লোকপুরাণ ও মঙ্গলকাব্য – ভারতচন্দ্র ও আলাওলের সঙ্গে তুলনা
মুকুন্দরামের কবি-ব্যক্তিত্বের স্বরূপ সন্ধানে মধ্যযুগের অপর দুজন প্রধান কবি ভারতচন্দ্র ও আলাওলের কবি-মানসের তুলনা করা যেতে পারে। আলাওলের প্রধান কাব্য ‘পদ্মাবতীর’ বিশিষ্টতা তার ব্যক্তিত্বেরই পাত্র থেকে উৎসারিত। ব্যক্তিগত জীবনে আলাওল হার্মাদ দস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রাণ রক্ষায় সমর্থ হন, পরে ঘোড়সওয়ার সেনানীর গতি ও শক্তির অধিকারী হিসাবে জীবিকা গ্রহণ করেন। আরাকান রাজসভার অমাত্য মাগনঠাকুরের আনুকূল্যে সারস্বত সাধনা আরম্ভ করেন। মাগনের পর সুলেমান ও মহম্মদের মত রাজ-অমাত্যের অনুগ্রহ-নির্ভর হয়েও সম্ভবত রাজকীয় ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করার সন্দেহে কারারুদ্ধ হন। মুক্তি পেলেও রাজকীয় মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা হারিয়ে “সবে ভিক্ষা জীব রক্ষা ক্লেশে দিন যাএ।”
অবশ্য পরে তিনি আবার রোসাঙ্গ রাজসভায় সৌভাগ্যলক্ষ্মীকে খুঁজে পান। তবু তাঁর ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে তার সেই ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের ভূকম্পনে সদাচঞ্চল জীবনের অদৃশ্য আবির্ভাব অনুভব করা যায়। অষ্টাদশ শতকের কবি ভারতচন্দ্রেরও ব্যক্তিগত জীবন বিপর্যয়-তরঙ্গে ফেনিলোচ্ছল। রাজকীয় সহায়তা লাভ করেও তিনি দারিদ্র্যের সর্পদংশনে হয়েছেন জর্জরিত। বিশ্ব বিধানের বিরুদ্ধে সেই ছলনার বিষ তার লেখনী থেকে ঝরে পড়েছে। ব্যঙ্গের আয়ুধে তিনি সকলকে করেছেন আহত। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা তাঁর ভাষা ও ভাবনাকে শিখরদশনা করে তুলেছে। কিন্তু মুকুন্দরামের রঘুনাথ সাহচর্যে তার সম্ভব ছিল না। তাই তাঁর কাব্যে বেদনার কালীদহে কালীয়নাগের আবির্ভাব হয় নি।
দুঃখমূলক প্রসঙ্গঃ মুকুন্দরামের কাব্যে নারীগণের পতিনিন্দা সাহানার সকরুণ ভাবমূর্ছনায় সঙ্গীতায়িত— “এক যুবতী বলে সই গোদা মোর পতি। কোয়া জ্বরের ঔষধ সদা পাব কতি/….গোদে তৈল দিতে কত তুলি ন্যাকার,” “আর যুবতী বলে পতির বর্জিত দশন/ …দড় ব্যঞ্জন আমি যেই দিন রান্ধি / মাড়য়ে পিঁড়ির বারি কোণে বস্যা কান্দি”, “আর যুবতী বলে সখি মোর পতি কালা / … রন্ধনের তরে আমি যদি চাহি জল / দড়ি ধরা এন্যে দেয় কালা মোরে ছাগল” —আপাতমধুর হাস্যরস – এর মধ্যে দিয়ে উচ্ছ্বসিত হলেও স্পষ্টতই তা বোঝা যায়, নিগৃহীতার নিরানন্দ জীবনের আর্তনাদ হতে উদ্ভূত। ভারতচন্দ্রের মত নারীদের অশাসিত যৌবনের যাযাবরী উদ্দামতা এখানে নেই। কৌতুক স্নিগ্ধ কথার আড়ালে পুরুষকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থার মর্মান্তিক জীবনসত্য তার পরিবর্তে উদ্ঘাটিত। তবু যুবতী জীবনের ঘাতকের প্রতি কোন আক্রোশ নয়, নারীর অন্তরের কথাই কালি কলমের চিত্রাল্পনায় রূপাঙ্কিত।
ফুল্লরার বারমাস্যা বর্ণনায় “দুঃখ করো অবধান দুঃখ করো অবধান। আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ্যমান” শুনতে শুনতে পাঠকের “দুঃখের বরষায় চক্ষের জল” ঝরে। তবু অন্যপূর্বা নারীকে স্বামী গ্রহণ করেছে মনের এই অনিশ্চিত আশঙ্কায় চণ্ডীর পরিচয় জিজ্ঞাসা করার সময় “হৃদে বিষ মুখে মধু জিজ্ঞাসে ফুল্লরা/দূরে গেল ক্ষুধাতৃষ্ণা রন্ধনের ত্বরা,” প্রভৃতি পঙ্ক্তির সুপ্ত কৌতুক অনুভব করা যায়। তাই মনস্পতি রবীন্দ্রনাথের সত্য-সুন্দর মস্তব্য— “ইহার মধ্যে অনেকখানি আমানি আছে, কিন্তু কবির অশ্রুজল নাই।”
কালকেতুর বিরুদ্ধে চণ্ডীর কাছে পশুদের আর্ত অভিযোগের মধ্য দিয়েও আত্মদুঃখের “গগন ছোঁওয়া নীরব অভিযোগ” সংকেতিত নয়। ভ্রান্ত বিচার-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সরস-কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে।
এ যুগের বিচার ব্যবস্থাকে কটাক্ষ বার্নাড শ’র স্মরণ সুন্দর মন্তব্য সম্ভবত মুকুন্দরামেরও অভিপ্রেত ঃ “When a man kills a tiger he calls it sport, but when a tiger kills a man he calls ferocity, there is no great difference between Crime and Jus tice.” “নেউগি চৌধুরী নই না রাখি তালুক” – এই উক্তির মধ্যে আত্মদুঃখ নিবেদন নয়, জমিদার ও সাধারণ প্রজার মধ্যে ব্যবধানের ইঙ্গিত আছে।
Leave a comment