রূপসী বাংলাদেশ

(সংকেত: ভূমিকা; বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান; ঋতু বৈচিত্রের দেশ বাংলাদেশ; প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ; বাংলাদেশের নদী বৈচিত্র্য; বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত; উপসংহার।)
ভূমিকাঃ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের অনন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। প্রকৃতির সৌন্দর্যের আলোক ছটায় বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে আপন আলোর চির ভাস্বর। পাহাড়-পর্বত, জলপ্রপাত, সমতল ভূমি, সমুদ্র সৈকত কি নেই এই রূপসী বাংলায়।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানঃ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বদ্বীপ বাংলাদেশ। এর আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কি.মি.। বাংলাদেশ ২০° (ডিগ্রী) ৩৪´ (সেন্টিগ্রেড) উত্তর অক্ষরেখা থেকে ২৬° (ডিগ্রী) ৩৮´ (সেন্টিগ্রেড) উত্তর অক্ষরেখা এবং ৮৮° (ডিগ্রী) ০১´ (সেন্টিগ্রেড) পূর্ব দ্রাঘিমা রেখা থেকে ৯২° (ডিগ্রী) ৪১´ (সেন্টিগ্রেড) পূর্ব দ্রাঘিমা রেখার মধ্যে অবস্থিত। বাংলাদেশের মাঝামাঝি স্থান দিয়ে অতিক্রম করেছে কর্কটক্রান্তি রেখা। বাংলাদেশের তিন দিকে ভারতের সীমানা দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং পূর্ব-দক্ষিণে মায়ানমার অবস্থিত।
ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশঃ ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। ছয়টি ঋতুর বৈচিত্র্যময় রূপের মধ্যে আমরা সারা বছর মোহিত থাকি। একটা ঋতুর মনোমুগ্ধকর আবেশ কাটতে না কাটতেই এসে হাজির হয় আরেকটি ঋতু। যার রূপের বাহার পূর্বের ঋতু থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে রূপের ছোঁয়া লাগে প্রতিটি প্রাণে। শীতের হিম শীতল, হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস আর ঘন কুয়াশার দিন শেষ হতে না হতেই আমাদের মন ভরে ওঠে কোকিলের কুহু-কুহু স্বরে। আবার গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবাদাহে অতিষ্ট হয়ে উঠে প্রাণিকূল। প্রকৃতিও হয়ে উঠে বিবর্ণ-বিষন্ন। চৈত্রের শেষ প্রান্ত থেকে পুরো বৈশাখ জুড়ে চলে কালবৈশাখীর মরণ ছোবল। জৈষ্ঠ্যের খরায়
যখন জীবকূল হাঁসফাঁস করছে তখনই জীবনের স্বস্তির নিঃশ্বাস হয়ে আসে বর্ষাকাল। ঘন কালো মেঘের খেলা আর গুড় গুড় শব্দই জানান দেয় বর্ষার আগামনি বার্তার। বর্ষার মেঘের কাছে বৃষ্টি চায় চাতক পাখি। রাতের আধারে মেঘের বিদ্যুৎ চমকানোর ফলে তৈরি হয় এক অপার্থিব সৌন্দর্য যা মনে অনাবিল আনন্দের সৃষ্টি করে। মাঠ, ঘাট, অনুর্বর মৃতপ্রায় মাটি জেগে উঠে। সবুজ শ্যামলিমায় ভরে যায় মাঠের প্রতি ইঞ্চি জমি। হেমন্তের ফসল নিয়ে শুরু হয় শীতের যাত্রা। কুয়াশায় পত্র-পল্লব শূন্য আর রিক্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে শীতের বৈচিত্র্যময় রূপে এর স্বাতন্ত্র্য মহীমায় উদ্ভাসিত। গাঁয়ের মেঠো পথের দূর্বা ঘাসের মাথার উপর জমে থাকা শিশির বিন্দুর উপর শীতের সূর্যের সোনালি রোদ পড়লে অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। শীতের নির্জনতার মধ্যে নীরব অস্তিত্বের প্রকাশও সৌন্দর্যমন্ডিত। প্রতিটি ঋতুই স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশঃ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার বাংলাদেশ। সবুজ শ্যামলিমায় ভরপুর বাংলাদেশ যেন কোনো দক্ষ কারুশিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় এক অনাবিল সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্র। এ দেশে রয়েছে পাহাড়, পর্বত, বিস্তৃর্ণ সমভূমি, রয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত। এই দেশের পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে উপভোগ করা যায় সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখার মতো এক অপার্থিব সৌন্দর্য। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানোগ্রোভ বন সুন্দরবন বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এদেশের অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চিরকাল ধরে মুগ্ধ কবিচিত্তে কাব্যস্রোত বইয়ে দিয়েছে। ভাবুকের হৃদয়ে কাব্যসুধাময় ভাবের যোগান দিয়েছে বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। বাংলার যে দিকে যে প্রান্তেই চোখ রাখা হোক না কেনো এর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য আমাদের মনে প্রশান্তি আনে। মন-প্রাণ ভরে উঠে এর অনাবিল সৌন্দর্য অবলোকন করে। পাহাড় টিলার রমনীয় শোভা, গাছপালা তৃণভূমি শোভিত বনের মনোরম দৃশ্য, নদ-নদীর অপরূপ সৌন্দর্য, শোভাময় ফসলের ক্ষেত সবই আমাদের হৃদয়ে আনন্দের স্রোতে ধারা বইয়ে দেয়। তাই কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছেন-
“ধনধান্যে পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা;
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা;
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাক তুমি
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।”
বাংলাদেশের নদী বৈচিত্র্যঃ বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বৈচিত্র্যময় আধার। ঋতু বৈচিত্র্যের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোর মধ্যেও সৌন্দর্যের বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। বর্ষাকালে উত্তাল ঢেউ ভয়ঙ্কর রূপধারণ করে আর শীতকালে নদী থাকে প্রশান্ত। এ সকল নদী বাংলার আবাদী জমি করেছে শস্য শ্যামলা ও অপরূপ সৌন্দের্যের অধিকারী। নদীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি কাজী কাদের বলেছেন-
পদ্মা যমুনা মধুমতি আর
মেঘনার মালা কণ্ঠে পরি,
দাঁড়িয়ে আছে সুজলা যে দেশ
সেই দেশে বাস আমরা করি।
বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকতঃ বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত বললে প্রথমেই মনে পড়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কথা। সেখানে রয়েছে সমুদ্রের নীল জলরাশি আর সারি সারি ঝাউগাছের মেলা। সৈকতের পাথরগুলো একবার সমুদ্র জলে ডুব দেয় আবার যেন ভেসে ওঠে। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে সমুদ্রের পানিতে ছোট ছোট লাল কাকড়া, মাছ, শামুক, আরো অনেক বিচিত্র প্রাণি। পাথরের উপরে দাঁড়ালে মনে হয় যেন সমুদ্রের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে। বিকেলে সূর্যাস্তের প্রাক্কালে লাল কাকড়ার দল বাঁধা সারি দেখলে মনে হয় যেন তারা সূর্যকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে সারিবদ্ধ হয়ে এসেছে। আর তখন অস্তগামী সূর্য আর সৈকতের রং মিলেমিশে একাকার হয়ে মনের মধ্যে এক অন্তহীন ভালোবাসার অনুভূতির সৃষ্টি করে।বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। দেশের সর্ব দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরের মাঝে অসংখ্য প্রবালে তৈরি হয়েছে এই সমুদ্র দ্বীপটি। সাগরের নীল জলরাশি আর সারি সারি নারকেল গাছ এই দ্বীপকে অপার সৌন্দর্যময় করে তুলেছে। প্রবালের প্রাচীর, বালুময় সৈকত আর সারিবদ্ধ কেয়া গাছ এই দ্বীপকে দিয়েছে আলাদা এক বৈশিষ্ট্য যা অন্য দ্বীপ বা সৈকত থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। কেয়া গাছের ফাঁকে উত্তাল সাগরের নোনা জল আছড়ে পড়ে। মৃদু বাতাসের সংস্পর্শে তৈরি হয় সফেদ ফেনা যা সত্যিই উপভোগ্য। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনেকটা অংশই জুড়ে রয়েছে দ্বীপ, সমুদ্র সৈকত আর নদ-নদী।
উপসংহারঃ রূপসী বাংলার অনাবিল সৌন্দর্য এতই মনোমুগ্ধকর যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুগ্ধ হয়ে কবিতায় বলেছেন- “সার্থক জন্ম আমার জন্মেছি এই দেশে/ সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে।” রূপসী বাংলা প্রকৃতিতে নিজেকে সমর্পিত করে, বাংলাদেশের রূপ বৈচিত্র্যে মুগ্ধ হয়ে হাজারো পর্যটকের ভিড় জমে এ দেশে। এক এক জায়গায় এক এক রূপ বৈচিত্র্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। যা সত্যিই অপূর্ব, অতুলনীয় এবং অসাধারণ।