প্রশ্নঃ লোক প্রশাসনের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধর। 

ভূমিকাঃ আধুনিককালে লোক প্রশাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিগণিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কার্যাবলির প্রসারের সাথে সাথে লোক প্রশাসনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আরও অধিক পরিমাণে অনুভূত হয়। আধুনিক রাষ্ট্র এখন কেবলমাত্র পুলিশী দায়িত্ব পালন করে না। বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের প্রভাবে পুলিশী রাষ্ট্রের স্থান দখল করেছে ‘কল্যাণকর রাষ্ট্র’। বিংশ শতকের প্রারম্ভ থেকে রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও জনকল্যাণকর কার্যাবলি সম্পাদন করে চলেছে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হলো সাধারণের কল্যাণ সাধন। আর তা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের কার্যাবলি ব্যাপক প্রসার ও বৃদ্ধি ঘটেছে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের কার্যাবলির পরিধি বৃদ্ধির সাথে সাথে লোক প্রশাসনের ভূমিকা ও গুরুত্বও বেড়ে চলেছে সমানতালে।

লোক প্রশাসনের ক্ষেত্র যথেষ্ট ব্যাপক ও বাস্তবভিত্তিক। কারণ সরকারি নীতিকে আন্তর্জাতিক পর্যায় হতে শুরু করে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত স্তরেই প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। লোক প্রশাসনের বিষয়বস্তু অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট। কেননা লোক বা সরকারি প্রশাসকগণ বর্তমানে মানবজীবনের বহুমুখী প্রয়োজন মিটানোর কাজে তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাশ, সামাজিক নিরাপত্তা বিধান ইত্যাদি কাজে লিপ্ত রয়েছেন। বস্তুত লোক প্রশাসনের প্রকৃতি, বিষয়বস্তু ও পরিধি এ সবকিছুই ‘আধুনিক শাসনব্যবস্থার সমস্যার মূল কেন্দ্রস্থল’ (Heart of the problem of modern government) [Felix A. Nirgo, Public Administration Reading and Documents, p. 2.] গঠন করে। তাই আধুনিক সমাজে লোক প্রশাসনের গুরুত্বকে কোনক্রমেই উপেক্ষা করা যায় না। নিচে লোক প্রশাসনের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলোঃ 

১। নাগরিক জীবনে ভূমিকাঃ লোক প্রশাসন নাগরিক জীবনে এক সৃজনশীল উপাদানস্বরূপ যার উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ সাধন নাগরিক জীবনে লোক প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত ব্যাপক। নিচে এ সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হলোঃ

প্রথমত, আধুনিক কল্যাব্রতী রাষ্ট্রে একজন নাগরিককে তার জীবনের প্রতিটি স্তরেই প্রশাসনের উপর নির্ভর করতে হয়। বর্তমান যুগের সরকার আগামী দিনের নাগরিকগণের জন্যও চিন্তাভাবনা করে থাকে। জন্মনিয়ন্ত্রণ, মাতৃসদন ও শিশুমঙ্গল কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে ভাবী নাগরিকদের যত্ন-পরিচর্যা সাধনে সচেষ্ট হয়। সরকার শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনের ও তাদেরকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে যথাযথভাবেই বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। এভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত নাগরিকগণকে যথোপযুক্ত কর্মে নিয়োগ করতে সরকার অনেক পরিকল্পনা ও কার্যসূচি গ্রহণ করে থাকে। এমনকি যারা প্রত্যক্ষভাবে সরকারি চাকরিজীবী নয়, তাদের কর্ম-জীবনেও সরকার ন্যূনতম মজুরি আইন, শ্রম আইন, কল্যাণমূলক কার্যসূচি এবং অন্যান্য বহুবিধ উপায়ে তাদেরকে সাহায্য করে থাকে।

দ্বিতীয়ত, লোক প্রশাসন নাগরিক জীবনের সর্বস্তরেই পরিব্যাপ্ত ও সক্রিয় রয়েছে। এ ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, জনস্বাস্থ্য, অবকাশ ইত্যাদির বিধান করেও প্রশাসন নাগরিকগণের জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আনয়ন করতে তৎপর হয়। এমনকি নাগরিকের মৃত্যুর পরও তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি তার ইচ্ছানুযায়ী তার উত্তরাধিকারী ও আশ্রিতদেরকে প্রদান করে প্রশাসন তা সেবা করে থাকে। বৈজ্ঞানিক ও যান্ত্রিক আবিষ্কার এবং শিল্প-বিপ্লবের প্রভাবের ফলে নাগরিক জীবনে লোক প্রশাসনের ভূমিকা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে এবং শহর নগরে বিরাট জনসমাবেশ ঘটেছে। এ সকল পরিস্থিতির কারণে নাগরিক সাধারণ তাদের জীবন ও স্বাস্থ্যের প্রতি বিপজ্জনক বস্তুসমূহ দূরীকরণের ব্যাপারে এবং সুখী ও সুন্দর জীবনের জন্য মৌলিকভাবে প্রয়োজনীয় বস্তুসমূহ ও সুযোগ- সুবিধা লাভের ব্যাপারে রাষ্ট্রের উপর অর্থাৎ লোক প্রশাসনের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছে।

তৃতীয়ত, এফ. এম. মার্কস (F. M. Marx) বলেছেন, “As the modern government has made administrative action the prime instrument of its day-to-day operation, so public administration has moved more and more toward the center of governing. The working of the administrative machinery is therefore a matter of vast significance to the success of the government itself and thus to the well-being of the citizen. It is one of the political issues of our time.” অর্থাৎ আধুনিক সরকার প্রশাসনিক কার্য ব্যবস্থাকেই এর প্রাত্যহিক কার্যাবলি সম্পাদনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করায় লোক প্রশাসন ক্রমবর্ধমানভাবে শাসন পরিচালনার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। সুতরাং প্রশাসনিক যন্ত্রের কার্যকারিতা সরকারেরই সফলতার পক্ষে এবং এরূপে নাগরিকের কল্যাণের পক্ষে বিরাটভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এটা আমাদের সময়ের অন্যতম বড় রাজনৈতিক সমস্যা। [L. D. White, Introduction to the Study of Public Administration, p.]

চতুর্থত, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে সরকারগুলো সাধারণ মানুষকে দারিদ্র্য, অনাহার, রোগ ইত্যাদির নাগপাশ হতে মুক্ত করে তাদের সাধারণ সুখ ও সমৃদ্ধি আনয়নের প্রচেষ্টায় ব্যাপক- ভিত্তিতে লিপ্ত রয়েছে, সেখানে লোক প্রশাসনের অতীব গুরুত্ব রয়েছে। কোন অর্থনৈতিক পরিকল্পনাই সাফল্যলাভ করতে পারে না, যদি না তার প্রশাসনিক বিষয়াদি পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করা হয় এবং উপযুক্ত প্রশাসনিক যন্ত্র গড়ে তোলা হয়। অর্ডওয়ে টীড (Ordway Tead)-এর মতে, “Administration is a moral act and administrator is a moral agent.” অর্থাৎ প্রশাসন একটি নৈতিক কাজ এবং প্রশাসক একজন নৈতিক প্রতিনিধি। [F. M. Marx, The Administration State, p. 1.] 

পঞ্চমত, ‘A Hand book of Public Administration’-এ বলা হয়েছে, “আধুনিক সরকারের দ্বারা সম্পাদিতব্য কার্যাদির বিবিধত্ব, সংখ্যা ও জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানে এক প্রশাসনিক পশ্চাৎপদতার সৃষ্টি হয়েছে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং সম্পাদিত কাজের মধ্যে উদ্ভূত প্রয়োজন এবং এ সকল প্রয়োজন মিটানোর প্রশাসনিক কাঠামোর পর্যাপ্ততার মধ্যে এক গুরুতর ভারসাম্যহীনতা বিদ্যমান। এ ভারসাম্যহীনতাই জাতীয় উন্নয়নের পক্ষে মারাত্মক বাধাস্বরূপ। যদি – আধুনিক সেবাব্রতী রাষ্ট্রকে এর ক্রমবর্ধমান দায়িত্বের এমনকি একটি অংশও মিটাতে হয়, তাহলে এটাকে অবশ্যই এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির কার্যসূচিকে বাস্তবায়ন করার মত প্রশাসনিক সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। বাস্তবায়ন করা যেতে পারে এমন সকল পরিকল্পনা ও কার্যসূচি প্রণয়নের জন্য এবং প্রণীত পরিকল্পনা ও কার্যসূচিকে কার্যে রূপায়িত করার জন্য সেবাব্রতী রাষ্ট্র লোক প্রশাসনকেই যন্ত্র বা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে।” [Ordway Tead, Administration : Its Purpose and Performance p. 67.] 

২। সভ্যতা ও কৃষ্টি সংরক্ষণঃ দেশের সভ্যতা ও কৃষ্টিকে সংরক্ষণ ও উন্নত করার এক এক কার্যকর মাধ্যম হিসেবে লোক প্রশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোন রাষ্ট্রের আদর্শ যতই উন্নত হোক না কেন যে উপায়ে এ আদর্শকে বাস্তবে রূপ দেয়া হয়, কেবল তা হতেই জনসাধারণের উপর এ আদর্শের প্রভাব বিচার করা যেতে পারে। এরূপে প্রশাসন এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয় এবং এর উপর এক মহান লক্ষ্য অর্জনের কাজ অর্পিত হয়। এ কারণেই ডুয়েট ওয়াল্ডো (D. Waldo) প্রশাসনকে সামগ্রিক কৃষ্টির অংশস্বরূপ হিসেবে গণ্য করেছেন যা কাজ করেও থাকে। (A part of cultural complex, and it is not only acted upon, but also acts.)। বস্তুত, কোন দেশের নাগরিকগণের বিশিষ্ট প্রকৃতি এটার প্রশাসনেই প্রতিফলিত হয় এবং তাদের গুণাবলি ও আশা-আকাঙ্ক্ষা এর প্রশাসনে রূপলাভ করে। এর অর্থ দেশের প্রশাসন কেবল কৃষ্টিগত স্থিতিশীলতার সংরক্ষণমাত্র নয়, বরং এটা প্রকৃতপক্ষে সামাজিক পরিবর্তন এবং অগ্রগতির মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

৩। সেবা ও সহায়তা প্রদানঃ বর্তমান যুগে সরকার দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান কার্যাবলির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সুতরাং আধুনিক কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রে লোক প্রশাসন কেবল দেশের নাগরিকগণকে বহিঃআক্রমণ বা আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা হতেই রক্ষাই করে না, বরং তাদেরকে শিক্ষাদান করা, পণ্য-উৎপাদন ও সেগুলো তাদের মধ্যে বণ্টন করা এবং এরূপ বিভিন্ন উপায়ে তাদেরকে সেবা-সহায়তা করার যথার্থ দায়িত্ব গ্রহণ করে। আর সেই কারণে নাগরিকগণের কল্যাণ ও অগ্রগতি বহুলাংশে প্রশাসনের কর্মদক্ষতার মানের উপর নির্ভর করে থাকে। বস্তুত, একথা বলা যেতে পারে, যদি লোক প্রশাসন কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমাদের আধুনিক সমাজ ও সভ্যতার সমগ্র কাঠামোই ভেঙ্গে পড়বে। ডব্লিউ. ভি. ডনহাম (w. v. Donham), “If our civilization fails it will be mainly because of a breakdown of administration.” অর্থাৎ যদি আমাদের সভ্যতা ব্যর্থ হয়, তাহলে এটা প্রধানত প্রশাসনের ভাঙ্গনের কারণেই ব্যর্থ হবে।

৪। সরকারি নীতি ও বিধি প্রণয়নঃ রাষ্ট্রের উপর নবতর ও ব্যাপকতর দায়িত্ব আরোপিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে লোক প্রশাসনের ভূমিকা সরকারের প্রায় যে কোন বিভাগের গুরুত্বের চেয়ে অধিকতর গুরুত্ব ও প্রাধান্য বিস্তার করেছে। লোক প্রশাসকগণ আইন বিভাগের দ্বারা প্রণীত নীতিসমূহ বাস্তবায়ন করার সাথেই সংশ্লিষ্ট নয়, বরং তারা তাদের বিশেষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দ্বারা নীতি প্রণয়নের ব্যাপারে আইনসভা ও মন্ত্রিগণকে সহায়তা করে থাকেন। তারা বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে খুঁটিনাটি দিকগুলো পরিপূরণ করে থাকেন। প্রতিটি সরকারি নীতির সফল কার্যকরীগণ প্রশাসকগণের ক্ষমতা দক্ষতা ও সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে। এ দক্ষতা ও কার্যক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় তারা আধুনিক রাষ্ট্রে জনকল্যাণ সাধনের প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়েছেন৷

৫। রাষ্ট্রের সকল প্রকার সমস্যার সমাধানঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতি বিশ্ব জনসমাজের জীবন ব্যবস্থা এবং জীবন ধারা পাল্টে দিয়েছে। এ বিপুল অগ্রগতির ফলে সৃষ্টি হয়েছে বৃহদায়তন শিল্প। উৎপাদনের উপকরণগুলো কেন্দ্রীভূত হয়েছে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির হাতে। নগরায়নের প্রসারের ফলে জনাকীর্ণ হয়ে পড়েছে শহর ও নগরগুলো। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, সেনিটেশন, সামাজিক সংরক্ষণ, ও শিক্ষা বিষয়ক নানাবিধ সমস্যা। এসব সমস্যার নিরসনের জন্য জনগণকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের উপরেই নির্ভর করতে হয়। এসব সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য রাষ্ট্র তার নিজস্ব হাতিয়ার ব্যবহার করে এবং রাষ্ট্রের এ হাতিয়ারই হচ্ছে লোক প্রশাসন৷ সুব্যবস্থিত সুশৃঙ্খল সুসংগঠিত ও সুদক্ষ লোক প্রশাসনই পারে রাষ্ট্রের সর্বপ্রকার সফল সমাধান করে জনগণকে শান্তিপূর্ণ নিরাপদ জীবন দান করতে।

৬। স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা রক্ষাঃ সমাজে লোক প্রশাসন এক বিরাট স্থিতিপ্রদায়নী শক্তি ও উপাদান। সমাজকে স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে লোক প্রশাসনের ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম বর্তমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনমতের চাপে সরকার প্রায়শ পরিবর্তিত হয়। কিন্তু প্রশাসনযন্ত্রে আকস্মিক ও আমূল পরিবর্তন ঘটে কদাচিৎ। সরকার পরিবর্তন হলে পূর্বতন শাসনব্যবস্থার সাথে বর্তমানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে লোক প্রশাসন ব্যবস্থা। শুধু গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায়ই নয়, সরকারের আঙ্গিক ও বৈশিষ্ট্যে যখন বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে, তখনও লোক প্রশাসন বা সরকারি প্রশাসন এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখে। বাংলাদেশের বারংবার এর উদাহরণ পরিলক্ষিত হয়েছে।

৭। পরিকল্পনা বাস্তবায়নঃ সমাজজীবনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং দেশের সম্পদাবলির বিকাশের জন্য রাষ্ট্র ও সরকারের চিন্তাভাবনার ফসল হিসেবে অবলম্বিত হয়েছে পরিকল্পনার ধারণা ও অনুশীলন। এ যুগের সব সরকারই নির্ধারিত উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত ও পরিকল্পনাভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন । পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে ব্যাপকভিত্তিক লক্ষ্য ও বিশদ প্রশাসনের তাগিদ অনিবার্য। আবশ্যিক বা প্রয়োজনীয় পরিকল্পনার ফলশ্রুতিতে লোক প্রশাসনের পরিধিও বেড়ে যায়; কারণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাথে সাথে অধিক সংখ্যক সরকারি উদ্যম ব্যবস্থাপনা অথবা পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কাঠামোধীনে বেসরকারি উদ্যোক্তা ও নাগরিকদের কার্যক্রম পরিকল্পনার জন্য অধিকতর নিয়ন্ত্রণ, বিধি নিয়ম স্থিরীকরণ ও বলবৎকরণের প্রয়োজন পড়ে।

৮। যুদ্ধ মোকাবিলাঃ আধুনিক যুগ সর্বাত্মক যুদ্ধের যুগ। যুদ্ধ মোকাবিলা করার জন্য এ যুগে রাষ্ট্রসমূহকে তাদের সমগ্র ধন সম্পদ ও জনবলের সমাবেশ ঘটাতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এ বিশাল দায়িত্ব অর্পিত হয় লোক প্রশাসনের উপর। সবদেশেই দেখা যায় যে, শান্তিকালীন সময়ে যেসব কর্মোদ্যম ও কার্যক্রম বেসরকারি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকে যুদ্ধকালে তা লোক প্রশাসন বা সরকারি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বিগত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সরকারি কর্তৃপক্ষ পণ্য ও উপযোগিতামূলক উৎপাদন বণ্টন ও ভোগের উপর যে নিয়ন্ত্রণ, পারমিট ও কোটা প্রচলন করেছিলেন, স্বাভাবিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উপর যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিলেন, অনেকেই সে কথা জানে।

৯। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনশক্তির পূর্ণ ব্যবহারঃ লোক প্রশাসনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনশক্তির পূর্ণ এবং সুদক্ষ ব্যবহার ও বণ্টনের দ্বারা জনকল্যাণ সাধন করা। এদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা খুবই জটিল কার্য। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং প্রযুক্তিবিদ্যার ব্যাপক প্রসারের সাথে সাথে ব্যবস্থাপনার সমস্যা অত্যধিক জটিল আকার ধারণ করছে। কর্মচারী প্রশাসনও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এ সকল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য প্রশাসকের যথেষ্ট তত্ত্বগত ও বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান থাকা একান্ত আবশ্যক। অধ্যাপক এল. ডি. হোয়াইট (L. D. White)-এর মতে, “The ends of administration are the ultimate objects of the state itself…in short, the attainment of good life.” অর্থাৎ রাষ্ট্রের ন্যায় প্রশাসনেরও উদ্দেশ্য হলো উত্তম জীবন লাভ করা। [A. Hand-book of Public Administration, United Nations, p. 5.] 

১০। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাঃ আধুনিক বিশ্বে সুষ্ঠু, ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রেই প্রশাসন ব্যবস্থার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান লোক প্রশাসন পাঠে জনগণের মধ্যে সামগ্রিকভাবে প্রশাসনিক চেতনাবোধ জাগ্রত হয়। জনগণ যখন প্রশাসনিক নীতি, পদ্ধতি এবং উদ্দেশ্য সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভ করে তখন তারা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কার্যে দক্ষতার সাথে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়। সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মচারিগণই সুষ্ঠু প্রশাসনের চাবিকাঠি।

১১। অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে ভূমিকাঃ অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে লোক প্রশাসনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যেখানে নাগরিক জীবনে লোক প্রশাসনের ঔষধ এতো অধিকভাবে বৃদ্ধি লাভ করেছে, সেখানে লোক প্রশাসন বিষয় অধ্যয়নের গুরুত্ব কোনক্রমেই অস্বীকার করা যেতে পারে না । বর্তমানে লোক প্রশাসন বিষয়ে শিক্ষা লাভ ও শিক্ষাদান বিভিন্ন দেশের শিক্ষাসূচির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে বিবেচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লোক প্রশাসন পাঠের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ইউরোপীয় দেশসমূহেও লোক প্রশাসন পাঠের যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। লোক প্রশাসনের শিক্ষা ও জ্ঞান দেশের জনগণকে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দক্ষ ও অভিজ্ঞ করে তুলবে এবং প্রশাসনিক কার্যাবলি যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে।

সমাপনীঃ উপরোক্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা শেষে একথা বলা যায় যে, লোক প্রশাসন মানব সভ্যতার হৃৎপিণ্ডস্বরূপ। আধুনিক গণতন্ত্র কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে। ধারণা জন্ম দিয়েছে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়োজনে লোক প্রশাসনের উপর তাগিদ এসেছে ক্রমবর্ধমান হারে সেবাদানের হোয়াইট (White)-এর ভাষায়, “একদা সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্যাতন আর নিপীড়ন ছাড়া জনগণ আর কিছুই প্রত্যাশা করত না। পরে তারা প্রশাসনের সাথে সংযোগহীন নিঃসঙ্গ থেকেছে। আজ তারা লোক প্রশাসনের কাছে চাচ্ছে আরও ছত্রছায়া, আরও সেবা।” অনিবার্যভাবে এর ফলে লোক প্রশাসনের ব্যাপ্তি ও দায়িত্ব আজ পূর্বাপেক্ষা বেড়েছে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে লোক প্রশাসনের কাছে মানুষের একমাত্র কাম্য হলো— সামগ্রিকভাবে জনগণের জন্য উন্নততর জীবন সুনিশ্চিত করা।

বস্তুত, লোক প্রশাসন মানব সমাজের এক অপরিহার্য অংশস্বরূপ ও আধুনিক জীবনযাত্রার একটি প্রাধান্যশীল উপাদান। আধুনিক যুগে ‘প্রশাসনিক রাষ্ট্র’ (Administrative State)-এর উদ্ভব ঘটেছে বলে যে মত ব্যক্ত করা হচ্ছে, তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। ডুয়েট ওয়াল্ডো এবং মরস্টেইন মার্কস (Dwight Waldo and Morstein Marx) তাই আধুনিক যুগকে ‘প্রশাসনিক রাষ্ট্রের যুগ’ (The era of administrative state) বলে অভিহিত করেছেন।