সমাজে মহিলাদের অবস্থান ও অবস্থা সম্পর্কে উদারনীতিক ও সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা আলোচনা করেছেন। কিন্তু এই দুই শ্রেণীর নারীবাদীদের এই সত্যটি ধরা পড়েনি যে সকল সামাজিক বিভাজনের মধ্যে নরনারীর বিভাজন হল সর্বাধিক মৌলিক। বিংশ শতাব্দীর ষাটের ও সত্তরের দশকে নারীবাদী আন্দোলন বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে প্রকাশ করার ব্যাপারে উদ্যোগ- আয়োজন গ্রহণ করেছে। কেবলমাত্র রাজনীতিক, আর্থনীতিক ও সর্বসাধারণের ক্ষেত্রে নয়, সামাজিক, ব্যক্তিগত ও লিঙ্গগত অস্তিত্বের সকল ক্ষেত্রে এই প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিকে ব্যক্ত করার চেষ্টা হয়েছে। এই প্রবণতা ও প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় বিশিষ্ট নারীবাদী চিন্তাবিদ সাইমন ডি বিয়ভয়ার (Simone de Beauvoir)-এর লেখায়। নারীবাদী চিন্তার এই ধারা বিকশিত হয়েছে প্রথম দিকের র্যাডিক্যাল (radical) নারীবাদীদের দ্বারা। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ইভা ফিগেস ও জারমেইন গ্রীয়ার-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সাইমন ডি বিয়ভয়ার: বিংশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে নারীবাদী ধারায় ভাটা দেখা দেয়। মহিলাদের রাজনীতিক ও আইনগত অধিকারসমূহ আদায় হয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় আগেকার ধ্যান-ধারণাসমূহ পুরাতন ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এই সময় সর্বসাধারণের মধ্যে সাধারণভাবে একটি বিষয়ে আগ্রহের আধিক্য ছিল। এই বিষয়টি হল প্রাক্-যুদ্ধ স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন। যুদ্ধকালীন অবস্থায় অনেক মহিলাই পুরুষের পেশায় যোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা ঘরে ফিরে আসেন। ভ্যালেরী ব্রাইসন Feminism শীর্ষক রচনায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “…..although labour shortages meant that more continued to enter paid employment, this was seen as contrary to their own interests, as the dominant cult of domesticity taught that true fulfilment for women lay with the family.”
নারীবাদী চিন্তাধারায় সাইমন ডি. বিয়ভয়ার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচিত করেন। সাইমনের নারীবাদী চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Second Sex শীর্ষক গ্রন্থে। গ্রন্থটি ১৯৪৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই মহিলা সমাজবিজ্ঞানীর অভিমত অনুযায়ী নারীত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ কেবলমাত্র গার্হস্থ্য জীবন ও স্ত্রীত্ব বা নারীত্বের মধ্যে নিহিত আছে এমন নয়। ঘরকন্না ও গৃহবধূর জীবন-চৌহদ্দির মধ্যে কৃত্রিমভাবে নারীজাতির জীবনকে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তারফলে মহিলাদের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং মানব সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ সবের সমর্থনে শ্রীমতী সাইমন ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, মনস্তাত্ত্বিক, সাহিত্যিক ও কাহিনীমূলক বক্তব্য-সম্ভার সমবেত করেছেন। তিনি যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন যে, অতীতে জৈবিক কারণে মহিলাদের যৌন অবস্থার মধ্যে আবদ্ধ রাখা হয়েছে। বর্তমানে নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যসমূহের উৎপাদনের প্রক্রিয়া সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন করা প্রয়োজন। এবং নারীজাতিকে অবহিত করা আবশ্যক যে, স্বতন্ত্রভাবে জীবন যাপনের সুযোগ-সুবিধা তাদের সামনে উন্মুক্ত আছে। এ বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে সাইমন সমাজবিজ্ঞানে এযাবৎ অনালোচিত নারী যৌন জীবনের বিভিন্ন গোপন বিষয় নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করেছেন। অনেকের কাছেই এই আলোচনা আকস্মিক ও যৎপরোনাস্তি বিহ্বলতাদায়ক এবং প্রেরণামূলকও বটে।
শ্রীমতী সাইমন (১৯০৮-‘৮৬)-এর ব্যক্তিগত জীবনধারার উল্লেখও এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক তিনি ব্যক্তিগত জীবনে গার্হস্থ্য জীবনের দায়িত্ব ও নারীত্বের নিয়ম-নিষেধকে উপেক্ষা করেছেন। নারীত্বের সাবেকি মহিমাকে তিনি অকাতরে অগ্রাহ্য করেছেন। তিনি একজন পুরুষ মানুষের মতই ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবী পুরুষসমাজেই সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বসবাস করেছেন। সাইমনের জীবনের কেন্দ্রীয় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল অস্তিত্ববাদী (existentialist) দার্শনিক জ্যা পল সাঁত্রে (Jean-Paul Sartro)-র সঙ্গে। তবে যৌন একগামিতার মধ্যে এই সম্পর্ক সীমাবদ্ধ ছিল এমন নয়। কিন্তু তাঁরা বিবাহ করেন নি বা বিবাহিত জীবনযাপন করেননি।
সাইমন সমকালীন বিশ্বে মহিলাদের অভিজ্ঞতাসমূহকে ঘিরে বিদ্যমান নীরবতার নিগড়কে ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। তিনি অন্তত কিছু মহিলাকে এই দুনিয়া দেখার পৃথক চোখ দিয়েছিলেন। নতুন প্রজন্মের নারীবাদীদের চিন্তা-চেতনায় তিনি নতুন প্রেরণা সঞ্চারিত করেছিলেন। যার ফলে বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে নতুন প্রজন্মের নারীবাদীরা নারীবাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে রাজনীতিক ক্রিয়াকর্মে রূপান্তরিত করার ব্যাপারে সচেষ্ট ও সক্রিয় হয়। সাইমনের ধ্যান-ধারণাসমূহ বহুলাংশে ‘অস্তিত্ববাদী দর্শন’ (existentialist philosophy)-এর সঙ্গে বিশেষভাবে সংযুক্ত ছিল। এ কথা ঠিক। কিন্তু মহিলাদের অনেকেই সাইমনের দার্শনিক ধারণাসমূহের অর্থ অনুধাবন করতে পারেননি; আবার অনেকে সে সব স্বীকার করতে চাননি। কিন্তু সাইমনের চিন্তাভাবনা সূত্রে অনেক মহিলাই স্বীকার করেন যে, মহিলাদের স্বাধীন অস্তিত্ব ও আত্মসম্মান বোধকে অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করা হয়েছে। মহিলাদের মধ্যে এই চেতনা সঞ্চারিত হয় যে, তারা নিজেরাই নিজেদের জীবনের দায়-দায়িত্ব বহন করতে সক্ষম।
আজকাল সাইমনের অনেক বক্তব্যই মামুলী ও ভ্রান্ত বলে সমালোচিত হয়। সমালোচকরা সাইমনের বিরুদ্ধে বিবিধ অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এই সমস্ত অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তিনি পুরুষদের অনুমানসমূহকে স্বীকার ও সমর্থন করেছেন; মহিলাদের অভিজ্ঞতার মূল্যকে তিনি অস্বীকার করেছেন; প্রথম লিঙ্গ (first sex) হিসাবে পুরুষদের মর্যাদা ও স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করেছেন।
আধুনিক র্যাডিক্যাল (radical) নারীবাদের অভ্যুত্থানের পিছনে কতকগুলি বিষয় বা আন্দোলনের সদর্থক অবদান অনস্বীকার্য। এগুলি যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন, পৌর অধিকারসমূহের জন্য আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, নয়া বোম-আন্দোলন প্রভৃতি। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে এই সমস্ত আন্দোলনে অর্জিত নারী সমাজের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক র্যাডিক্যাল নারীবাদী ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি হয়। নতুন প্রজন্মের তরুণী যুবতিরা অনুধাবন করে যে নারীদের যৌন বিষয়, মহিলা সহায়ক ও গৃহবধূ হিসাবে বিবেচনা করা হয়; তাদের সম রাজনীতিক অংশীদার হিসাবে গণ্য করা হয় না। এ সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে সাধারণত উপেক্ষা, উপহাস ও অপমান করা হয়; নতুবা নীরবতার সঙ্গে অগ্রাহ্য করা হয়। এ ধরনের আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী উদ্যোগ-আয়োজনের সুবাদে নতুন বৈপ্লবিক মতাদর্শমূলক অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিদ্যমান ব্যবস্থাদির বিরুদ্ধে মৌলিক প্রতিবাদের সৃষ্টি হয়। নারীসমাজ অচিরেই অনুধাবন করতে পারে যে তাদের সমস্যাদির ব্যাপারে সহমত পোষণ করে এমন মানুষের সংখ্যা অসংখ্য। এর ফলে ব্যাপকভাবে নারীবাদী সচেতনতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়। মহিলাদের গোষ্ঠীসমূহে মহিলাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাসমূহ সম্পর্কে সম্যক আলোচনা, তার রাজনীতিক তাৎপর্য ও অভিপ্রেত পরিবর্তনের জন্য প্রক্রিয়া স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়। এইভাবে র্যাডিক্যাল নারীবাদের বিকাশ ঘটে। নারীবাদী এই দৃষ্টিভঙ্গি আবার বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড অংশে বিভক্ত। বহু ও বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা র্যাডিক্যাল নারীবাদ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।
র্যাডিক্যাল নারীবাদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কেন্দ্রীয় রাজনীতিক বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। এ ধরনের নারীবাদী আলোচনায় রাষ্ট্রকে পুরুষের রাজনীতিক ক্ষমতার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ হিসাবে দেখা হয়। শোষণ-পীড়নের অন্যান্য গভীর কাঠামোর প্রতিফলন এই রাষ্ট্রের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। মাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে মহিলাদের বাদ দেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে মহিলাদের বাদ পড়ার বিষয়টি সরকারী নথিপত্রের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত। এই বিষয়টি লিঙ্গগত অসাম্য-বৈষম্যের লক্ষণ, কারণ নয়। মার্কসবাদী ব্যাখ্যায় বলা হয় যে, নারী-নিপীড়নের বিষয়টি হল শ্রেণীসমাজের ফলশ্রুতি। পুঁজিবাদের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে নারী-নিপীড়নেরও সমাপ্তি ঘটবে। এই মার্কসীয় ব্যাখ্যাকেও র্যাডিক্যাল নারীবাদে স্বীকার বা সমর্থন করা হয় না।
র্যাডিক্যাল নারীবাদ অনুযায়ী পুরুষজাতের ক্ষমতার বিষয়টি নিছক অর্থনীতির মধ্যে নিহিত নেই। পুরুষ জাতির ক্ষমতা নিহিত আছে পরিবারের মধ্যে, প্রজনন প্রক্রিয়ায় এবং এমনকি আমাদের ভাষার মধ্যেও। র্যাডিক্যাল নারীবাদীদের অনেকের অভিমত অনুযায়ী পুরুষজাতির পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার মূল হল পরিবার। পারস্পরিক ভালবাসা ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে গড়ে উঠা পরিবার কোন স্বাভাবিক ব্যবস্থা নয়। পরিবার হল একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এই সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নারীজাতির শ্রমকে শোষণ করা হয়। পরিবারের মধ্যে লিঙ্গগত নিপীড়নের ঘটনা ঘটে এবং তার শিক্ষা পাওয়া যায়। পুরুষের যৌন ক্ষমতার হিংস্র প্রকাশ পরিবারের মধ্যে ঘটে। সুতরাং পরিবার হল নিপীড়নের একটি উৎস এবং পরিবার জনজীবনে পুরুষের প্রাধান্যমূলক ক্ষমতাকে অব্যাহত রাখে।
অনেকে আবার প্রজনন ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এই শ্রেণীর নারীবাদীরা গর্ভধারণ ও সন্তান প্রজননের বিষয়টিকে মানবজাতির ক্রমবিবর্তনের নিম্নতর পর্যায়ের বর্বরসূলভ অসভ্যতার অবশিষ্টাংশের নিদর্শন। এই নৃশংস অবস্থা থেকে নারীজাতিকে মুক্তি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অযৌন প্রজনন প্রযুক্তি অনুসরণের কথা বলেছেন। অন্যান্য অনেকে আবার বিষয়টির ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মতানুসারে মহিলাদের সন্তান প্রজনন পরিপূর্ণতা প্রদানকারী এবং সৃজনশীল অভিজ্ঞতা। মাতৃত্ব হল উন্নততর নারীসুলভ মূল্যবোধ। প্রতিপালন, সহযোগিতা ও শান্তি এই মূল্যবোধের সঙ্গে সংযুক্ত। নারীবাদী এই সমস্ত যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন আর এক ধরনের নারীবাদী মতবাদের অভ্যুদয় ঘটেছে। এই মতবাদটি ‘eco-femenist’ মতবাদ হিসাবে পরিচিত। বিবিধ অভিব্যক্তি সত্ত্বেও র্যাডিক্যাল নারীবাদীরা এই বক্তব্যের ক্ষেত্রে সহমতাবলম্বী যে, প্রজনন রাজনীতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, একে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে পুরুষদের উদ্যোগ হল মহিলাদের উপর গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। ব্রাইসন এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন “…all can therefore unite behind the slogan of ‘A woman’s right to choose”
র্যাডিক্যাল নারীবাদের অন্যান্য আরও ধারা বা দিক আছে। এই শ্রেণীর কিছু নারীবাদীর অভিমত হল যে, নারী নিপীড়নের মূল সামাজিক সংগঠন বা শারীরিক প্রাধান্যমূলক আচরণের মধ্যে নিহিত নেই। নারী নিপীড়নের মূলে আছে সংস্কৃতি, ভাষা ও জ্ঞানের উপর পুরুষজাতির নিয়ন্ত্রণ। এই নিয়ন্ত্রণের ফলে মানুষের চিন্তা-ভাবনার পথে সীমাবদ্ধতা আরোপিত হয়। এবং এইভাবে নর-নারী উভয়ের অন্তরে পিতৃতান্ত্রিকতার ধ্যান-ধারণা সুপ্রবিষ্ট হয়। এই অবস্থায় বিপরীত একটি সংস্কৃতি বা জীবনধারা গড়ে তোলার ব্যাপারে নারীবাদীদের উদ্যোগী হতে হবে। পুরুষ-পক্ষপাতিত্বকে তুলে ধরতে হবে এবং লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ভাষাকে বিকশিত করতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও সকল স্তরে নারীজাতির জ্ঞানকে বিকশিত করতে হবে।
র্যাডিক্যাল নারীবাদীদের মধ্যে অনেকের অভিমত অনুযায়ী পুরুষজাতির শক্তির মূল উৎস হল ‘যৌনতা’ (sexuality)। পুরুষজাতির যৌনতার মধ্যে ইতররতি প্রবণতা (heterosexuality) বর্তমান। পুরুষের ইতররতি প্রবণতা মহিলাদের জন্য পরিপূর্ণতার পরিপন্থী। পুরুষেরা এই ইতররতি প্রবণতার পথে মহিলাদের বিভক্ত করে ও নিয়ন্ত্রণ করে। ইতররতি প্রবণতা যৌনসহবাস পুরুষজাতির সামাজিক ক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত। সুতরাং পুরুষের ইতররতি প্রবণতা পরিহারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিষয়টি নিছক ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার নয়। এ হল রাজনীতিকভাবে ক্ষমতান্বিত করার একটি ক্রিয়া। এই ক্রিয়ার মাধ্যমে পুরুষকে সন্তুষ্ট করার বাধ্যবাধকতা থেকে নারী মুক্তি লাভ করে।
আবার র্যাডিক্যাল নারীবাদীদের অনেকে মনে করেন যে, ইতররতি প্রবণতাই এ ক্ষেত্রে মূল বিষয় নয়। ইতররতি প্রবণতার সঙ্গে হিংস্রতা সংযুক্ত হলে নারী-নিপীড়নের সৃষ্টি হয়। যৌন নিপীড়নের ঘটনা কদাচিৎ ঘটে এমন নয়। মানুষের সমাজ-সংস্কৃতিতে যৌন-পীড়নের বিষয়টি ভালভাবে জায়গা করে নিয়েছে। অশ্লীল রচনা ও চিত্রের সমৃদ্ধ শিল্প ইতররতি প্রবণতা ও যৌন পীড়নের বিষয়টিকে অধিকতর পরিপুষ্ট করে। এই অবস্থায় নারীকে যৌন বিষয় হিসাবে দেখা হয়, পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে দেখা হয় না। তারফলে মহিলাদের জীবন কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। এ ধরনের যৌন পীড়নের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মহিলারা কিছু পুরুষের আশ্রয় বা নিরাপত্তা লাভের চেষ্টা করে। এই চেষ্টার উদ্দেশ্য হল অন্যান্য পুরুষের যৌন পীড়ন থেকে পরিত্রাণ পাওয়া। মহিলারা কিন্তু ইতররতি প্রবণতায় ও হিংসাত্মক যৌনক্রীড়ায় পুরুষদের সঙ্গে সমভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সামিল হয় না। এই শ্রেণীর নারীবাদীদের বক্তব্য অনুযায়ী সকল পুরুষই অশ্লীল রচনা ও চিত্র এবং ধর্ষণের সুবিধা পায়। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ এসবের নিন্দা করল কিনা, তা বড় কথা নয়।
অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন: “Susan Brownmiller’s *Against Our Will’ (1975) emphasized that men dominate women through a process of physical and sexual abuse. Men have created an ideology of rape’, which amounts to a ‘conscious process of intimidation by which all men keep all women in a state of fear”. Brownmiller argued that men rape because they can, because they have the “biological capacity to rape’, and that even men who do not rape nevertheless benefit from the fear and anxiety that rape provokes amongst all women.”
উপরিউক্ত নারীবাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু মহিলার মধ্যে চরমপন্থী নারীবাদী অবস্থান গ্রহণের প্রবণতা দেখা দেয়। তাঁরা সমকামী বিচ্ছিন্নতাবাদ (lesbian speratism)-এর পথে অগ্রসর হতে চান। তবে অধিকাংশ নারীবাদী এই প্রবণতার বিরোধিতা করেন। এবং এক্ষেত্রে তাঁরা বিবিধ যুক্তির অবতারণা করেন। তাঁরা লিঙ্গগত বিষয়াদিকে নিছক ‘যৌনতা’ (sexuality)-র পর্যায়ে নামিয়ে আনার ঘোরতর বিরোধিতা করেন। এতদ্সত্ত্বেও জনমতের উপর র্যাডিক্যাল নারীবাদীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করা যায় না। অশ্লীল রচনা ও চিত্র সম্পর্কে অধুনা ব্যাপকতর বিতর্ক ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায় যৌন অত্যাচারের ঘটনাবলী নিয়ে অধুনা সোরগোল পড়ে যায়। যৌন পীড়নকে এখন আর নির্দোষ বিনোদন হিসাবে বিবেচনা করা হয় না।
র্যাডিক্যাল নারীবাদের কতকগুলি মৌলিক বৈশিষ্ট্য বর্তমান। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হওয়া আবশ্যক। তা হলে নারীবাদী অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে র্যাডিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য প্রসঙ্গে অবহিত হওয়া যাবে।
এক: র্যাডিক্যাল নারীবাদ মহিলাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও ধারণাসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত। বিদ্যমান রাজনীতিক প্রেক্ষিত বা কর্মসূচীর সঙ্গে সমঝোতার ব্যাপারে এই নারীবাদ কোন রকম তাগিদ অনুভব করে না। কারণ র্যাডিক্যাল নারীবাদ হল মহিলাদের, মহিলাদের দ্বারা এবং মহিলাদের জন্য এক মতবাদ।
দুই: এই মতবাদে মহিলাদের উপর পীড়নকে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার একটি বিশ্বজনীন ও মৌলিক প্রকৃতির উপায় হিসাবে দেখা হয়। এই মতবাদের উদ্দেশ্য হল এই পিতৃতান্ত্রিক প্রাধান্যকে অনুধাবন করা এবং এর অবসানকে সুনিশ্চিত করা।
তিন: এই মতবাদ অনুযায়ী মহিলারা হল একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী। তাদের স্বার্থসমূহ পুরুষদের স্বার্থসমূহের বিরোধী। অভিন্ন স্বার্থসমূহের ভিত্তিতে মহিলারা সাধারণ ভগিনীত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। মহিলাদের এই ঐক্য ও সংহতি জাতি ও শ্রেণীগত বিভাজনকে অতিক্রম করে যায়। এই মতবাদে বলা হয় যে, নিজেদের স্বাধীনতা ও যুক্তির জন্য মহিলাদের ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করতে হবে।
চার: র্যাডিক্যাল নারীবাদে রাজনীতির প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তদনুসারে কেবলমাত্র সর্বসাধারণের ক্ষেত্রেই ক্ষমতা সীমাবদ্ধ নয়; পরিবার এবং লিঙ্গগত সম্পর্কের মত জীবনের ব্যক্তিগত এলাকায়ও ক্ষমতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত। পরিবার এবং লিঙ্গগত সম্পর্ক এই দুটি বিষয় পিতৃতান্ত্রিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রীয় হাতিয়ার হিসাবে পরিগণিত হয়। পুরুষদের ক্ষমতাকে চিহ্নিত করাটাই হল একটি রাজনীতিক ক্রিয়া। সাবেকী মুখ্য রাজনীতিক মতবাদসমূহে লিঙ্গগত বিষয়াদির আলোচনা অনুপস্থিত। এই অনুপস্থিতি কোন আকস্মিক বিষয় নয়। এ হল পুরুষদের ক্ষমতা ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ারই অংশ বিশেষ। ভ্যালেরী ব্রাইসন তাঁর Feminism শীর্ষক এক রচনায় এ বিষয়ে বলেছেন: “The role of feminist theory is to show the political nature of areas of life that have hitherto been deemed personal, and to challenge male power by naming it.”
মহিলাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে এই চেতনার সৃষ্টি হয় যে, র্যাডিক্যাল নারীবাদের মাধ্যমে নারীসমাজের বক্তব্যসমূহের সম্যক অভিব্যক্তি ঘটেছে; সাবেকি মতবাদসমূহের মাধ্যমে তা সম্ভব হয়নি। নারীবাদী এই সমস্ত নতুন চিন্তা-চেতনা জনপ্রিয়তা পেয়েছে বিশেষ কিছু সমাজবিজ্ঞানীর রচনা সমূহের মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য হল ফিগেস প্রণীত Patriarchal Attitudes (1970), জারমেইন গ্রীয়ার প্রণীত The Female Eunuch (1970), কাতে মিল্লেৎ প্রণীত Sexual Politics প্রভৃতি গ্রন্থ।
ফিগেসের Patriarchal Attitudes শীর্ষক গ্রন্থটি ১৯৭০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মহিলাদের দুঃখকষ্টের কারণ স্বরূপ সুপরিচিত আইনগত ও সামাজিক অসুবিধাসমূহ তুলে ধরা হয়। সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বসহকারে দেখান হয় যে, সমাজের সংস্কৃতি, ন্যায়-নীতি, ধর্ম, দর্শন প্রভৃতি পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার অধীন। জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীজাতিকে পুরুষজাতির অধীন ও হীনতর হিসাবে দেখান হয়। পুরুষেরা মহিলাদের উপর চিরাচরিত নারীত্ব আরোপ করে চলে।
জারমেইন গ্রীয়ার (প্রণীত The Female Eunuch শীর্ষক গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। সমাজবিজ্ঞানী জারমেইন তাঁর নারীবাদী আলোচনায় নতুন বামপন্থী লেখকদের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে হারবার্ট মারকুইজ, উইলহেলম রীচ প্রমুখ বামপন্থী চিন্তাবিদদের নাম করা যায়। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদরা সাবেকি সমাজব্যবস্থায় পীড়নমূলক প্রকৃতির সমালোচনা করেছেন এবং লিঙ্গগত স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন। জারমেইনের মতানুসারে মহিলাদের নিষ্ক্রিয় যৌন ভূমিকা পালনে বাধ্য করা হয়। তার ফলে মহিলাদের যথার্থ যৌনত্ব অবদমিত হয়, মহিলাদের ব্যক্তিত্বের অধিকতর সক্রিয় ও দুঃসাহসিক দিকগুলির অভিব্যক্তি ঘটে না। মহিলাদের বহুলাংশে যৌনতাহীন মানুষ হিসাবে গণ্য করা হয়।
মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী মিল্লেৎ র্যাডিক্যাল নারীবাদকে লিঙ্গমূলক পীড়ন সম্পর্কিত একটি সুসংহত মতবাদে পরিণত করেন। নারীবাদী এই মতবাদ প্রচলিত উদারনীতিক ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার থেকে স্বতন্ত্র। মিল্লেতের Sexual Politics শীর্ষক গ্রন্থটিও ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয়। এই সমাজবিজ্ঞানীর অভিমত অনুযায়ী পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা হল সমাজে অবিরামভাবে বর্তমান একটি স্থির ব্যবস্থা। সকল ঐতিহাসিক ও সাম্প্রতিককালের সমাজব্যবস্থায় এবং প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে এই ব্যবস্থা বর্তমান। সকল সামাজিক, রাজনীতিক ও আর্থনীতিক সাংগঠনিক কাঠামোতে পিতৃতান্ত্রিক ধারা বহমান। নরনারীর পৃথক ভূমিকাসমূহের সূত্রপাত ঘটে স্বভাবঅন্তর্ভুক্তকরণ (conditioning) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। শৈশবেই এই প্রক্রিয়ার প্রয়োগ শুরু হয়। বালক-বালিকারাই লিঙ্গগত স্বাতন্ত্র্য্যমূলক অবস্থানের সঙ্গে পরিচিত হয়ে যায়। পরিবারের মধ্যে প্রক্রিয়ার ব্যাপক প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। এবং এই পরিবারই হল পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া সাহিত্য, শিল্পকলা, অর্থনীতি ও জনজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিকতার প্রকাশ পরিদৃষ্ট হয়। মিল্লেতের মতানুসারে র্যাডিক্যাল নারীবাদের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসাবে এই বিশ্বাসের কথা বলা হয় যে, লিঙ্গগত পীড়ন হল সমাজের সর্বাধিক মৌলিক বৈশিষ্ট্য। শ্রেণী-শোষণ, জাতিগত ভেদাভেদ প্রভৃতি অপরাপর অন্যায় অবিচার এর তুলনায় গৌণ প্রকৃতির। লিঙ্গগত ভেদাভেদ হল সর্বাধিক গভীর সামাজিক সংঘাত। রাজনীতিক দিক থেকেও এই সংঘাত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সামাজিকশ্রেণী ও জাতির দিক থেকে বিচার করলেও লিঙ্গগত অসাম্য-বৈষম্যের বিষয়টি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। মিল্লেই প্রথম পিতৃতন্ত্রের মতবাদের সুশৃঙ্খল বিবরণ প্রদান করেছেন। ভ্যালেরী ব্রাইসন তাঁর Feminism শীর্ষক এক রচনায় এ বিষয়ে বলেছেন: “Millett argued that in all known societies, the relationship between the sexes has been based on power, and that, it is therefore political. This power takes the form of male domination over women in all areas of life, and it is so universal, so ubiquitous and so complete that it appears ‘natural’. The patriarchal power of men over women is maintained by a process of socialization which begins in the family and is reinforced by education, literature and religion; it also rests upon economic exploitation and, ultimately, force (particularly sexual violence and rape).” মিল্লেতের মতানুসারে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া হিসাবে শিক্ষাদান ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মহিলারা ক্রমশ অবহিত হতে পারবে যে, লিঙ্গগত বিচার-বিবেচনাই সমাজের সাংগঠনিক প্রকৃতিকে নির্ধারণ করে। স্বভাবতই মহিলারাই কালক্রমে পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সক্রিয় হবে। নারীমুক্তির জন্য বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিবার ব্যবস্থাকে পরিহার করতে হবে। সমাজের সকল স্তরে যে মনস্তাত্ত্বিক ও লিঙ্গগত পীড়ন পরিচালিত হয় তার মূলোৎপাটন করতে হবে।
র্যাডিক্যাল নারীবাদের সমালোচনা
র্যাডিক্যাল নারীবাদ বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সমালোচকরা নারীবাদের এই ধারার বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করে থাকেন। এই সমস্ত যুক্তির মধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এক: র্যাডিক্যাল নারীবাদের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ বা দিক বর্তমান। কিন্তু এই শ্রেণীর নারীবাদীদের কোন ধারাই নারীজাতির সামগ্রিক অবস্থার সম্পূর্ণ পরিচয় দিতে পারেনি বা নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিতে পারেনি।
দুই: র্যাডিক্যাল নারীবাদ কোন সুসংহত মতাদর্শগত অবস্থান সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়নি। এই মতবাদকে পুরুষ-বিদ্বেষ বা বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি হিসাবে প্রতিপন্ন করা যায় না। ভ্যালেরী ব্রাইসন এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন— “…this must be combined with the understanding that complex issues cannot be reduced to simple cause, and that patriarchy cannot be isolated from other forms of inequality and oppression.”
তিন: অনেকের অভিযোগ অনুযায়ী র্যাডিক্যাল নারীবাদ অনৈতিহাসিক। এই মতবাদের বিশ্ব-জনীনতার দাবি ভ্রান্ত। কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গ মধ্যবিত্তশ্রেণীর মহিলাদের অভিজ্ঞতাসমূহের প্রতিনিধিত্ব করে এই মতবাদ।
চার : অন্যান্য নারীবাদী চিন্তাবিরা র্যাডিক্যাল নারীবাদের তীব্র বিরূপ সমালোচনা করেন। তাঁদের অভিযোগ অনুসারে ‘পুরুষরা মহিলাদের শত্রু’ এরকম এক ভ্রান্ত ধারণার উপর এই নারীবাদ প্রতিষ্ঠিত। ‘পুরুষ নারীর শত্রু’— এ ধরনের ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে নারী সমাজের মধ্যে ‘সমকামী বিচ্ছিন্নতাবাদ’ ( lesbian separatism) দেখা দিতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ মহিলার কাছে সমকামী বিচ্ছিন্নতাবাদ আবেদনহীন ও অপ্রাসঙ্গিক।
পাঁচ: র্যাডিক্যাল নারীবাদে দেখান হয়েছে যে, যুগ যুগ ধরে পুরুষজাতি নারীজাতির উপর অন্যায় অত্যাচার করে আসছে এবং নারীসমাজ হয়েছে এই অন্যায়-অত্যাচারের নিষ্ক্রিয় শিকার। এ ধারণা সর্বাংশে স্বীকার্য নয়।
ছয় : সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী র্যাডিক্যাল নারীবাদ বর্ণনামূলক। এ ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অভাব আছে। পুরুষের ক্ষমতার উদ্ভব ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এই মতবাদ ব্যর্থ। স্বভাবতই এর অবসানের ব্যাপারেও উপযুক্ত উপায়-পদ্ধতির সন্ধান দিতে এই মতবাদ পারেনি।
সাত : র্যাডিক্যাল নারীবাদের মধ্যে বহু ও বিভিন্ন উপাদান বর্তমান। কিছু কিছু উপাদান নর-নারীর মধ্যে মৌলিক প্রকৃতির ও অপরিবর্তনীয়। নারীজাতির পক্ষে বলা হয়েছে যে, মহিলাদের মানসিকতা মনোভাব ও মূল্যবোধ পুরুষদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। নির্দিষ্ট কতকগুলি ক্ষেত্রের পরিপ্রেক্ষিতে মহিলারা উন্নততর; মহিলাদের মধ্যে সৃষ্টিশীল গুণগত যোগ্যতা আছে, মহিলারা অধিকতর অনুভূতিপ্রবণ ও তত্ত্বাবধানকারী প্রভৃতি। পুরুষেরা মহিলাদের এ সমস্ত গুণাবলী বড় একটা উপলব্ধি করে না বা বিকশিত করে না। পুরুষের মধ্যে এসব গুণাবলীর সমাহার দেখা যায় না। র্যাডিক্যাল নারীবাদীদের এই সমস্ত বক্তব্য সর্বাংশে স্বীকার্য নয়।
উপসংহার: র্যাডিক্যাল নারীবাদের কোন কোন ধারা সম্পর্কে উপরিউক্ত সমালোচনাসমূহের সারবত্তাকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। এতদ্সত্ত্বেও এই মতবাদের গুরুত্ব ও উৎকর্ষকে অস্বীকার করা যায় না। র্যাডিক্যাল নারীবাদে পিতৃতান্ত্রিকতার স্বরূপ সম্যকভাবে উদ্ঘাটিত হয়েছে। নারীবাদী চিন্তাধারার উপর এর প্রভাব বিশেষভাবে পড়েছে। এদিক থেকে বিচার করলে র্যাডিক্যাল নারীবাদ প্রথাগত রাজনীতিক মতবাদসমূহের বিরুদ্ধে একটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ হিসাবে প্রতিপন্ন হয়।
অনেকের অভিমত অনুসারে কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পিতৃতান্ত্রিকতার প্রকৃতিগত পরিবর্তন ঘটেছে। নিপীড়নের অন্যান্য ধরনের সঙ্গে পিতৃতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের মিথস্ক্রিয়ার পরিবর্তন ঘটেছে। প্রেক্ষিতের পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা সর্বশক্তিমান, সর্বজনীন বা জীববিদ্যাগত বিচারে নির্ধারিত ব্যবস্থা নয়। নির্দিষ্ট পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের পরিপ্রেক্ষিতে পিতৃতান্ত্রিকতা হল একটি পরিবর্তিত ব্যবস্থা। সমষ্টিগত নারীবাদী কার্যকলাপের দ্বারা এই পরিবর্তিত পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অধিকতর পরিশীলিত করা সম্ভব।
আধুনিককালে অনেকে পুরুষজাতির পীড়নের কাঠামো এবং ব্যক্তি-পুরুষের পীড়নের মধ্যে পার্থক্য প্রতিপাদনের পক্ষপাতী। অর্থাৎ অভিব্যক্তির বিভিন্নতা সত্ত্বেও সাধারণভাবে পুরুষ-শক্তিই হল শত্রু। কিন্তু পুরুষের এই ক্ষমতাকে সামাজিকভাবে সংগঠিত ক্ষমতা হিসাবে দেখা হয়; এই ক্ষমতা জৈবিকভাবে পুরুষের মধ্যে প্রবিষ্ট, সেভাবে দেখা হয় না।
Leave a comment