‘রূপকথা-উপকথা’ এই দুই শব্দের ব্যাকরণগত দিক বাদ দিয়ে নান্দনিক দিকের আলোচনা করলে দুই স্বতন্ত্র মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। উপকথার পশ্চাতে আছে প্রচ্ছন্ন অবজ্ঞার ভাব। এই অবজ্ঞা নকলের প্রতি আসলের, মেকির প্রতি খাঁটির, নীচের প্রতি উচ্চের অবজ্ঞা। উন্নাসিক বয়স্ক মানুষের অবজ্ঞাপূর্ণ নাসিকাকুঞ্জনের ভেতর উপকথার সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়ে আছে। রূপকথার নামের অন্তরালে রহস্যময় মাধুর্য, ঐন্দ্রজালিক মায়ার বলয় নিহিত আছে। রূপকথা নামটি পাঠকের হৃদয়ের গোপন কক্ষে আঘাত করে মনের গভীরে সাড়া জাগিয়ে তোলে। উপকথা নামের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে, তা সমালোচকরা হয়তো পছন্দ করবেন। কিন্তু রূপকথার মধ্যে যে রহস্যমায়া লুকিয়ে আছে, তা রসগ্রাহী পাঠককে ব্যাকুল করে তোলে।
রূপকথার বৈশিষ্ট্য রহস্যময় মায়াঘোর। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য এর প্রাচীনত্ব। এই প্রাচীনত্বের সুর রূপকথার বৈশিষ্ট্য। সব দেশের সাহিত্যে অতীতে প্রত্যাবর্তনের সুর খোঁজা হয়। অতীতে প্রত্যাবর্তন সকল দেশের সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য। অষ্টাদশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যে এই অতীতে প্রত্যাবর্তনের রূপটি পাওয়া যায়। মধ্যযুগের পল্লীগাথার রসাস্বাদ এক নতুন সুর সৃষ্টি করেছিল। রূপকথার মধ্যে যে কৌতূহল ও রহস্য ফুটে ওঠে, তার মধ্য দিয়ে এর সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়। আধুনিক সাহিত্যের আদর্শে রূপকথা বিচার্য নয়। রূপকথার আর একটি বৈশিষ্ট্য এর আদর্শপ্রিয়তা। পৃথিবীর চিরপরিচিত বস্তু অতিরঞ্জনের রাগে রঞ্জিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। কল্পনার আধিক্যই অতিরঞ্জনকে সম্ভব করে তোলে। কোন ব্যক্তি-কবি রূপকথার স্রষ্টা নন। এর মধ্যে ফুটে ওঠে জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা। সমস্ত প্রাচীন সাহিত্যের মতো মহাকাব্য বা লৌকিক গান ও গাথায় যেমন ব্যক্তি জীবনের স্বাতন্ত্র্য চিহ্ন লুপ্ত মনে হয় সমষ্টিগত জাতীয় মানস তিলে তিলে এদের সৃষ্টি করেছে। সেই রকম রূপকথাও যেন নামহীন কোন স্রষ্টা তিলে তিলে এদের রচনা করেছে। রূপকথার এই বৈশিষ্ট্যটি অবিস্মরণীয়।
রূপকথায় সর্বত্র যেমন আদর্শ কল্পনার জগৎ ছড়িয়ে আছে, তেমনি সর্বত্রই একটি উদারতার ক্ষেত্র সক্রিয়। সাধারণ মানুষ রূপকথার মধ্যে যেভাবে ধরা পড়েছে, তাতে তাদের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা বিদ্বেষমুক্ত, সংকীর্ণতামুক্ত মানসিকতার দ্যোতনা বহন করে। রূপকথার প্রভাব শিশুমনে প্রবল। শিশুমনের কল্পনাকে তা উদ্দীপ্ত করে। ঠাকুমার স্নেহকাতর বক্ষের কাছে ঘেঁষে কল্পনাপ্রবণ আশা-আকাঙ্ক্ষা উদ্বেল শিশুহৃদয় এক অপূর্ব মায়াজালের মধ্যে হারিয়ে যায়। শিশুর মনে সম্ভব-অসম্ভবের সীমারেখা মুছে যায়। তাই শিশুমন কল্পনার রাজ্যে ছুটতে ছুটতে তেপান্তরের মাঠে হারিয়ে যায়। শিশুর অন্তররাজ্যের নানা আকাশকুসুম এইভাবে ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে। রূপকথা চিরশিশুর রাজ্যকে চোখের সামনে উজ্জ্বল করে তুলে ধরে। লেখকের ভাষায় “রূপকথা তাহার সম্মুখে একটি দিগন্তবিস্তৃত, বাধাবন্ধনহীন কল্পনারাজ্যের দ্বার খুলিয়া দিয়া তাদের সংসারানভিজ্ঞ মনের স্বচ্ছন্দ প্রকাশের উপযুক্ত ক্ষেত্র রচনা করে। রূপকথার সৌন্দর্যসত্তার তাহারই জন্যে, যে পৃথিবীর সংকীর্ণ আয়তনের মাঝে নিজ আশা ও কল্পনাকে সীমাবদ্ধ করে নাই।”
কোন সীমাচিহ্ন দিয়ে যাদের মনোজগৎকে চিহ্নিত করা যায়, সেই চিরন্তন শিশু ও কিশোরদের মনে যে রূপকথার প্রভাব দুর্বার হয়ে উঠবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। রূপকথার রাজ্যকে পরিমাপ করতে গেলে চাই প্রবল কৌতূহলের শক্তি। এক প্রবল কৌতূহলের ধারা রূপকথাকে ঠাকুরমার স্নেহসিঞ্জিত গৃহকোণ থেকে বিশ্লিষ্ট করে এনে সাহিত্যের দরবারে দাঁড় করিয়েছে। আধুনিক সাহিত্যিক তাদের চিন্তাভাবনার মানদণ্ড দিয়ে রূপকথার সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যকে পরিমাপ করে। কিন্তু এই প্রয়াস সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে ওঠে। কারণ রূপকথার গঠনপ্রণালী ও জন্মমুহূর্ত আধুনিক সাহিত্যের মাপকাঠির বাইরে। এইজন্য রূপকথাকে নাগরিক সভ্যতার স্পষ্ট রূপে পরিমাপ করা যায় না। তার জন্য চাই রূপকথার আদর্শ সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি। রূপকথাকে প্রণিধান করতে হলে, তার মাধুর্যের পরিমাপ করতে হলে চাই জন্মমুহূর্তের দৃশ্য সম্পর্কে সঠিক কল্পনা। রূপকথার পরিবেশটি শহরের রুঢ় বাস্তব থেকে কত আলাদা তা বোঝা যায় রূপকথার পরিবেশের প্রণিধানে। পরিবেশটি এইরকম: বর্ষণমুখর রাত, প্রদীপের ম্লান আলোর ছায়া গৃহকোণে। সেখানে আলোছায়ার চঞ্চল নৃত্যলীলা, সর্বোপরি কল্পনাপ্রবণ আশা-আকাঙ্ক্ষা উদ্বেল শিশুহৃদয়। সাহিত্য ব্যবসায়ীরা এই পরিবেশকে পরিমাপ করতে পারবেন না, স্টীলের কলমের কালিতে এই পরিবেশ চিত্রিত করা যাবে না। “শিশুচিত্তের উপরে ইহার অনুপম প্রভাব বুঝিতে হইলে আগে শিশুর মনোজগতের কতকটা পরিচয় থাকা চাই।”
পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির পরিণত চিত্তার সামনে রূপকথা তার ঐশ্বর্যকে উন্মুক্ত করে দেয় না। এই কারণে তারা তাদের রসও আস্বাদ করতে পারে না। মানবমনে রূপকথার প্রভাবকে পরিমাপ করতে গেলে তাই স্বতন্ত্র অনুভূতি ও কল্পনাকে প্রয়োজন। রুপকথার বৈশিষ্ট্য ও প্রভাবকে পরিমাপ করতে হলে প্রয়োজন সেই বিস্মৃত পরিবেশের পুনঃপ্রত্যাবর্তন, মানুষের প্রাচীন কল্পনার প্রত্যাবর্তন। আধুনিক মন নিয়ে সেই পরিবেশকে পরিমাপ করা যায় না। তার বৈশিষ্ট্যকেও উপলব্ধি করা যায় না। এর জন্য চাই অতীতে প্রত্যাবর্তন। অতীতের সেই রহস্যঘন পরিবেশের সঙ্গে একাত্মতা ও শিশুমনের অবাধ কল্পনা।
Leave a comment