সূচনা: ব্রিটিশ সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয়দের সাহায্য লাভের লক্ষ্যে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। এই লক্ষ্যপূরণের জন্য বড়ােলাট লিনলিথগাে সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং কিছু প্রস্তাব পেশ করেন যা লিনলিথগাে প্রস্তাব নামে পরিচিত।
[1] প্রেক্ষাপট: এইসময় ভারতের বড়ােলাট লিনলিথগাে একতরফা ঘােষণায় বলেন যে ভারত ব্রিটেনের পক্ষে বিশ্বযুদ্ধে যােগ দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হল যে লিনলিথগাে ভারতীয় নেতৃবর্গ বা কেন্দ্রীয় আইনসভার সঙ্গে কোনােরকম পরামর্শ না করেই এই ঘােষণা করে দেন তাই লিনলিথগাের এই ঘােষণায় ভারতের জনগণ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন।
[2] কংগ্রেসের শর্তাধীন সহযােগিতার সিদ্ধান্ত: লিনলিথগাের ঘােষণার প্রতিবাদে জাতীয় কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলি থেকে পদত্যাগ করে। তবে কংগ্রেস ব্রিটিশের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার পথ খােলা রাখে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই প্রস্তাবে ব্রিটেনের পক্ষ অবলম্বনের ব্যাপারে কংগ্রেস দুটি শর্তের উল্লেখ করে। প্রথম শর্তে বলা হয়, কেন্দ্রে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। আর দ্বিতীয় শর্তে বলা হয়, ব্রিটিশকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে যুদ্ধ শেষে তারা ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান করবে। জাতীয় কংগ্রেসের এই ভূমিকার বিরুদ্ধে সরব হয় বামপন্থী গােষ্ঠীগুলি।
[3] ব্রিটিশের বিভেদকামী ভূমিকা: বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম লিগকে অধিক গুরুত্ব দিতে শুরু করে। বিশেষত কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লিগের বিদ্বেষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্রিটিশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে লিগ ও কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
[4] লিনলিখগাের আগস্ট প্রস্তাব: গভর্নর জেনারেল এক ঘােষণায় বলেন (১৯৪০ খ্রি., ৮ আগস্ট)-
-
[i] ব্রিটিশ সরকার ভারতে ডােমিনিয়ন ধরনের এক দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকার গঠনে ইচ্ছুক।
-
[ii] ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের কোনাে পরিবর্তন করার আগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরামর্শ নেওয়া হবে। পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন দল, সম্প্রদায় এবং দেশীয় রাজাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করা হবে।
[5] কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশন: কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশনে (১৯৪০ খ্রি., মার্চ) লিনলিথগাের প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করা হয়। তাই রামগড় অধিবেশনে স্থির হয়—
-
[i] সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেস অংশ নেবে না।
-
[ii] ডােমিনিয়নের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা হবে।
-
[iii] গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ গঠন করতে হবে।
-
[iv] জাতীয় কংগ্রেস সাংগঠনিকভাবে নিজেদেরকে প্রস্তুত করবে এবং সংকট তৈরি হলে আইন অমান্য করবে।
[6] মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশন: মুসলিম লিগ কংগ্রেসের গণপরিষদ গঠনের দাবি প্রত্যাখ্যান করে। লিগ আশঙ্কিত হয় এই ভেবে যে, প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে গণপরিষদ বা সংবিধান সভা গঠিত হলে জাতীয় কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এ সময়কালে মুসলিম লিগের লাহাের অধিবেশনে মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ফলে জাতীয় রাজনীতি এক জটিল আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়।
[7] সমালােচনা
-
এই প্রস্তাবে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতাদানের ব্যাপারে স্পষ্ট কোনাে উল্লেখ ছিল না। বলা হয়েছিল যুদ্ধ শেষে ভারতকে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের মধ্যে একটি ডােমিনিয়নের মর্যাদা দেওয়া হবে।
-
এই প্রস্তাবে সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই অহেতুক প্রতিশ্রুতিদান আসলে জিন্নার পাকিস্তান দাবিকেই সমর্থন করেছিল বলা চলে। তাই এই প্রস্তাবকে কংগ্রেস হতাশাজনক বলে সমালােচনা করে।
[8] ফলাফল
-
গান্ধিজির ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ: জাতীয় কংগ্রেস দ্বারা আগস্ট প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। বড়লাট লিনলিথগাের ঘােষণায় আপত্তি তুলে গান্ধিজি ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহের উদ্যোগ নেন। কংগ্রেস কার্যকরী সমিতির অনুমােদনের পর প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিগুলি এবং কংগ্রেসের সাধারণ কর্মীগণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেয়।
উপসংহার: কংগ্রেস ছাড়াও লিগসহ অন্যান্য দলগুলিও ব্রিটিশের বিরােধিতা শুরু করে। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে এক অচলাবস্থা তৈরি হল। জাতীয় রাজনীতির এই অচলাবস্থা দূর করার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল এই প্রস্তাবের কিছু অংশ সংশােধন করে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ক্রিপস মিশনকে ভারতে পাঠান।
ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবগুলি আলােচনা করাে। ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার কারণগুলি ব্যাখ্যা করাে।
ভারত ছাড়াে আন্দোলনের পটভূমি ও অগ্রগতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
Leave a comment