ভূমিকাঃ পদ্ধতি হচ্ছে অধ্যয়নের এমন একটি পন্থা, যার দ্বারা বিষয়বস্তু নির্ধারণ ও বিশ্লেষণ করা হয়। প্রত্যেক সামাজিক বিজ্ঞান অধ্যয়ন করবার নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। লোক প্রশাসন সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। তাই সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে এর অধ্যয়নে বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। প্রশাসনিক প্রকৃতি, উদ্দেশ্য এবং স্বরূপ সঠিকভাবে জানবার এবং অনুধাবন করবার জন্য এ সকল পদ্ধতি অতি গুরুত্বপূর্ণ। লোক প্রশাসন অধ্যয়নে সাধারণত যে সকল পদ্ধতি অধ্যয়ন করা হয়, সেগুলো নিচে আলোচনা করা হলোঃ
১। ঐতিহাসিক পদ্ধতি (Historical Approach) : লোক প্রশাসন অনুসন্ধান পদ্ধতির মধ্যে ঐতিহাসিক পদ্ধতি এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগেও লোক প্রশাসনের চিন্তাবিদগণ ঐতিহাসিক পদ্ধতির উপর তেমন কোন গুরুত্ব আরোপ করেন নি। তবে সম্প্রতিকালে লোক প্রশাসনের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক পদ্ধতির ব্যবহার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পদ্ধতি অনুসারে আদি থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি, বৃদ্ধি ও অগ্রগতির ইতিহাস জানার পরে এর বর্তমান স্বরূপ উপলব্ধির নির্দেশ দেয়। কারণ এ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্ম কোন কোন বিশেষ পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে হয়েছিল কিংবা কোন্ সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রতিঘাতে তাদের বিশেষ ধরনের অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল তা জানা না গেলে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান স্বরূপকে কিছুতেই বুঝে উঠা সম্ভব নয়। অবশ্য অতীতকে জানার মধ্যেই প্রতিষ্ঠানকে সম্যকভাবে বুঝে উঠা নির্ভর করে না। তবু প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অতীত যে জ্ঞানের সন্ধান দেয় তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক এল. ডি. হোয়াইট (L. D. White) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ৪০ বছরের যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থাকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ হতে অধ্যয়ন করেছেন। তিনি তার ‘The Federalist’, ‘Jeffersonians’, ‘Jacksonians’-এবং ‘Republican Era’ নামক চারটি ঐতিহাসিক সোনা সমীক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল প্রশাসনের গোড়ার দিকের প্রকৃত অবস্থার বর্ণনা দান করেন৷ সাম্প্রতিককালে ইউরোপ ও আমেরিকার প্রখ্যাত প্রশাসকগণ প্রশাসন ক্ষেত্রের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য ঐতিহাসিক ঘটনাবলির উপর বহুল পরিমাণে নির্ভর করতেছেন। শুধু তাই নয় তারা বিভিন্ন প্রকার জীবনীমূলক ও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে প্রশাসনিক সংস্থার অভ্যন্তরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এ সকল গ্রন্থ প্রশাসনিক বিকাশের তত্ত্ব প্রণয়নে যথেষ্ট সাহায্য করে।
২। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (Scientific Management Approach): লোক প্রশাসন অধ্যয়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা আন্দোলন হতে এ পদ্ধতি উদ্ভূত হয়েছে। ফ্রেডারিক ডব্লিউ. টেলর (Frederich W. Taylor)-এর গবেষণা হতেই মূলত এ পদ্ধতির সূত্রপাত ঘটে। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনুযায়ী লোক প্রশাসন অধ্যয়নের লক্ষ্য হলো, প্রশাসনিক সমস্যাদির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ও কলাকৌশল প্রয়োগ করা। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় লোক প্রশাসনের ক্ষেত্রেও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উপাত্ত সংগ্রহ, উপাত্তসমূহের শ্রেণীবিভাগ এবং প্রকল্পসমূহের (Hypotheses) সত্যতা যাচাইয়ের আরোহমূলক পদ্ধতি (Inductive method) প্রয়োগ করা হয়। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ব্যবস্থাপনা কার্য পরিচালনার প্রচেষ্টার ফলে সংগঠন, ব্যবস্থাপনা, আয়ব্যয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে কার্যকর কলাকৌশলের বিকাশ ঘটে। রাজনীতি হতে প্রশাসন কার্যকে পৃথক করে দেখা হয় এবং প্রশাসনের ক্ষেত্রে যান্ত্রিক নিয়মকানুন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। বর্তমান সময়ে অফিসের ব্যবস্থাপনা, হিসাবনিকাশ ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক নীতির ভিত্তিতে নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কাজের পরিমাণ (Measurement of work), ওয়ার্ক ফ্লো চার্ট (Work flow chart), কস্ট একাউন্টিং (Cost accounting), টাইম এন্ড মোশান স্টাডি (Time and motion study), ওপিনিয়ন স্যাম্পলিং এন্ড পোলস (Opinion sampling and poles) ইত্যাদি কলাকৌশল বৈজ্ঞানিক ও টেকনিক্যাল পদ্ধতির উপরই প্রতিষ্ঠিত এবং সেগুলো প্রশাসনিক সমস্যাদি সমাধানের জন্য প্রয়োগ করা হয়।
৩। পরীক্ষামূলক পদ্ধতি (Experimental Approach): লোক প্রশাসন অধ্যয়নে পরীক্ষামূলক পদ্ধতি ব্যাপক পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিটি প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থাকে এক একটি পরীক্ষাগার বলে মনে করা যেতে পারে। এ পরীক্ষাগারে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংস্কার আইনের নীতিমালা প্রবর্তন করার মানসে নতুন নতুন কৌশল বাস্তবায়নের কাজ গৃহীত হয়। উন্নত এবং সমৃদ্ধিশালী জীবন গঠনের তাগিদে এ সমস্ত নীতিমালা প্রায় পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। এভাবে কোন দেশে কোন একটি নির্দিষ্ট সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেমনঃ ধনতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র পরীক্ষামূলকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে।
৪ । আইনগত পদ্ধতি (Legal Approach): আইনগত বা আইনভিত্তিক পদ্ধতি অনুসারে লোক প্রশাসনকে এক প্রকার আইনগত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সাথে তুলনা করা হয়। যে সকল দেশে প্রশাসনিক আইনের ঐতিহ্য সুদীর্ঘকাল ধরে বিদ্যমান, সে সকল দেশেই (দৃষ্টান্তস্বরূপ, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি ইত্যাদি) লোক প্রশাসনকে আইনগত দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে অধ্যয়ন করার রীতি বহুলাংশে প্রচলিত রয়েছে। সকল দেশে প্রশাসনিক আইন রাষ্ট্রীয় আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশস্বরূপ এবং সরকারি কর্তৃপক্ষসমূহের সংগঠন ও কার্যাবলি, তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক, তাদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব ইত্যাদি এ প্রশাসনিক আইনের আতওাভুক্ত বলে ধারণা করা হয়। এরূপে সেখানে যেহেতু লোক প্রশাসনকে প্রশাসনিক আইনেরই অংশ বিশেষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং সেহেতু লোক প্রশাসককে আইনগত দৃষ্টিকোণ হতে অধ্যয়ন করা হয়।
গ্রেট ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রশাসনিক আইন ও প্রশাসনিক ট্রাইবুন্যালসমূহের বিকাশের ফলে, সে সকল দেশে অনেক চিন্তাবিদ এ সকল ট্রাইবুন্যাল ও তাদের প্রশাসনিক কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে আগ্রহী হয়েছেন। এরূপে সেখানে অনেকেই আইনগত পদ্ধতিতে লোক প্রশাসনকে অধ্যয়ন করার রীতির সমর্থক হয়ে উঠেছেন। সেখানে সরকার জনসাধারণের জন্য যতই কল্যাণমূলক কার্যসূচি গ্রহণ করবে, সেখানে প্রশাসনিক আইন ও বিচারালয় ততই প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। ফলে লোক প্রশাসনের এ দিক সম্পর্কে অধ্যয়ন করার উদ্দেশ্যে অধিকতরভাবে আইনগত পদ্ধতি অনসুরণ করার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়ে দেখা দিবে। ফ্রাংক জে. গুডনোও (Frank J. Goodnow) এ পদ্ধতির শক্তিশালী প্রবক্তা। যেহেতু লোক প্রশাসন দেশের আইনগত কাঠামোর ভিতরে থেকেই কাজ করে, সেহেতু ঐ আইনগত কাঠামোর উপর আলোকপাত করার ব্যাপারে আইনভিত্তিক অনুশীলন-পদ্ধতির মূল্য রয়েছে। কিন্তু এ পদ্ধতির ত্রুটি হলো এই যে, এটি প্রশাসনের সমাজতাত্ত্বিক দিককে উপেক্ষা করে যায়৷
৫। বর্ণনামূলক ও প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি (The Descriptive and Institutional Approaches): বর্ণনামূলক ও প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি লোক প্রশাসন অধ্যয়ন করার সর্বাপেক্ষা পুরনো এবং এটি সর্বাপেক্ষা বেশিসংখ্যক লেখকগণের দ্বারা অনুসরণ করা হয়। বস্তুত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হতে শুরু করে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার কলাকৌশলের বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণই এ পদ্ধতি অনুযায়ী লোক প্রশাসন অধ্যয়ন করেছেন। এ অনুশীলন পদ্ধতির অনুসারীগণ প্রশাসকগণের কার্যকে অরাজনৈতিক বা প্রযুক্তিগত হিসেবে গণ্য করেছেন। তাদের মতে, প্রশাসনিক কাজ বলতে শুধুমাত্র নৈতিকতা-নিরপেক্ষ উপায়ে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা কার্যকরী করাকেই বুঝায়। এরূপে তারা লোক প্রশাসনের মূলনীতিসমূহ উদঘাটন করতে সর্বাত্মকভাবে প্রয়াসী হন।
এ অনুশীলন পদ্ধতিকে সনাতন পদ্ধতিও বলা হয়ে থাকে। এ অনুশীলন পদ্ধতির অনুসারীগণ প্রাথমিক পর্যায়ে এক অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও বাস্তবধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করেছিলেন। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল এ ধরনের বাস্তব তথ্যাবলির বর্ণনা উপস্থাপন করা, কোন তত্ত্ব গঠন করা নয়। অর্থাৎ প্রশাসনের বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করাই এ পদ্ধতির মূল লক্ষ্য। তাই এ পদ্ধতি মূলত যুক্তিবাদী ও বাস্তববাদী। এ দৃষ্টিভঙ্গির শ্রেষ্ঠ প্রবক্তাগণ ছিলেন লিওনার্ড ডি. হোয়াইট (Leonard D. White) ও লুথার গুলিক (Luther Gulick) বিগত দু’টি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ পদ্ধতিটি বিশেষভাবে প্রাধান্য লাভ করে।
৬। রাজনীতিভিত্তিক পদ্ধতি (The Political Approach): বিংশ শতাব্দীর ৬০-এর দশক হতে বর্ণনামূলক ও প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলন পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটেছে। যদিও অনুশীলন পদ্ধতিটি-এর বর্ণনামূলক ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনও বজায় রয়েছে, তথাপি বর্তমানে লোক প্রশাসনের রীতিসিদ্ধ বা আদর্শগত দিকগুলোর (Normatic aspects) দিকে অধিকতর নজর দেয়া হচ্ছে এবং প্রশাসনকে রাজনৈতিক তত্ত্ব ও প্রচলিত রাজনৈতিক মূল্যবোধেরই উপাদান হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, অতীতে কার্যদক্ষতা ও মিতব্যয়কেই লোক প্রশাসনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে ধারণা করা হত; কিন্তু বর্তমানে সে ধারণাকে ‘অফলদায়ক, অতি পাণ্ডিত্যপূর্ণ এবং পরিহরণীয়’ (Sterile, scholastic and to be avoided) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রশাসনকে এর সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি হতে বিচ্ছিন্নভাবে অধ্যয়ন করা যেতে পারে-এ মত রাজনীতিভিত্তিক পদ্ধতির অনুসারীগণ কর্তৃক প্ৰত্যাখ্যাত হয়।
আধুনিক সময়ে এ যুক্তি জোরালোভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, সু-প্রশাসন কোনভাবেই স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প নয় এবং সেহেতু স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে আবশ্যকীয় শর্তাবলির সাথে সু-প্রশাসনের কোন বিরোধ ঘটা চলবে না; সুতরাং সংগঠন, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সংক্রান্ত সমস্যাবলিকে গণতান্ত্রিক আদর্শ ও লক্ষ্যের পটভূমিকাতেই অনুশীলন করতে হবে এবং এ পথেই এ সকল সমস্যা সমাধানের পথ বের করতে হবে। পল এইচ অ্যাপলেবি (Paul H. Appleby), জন এম. গউস (John M. Gaus) প্রমুখ চিন্তাবিদ লেখকগণ প্রশাসনকে টেকনিক্যাল কাজ হিসেবে গণ্য করার দৃষ্টিভৃঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং তারা ব্যাপক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ হতে লোক প্রশাসনকে অধ্যয়ন করেন।
৭। কেস স্টাডি পদ্ধতি (Case Study Method): লোক প্রশাসনের ক্ষেত্রে ‘কেস স্টাডি’ বা ‘ঘটনা সমীক্ষা’ পদ্ধতি মূলত একটি ইতিহাসগত অধ্যয়ন পদ্ধতি। এ কেস স্টাডি পদ্ধতি লোক প্রশাসন অনুশীলন পদ্ধতির ক্ষেত্রে আমেরিকান লেখকদের বিশেষ অবদানস্বরূপ। কোন ‘কেস’ বলতে যে কোন প্রশাসনিক শাখায় উদ্ভূত ও সমাধাকৃত যে কোন বিশেষ সমস্যাকেই বুঝায় এবং ‘কেস’ সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে গিয়ে ‘কেস’র পরিস্থিতি লিপিবদ্ধ করা হয়; যে সকল কার্যপদ্ধতি ও পদক্ষেপের ভিতর দিয়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল তা উল্লেখ করা হয়; এ সিদ্ধান্তের কারণসমূহ বর্ণিত হয় এবং উদ্ভূত ফলাফলের আলোকে এ সিদ্ধান্তের মূল্যায়ন করা হয়। এ পদ্ধতি অনুযায়ী ইতিহাস-সুলভ উদঘাটনের উদ্দেশ্যে কোন নির্দিষ্ট প্রশ্ন বা সমস্যার ক্ষেত্রে গৃহীত কোন প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে অধ্যয়ন চালানো হয়। এরূপ পদ্ধতির লক্ষ্য হলো কোন কোন্ উপাদান বা কারণ-রাজনৈতিক হোক আর অর্থনৈতিকই হোক, ব্যক্তিগত হোক অথবা অন্য যে কোন ধরনেরই হোক-প্রশাসকের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে, তা উদ্ঘাটন করা এবং সে সাথে সিদ্ধান্ত বা নীতি প্রণয়নের কার্য-প্রক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা। সংশ্লিষ্ট দলিল-পত্রাদির সাহায্য গ্রহণ, অনুসন্ধান, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণের সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং অন্যান্য উৎস হতে সাহায্য গ্রহণ করে ‘কেস স্টাডি’ পদ্ধতি অনুযায়ী লোক প্রশাসন সম্পর্কে অধ্যয়ন করা হয়। বিভিন্ন দেশে জাতীয় লোক প্রশাসন প্রতিষ্ঠানগুলো এ পদ্ধতি অনুযায়ী নিজ নিজ দেশের প্রশাসন সম্পর্কে অধ্যয়ন করে যাচ্ছে এবং এরূপ অধ্যয়নলব্ধ জ্ঞান-তথ্যাদি পুস্তক-পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করছে।
অধ্যয়নশীল ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সরবরাহ করা ও তাকে সংশ্লিষ্ট অফিসিয়াল ফাইল ও রেকর্ড-পত্রাদি দেখার অনুমতি দান করার ব্যাপারে প্রশাসকগণ তার সাথে সহযোগিতা করতে যতখানি ইচ্ছুক, তার উপরই কেস স্টাডি অনুশীলন পদ্ধতির প্রয়োগ-সম্ভাবনা নির্ভর করে। যেখানে প্রশাসকগণ এরূপ সহযোগিতা করতে অনিচ্ছুক, সেখানে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব নয়।
১৯৫২ সালে প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘Inter University case Program’-এ কমপক্ষে ২০টি বিভিন্ন ঘটনার ইতিহাস সন্নিবেশিত করা হয় হেরল্ড স্টেইন (Harold Stein) সম্পাদিত ‘Public Administration and Policy Development’ শিরোনামের অধীনে ১৯৫৯ সালে ম্যানিলার লোক প্রশাসন ইনস্টিটিউট হতে খোশ আলমেনা লিখিত ‘Focus on the Barris’ প্রকাশিত হয়। একই বছর ভিয়েতনাম প্রশাসন ইনস্টিটিউট ‘Case in Veitnamses Administration’ প্রকাশ করে। আবার ১৯৬১ সালে এম. জি. উইলসন (M. G. Wilson) লিখিত ‘Administrators in Action : British Case Studies’ প্রকাশিত হয়। এটি ছাড়া ভারতে লোক প্রশাসন ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশে জাতীয় লোক প্রশাসন ইনস্টিটিউট (নিপা) যা বর্তমানে লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (পি. এ.টি. সি.) বলে অভিহিত তা কয়েকটি কেস স্টাডি প্রকাশ করে।
৮। কাঠামোগত পদ্ধতি (Structural Approach): লোক প্রশাসন পাঠের অপর একটি অন্যতম পদ্ধতি। কাঠামোগত পদ্ধতি সরকারি সংস্থার প্রশাসনিক কাঠামো বর্ণনা করা। এ পদ্ধতির অন্যতম কাজ অধ্যাপক এল. ডি. হোয়াইট তার ‘Introduction to the Study of Public Administration’ গ্রন্থে এবং লুথার গুলিক তার “Papers on the Science of Administration” গ্রন্থে এ পদ্ধতির বর্ণনা দেন। এ পদ্ধতি প্রশাসনিক বিষয়ের উপর গুরুত্ব প্রদান করে। এটি ‘POSDCORB’ মতবাদের উপর দৃষ্টি নিবন্ধ করে। উপরন্তু এ পদ্ধতি প্রশাসনিক সংগঠন (Administrative Organization), কর্মচারী ব্যবস্থাপনা (Personnel Management) এবং আর্থিক প্রশাসন (Financial Administration) নিয়ে আলোচনা করে। তবে এ পদ্ধতি সমস্যামুক্ত নয়; এতে দু’টি প্রধান দোষ দেখা যায়। প্রথমত, লোক প্রশাসনের কর্মক্ষেত্র বা পরিবেশের উল্লেখ ব্যতীত প্রশাসনিক কাঠামোর ধারণা করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, এ পদ্ধতি সম্পূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ নয়। কারণ এটিতে মানবিক উপাদানসমূহ যথাযথভাবে গৃহীত হয় না।
৯। আচরণগত পদ্ধতি (Behavioral Approach): বর্তমানকালে লোক প্ৰশাসন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আচরণগত পদ্ধতির ব্যবহার দ্রুত বেড়ে চলছে। এটি সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি (Social Psychological Method) নামেও পরিচিত। এ পদ্ধতি প্রশাসনিক সংগঠনে মানুষের বিভিন্ন কার্যক্রম ও আচরণ নিয়ে আলোচনা করে। সংগঠনে ব্যক্তি-আচরণ পর্যালোচনা করে কতকগুলো সাধারণ সূত্রে (General Principles) উপনীত হওয়া এ পদ্ধতির মূল লক্ষ্য। সংগঠনের প্রতিটি ব্যক্তির দ্বৈত ভূমিকা পরিদৃষ্ট হয়। একটি ভূমিকা পালিত হয় সংগঠনের ভিতরে এবং অপরটি পালিত হয় সংগঠনের বাইরে। প্রথমটিকে সাংগঠনিক ভূমিকা (Organization Role) আর দ্বিতীয়টিকে সামাজিক ভূমিকা (Social Role) বলা যেতে পারে। প্রশাসন ব্যক্তির এ ভূমিকার ভিন্নমুখীতার কারণে উদাসীন থাকতে পারে না। প্রশাসনিক সংগঠন কাজ করে কিভাবে, ব্যক্তির মনে কি কি সচরাচর প্রবণতা পরিদৃষ্ট হয় আচরণগত পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে আমরা তা অবগত হতে এবং তা হতে প্রশাসনের সাধারণ নীতিমালা সম্পর্কে জানতে পারি।
আচরণগত পদ্ধতির অন্যতম ও শক্তিশালী প্রবক্তা হলেন হার্বার্ট এ. সাইমন (Herbert A. Simon)। তিনি তার ‘Administrative Behavior’ নামক সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থে লোক প্রশাসনে ব্যবহৃত সকল সাবেকি পদ্ধতির বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তার মতে, সংগঠনে মানবিক আচরণ মানবিক সম্পর্ক এবং সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রমের আলোচনাই প্রশাসনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তিনি আরও মনে করেন যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রশাসনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কার্য। প্রশাসনিক বিজ্ঞান মূল্যবোধ বিচারের প্রশ্নে না গিয়ে বাস্তবে কিভাবে যাবতীয় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় তার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। হার্বার্ট এ. সাইমনের ন্যায় অধ্যাপক আর. এস. পার্কারও ( R. S. Parker) লোক প্রশাসন অধ্যয়নে আচরণগত পদ্ধতির উপর সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে। তার মতে, আচরণগত পদ্ধতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য তার সর্বজনীনতা এবং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তি ও প্রশাসনিক সংগঠনের পারস্পরিক সম্পর্কশীল সূত্রকরণ পদ্ধতি গড়ে তোলা।
১০। তুলনামূলক পদ্ধতি (Comparative Approach): তুলনামূলক পদ্ধতিকে ঐতিহাসিক পদ্ধতির পরিপূরক (Complementary) বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাজনৈতিক ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে যেমন তুলনামূলক পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, ঠিক তেমনি বর্তমানে প্রশাসনের ক্ষেত্রেও এ পদ্ধতির ব্যবহার বহুল পরিমাণে হচ্ছে। এ পদ্ধতি অনুযায়ী বর্তমানের প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহ তুলনামূলকভাবে পর্যবেক্ষণ করে কতকগুলো সাধারণ সূত্রে উপনীত হওয়া যায়। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল (Aristotle) তার ‘Politics’ নামক গ্রন্থে এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে দেখা যায়। তিনি বিভিন্ন দেশের ১৫৮টি শাসনব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা করে পরিশেষে যে একটি সাধারণ সূত্রে উপনীত হন, আর সে সূত্রটি হলো বিপ্লবের কারণ সম্পর্কিত। তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বিপ্লবের একটি সাধারণ কারণ ব্যাপক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা। উইলিয়াম জে. সিফিন (William J. Siffin) তার ‘Toward Comparative Study of Public Administration’ গ্রন্থে এবং ফ্রেড. ডব্লিউ. রাগস্ (Fred W. Riggs) ‘The Politics of Developing Areas’ গ্রন্থে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের প্রশাসন ব্যবস্থার স্বরূপ ও প্রকৃতির বাস্তব সমীক্ষা উপস্থাপন করেছেন।
উপরোক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, লোক প্রশাসনের উপরোক্ত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে কোটি সঠিক পদ্ধতি তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। বস্তুত কোন একটি পদ্ধতিই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তবে লোক প্রশাসন অধ্যয়নের জন্য কয়েকটি পদ্ধতির একত্র প্রয়োগই লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক। এগুলো নির্দিষ্ট করে দেয়ারও কোন উপায় নেই। এগুলো নির্ভর করে সম্পূর্ণভাবে প্রশাসনিক সংস্কৃতির উপর।
Leave a comment