প্রশ্নঃ লাওৎসের দর্শনের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা কর।

অথবা, প্রাচীন চীনের তাওবাদের বৈশিষ্ট্য আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসে যে সকল দার্শনিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন তাদের মধ্যে চীনা দার্শনিক লাওৎসে ছিলেন অন্যতম। চীনে চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি হওয়ার প্রাথমিককালেই ধারণা জন্মে যে, ঈশ্বর স্রষ্টা নন, তিনি মানুষের কৃতকর্মের বিচারক। এ থেকে চীনের চিন্তাবিদগণ ঈশ্বরের শাস্তি থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করেন। এ চিন্তার পথ ধরেই চীনের প্রাচীনতম দার্শনিক লাওৎসের (৬০৪-৫১৭ খ্রিঃপূর্ব) দর্শনের জন্ম হয়। লাওৎসের প্রচলিত মতবাদ তাওবাদ নামে পরিচিত। লাওৎসের মতবাদের ওপর ভিত্তি করে প্রচারিত গ্রন্থ Tao Te Ching নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন নৈরাজ্যবাদী দার্শনিক।

লাওৎসের পরিচিতিঃ লাওৎসে কনফুসিয়াসের প্রায় সমসাময়িক এবং তাওবাদের প্রতিষ্ঠাতা। তার জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ঐতিহাসিক জুমা চিয়েনের মতে তিনি ছিলে রাজকীয় গ্রন্থাগারের অধ্যক্ষ। কিংবদন্তি থেকে জানা যায় লাওৎসে ৮৭ বছর (খ্রিঃপূঃ ৬০৭-৫১৭ অব্দ) বেঁচে ছিলেন। এ মহামানবের জীবনকালে কনফুসিয়াসের সঙ্গে সাক্ষাৎও হয়েছিল।

লাওৎসের দর্শনঃ নিম্নে লাওৎসের দর্শন সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে-

নৈতিক দর্শনঃ লাওৎসে শিক্ষার মূল বক্তব্য ছিল ‘তাও’ এবং তার মতবাদ ‘তাওবাদ’ নামে পরিচিত। তাও অর্থ পথ। তাওবাদের প্রতিপাদ্য বিষয় হলাে জীবন-পদ্ধতির প্রজ্ঞাগত অতীন্দ্রিয়বাদী বিশ্লেষণ। তাও তে কিং-এ উলেখ আছে, তাও এমনই একটি ধারণা যার আকার নেই, শব্দ নেই, পরিবর্তন নেই এবং তা স্বর্গ ও পৃথিবী সর্বত্র অবস্থান করে। আমরা এর নাম জানি না কিন্তু একে বলি ‘তাও’। তাও কোন কর্ম করে না, সকল কর্ম তার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। তাও কায়াহীন, ছায়াপথ। নৈষ্কর্মের দ্বারা যে ব্যক্তি তাও পথের যাত্রী। তাও হন তার সাথী, তাও-এর মধ্যে সে বিলীন হয়ে যায়।

শিক্ষাদর্শনঃ শিক্ষা সম্পর্কে লাওৎসের মতবাদ ছিল, “শিক্ষা মানুষকে চৌর্যবৃত্তিতে সাহায্য করে। যারা শিক্ষা দেয় তারা কিছু জানে না, যারা জানে তারা শিক্ষা দেয় না। তাই জ্ঞান ও শিক্ষাকে পরিহার করা গেলে মানুষ উপকৃত হবে। মিতব্যয়িতা ও নিরহংকারকে তিনি খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন। “একজন সত্যিকারের পরিপূর্ণ মানুষ সেই যে নিরহংকার। জ্ঞানী ব্যক্তি সঞ্চয় করতে পারে না। যত বেশি অন্যের জন্য ব্যয় করবে তত বেশি নিজের জন্যে পাবে।” লাওৎসের শিক্ষা ছিল বিশ্বজনীন শান্তিবাদ। তার উপদেশের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে- (১) বিশ্বজনীন শান্তিবাদ-প্রতিশােধপরায়ণ না হওয়া; (২) প্রেমের মাধ্যমে মানষে মানষে প্রীতি স্থাপন করা এবং (৩) সাম্যবাদ-যার অধিক আছে তার কাছ থেকে যার নেই তাকে দেয়াই স্বর্গীয় নীতি।

রাষ্ট্রদর্শনঃ রাজনৈতিক জীবনে লাওৎসে অবাধনীতির প্রবক্তা। তিনি বিশ্বাস করতেন সরকারি হস্তক্ষেপ অনাচার বৃদ্ধি করে। মানুষকে যদি তার বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করতে দেয়া হয় তবে স্বাভাবিকভাবে একে অন্যের সঙ্গে কাজ করতে পারবে। সমাজে বাধা-নিষেধ যত গড়ে তােলা যায়, প্রজারা ততই নিঃস্ব ও রিক্ত হয়। অস্ত্র যত শাণিত হয় বিশৃঙ্খলা তত বাড়ে। আইনের সংখ্যা বাড়লে চোর-ডাকাতের সংখ্যাও বাড়ে। কারণ আইন বুদ্ধিমান ব্যক্তির দ্বারা সষ্টি হয় এবং আইনই অপরাধের সৃষ্টি করে। তাই প্রশাসনিক ব্যাপারে রাজার হস্তক্ষেপ যত কম হয় ততই ভালাে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, লাওৎসে ছিলেন একজন নৈতিক এবং সত্যবাদী দার্শনিক। তার দর্শন তৎকালীন চীনের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু তার তাওবাদ অবক্ষয়ের দিকে নেমে আসে। কারণ চীনের সমাজ ও চিন্তাধারার সাথে তার দর্শনের তেমন সঙ্গতি ছিল না।