প্রশ্নঃ লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের পার্থক্য দেখাও।

অথবা, লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের তুলনামূলক আলােচনা কর।

অথবা, লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের বৈসাদৃশ্য আলােচনা কর।

অথবা, লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের বৈপরীত্য আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিজস্ব সংবিধান থাকে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সরকারের রূপ সংবিধানের দ্বারাই নির্ধারিত হয়। সরকার ও জনগণের মধ্যে কি সম্পর্ক থাকবে তাও সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত হয়। সংবিধান হলাে রাষ্ট্রের সেসব বিধিবদ্ধ নিয়ম ও নীতিমালা, যা দ্বারা রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। একটি রাষ্ট্রে সংবিধান সরকারের সৃষ্টি নয়, বরং সরকারই সংবিধানের সৃষ্টি। Aristotle বলেছেন, “Constitution is the : way of life, the state has chosen for itself.” যাহােক, বিভিন্ন রাষ্ট্রে সংবিধান বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। অর্থাৎ সংবিধানের প্রকারভেদ রয়েছে।

লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য (Distinction between written and unwritten constitution): লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের বৈশিষ্ট্যগুলাে বিচার করলে উভয় ধরনের সংবিধানের মধ্যে কতকগুলাে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এ পার্থক্যগুলাে আলােচনার পূর্বে লিখিত ও অলিখিত সংবিধান বলতে কি বুঝায় তা জেনে নেয়া আবশ্যক।

লিখিত সংবিধানঃ লিখিত সংবিধান বলতে আমরা সে সংবিধানকে বুঝি, যাতে শাসনতান্ত্রিক বিষয়সমূহ এক বা একাধিক দলিলে লিখিত থাকে। Prof. J. Garner বলেছেন, “লিখিত সংবিধানে শাসনসংক্রান্ত বিষয়সমূহ দলিলে লিপিবদ্ধ থাকে। শাসনকার্য কিভাবে পরিচালিত হবে এবং বিভিন্ন বিভাগসমূহ কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে তা পূর্বেই নির্ধারিত হয়। [J. Garner, Introduction to Political Science, P-384-85] যেমন- আমেরিকা, ভারত ও কানাডার সংবিধান।

অলিখিত সংবিধানঃ অলিখিত সংবিধান বলতে প্রচলিত প্রথা, দেশাচার ও রীতিনীতিকে বুঝায়। এগুলাে কোন দলিলে সন্নিবেশিত না থাকলেও লিখিত সংবিধানের মতােই এগুলাে সরকার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ব্রিটেনের সংবিধানকে অলিখিত সংবিধান বলা হয়ে থাকে।

নিম্নে লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্যগুলাে উল্লেখ করা হলাে-

১. আনুষ্ঠানিকতার ক্ষেত্রেঃ লিখিত সংবিধানের সাথে আনুষ্ঠানিকতা জড়িত থাকে। কোন পরিষদ বা কনভেনশনে আনুষ্ঠানিকতায় ঘােষিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালে ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক বিজয় দিবসকে সামনে রেখে গণপরিষদের সদস্যদের স্বাক্ষরদানে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। [আবুল ফজল হক, বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতি (ঢাকা, বাংলা একাডেমী), ১৯৮৮, পৃঃ ১০০.] কিন্তু অলিখিত সংবিধান এমনিতে প্রণীত ও গৃহীত হয় না। এটা প্রচলিত প্রথা, আচার আচরণ ও বিচারকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠে। ব্রিটেনের সংবিধান প্রথা নির্ভর এবং জেনিংস প্রথাসমূহকে শাসনতন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি বলে অভিহিত করেছেন।

২. সর্বোচ্চ আইনের ক্ষেত্রেঃ লিখিত আইনকে দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই সকলেই সংবিধানের আওতার মধ্যে থেকে কাজ করতে বাধ্য থাকে। কোন সময় খেয়ালখুশিমতাে কোন আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ লিখিত সংবিধানের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক ও সাধারণ আইনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা হয়। কিন্তু অলিখিত সংবিধানে তা করা হয় না। ব্রিটেনে সাংবিধানিক ও সাধারণ আইনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

৩. নাগরিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রেঃ প্রচলিত ধারণা হলাে নাগরিক স্বাধীনতা এবং অধিকার রক্ষার জন্য সংবিধান লিখিত হওয়া প্রয়ােজন। সংবিধানে অধিকারসমূহ বিধিবদ্ধ থাকলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ইচ্ছানুযায়ী ঐ অধিকার ক্ষুন্ন করতে পারে না। কিন্তু ধারণা করা হয় অলিখিত সংবিধানে নাগরিক অধিকার রক্ষা করার ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ভূমিকা পালিত হয়।

৪. বিচার বিভাগের প্রাধান্যের ক্ষেত্রেঃ লিখিত সংবিধানে বিচার বিভাগের প্রাধান্য থাকে। এ বিধানানুসারে সকল বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা স্বতন্ত্রভাবে বন্টিত হয়। কোন বিভাগ কোন বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বিচার বিভাগের রায়ই হয় চূড়ান্ত। অপরদিকে, অলিখিত সংবিধানে বিচার বিভাগের পরিবর্তে আইনসভার প্রাধান্য স্বীকৃত হয়। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনকে বাতিল করার ক্ষমতা বিচার বিভাগের থাকে না। এক্ষেত্রে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ব্যবস্থা ব্রিটেনে বর্তমান।

৫. সংবিধান সংশােধনের ক্ষেত্রেঃ লিখিত সংবিধান সংশােধন করতে বিশেষ ও জটিল পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হয়। লিখিত সংবিধানের সংশােধন পদ্ধতি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘতর এবং কঠিন। কিন্তু অলিখিত সংবিধান সহজে পরিবর্তনশীল বিধায় এর জন্য কোন বিশেষ বা জটিল পদ্ধতির অনুসরণ করতে হয় না।

৬. স্পষ্টতার কি থেকেঃ লিখিত সংবিধান সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট। দ্বি-অর্থবােধক শব্দগুলােও যথাসম্ভব পরিহার করা হয়। তাই এর কোন বিষয় নিয়ে তেমন কোন বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় না। কিন্তু অলিখিত সংবিধান অস্পষ্ট এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা সুনির্দিষ্ট নয়।

৭. প্রকৃতিগত পার্থক্যঃ লিখিত সংবিধান দুস্পরিবর্তনীয়। লিখিত সংবিধানের স্থায়িত্ব থাকে বলে তা সহজে পরিবর্তন করা যায় না। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হয়। অন্যদিকে, অলিখিত সংবিধান সুপরিবর্তনীয় প্রকৃতির মতাে হয়ে থাকে। প্রয়ােজনমতাে এ সংবিধানের ধারা পরিবর্তন করে দ্রুত জরুরি অবস্থার মােকাবিলা করা সম্ভব।

৮. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের ক্ষেত্রেঃ লিখিত সংবিধানে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের নীতি বিদ্যমান। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ তাদের কার্যপরিধি জানতে পারে এবং কেউ কারাে কাজে হস্তক্ষেপ করে না। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ কার্যকরী করার জন্য লিখিত হওয়া আবশ্যক। কিন্তু অলিখিত সংবিধানে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বিদ্যমান থাকে না। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ তাদের কার্যপরিধি সম্পর্কে অবগত থাকে না ফলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।

৯. লিপিবদ্ধকরণের দিক থেকেঃ লিখিত সংবিধানের অধিকাংশ ধারাসমূহ এক বা একাধিক দলিলে লিপিবদ্ধ থাকে। এ সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ থাকে। ফলে ক্ষমতাশীল দল ইচ্ছা করলেই জনগণের অধিকার হরণ করতে পারে না। কিন্তু অলিখিত সংবিধানের অধিকাংশ ধারাসমূহ কোন দলিলে লিপিবদ্ধ থাকে না।

১০. সাধারণ আইন ও সাংবিধানিক আইনঃ লিখিত সংবিধানে সাধারণ আইন এবং সাংবিধানিক আইনের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এ সংবিধানে বিভিন্ন আইন সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকে বলে জনগণ সহজেই সাধারণ আইন এবং সাংবিধানিক আইনের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে। কিন্তু অলিখিত সংবিধানে এরূপ কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না।

উপসংহারঃ উপযুক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে এরূপ পার্থক্য অনেকটা অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক ও অবাস্তব। এ পার্থক্য, মােটেই মৌলিক নয়। গেটেল (Gettell) এর মতে, “The distinction between written and unwritten constitution is a matter of degree not of kind.” তবে যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত না হলেও সংবিধানের এ শ্রেণিবিভাগের ব্যবহারিক মূল্যকে অস্বীকার করা যায় না। লিখিত সংবিধানের বিধিবদ্ধ অংশকে ভিত্তি করেই অলিখিত অংশের সৃষ্টি হয়। আবার বিপরীতক্রমে এভাবেই অলিখিত সংবিধানের লিখিত অংশের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ অলিখিত সংবিধানের যেমন অনেক লিখিত দিক রয়েছে, তেমনি লিখিত সংবিধানেরও অলিখিত দিক রয়েছে।