কবি মধুসূদনের অনবদ্য পত্রকাব্য বীরাঙ্গনা কাব্য, বিভিন্ন পৌরাণিক নায়িকার একোক্তি মূলক রচনা। এই কাব্যের এগারো জন নায়িকা তাঁদের স্বভাব চরিত্র হৃদয়বৃত্তি ভেদে স্বতন্ত্র ধরণের এগারোটি পত্রিকা রচনা করেছেন। প্রতিটি পত্রিকাই অনবদ্য এবং প্রতিটি পত্রিকাই উক্ত নায়িকাদের হৃদয় নির্যাস। প্রতিটি তাদের প্রেমাষ্পদ বা পতির কাছে তাঁদের হৃদয়াবেগ উদ্ধৃত সংলাপ পত্রাকারে লিখে পাঠিয়ে ছিলেন। সে পত্রে তাদের মনের ভাব, হৃদয়ের আবেগ, আর্তি, প্রেম, অভিমান ইত্যাদি পরিস্ফুট হয়েছে। কেউ স্বামী বিরহে কাতর। কেউ অপর পুরুষের প্রতি প্রণয়াসক্ত। কেউ তার প্রেম প্রত্যাখ্যান করতে চায়, কেউ আবার স্বামীর প্রতি ক্ষুব্ধা, অভিমানী। মধুসূদনের এগারো জন নায়িকার মধ্যে বালিকা-যুবতী-পৌড়া এবং অবিবাহিত-বিবাহিতা ও বিধবা এই তিন শ্রেণীর অবস্থা ও অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। এদের মনের অবস্থা পত্রাকারে রচনা করেই সৃষ্টি হয়েছে। বীরঙ্গনা কাব্যের।

ইতালীর নব যুগের সাহিত্যে যে কজন প্রসিদ্ধ কবির নাম স্মরণ করা যায় তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ওভিদ। দাঁতে, পেত্রাক ও ভার্জিলের পরেই ওভিদের নাম স্মরণযোগ্য। ওভিদ তাঁর যুগের ধারানুয়ায়ী পৌরাণিক সাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ করে নবযুগোপযোগী ব্যাখ্যা সহযোগে নব মূল্যায়ন করে পুরাণ সাহিত্যের নবায়ণ ঘটিয়েছেন। বিভিন্ন পৌরাণিক নায়িকার প্রেমমন্সতত্ত্ব বিশ্লেষণ অভিপ্রায়ে তিনি পত্র কাব্য রচনা করেছিলেন। ওভিদ তাঁর পত্র কাব্য রচনায় প্রেরণা পেয়েছিলেন তাঁর এক বন্ধু প্রোপার্টিয়াসের (Propertius) কাছে।

ওভিদের কাব্যের বড়গুণ হল পত্র কাব্যের বাস্তবতা। তিনি এমনভাবে কাহিনীর উপস্থাপন ও বর্ণনা করেছেন যাতে মনে হয় নায়িকারা যেন তাঁদের চিন্তা ভাবনা নিয়ে স্বশরীরে পাঠকের সামনে আভির্ভূত হয়েছেন। মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যের মধ্যেও এই গুণ, এই বাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতপক্ষে প্রবীন ও নবীন কবিদের মধ্যে ওভিদের কাব্যের আকর্ষণ অত্যন্ত প্রবল। কবি মধুসূদনও এই আকর্ষণকে উপেক্ষা করতে পারেন। নি। তাই তার কাব্যেও ওভিদের প্রেরণা লক্ষ্য করা যায়।

মাইকেল মধুসূদনের চিঠিপত্র ইত্যাদি থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায় যে তিনি পাবলিয়াস ও ভিদিয়স নাসো-র The Heroides or Epistle of the Heroines-এর আদর্শে বীরাঙ্গনা কাব্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। ওভিদের ‘The Heroides বা বীরগাথা সর্বমোট একুশটি পত্রযোগে রচিত। মধুসূদনও চেয়েছিলেন একুশটি পত্রযোগে বীরাঙ্গনা কাব্য প্রকাশ করতে কিন্তু নানা কারণে এগারোটি পত্র সংকলিত করেই বীরাঙ্গনা কাব্য প্রকাশিত হয়।

ওভিদ তাঁর রচনাপর্বে নায়িকাচরিত্র নির্বাচন করেছেন তাদের প্রেম মনতত্ত্ব বিশ্লেষণ অভিপ্রায়ে। তাঁর কাব্যের সবচেয়ে বড় গুণ হল বাস্তবতা। এমন ভাবে সেই সমস্ত পত্রিকা তিনি রচনা করেছেন যাতে মনে হয় যেন নায়িকারা তাদের চিন্তা ভাবনা সহযোগে পাঠকের দরবারে এসে উপস্থিত হয়েছেন। প্রতিটি নায়িকাই পৌরাণিক কাব্য থেকে চয়িত। হোমার, ইউরিপিদেস, সাফো প্রমুখদের রচনা থেকে সংগৃহীত উপাদান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তাঁর The Heroides বা বীরগাথা। ওভিদের একুশটি পত্রের মূল বিষয়বস্তু হল প্রেম। এই একটি বিষয়বস্তুকে নিয়েই রচিত তাঁর বীরগাথা। The Heroides-এর একুশটি পত্রের মধ্যে পনেরোটিই পত্র নায়কের উদ্দেশ্যে নায়িকার রচনা। অপর ছয়টি নায়িকা-নায়কের কথোপকথন মূলক।

ওভিদের পত্রিকাগুলির মতো মধুসূদনের বীরঙ্গনা কাব্যের পত্রিকাগুলিও নায়িকার মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ অভিপ্রায়ে রচিত। মানবিকতা ও আধুনিকতার ধ্বজাবাহী। ওভিদের মতোই উদগ্র, কোথাও আবার অবৈধ সম্পর্কযুক্ত।

ওভিদের ফিড্রা যেমন সপত্নীপুত্র হিপোল্লিটাসকে লিখেছেন— 

“No Blame will You receive, But praise

instead 

Safe at my side, and even in my bed,

Only make haste and straight our union seal, 

Ere You, like me, broken on Love’s wheel.”

এই দুর্বার প্রবৃত্তি চাঞ্চল্য বীরাঙ্গনা কাব্যের তারার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। তারাও তাঁর পুত্রবৎ চন্দ্রের প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী। আবার থিসিউসকে লেখা অ্যারিয়ডনির পত্রে রয়েছে অনুযোগের ঝাঁঝ, যা বীরাঙ্গনা কাব্যের জন্য পত্রিকাকে স্মরণ করায়—

“Where are you fleeing? Wicked man, turnback.

Reverse your ship for one her crew doth lack.”

বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণও ওভিদের হিরোইদেসের নামানুসৃতি বলে অনুমান করা হয়ে থাকে। সম্ভবতঃ The Heroides or Epistles of the Heroines এর Heroine শব্দটি কবির মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে থাকবে। কিন্তু সর্বত্রই দেখা যায় কবি মধুসূদন তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ও উদ্ভাবনী শক্তি এবং কবিত্ব শক্তির দ্বারা সমস্ত প্রেরণা সঞ্চারককে ছাড়িয়ে অনেক উন্নত মার্গে উন্নীত হতে পেরেছেন।

ওভিদ তাঁর নায়িকাদের প্রেম ও তাদের হৃদয়ের আবেগ ও আর্তিকে তাঁর কাব্যের বিষয় করে তুলেছেন। এখানে মধুসূদন বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন। মধুসূদনের নায়িকাদের মধ্যে প্রেমের আর্তি যেমন আছে, প্রত্যাখ্যান তেমনি আছে। আবার দুই বিগতযৌবনা নায়িকা তাঁদের স্বামীদের বিরুদ্ধে অনুযোগ পত্রিকাও রচনা করেছেন। কেকয়ী যেমন স্বামী দশরথকে সত্যের অপলাপ ঘটানোর জন্যে, কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়েও ক্ষুব্ধ হয়ে অভিশাপ দিয়েছেন— 

থাকে যদি ধর্ম, তুমি অবশ্য ভুঞ্জিবে

এ কর্মের প্রতিফল দিয়া আশা মোরে, 

নিরাশ করিলে আজি; দেখিব নয়নে 

তব আশা-বৃক্ষে ফলে কি ফল নৃমণি।

অন্যদিকে জনা তার স্বামী নীলধ্বজের প্রতি ক্ষুব্ধ হলেও কোন পুরুষ বাক্য উচ্চারণ করেন নি। তিনি স্বামীর প্রতি যথোচিত শ্রদ্ধা ও অনুরাগ বজায় রেখেই পত্র রচনা করেছেন।

মধুসূদনের কাব্যে নব যুগের মানবতাবাদ ধ্বনিত হয়েছে। যার ফলে মেঘনাদবধ কাব্যে যেমন রাম দেব-চরিত্র হলেও নায়কের মর্যাদা পেয়েছে রাবণ। তেমনি বীরাঙ্গনা কাব্যে দেখি নারী প্রগতির চিন্তাধারা। নারীদের মনুষ্য সত্তায় স্বীকৃতি। এখানে তাঁর কবি সংস্কারের সঙ্গে ধর্ম সংস্কারের কোন বিরোধ নেই। তিনি খৃষ্টান হলেও পৌত্তলিকের মতোই তিনি সৌন্দর্যের মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেই উপাসনা করেছেন। এই ওভিদের প্রেরণা সঞ্জাত কাব্যের মধ্যেই দৃষ্ট হয় পুরাণ ও মহাকাব্যের অনুগম্যতা। এখানে তাঁর ভারতীয় ধ্রুপদী সাহিত্যের প্রতি নিষ্ঠা প্রবলরূপে দেখা দেয়। তাই ওভিদের মতো তিনি প্রেমের মনস্তাত্ত্বিক পরিচয় দিতে গিয়ে সামাজিক সংযমের দিকটি লঙ্ঘন করেন নি।

এ ছাড়াও নানা ভারতীয় সংস্কার এবং ভাবধারা তাঁর কাব্যের বাতাবরণ ও প্রেক্ষাপট রচনা করার ফলে ওভিদের রচনাদর্শ থেকে অনেক দূরে বীরাঙ্গনা কাব্যকে অবস্থিত করিয়েছে। মহৎ কবি মাত্রেরই এই অবস্থা অনস্বীকার্য। তাঁরা কোন একটি আদর্শ বা প্রেরণা উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁদের সৃষ্টি কার্য শুরু করেন। কিন্তু পরে আপন প্রতিভা বলে তাঁদের রচনা সম্পূর্ণ মৌলিক ভাবের দ্যোতনায়, নতুন আলোময়তায় উজ্জ্বল হয়ে সেই প্রেরণা সঞ্চারককে ছাড়িয়ে অনেক উন্নত স্তরে উন্নীত হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। তাই ওভিদের আদর্শে বীরাঙ্গনা কাব্য রচিত হলেও এখানে মধুসূদনের মৌলিকতা স্বীকার না করে উপায় নেই।