প্রশ্নঃ রোমান সাম্রাজ্য পতনের কারণসমূহ কী কী?

অথবা, রোমান সাম্রাজ্য পতনের কারণসমূহ আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ সকাল বেলা রাজারে তুই, ফকির সন্ধ্যা বেলা। টয়েনবির মতে, কোন সভ্যতা যদি তার পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়, তবে সে সভ্যতার পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনও এ নিয়মের বাইরে ছিল না। রোমান সাম্রাজ্যের পতন তাৎক্ষণিক কোন ঘটনার ফল নয়। বরং দীর্ঘ সময় ধরে তার পতনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিল। অবশেষে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট রোমিউলাস অগাস্টুলাস বর্বর নেতা অডোএকারের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হলে রোমান সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন ঘটে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, অন্যান্য সভ্যতার চেয়ে রোমান সভ্যতার চূড়ান্ত পতনের কারণসমূহ কিছুটা ভিন্ন। নিম্নে রোমান সভ্যতা পতনের কারণসমূহ উল্লেখ করা হলো-

(১) সামাজিক কারণঃ রোমান সমাজ ছিল শ্রেণী বিভক্ত। অভিজাত, কিউরিয়ালস ও সাধারণ মানুষ; এ তিন শ্রেণীতে সমাজ ছিল বিভক্ত। তবে সমাজের শীর্ষ ছিল অভিজাতরা, বিশেষ করে সিনেটর শ্রেণী। সিনেট উপাধিপ্রাপ্তরা অভিজাত্য লাভ করার পাশাপাশি অনেক রাষ্ট্রীয় দায়-দায়িত্ব পালন হতেও অব্যাহতি পেতেন। অভিজাত শ্রেণীর পরেই ছিল কিউরিয়ালস শ্রেণীর অবস্থান। এরা বেতন পেতনা; তবে নানাবিধ রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পেত। সিনেটদের পরেই ছিল তাদের সামাজিক মর্যাদা। তাদেরকে শহরের ভিতরেই বসবাস করতে হতো এবং তাদের এ পদ ছিল উত্তরাধিকারী ভিত্তিক। অভিজাত শ্রেণী ও কিউরিয়ালস ছাড়া অন্য সকলে ছিল সাধারণ মানুষ। এদেরকে বলা হতো Zens। সাধারণ মানুষ, দাস ও স্বাধীন নাগরিক এই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। দাসরা মনিবের বাসা ও কৃষিকাজে নিয়োজিত থাকত। স্বাধীন কৃষকগণ জমির কর দানের বিনিময়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিতে চাষ করত। এ সব স্বাধীন কৃষককে Coloni বলা হত।

(২) দাসপ্রথাঃ দাসপ্রথা ছিল রোমান সভ্যতা পতনের অন্যতম কারণ। রোমান দাস মালিকারা দাসদের মানুষ বলে বিবেচনা করত না। তারা উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে দাসদের বিবেচনা করত এবং ব্যবহার করত। তাদের কাছে পশুর চেয়ে দাসদের জীবনের অধিক কোন মূল্যই ছিল না। অভিজাত শ্রেণী আনন্দ উপভোগ করার জন্য দাসদেরকে সিংহ, বাঘ প্রভৃতি হিংস্র পশুর সাথে লড়াই করতে বাধ্য করত। এ মরণ খেলায় দাস অথবা হিংস্র জন্তুর যে কোন একটির প্রাণ যেত। এতে তারা উল্লাসে ফেটে পড়তো। অত্যাচারিত দাসরা মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে সংঘটিত দাস বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলে। স্পার্টাকাসসহ হাজার হাজার দাস এ বিদ্রোহে নিহত হয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে দাস বিদ্রোহ ব্যর্থ মনে হলেও বাস্তবে এটি রোমান সভ্যতাকে দূর্বল করে দিয়েছিল। ফলে রোমান সভ্যতা পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে এটি প্রতিভাত হয়।

(৩) অর্থনৈতিক অবক্ষয়ঃ রোমান সাম্রাজ্যের পতনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ অর্থনৈতিক অবক্ষয়। বিশাল রোমান সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ছিল দাসভিত্তিক ও কৃষিনির্ভর। বারবার দাস বিদ্রোহ ও ভূমিদাস প্রথা উৎপাদন ব্যবস্থার গতিকে শ্লথ করে দেয়। তাছাড়া দাসদেরকে কৃষি জমি ও কারিগরি শিল্পে ব্যবহার করায় স্বাধীন শ্রমিক কৃষকেরা কর্মহীন হয়ে পড়ে, যা রোমান অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দ হতে জার্মান জাতিসহ বিভিন্ন বৈদেশিক শক্তির আক্রমণের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধে নতুন সৈন্য নিয়োগ করতে যেয়ে সামরিক ব্যয় বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে এ খাতে অর্ধেক রৌপ্য ও দুই ততীয়াংশ সোনা খরচ হয়ে যায়। এ অবস্থায় ঘাটতি পূরণে খাদ মেশানো নতুন মুদ্রা চালু করা হয়। এ সময় খাদের পরিমাণ শতকরা ৯৮ ভাগে পৌঁছে। ফলে মুদ্রা ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দেয়। রোমান অর্থনীতির এই সংকট রোমের পতনকে তরান্বিত করে।

(৪) উত্তরাধিকার আইনের দূর্বলতাঃ রোমে সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকার আইন ছিল না। সে সময় আইনের পরিবর্তে বাহু বলই ছিল ক্ষমতা দখলের মূলনীতি। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে কিছু সংখ্যক উচ্চাভিলাষী ব্যক্তির উত্থান ঘটায় রোমান সাম্রাজ্যের সংহতি বিনষ্ট হয় এবং রোমের বিচ্ছিন্নতা রোমান সভ্যতাকে দূর্বল করে দেয়। ২৩৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে রোমান সাম্রাজ্যে চরম অরাজকতা দেখা দেয়। উক্ত সময়কালে ২৬ জন শাসকের মধ্যে ১৫ জনই ঘাতকের হাতে নিহত হয়। এ সকল অরাজকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ রোমের পতনকে অনিবার্য করে তোলে।

(৫) বৈদেশিক আক্রমণঃ দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দ হতে বৈদেশিক আক্রমণ রোমকে পর্যুদস্ত করে তোলে। খ্রিস্টীয় চতুৰ্থ শতাব্দীতে থিউডোসিয়াসের মৃত্যুর পর রোমান সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। কারণ সামরিক বাহিনী এ সময় বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। ৪২৫ খ্রিস্টাব্দে এলরিকের নেতৃত্বে গথ উপজাতি রোম আক্রমণ করে শহরটিকে ধ্বংসস্থূপে পরিণত করে। এর কিছুদিন পর ৪৩৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এটিলার নেতৃত্বে হুন নামক এক দূর্ধর্ষ উপজাতি সমগ্র পূর্ব ইউরোপ বিধ্বস্ত করে রোমের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু পোপের বিশেষ অনুরোধে এটিলা বাহিনী রোম আক্রমণ থেকে বিরত থাকে। এটিলা রোম আক্রমণ না করলেও পরবর্তী পর্যায়ে ভিসিগথ, ভ্যাত্তাল, টিউটন প্রমুখ বর্বর জাতি রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নেয়। এরপর পাঁচ শতকে সমগ্র রোমান সাম্রাজ্য বর্বরদের হাতে চলে যায়।

(৬) বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের প্রতি অনগ্রসরতাঃ রোমানরা আইন, সাহিত্য ছাড়াও বিভিন্ন দিকে যতটুকু এগিয়ে গিয়েছিল বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের ক্ষেত্রে ততটা আগাতে পারেনি। তারা দাস ভিত্তিক অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। তারা অন্যান্য সভ্যতার মত বিজ্ঞানকে কাজে লাগায়নি, যার ফলে এ সভ্যতার পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে।

(৭) অতিরিক্ত যুদ্ধ-বিগ্রহঃ অতিরিক্ত যুদ্ধ-বিগ্রহ রোমান সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ। এ সকল যুদ্ধে রোমের অর্থনীতি একেবারেই ভেঙে যায় এবং প্রচুর লোক মারা যায়। এভাবে অর্থ ও জনবলের অভাবে ধীরে ধীরে এ সাম্রাজ্যের ভিত্তি ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়ে। রোমের শক্তি ও সামর্থ দূর্বল হওয়ার ফলে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন জাতি তাদের উপর আক্রমণ চালায়, যার ফলে এ সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।

(৮) প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দূর্বলতাঃ এ সময় রোমান শাসকরা অতিলোভী হয়ে পড়ে; যার ফলে সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দূর্বল হয়ে পড়ে। এছাড়া এ সময় অতিরিক্ত যুদ্ধের কারণে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীকালে বেতনভোগী সেনাবাহিনী অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়ে। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে এক গৃহযুদ্ধের সূচনা করে, যার ফলে শেষ পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রের অবসান হয়ে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে বিদেশী শক্তিকে পরাভূত করতে তারা ব্যর্থ হয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, রোমান সাম্রাজ্যের পতন অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু রোমের সামরিক বাহিনীর দূর্বলতা, জনগণের নৈতিক অবক্ষয়, সকল ক্ষেত্রে দাস ব্যবহার, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা ইত্যাদি রোমান সাম্রাজ্যের পতনকে আরও অনিবার্য করে তোলে। এর ফলে তারা বর্বর জার্মানদের হাত থেকে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে পারেনি। তাই সর্বশেষে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে এ সভ্যতার চূড়ান্ত পতন ঘটে।