প্রশ্নঃ অধ্যয়ন শাস্ত্র হিসেবে লোক প্রশাসনের বিকাশ আলোচনা কর। 

ভূমিকাঃ প্রশাসন যন্ত্রের উদ্ভাবন প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্র ও কার্য বিস্তৃতির সাথে সাথে লোক প্রশাসন একটি সুসংবদ্ধ শাস্ত্র হিসেবে বিকাশ লাভ করে। তবে ঠিক কখন বা কোথায়’ লোক প্রশাসনের সূত্রপাত ঘটেছিল, তা কেউই বলতে পারে না। কারণ কখন বা কোথায় মানুষ নিজেদেরকে জনসমষ্টির সদস্য হিসেবে, জনসাধারণ হিসেবে মনে করেছিল, তা কেউই জানে না। তাই মার্কস (Marx) বলেছেন যে, “Precisely when or where public administration began no one can say, because no one knows when or where men first thought of themselves as ‘comprising a community, being a public”. [F. M. Marx (ed.), Elements of Public Administration, p. 3.] 

লোক প্রশাসনের বিকাশঃ বস্তুত ‘লোক প্রশাসন’ (Public Administration) কথাটি সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্যবহৃত হতে শুরু হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন (Washington) ও হ্যামিলটন (Hamilton) অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে এটিকে এর বর্তমান অর্থে ব্যবহার করেন। হ্যামিলটন ‘The Federolist Papers (No. 72)’ রচনায় লোক প্রশাসনের অর্থ, সংজ্ঞা ও বিষয়বস্তু নির্দেশ করেন। ১৮১২ সালে চার্লস জ্যাঁ বুনিন (Charles Jean Bounin) ‘Principle of Public Administration (‘Principles d’ Administration Publique) নামক প্রশাসন-বিষয়ক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এরপর আরও কিছুসংখ্যক খ্যাতনামা রাষ্ট্রচিন্তাবিদ প্রশাসন বিষয়ের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যয়ন ও অনুশীলন করেন।

ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই লোক প্রশাসন একটি সুসংবদ্ধ আলোচ্য বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। এ ক্ষেত্রে প্রতিভাময় অবদান রাখেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson)। ১৮৮৭ সালে তার রচিত ‘The Study of Political Science’ প্রবন্ধটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘Political Science Quarterly’ নামক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উক্ত প্রবন্ধে লোক প্রশাসনকে একটি স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ বিষয় হিসেবে প্রথম উপস্থাপন করেন। তাই ডুয়েট ওয়াল্ডো ( Dwight Waldo) উড্রো উইলসনকে “লোক প্রশাসন শাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা জনক” (Founding father of public administration as a discipline) হিসেবে অভিহিত করেছেন। চার্লস এ. বিয়ার্ড ( Charles A. Beard), লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) প্রমুখের রচনাবলিতেও প্রশাসন সম্পর্কে বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ হতেই লোক প্রশাসন সম্পর্কে সুব্যবস্থিত উপায়ে আলোচনা করা হয়েছে।

১৯০০ সালে ফ্রাংক জে. গুডনোও (Frank J. Goodnow) রাজনীতি ও প্রশাসনকে দু’টি ভাগে বিভক্ত করার ফলে পরবর্তীকালে লোক প্রশাসন সংক্রান্ত বই-পুস্তকে এক বিতর্কমূলক আলোচনার সৃষ্টি হয় । ১৯২৬ সালে এল.ডি. হোয়াইট (L. D. White রচিত ‘Introduction to the Study of Public Administration’ গ্রন্থখানি এবং ১৯২৭ সালে ডব্লিউ. এফ. উইলোবি (W. F. Willoughby) রচিত ‘Principles of Public Administration’ গ্রন্থখানি ১৯২৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশ লাভ করে। এ দু’টি গ্রন্থ প্রকাশ লাভের পর একটি পৃথক পাঠ্য-বিষয় হিসেবে লোক প্রশাসন স্বীকৃতি ও মর্যাদা লাভ করে। বহু সংস্করণ ও সংশোধনের পর হুয়াইটের গ্রন্থখানি বর্তমানেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। জেম্স ডি. মুনি (James D. Mooney ) কর্তৃক রচিত ‘Principles of Organization’ গ্রন্থটি ১৯৩১ সালে আত্মপ্রকাশ করে। এর পর প্রশাসন সম্পর্কে বিভিন্ন লেখকগণের রচনাও প্রকাশিত হতে থাকে।

প্রশাসন ও রাজনীতি সম্পূর্ণ পৃথক এ নীতির ভিত্তিতেই ঐ সময়ে লোক প্রশাসন সম্পর্কে অধ্যয়ন করা হয়েছিল। রাজনীতি সরকারি নীতি-নির্ধারণের সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিল এবং প্রশাসন এ নীতিকে কার্যকরী করার সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিল; রাজনীতি জনগণের ভাবাবেগের উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং লোক প্রশাসন যান্ত্রিক ও পেশাভিত্তিক ছিল এবং সেহেতু বিশুদ্ধ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিসমূহ লোক প্রশাসনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। এফ. ডব্লিউ. উইলোবি (W. F. Willoughby)-এর Principle of Public Administration,’ রিচার্ড এ. ওয়ার্নার (Richard A. Warner) রচিত ‘The Principles of Public Administration, জে. ডি. মুনি (J. D. Mooney) কৃত ‘Principles of Organization’ এবং এল. ডি. হোয়াইট (L. D. White)-এর ‘Introduction of the Study of Public Administration’ (প্রথম সংস্করণ) গ্রন্থসমূহের মূল বিশ্বাস হচ্ছে যে, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মিতব্যয় ও কর্মদক্ষতার বিধান করাই প্রশাসন সম্পর্কে অধ্যয়ন করার একমাত্র লক্ষ্য এবং যেহেতু প্রশাসন হচ্ছে একটি যান্ত্রিক সংগঠন, সেহেতু এ সংগঠনের বৈজ্ঞানিক আইন উদঘাটনের জন্য বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করা হলে লোক প্রশাসনের বিজ্ঞানসম্মত আইন ও নীতিগুলো আবিষ্কার করা যাবে।

তবে বিংশ শতাব্দীর ৫০-এর দশকে লোক প্রশাসন সম্পর্কিত এ যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মেরী পার্কার ফলেট (Mary Parker Follett), হারবার্ট সাইমন (Herbert Simon) প্রমুখ লোক প্রশাসন সম্পর্কে অধ্যয়ন করেছেন। তারা জোর মত ব্যক্ত করেছেন যে, প্রশাসন বলতে কোন যন্ত্রব্য সংগঠনকে বুঝায় না, বরং প্রশাসন মূলত মানবিক সম্পর্কাদি সংক্রান্ত একটি সমস্যাস্বরূপ এবং সেহেতু লোক প্রশাসন সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে গিয়ে আমাদিগকে অবশ্যই মানবিক আচরণ অধ্যয়ন করতে হবে। সাইমন (Simon)-এর ‘Administrative Behavior’ এবং অন্য দু’জন মনোবিজ্ঞানী স্মিথবার্গ (Smithburg) ও থমসন (Thomson)-এর সহযোগিতায় তাঁর দ্বারা রচিত ‘Public Administration’ গ্রন্থ দু’টিতে এ মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটে।

বর্তমানে প্রশাসন সম্পর্কে অধ্যয়ন করার স্বীকৃত লক্ষ্য হচ্ছে—

১। সংগঠনের ভিতর ব্যক্তিগণ কিভাবে আচরণ করেন ও কিভাবে সংগঠনগুলো কাজ করে, তা জানা;

২। কিভাবে সংগঠনগুলো সর্বাপেক্ষা কার্যকরভাবে গড়ে তোলা যায়, তা বুঝে উঠা অর্থাৎ সংগঠনের ভিতর মানবিক আচরণ সম্পর্কে ফলপ্রসূ তত্ত্ব উদ্ঘাটন করা।

মূলত মূল্যবোধ বিশ্লেষণ নয়, বরং তথ্য বিশ্লেষণ করাই তাদের কাজ বলে বর্তমান সময়ের প্রশাসন বিজ্ঞানীগণ মনে করেন। তারা বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে লোক প্রশাসন সম্পর্কে অধ্যয়ন করার উপরই গুরুত্ব আরোপ করেন। অর্থাৎ তারা প্রশাসন কিরূপ হওয়া উচিত, সে বিষয়ের চেয়ে বরং তার প্রশাসন বর্তমানে যেরূপ রয়েছে, সে অবস্থাতেই একে অধ্যয়ন করতে অধিকতরভাবে সচেষ্ট হন।

লোক প্রশাসন অধ্যয়নের সাম্প্রতিক প্রবণতা লুথার গুলিক (Luther Gulick)-এর ‘Papers on the Science of Administration’, পি. এইচ. অ্যাপলেবি (P. H. Appleby)-র ‘Morality and Administration’, চেস্টার বার্নার্ড (Chaster Bernard)-এর ‘Functions of the Executive’, ডুয়েট ওয়াল্ডো (Dwight Waldo)-র ‘The Study of Public Administration’ এবং ‘The Administrative State’ ইত্যাদি রচনাবলিতে পরিলক্ষিত হয়।

অতি সাম্প্রতিককালে প্রশাসনকে অনেকে তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করতে আগ্রহী হয়েছেন। তুলনামূলক পদ্ধতিতে যারা প্রশাসনকে বুঝাতে চেয়েছেন তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে আছেন ফ্ৰেড. ডব্লিউ. রিগস্ (Fred. W. Riggs) পাশ্চাত্যের অনেক পণ্ডিত উন্নয়নশীল দেশের প্রশাসন সম্পর্কে গবেষণা চালিয়ে একটি সর্বজনীন প্রশাসনিক মতবাদ বা তত্ত্ব প্রদানে প্রয়াসী হয়েছেন। রিগস্ (Riggs) কর্তৃক রচিত দু’খানি পুস্তক ‘The Ecology of Public Administration’ এবং ‘Administration in Developing Countries’-এ প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘উন্নয়নগামী দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও সমস্যা’ আলোচনায় একটি স্মরণীয় অবদান।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষের দিক থেকেই লোক প্রশাসনে একটি মৌলিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এরূপ পরিবর্তনের ঢেউ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, এ পরিবর্তন বৈশিষ্ট্যগতভাবে লোক প্রশাসনকে একটি নতুন ও সুশৃঙ্খল বিজ্ঞানে পরিণত করার প্রয়াসে উদ্যোগী হয়।