক বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেন। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উড্রো উইলসন ১৮৮৭ সালে তার ‘Study of Administration’ তথা ‘প্রশাসন সমীক্ষা’ নিবন্ধে সর্বপ্রথম এ দু’টি বিষয়কে স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। সে সময় থেকে ৪০-এর দশকের পূর্ব পর্যন্ত লোক প্রশাসন বিষয়ে যত প্রবন্ধ, পুস্তক ও অন্যান্য আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে, তা উইলসনের এ মতবাদকে সমর্থন জানিয়েছেন। উইলসনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যে সকল প্রশাসন বিশেষজ্ঞ রাজনীতি ও প্রশাসনকে সম্পূর্ণ পৃথক বলে বর্ণনা করেছেন, তাদের মধ্যে ফ্রাঙ্ক জে. গুডনোও (Frank J. Goodnow), ব্লুন্টসলি ( Bluntschli), উইলোবি (Willoughby), ফিফনার ( Pfiffner) সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। তাদের মতে, নীতি নির্ধারণই রাজনীতির প্রধান প্রধান এখতিয়ার, আর লোক প্রশাসনের কাজ হলো ঐ সকল নীতিকে দক্ষতার সাথে বাস্তবে রূপদান করা।
→ উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson) বলেছেন, “রাজনীতি হলো প্রশাসনের আওতা-বহির্ভূত একটি বিষয়। প্রশাসনিক প্রশ্ন কিন্তু রাজনৈতিক প্রশ্ন নয়। রাজনীতিই প্রশাসনের কার্য ও দায়িত্ব স্থির করে দেয় বটে, তাই বলে প্রশাসনের দায়িত্ব রাজনীতির দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে না। ” তিনি আরও বলেন, “যদিও প্রশাসনের ভূমিকা ও করণীয় রাজনীতিই নির্ধারণ করে থাকে, তথাপি প্রশাসনিক কার্যালয়ে তাঁর আনাগোনা অনুচিত। প্রশাসনের অঙ্গন হচ্ছে বাস্তব কাজের অঙ্গন। রাজনীতির দলাদলি, কোন্দল এবং ব্যস্ততা থেকে প্রশাসন অনেক দূরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্ৰশাসন সাংবিধানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিতর্কের পরিসর থেকেও বিচ্ছিন্ন।
→ র্যালফ্ সি. চ্যান্ডলার এবং জ্যাক সি: প্লানো (Ralph C. Chandler and Jack C. Plano) রাজনীতি ও প্রশাসনের মধ্যকার বিভক্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, “Politics- administration dichotomy refers to the view that public administration should be premised on a science of management and kept separate from traditional partisan politics and general policy making. This dichotomy. suggested to American readers by Woodrow Wilson in his 1887 essay “The study of Administration’ posits a major distinction between politics and administration. Politics is the proper activity of administration legislative bodies and other policy-making groups. The administration is the proper activity of administrators, who carry out the policies stated in the laws of the jurisdiction or political unit.”
→ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভেই ফ্রাঙ্ক জে. গুডনোও (Frank J. Goodnow) ‘Politics ard Administration’ বা রাজনীতি এবং প্রশাসন নামক নিবন্ধে লিখেছেন যে, “রাজনীতির ক্ষেত্র এবং প্রশাসনের ক্ষেত্র জুন-জীবনের দুটি পৃথক ও স্বতন্ত্র ক্ষেত্র।” তার মতে,“সরকারি কার্যক্রমের উপর রাজনীতির প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে খারাপ ফল উদ্রেক করে।” সকল সরকারি কার্যক্রমকে তিনি রাজনীতি ও প্রশাসন এ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেন এবং কোন্ কোন্ বিভাগের উপর রাজনীতি ও নীতি নির্ধারণের কাজ এবং অপর কতকগুলো বিভাগের উপর উক্ত নীতিসমূহের বাস্তবায়নের কাজ অর্পণ করেছেন।
→ সুপ্রসিদ্ধ জার্মান লেখক রুন্টসলি (Bluntschli)-ও রাজনীতি এবং প্রশাসনের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করতে অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর মতে, “রাজনীতি হচ্ছে মহৎ ও সর্বজনীন বিষয়াদির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপ; আর প্রশাসন হচ্ছে ব্যক্তিগত এবং ক্ষুদ্র বিষয়াদির ক্ষেত্রে ক্রিয়াকলাপ। ”
→ উইলোবি (Willoughby) প্রশাসনকে রাজনীতি থেকে শুধু পৃথকই করেন নি, বরং প্রশাসনকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গরূপে স্বীকৃতি দেন। তিনি প্রশাসনকে শুধু প্রশাসনিক শাখার কার্যপরিধির মধ্যে সীমিত করেন। তিনি প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং কার্যনির্বাহীর ক্ষমতার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন। প্রশাসনকে কার্যনির্বাহী থেকে আলাদা করার কারণ হিসেবে উইলোবি উল্লেখ করেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন এবং তিনি সাধারণভাবে আইন পরিষদের নিয়ন্ত্রণভুক্ত নন। কাজেই প্রশাসন চতুর্থ অঙ্গ হিসেবে আইন পরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে। লেপাস্কি (Lepawpsky) মন্তব্য করেছেন যে, “উইলোবি কর্তৃক প্রশাসনকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গরূপে চিহ্নিত করা একটি চূড়ান্ত অভিমত, কিন্তু এটি হলো উইলসন কর্তৃক ঘোষিত প্রশাসন ও রাজনীতির মধ্যে স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার যুক্তিসঙ্গত ফলাফল।
→ ফিফনার (Pfiffner) যদিও এ দু’য়ের স্বতন্ত্রীকরণ মতবাদ সমর্থন করেছেন, তথাপি তিনি উল্লেখ করেছেন যে, রাজনীতি এবং প্রশাসনকে সবসময়ই আলাদা করা যায় না। তবে মনে রাখতে হবে যে, দু’টি বিষয়কে কেন্দ্র করে যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে অর্থাৎ একটি অপরটির ক্ষেত্রে অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করবে না, এটি যাতে কোনভাবেই বিপর্যস্ত না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। দলীয় রাজনীতিকে প্রশাসন থেকে বিযুক্ত রাখা কারিগরি ও বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের স্থায়িত্বকাল নিশ্চিত করার উপর প্রশাসনিক সাফল্যও অনেকাংশে নির্ভর করবে।
→ অধ্যাপক ফিফনার (Pfiffner) রাজনীতি ও লোক প্রশাসনের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করতে গিয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার মধ্যকার পার্থক্যের উপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন। নিচে তা উল্লেখ করা হল
োঃ
উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson) রাজনীতি ও প্রশাসনের যে বিভাজন দেখিয়েছেন তা মূলত নীতি এবং প্রশাসনের বিভাজন। রাজনীতি বলতে রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত নীতি সিদ্ধান্তকে বুঝায়।
নীতি সিদ্ধান্তকে কার্যকরণ করার প্রক্রিয়া হলো প্রশাসন। এ দু’য়ের পার্থক্য অনেকটা লক্ষ্য এবং উপায়কে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত। লক্ষ্য হলো রাজনীতি, উপায় হলো প্রশাসন। এ বিভাজন অনুযায়ী সংস্থা হিসেবে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে আছে আইন পরিষদ এবং প্রশাসনের সাথে নির্বাহী বা শাসন বিভাগ। রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি হচ্ছে সংসদ, রাজনৈতিক দল এবং চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী আর প্রশাসনের হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ। পেশাগত দিক থেকে রাজনীতি হলো রাজনৈতিক নেতারা কি বলেন বা করেন। প্রশাসন হলো প্রশাসকরা কি করেন।
যা হোক উইলসনের এ বিভাজন থেকে দু’টি দিক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমনঃ প্ৰথমত, রাজনীতিকে প্রশাসন থেকে আলাদা করার কথা যে বলা হয়েছে সেটি হলো দলীয় রাজনীতি দ্বিতীয়ত, রাজনীতিকে নীতি প্রণয়নের সাথে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে এ ধারণা চলতে থাকবে এবং এ নীতি প্রণয়ন হলো জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ। জীবনবৃত্তি পেশায় নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী যাদের নিয়ে প্রশাসন গঠিত হয়েছে তাদের কাজ নীতি প্রণয়ন নয় বরং নীতি বাস্তবায়ন।
উইলসন (Wilson) ও অন্যান্য প্রবক্তার এ মতবাদে বিশ্বাস করার কারণ এই যে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে যে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু ছিল তাতে প্রশাসন অযোগ্যতা ও দুর্নীতির শিকারে পরিণত হয়েছিল। এ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এ দু’টির স্বতন্ত্রতার উপর উইলসন এত গুরুত্ব দিয়েছেন। উইলসন (Wilson) স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেন যে, লোক প্রশাসন বলতেই সরকারি আইনের সুসংহত ও সুবিস্তৃত বাস্তবায়নকে বুঝায়। এ ছাড়া রাজনীতি ও প্রশাসনের বৈশিষ্ট্য আলাদা প্রকৃতির। রাজনীতির পেছনে রয়েছে আকাঙ্ক্ষা, আবেগ, ক্ষমতা দখল করা এবং তা রক্ষা করার প্রবল ইচ্ছা। অপরদিকে প্রশাসনের মূলে রয়েছে একটি শান্ত, গাণিতিক এবং বিচার বিবেকসম্পন্ন উদ্দীপনা যা জনগণের কল্যাণার্থে প্রয়োজনীয় জিনিস উৎপাদন ও সেবা প্রদানের জন্য ব্যবহার করা উচিত।
উপরোক্ত প্রবক্তাদের অভিমত বিচার-বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, রাজনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে নিম্নোক্ত পার্থক্য বিদ্যমানঃ
প্রথমত, রাজনীতির সম্পর্ক মূল্যবোধের সাথে, পক্ষান্তরে, প্রশাসনের সম্পর্ক সাক্ষাৎ ঘটনাবলির সাথে। অর্থাৎ প্রথমোক্তটি হলো নীতি বিষয়ক বা নৈতিক এবং পরেরটি হলো টেকনিক্যাল। রাজনীতি হচ্ছে রাষ্ট্রনায়কদের বিচরণের বিশেষ এলাকা । অন্যদিকে, প্রশাসন হচ্ছে টেকনিশিয়ানদের এলাকা।
দ্বিতীয়ত, উভয়ের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হচ্ছে— ক্ষমতা অর্জনই রাজনীতিবিদের প্রধান লক্ষ্য। কিভাবে ক্ষমতা লাভ করা যাবে, কিভাবে ক্ষমতা বজায় রাখা যাবে, কিভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাখতে হবে এবং বিরোধীদের কিভাবে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে হবে- এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনাই তার কাজ। পক্ষান্তরে, প্রশাসক সে ক্ষমতাই প্রয়োগ ও ভোগ করেন- যা তিনি প্রশাসনে তার মর্যাদা অনুযায়ী লাভ করেন বা তার উপর ন্যস্ত করা হয়। তিনি শুধু ক্ষমতার জন্যই ক্ষমতা প্রয়োগ করেন না, জনসাধারণের সেবার জন্যই ক্ষমতাকে ব্যবহার করেন।
তৃতীয়ত, আলো আর ছায়ার মত রাজনীতি ও প্রশাসন একে অপরের উপর, বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ের উপর ছায়াপাত করে। উচ্চ পর্যায়ে এটা বিশেষ করে সত্য; কারণ ঐ পর্যায়ে রাজনীতিক- মন্ত্রিরা নীতি নির্ধারণ করেন এবং নীতি বাস্তবে রূপায়ণের ব্যাপারে সামগ্রিক তত্ত্বাবধানের ভূমিকা পালন করেন । এ দিকে উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মচারীরা নীতি প্রণয়নে উপদেশ দেন এবং নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব বহন করেন।
সুতরাং বলা যায়, রাজনীতি ও প্রশাসনের ক্ষেত্র ও পরিধির মধ্যকার উপরোক্ত পার্থক্য এ কালের গণতান্ত্রিক সরকারের সন্তোষজনক কার্যপরিচালনা এবং কর্মনির্বাহী ধারণা হিসেবে কার্যকরী।
দ্বিতীয় মতবাদঃ প্রশাসন ও রাজনীতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত-
Second Concept: Administration and Politics are Close Connected সম্প্রতিকালের প্রশাসন বিশেষজ্ঞগণ রাজনীতি ও লোক প্রশাসনকে বিচ্ছিন্ন করার রীতিকে সমালোচনা করেন এবং তারা লোক প্রশাসন ও রাজনীতির মধ্যকার নিবিড় সম্পর্কের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে উদ্যোগী হয়েছেন। রাজনীতি এবং প্রশাসনকে পৃথক পৃথক করার পুরনো মতবাদের স্থলে বর্তমানে এ মত ব্যক্ত হয়েছে যে, কোন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং প্রশাসন ব্যবস্থার প্রতি অপ্রাসঙ্গিক বা অসংশ্লিষ্ট নয়; বরং লোক প্রশাসন সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারই অংশবিশেষ। তাই বলা যায়, রাজনীতি ও প্রশাসন স্বতন্ত্র নয়, উভয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। এ মতবাদ যেসব প্রশাসন বিষয়ক চিন্তাবিদ সমর্থন করেন, এরা হলেন জন এম. গউস (John M. Gaus ), লেসলি লিপসন (Leslie Lipson), এল. ডি. হোয়াইট (L. D. White), ই. পি. হেরিং (E. P. Harring), মার্শাল ই. ডিমোক (Marshal E Dimock), কার্ল জে. ফ্রেডারিক (Karl J. Frederick), পল এইচ. অ্যাপলেবি (Paul H. Appleby), চার্লস মেরিয়াম (Charles Marium), হার্বাট এ. সাইমন (Herbert A. Simon), ডুয়েট ওয়ান্ডো (Dewight Waldo), জে ডি কিংসলে (J. Kinsley), লুথার গুলিক (Luther Gulick) প্রমুখ। এরা সকলেই রাজনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে সম্পর্কের কথা বলেছেন।
→ লুথার গুলিক (Luther Gulick) রাজনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেছেন। তাঁর মতে, “রাজনীতি ও প্রশাসন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সত্যিকার অর্থে রাজনীতি হচ্ছে এক প্রকার ক্রিয়া, যে ক্রিয়া শাসকদের নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট থাকে। গণতান্ত্রিক ধারণার বিকাশের সাথে সাথে এ নিয়ন্ত্রণ কার্যে জনগণের অংশগ্রহণ করা বহুলাংশে বৃদ্ধি লাভ করেছে। আর এর অব্যবহিত ফল হলো স্ব-শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠা। এ অর্থে রাজনীতিকে প্রশাসন হতে এবং প্রশাসনকে রাজনীতি হতে বিচ্ছিন্ন বলে ভাবা যায় না।”
→ ফ্রেডারিক (Frederick) মনে করেন, “রাজনীতি প্রশাসন বিভাজন একটি বিপথগামী পার্থক্য এবং এ পার্থক্য তাত্ত্বিক ও কর্মরত প্রশাসকদের মনে একটি বাঁধাধরা অযৌক্তিক বিশ্বাস হিসেবে গেঁথে আছে।” জেডি কিংসলে প্রশাসনকে রাজনীতির শাখা হিসেবে গণ্য করেন।
→ ওয়ালডো (Waldo) মন্তব্য করেন যে, “রাজনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে স্বতন্ত্রীকরণ একটি জীর্ণ ধর্মমতে পরিণত হয়েছে।”
→ এ্যাপলেবি (Appelby) এবং গউস (Gaus)-এর মত লেখকগণ অত্যন্ত জোরের সাথে বলেন যে, প্রশাসনের সব কিছুই রাজনীতি। অর্থাৎ লোক প্রশাসন বলতে রাজনীতিও বুঝায়।
→ জন. এম. গউস (John M. Gaus). বলেছেন, “A theory of public administration means in our time a theory of politics too.” অর্থাৎ লোক প্রশাসনের কোন মতবাদ আমাদের সময়ে রাজনীতিরও মতবাদ।
→ লেসলি লিপসন ( Leslie Lipson ) -এর মতানুসারে, “Government is a continuous process. It is true that the process contains phases. Legislation is one phase, administration another. But these are merged together and at certain points become indistiguishable.” অর্থাৎ সরকার এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়াস্বরূপ। এ কথা সত্য যে, এ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। আইন প্রণয়ন হলো এরূপ একটি ধাপ এবং প্রশাসন হলো অপর এক ধাপ। কিন্তু এ সকল ধাপ মিশে যায় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অপৃথকীয় হয়ে পড়ে।
→ ওয়ালাস এস. স্যায়ার (Wallace S. Sayre ) বলেছেন যে, “The exercise of discretionary power, the making of value choices, is a characteristic and increasing function of administration and bureaucrats; they are thus importantly engaged in politics.’
→ ডেভিড লিলিয়ানথাল (David Lilienthal) উল্লেখ করেছেন যে, “রাজনীতি ও প্রশাসনের মধ্যকার পার্থক্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ তাদের একটি কিংবা উভয়েই গণতান্ত্রিক সমাজের ক্ষতিসাধন করতে পারে।”
→ ফিলিপ সেলজনিক (Philip Selzunick) বলেছেন যে, “রাজনীতি ও প্রশাসনের পার্থক্যের প্রয়োগ অন্য কোন ক্ষেত্রে তো নয়ই এমনকি রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আর কার্যকর হয় না।”
→ আবার পল এইচ. অ্যাপলেবি (Paul H Appleby) বলেছেন, “Every governmental employee is engaged in political work. Government and politics are synonymous, although not identical terms. They are not identical because some very important political activities are carried on outside government proper in parties and in many other citizen affairs directed toward influencing the conduct or government.”
উপরোক্ত অভিমতগুলোর ভিত্তিতে বলা যায়, লোক প্রশাসন সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। লোক প্রশাসন একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাহিরের কিছু নয়, বা একটি দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু নয়, বরং এর সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আধুনিককালে লোক প্রশাসন অনেকটা রাজনৈতিক তত্ত্বও বটে। বর্তমানে লোক প্রশাসনের পরিধি বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি লাভ করেছে। এখন আর এটি কতকগুলো যান্ত্রিক নিয়মাবলির বেড়াজালে আবদ্ধ নয়। এটি বর্তমানে একটি চলমান এবং গতিশীল প্রক্রিয়ারূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
সরকারের কাজের চাপ বৃদ্ধি পাবার ফলে প্রয়োজনের তাগিদে অধিক সংখ্যক সিদ্ধান্ত এখন সরকারের রাজনৈতিক শাখার পরিবর্তে প্রশাসনিক শাখায় প্রণীত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান হারে এটি সুস্পষ্ট হচ্ছে যে, সরকারের সকল সিদ্ধান্ত অসংখ্য প্রশাসনিক ভবনে বা দপ্তরে প্রণীত হচ্ছে। আরো বলা যায় যে, প্রশাসনিক বিষয়ে পুস্তক, প্রবন্ধ, গবেষণা ও পত্রপত্রিকায় ব্যবস্থা তত্ত্ব কাঠামো ও কার্যাত্মক বিশ্লেষণ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে রাজনীতি ও প্রশাসনের পৃথকীকরণের চেয়ে এ দু’য়ের মধ্যে পরস্পর যোগাযোগ সম্পর্ক দিন দিন বেড়ে চলেছে।
প্রাকৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশের ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে এমন সব সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট চিন্তাভাবনার প্রয়োজন হয় এবং তা করতে হলে বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকার প্রশাসকদের একদিকে যেমন নীতি প্রণয়নকে বাস্তব রূপ দান করতে হয় অপরদিকে এগুলোর প্রয়োগ ক্ষেত্রে বাস্তব অবস্থার নিরিখে নব নব আইন ও পদ্ধতিমূলক ব্যবস্থা প্রশাসকদের গ্রহণ করতে হয়। বর্তমানে অনেক ধরনের সংস্থা রয়েছে। যেমন পরিবেশ রক্ষাকারী সংস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধকারী সংস্থা। এগুলোকে ব্যাপক নীতি প্রণয়ন করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। নীতি প্রণয়ন করার মধ্যে এ সংস্থাসমূহের দায়িত্বের সমাপ্তি ঘটে না, এগুলোকে বাস্তবায়ন করার দায়িত্বও রয়েছে এবং এ দায়িত্ব পালনের জন্য বিভিন্ন কাৰ্যমুখী পদক্ষেপও নিতে হচ্ছে।
নীতি প্রণয়ন হলো রাজনৈতিক কাজ। রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাজনের একটি দিক হলো রাজনীতি নীতি প্রণয়ন করে, আইন প্রণয়ন করে অথবা উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে। পক্ষান্তরে, প্রশাসন নীতি বাস্তবায়ন বা আইন কার্যকরণ করে। রাজনীতি হলো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য, আর প্রশাসন হলো এ উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বা উপায়। এ অর্থে এ দু’য়ের মধ্যে পুরোপুরি স্বতন্ত্রী মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং দু’য়ের মধ্যেই পরস্পর সম্পর্কের উপর গুরুত্ব আরোপ করা এবং এ দু’টি প্রতিষ্ঠান পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং এটিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য।
এফ. এম. মার্কস (F. M. Marx) মন্তব্য করেছেন যে, “সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই প্রশাসন হলো নীতির ভৃত্য। ব্যবস্থাপনা বলতে ‘উপায়’ বুঝায় এবং লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ব্যতীত এ ‘উপায়ের’ কোন গুরুত্ব নেই।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কতক পণ্ডিত এরূপ ধারণা পোষণ করেন। জোসেফ লা পালোমবারা (Joseph La Palombara) বলেন যে, “রাজনীতি এবং প্রশাসনকে পুরোপুরি আলাদা করা যায় না।” অধ্যাপক ডব্লিউ. এফ. উইলোবি (W. F. Willoughby) বলেছেন যে, “Discretion, the use of judegement, is the essential element in the determination of policy. If any Government employee or any ruler has discretion, he not only has the power, but is by circumstances compelled to determine policy. It is quite impossible to discover any position in Government service in which the element of discretion is absent.” অর্থাৎ নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা একটি অতীব প্রয়োজনীয় উপাদান। যদি কোন সরকারি কর্মচারীর বা শাসনকর্তার বিশেষ ক্ষমতা থাকে তাহলে এ কথা বলা চলে যে তার কেবল ক্ষমতাই আছে তা নয় বরং তিনি নীতি নির্ধারণ করতেও বাধ্য।
অধিকাংশ পণ্ডিতদের মত এবং আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োগ অনুসারে নীতি প্রণয়ন ও ‘নীতি’ এবং নীতি বাস্তবায়নের মধ্যে পৃথকীকরণ করা সম্ভব নয়। এরূপ মতবাদ প্রকৃতপক্ষে ‘প্রশাসনের’ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে অস্পষ্ট সংজ্ঞা এবং অনুপপত্তি রয়েছে তার উপর অবস্থিত। কেবল নীতি প্রণয়ন ও নীতি বাস্তবায়ন এ দুই ক্ষেত্রেই রাজনীতি ও প্রশাসনের সম্পর্ক নিবিড় নয় বরং এদের সম্পর্ক সংবিধান তত্ত্ব, স্থানীয় সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে।
আধুনিক রাষ্ট্রের কঠিন বাস্তবতা হলো, আমলাতন্ত্রকে কঠোরভাবে নীতি বাস্তবায়ন ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করা যায় না। এমন কি কাঠামোগতভাবে বিশেষায়িত রাজনৈতিক সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান রাষ্ট্রসমূহে রাজনীতি-প্রশাসন বিভাজনকে প্রয়োগ করা যায় না। পাশ্চাত্য জগতে লোক প্রশাসনকে যারা বিশেষভাবে পর্যালোচনা করেছেন তাদের কাছে এ দু’য়ের ব্যবধান অবাস্তব এবং কাল্পনিক বলে প্রতিভাত হয়েছে। প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে কোন সমাজেই এ বিভাগ বাস্তবভিত্তিক বলে গ্রহণযোগ্য নয়। এ পার্থক্য অনেকটা কৃত্রিম এবং বস্তুতপক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধার জন্য সরকারি সিদ্ধান্তের ব্যাপক ও সংকীর্ণ এবং মোটামুটি, আর সংক্ষেপ ও বিস্তৃত এ দিকগুলো লক্ষ্য করে নির্ণয় করা হয়েছে।
সুতরাং বলা যায় যে, রাজনীতি থেকে প্রশাসনকে কোনভাবেই সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র করা যায় না। একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। সরকারি নীতি প্রণয়নে অংশগ্রহণই বস্তুত রাজনৈতিক কাজ। অধিকন্তু রাজনীতি বলতে ক্ষমতা ও প্রভাব অর্জন ও প্রয়োগ করার প্রক্রিয়াকেও বুঝায় এবং প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত রয়েছে প্রশাসন । সরকারি কর্মকর্তাগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইন প্রণেতা ও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট কার্যসূচিই বাস্তবায়ন করেন এবং সেদিক থেকেও প্রশাসনকে রাজনীতির অঙ্গনের বাইরে এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বলেও গ্রহণ করা যায় না। সুতরাং দু’য়ের স্বতন্ত্রীকরণ প্রশাসনিক বাস্তবতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কেবল একটি অর্থহীন তাত্ত্বিক আলোচনা মাত্র।
উপসংহারঃ উপরোক্ত আলোচনা শেষে এ কথা বলা যায় যে, রাজনীতি এবং লোক প্রশাসনের পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে উপরোক্ত দু’টি মতবাদই এক তরফা। আসল কথা এই যে, প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে রাজনীতিগ্রস্ত হলে যেমন বিপদের আশঙ্কা থাকে ঠিক তেমনি প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে রাজনীতি বিবর্জিত হলেও বিপদের সম্ভাবনা দেখা দেয়। সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থার জন্য উভয়ের মধ্যেই পারস্পরিক এবং যথার্থ ভারসাম্য রক্ষা করা আবশ্যক।
Leave a comment