নারী ও পুরুষের ব্যবহৃত ভাষার মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করে ভাষাবিজ্ঞানীরা লিঙ্গনির্ভর সমাজভাষার কথা বলেছেন। নারী ও পুরুষের ভাষার মধ্যে পার্থক্যের কারণ উভয়ের জীবনাচরণের ধারা এবং সামাজিক জীবনপ্রণালী সমশ্রেণির নয়। পুরুষদের পৃথিবী ঘরােয়া নারীদের পৃথিবী থেকে যেহেতু অনেক বিস্তৃত, তাই তাদের ব্যবহৃত ভাষার শব্দভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ। তা ছাড়া, পুরুষরা মান্যভাষার অনেক নিকটবর্তী ভাষাতেও কথা বলেন। এমন এক সময় ছিল যখন নারীদের পক্ষে বিশেষ কতকগুলাে শব্দ উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ ছিল। পুরুষেরাও বেশ কিছু শব্দ মহিলাদের সামনে উচ্চারণ করতেন না। যেমন, আগেকার দিনে হিন্দু রমণীরা স্বামী, শ্বশুর বা ভাসুরের নাম নিজ মুখে উচ্চারণ করতেন না, অন্য শব্দ প্রয়ােগ করতেন। মেয়েরাই কেবল দিব্যি কাটতে ‘থুরি’, ‘মাইরি’ প্রভৃতি শব্দ উচ্চারণ করতেন। নারীরা অনেক সময় নিজেদের মধ্যে সাংকেতিক ভাষাও ব্যবহার করতেন। যেমন আমি যাব না’ কথাকে হয়তাে তারা বললেন, বােআ বােমি বােযা বােব বােনা। পুরুষরা নিজেদের মধ্যে যে ভাষায় কা বলেন, একজন বা দুজন নারীর উপস্থিতিতে তেমন ভাষা আর ব্যবহার করেন না। নারীদের ক্ষেত্রেও একথা প্রযােজ্য। আবার বিশেষ কিছু নিন্দাসূচক শব্দ বা গালিগালাজ ভাষায় প্রচলিত থাকে যাকে পুরুষরাই কেবল ব্যবহার করেন। নারীদেরও আছে পৃথক ধরনের এই জাতীয় শব্দ। বাংলা ভাষায় মেয়েলি কথ্যরীতিকে অধ্যাপক সুকুমার সেন বলেছেন Women’s Dialect বা মেয়েলি উপভাষা।

শ্রেণি বর্ণ ধর্মভেদে সমাজভাষার পার্থক্য দেখা যায়। এমনকি শহর ও গ্রামের ভাষাভাষীদের মধ্যেও ভাষার পার্থক্য স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়।

গ্রাম-শহর ভেদে ভাষার পার্থক্য: গ্রামের মানুষ সাধারণত স্থানীয় বা গােষ্ঠীগত উপভাষা ব্যবহার করেন। অন্যদিকে শহরের মানুষের মধ্যে শিক্ষিত-ভদ্র শ্রেণিতে ইংরেজি মিশ্রিত মান্যভাষা এবং বস্তিবাসীদের মধ্যে হিন্দি-উর্দু মিশ্রিত মান্যভাষা প্রচলিত। এটা কলকাতা ও ঢাকা শহরের ক্ষেত্রেই অবশ্য বিশেষভাবে প্রযােজ্য। জেলাশহরে অবশ্য অবিমিশ্র বাংলা ভাষাই ব্যবহৃত হয়। গ্রামে যেমন মাদুর, পিঁড়ি, খেত ইত্যাদি শব্দ বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়, শহরে তেমনি বাগান, টব, সােফা, ফ্ল্যাট ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়। প্রধানত শহরে থাকা উচ্চবিত্ত মানুষেরা সাহিত্য-ঘেঁষা মান্যচলিত ভাষা ব্যবহার করেন। তাতে ইংরেজি বাক্য, বাক্যাংশ এবং শব্দ মেশানাে থাকে। ইংরেজিতেও প্রায়শই তারা কথা বলে থাকেন, এমনকি অন্য বাঙালিদের সঙ্গেও।

অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদে ভাষার পার্থক্য: মধ্যবিত্তরা মান্য চলিত বাংলায় বা কোনাে আঞ্চলিক উপভাষায় (গ্রামে) কথা বলে থাকেন। সে-কথার মধ্যে কিছু কিছু ইংরেজি শব্দ অবশ্য মিশে থাকে। শহরের নিম্নবিত্তরা হিন্দি-উর্দু মিশ্রিত অপভাষায় এবং গ্রামের নিম্নবিত্তরা স্থানীয় বা গােষ্ঠীগত উপভাষা ব্যবহার করেন।

সম্প্রদায়ভেদে বাঙালিদের মধ্যে ভাষাগত পার্থক্য আমরা যথেষ্ট পরিমাণে লক্ষ করি। বাঙালি হিন্দুরা যেমন জল শব্দটি ব্যবহার করেন, তেমনি বাঙালি মুসলমানরা পানি শব্দটি ব্যবহার করেন। যদিও পানি এবং জল দুটি সংস্কৃত-জাত শব্দ। হিন্দিভাষী হিন্দু-মুসলমানরা অবশ্য পানি কথাটাই ব্যবহার করেন। হিন্দু বাঙালিদের ব্যবহৃত বাবা, মা, মাসি, মেসােমশায়, ঠাকুমা, দিদি, দাদু, দিদা, কাকা, কাকি, বই, বিয়ে, নমস্কার—এই শব্দগুলি মুসলমান বাঙালিদের ক্ষেত্রে হয় যথাক্রমে আব্বা, আম্মা, খালা, খালু, দাদিমা, আপা, নানা, নানি, চাচা, চাচি, কেতাব, সাদি, আস্সালামু-ওয়ালায়কুম, খােদা হাফেজ।

এ ছাড়াও বলা যায় যে, ভারতীয় বাঙালি এবং বাংলাদেশি বাঙালিদের মধ্যেও ভাষাগত পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যেমন, ‘উনি হচ্ছেন গিয়ে অধ্যাপক বিবেক কুণ্ডু’–এরকম বাক্যরীতি বাংলাদেশের বাঙালিরা ব্যবহার করেন না। সুতরাং অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা, ধর্মপরিচয়, বাসস্থান (শহর বা গ্রাম), রাষ্ট্রপরিচয় এসবের নিরিখেই শ্রেণিনির্ভর সমাজভাষা গড়ে ওঠে।

সাধারণভাবে মনে করা হয়, বাংলা সাধু গদ্যের উদ্ভব উনিশ শতকে। কিন্তু এই ধারণাটি ভ্রান্ত। উনিশ শতকেরও অনেক আগে থেকে বাংলা সাধু গদ্যের ব্যবহার হয়ে আসছে।

প্রা-উনিশ শতকের সাধুভাষা: চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ এবং কিছু কিছু বৈয়বীয় নিবন্ধে বাংলা সাধু গদ্যের অনেক প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায়। যেমন, কোচবিহারের মহারাজ নরনারায়ণের লেখা একটি চিঠি। চিঠিটি ১৪৭৭ শকাব্দে অর্থাৎ ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে লেখা হয়েছে আহােমরাজ (অসমরাজ) চুকামা স্বর্গদেবকে। চিঠিটির কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে-

লেখনং কার্যঞ। এথা আমার কুশল। তােমার কুশল নিরন্তরে বাঞ্ছা করি। অখন তােমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত রহে। তােমার আমার কর্তব্যে বাৰ্ধতাকপাই পুষ্পিত ফলিত হইবেক।

অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের, ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে লেখা একটি চিঠির কিছুটা অংশ এইরূপ-

এখন তােমার উকিল পত্র সহিত আসিয়া আমার স্থান পছিল। আমিও প্রীতিপ্রণয়পূর্বক জ্ঞাত হইলাম। আর তুমি যে লিখিয়াছ তােমার উত্তম পত্র আসিতে আমার কিঞ্চিৎ মনস্বিতা না রহে এ যে তােমার ভালাই দৌলত।

সপ্তদশ শতকে রচিত একটি বৈয়ব ‘কড়চা’র কিছুটা অংশ এখানে তুলে দেওয়া হল-

তুমি কোন জীব। আমি তটস্থ জীব। থাকেন কোথা। ভাণ্ডে। ভাণ্ড কিরূপ হইল। তত্ত বস্তু হইতে।

এইরকম আরও বেশ কিছু নিদর্শন উদ্ধৃত করা যায় যেগুলি লেখা হয়েছে উনিশ শতকের আগেই। সুতরাং, উনিশ শতকে বাংলা সাধু গদ্যের উদ্ভব হয়েছে, এই ধারণা ইতিহাস সমর্থন করে না।

বাংলাভাষার সামগ্রিক ভাষাবৈচিত্র্য সম্বন্ধে আলােচনা করাে।

ভাষা বলতে কী বােঝ? কোন্ উপভাষা নিয়ে এবং কেন মান্য চলিত বাংলা ভাষা তৈরি হয়েছে?

উপভাষা কাকে বলে? উৎপত্তির কারণ অনুযায়ী উপভাষাকে কয়ভাগে ভাগ করা যায় ও কী কী? প্রতিটি ভাগের আলােচনা করাে।

মান্যভাষার পরিচয় দিয়ে উপভাষার সঙ্গ মান্যভাষার তুলনা করাে।

রাঢ়ি উপভাষার প্রচলিত অঞ্চলগুলি লেখাে। এর ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে।

রাঢ়ি উপভাষার রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে।

ঝাড়খণ্ডি উপভাষার প্রচলিত অঞ্চলগুলি লেখাে। এর ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে।

ভাষা কীভাবে ব্যক্তি, পেশা ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে আলাদা রূপ নেয়, তা দেখাও।

উনিশ ও বিশ শতকের সাধুগদ্যের পরিচয় দাও।

চলিতভাষার উদ্ভব ও বিবর্তন পর্যালােচনা করাে।

বাংলা গদ্যের সাহিত্যিক উপভাষা সম্বন্ধে নাতিদীর্ঘ আলােচনা করাে।

উপভাষা-শৃঙ্খল (Dialect Continuum) বলতে কী বােঝ?