রুপকথা শিশুহৃদয়ে তার মায়াজাল বিস্তার করে। কারণ শিশুহৃদয়ের কাছে সম্ভব অসম্ভবের সীমারেখা মুছে গেছে। তারা সংসারের প্রাপ্য-অপ্রাপ্যের মধ্যে ভেদ করতে শেখেনি, পাওয়া-না পাওয়ার মানদণ্ডে যিনি জীবনকে দেখেন না, যাঁদের জগৎ কল্পনার অনুরঞ্জনে অনুরঞ্জিত। শিশুর মনের আকাশে যে কুহেলিকা ব্যাপ্ত, তাতে মশগুল হয়ে থাকে। রূপকথা শিশুমনে অবাধ-অসীম কল্পনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। কিন্তু বয়স্ক ব্যক্তি এই কল্পনার অবাধ-অসীম যাত্রাকে উপলব্ধি করতে পারে না। তার জীবন পৃথিবীর সংকীর্ণ সীমায় সীমায়িত, তাই রূপকথার রস তার পক্ষে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা সম্ভব নয়। তারা রুপকথাকে অলীক-অবাস্তব বলে অভিযোগ করে। পূর্ণবয়স্কদের জগতে এই ধরনের আজগুবি কল্পনার মূল্য কম, তাই তাঁদের প্রধান দাবী বাস্তবতা। রূপকথা বাস্তবকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরে না। বাস্তবের কঠিন মৃত্তিকায় তার প্রতিষ্ঠা নয়। এই কারণে পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিদের কাছে মনে হয় রূপকথায় সবই অলীক, সবই অবাস্তব। এই মন্তব্য অনেক সময় রুপকথার সৌন্দর্যকে খর্ব করে তোলে। রূপকথার মাধুর্যকে পরিমাপ করতে গেলে যে কল্পনাশক্তি প্রয়োজন তা জীবনসংগ্রামের পথে পথে পরিক্রমা করতে করতে তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন। এই অভিযোগ কতখানি সত্য তা বিচার্য।
রূপকথা অলীক ও অবাস্তব। রূপকথার বিরুদ্ধে এইটেই মুখ্য অভিযোগ। কিন্তু লেখক মনে করেন, পৃথিবীতে বাস্তবেরও একটা মূল্য আছে, প্রয়োজন আছে। সংসারে অবাস্তবের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। মাটির সঙ্গে যোগ না থাকলে, মাটিতে শেকড় না গাড়লে, প্রত্যহের জীবনের সঙ্গে যুক্ত না হলেই যে তা পরিহার্য এমন কথা বলা যায় না। সুন্দর পৃথিবী ও সুন্দরতর মানবমন থেকে বাস্তব ও প্রাত্যহিক ব্যাপারকে নির্বাসনে পাঠানো যায় না। নানা বন্ধনে আমাদের বেঁধে রাখে। আমাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে তোলে। বাস্তবজীবনের তুচ্ছতার ওপর একটা আস্তরণ বিছিয়ে রাখে। জীবনের উগ্র কল-কোলাহলের ওপর এক শান্তস্নিগ্ধ শাস্তির মধুলেপ বিস্তার করে। নিবিড় নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে সামাজিক মানুষের উদ্ধৃত বিদ্রোহ ও অশান্ত স্বভাব শান্তিতে স্থির হয়ে ওঠে। তাই নীল আকাশকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিলে মানবমন তার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। নীল আকাশ যেমন মানবজীবনে প্রয়োজনীয়, রূপকথাও তেমনি রসকৌতূহলী মানুষের পক্ষে প্রয়োজনীয়। লেখকের ভাষায়, “সেই হিসাবে রুপকথারও একটা প্রয়োজনীয়তা আছে।” এ ছাড়াও অন্য দিক থেকে বিচার করলে রূপকথারও একটা প্রয়োজনীয়তা আছে। রূপকথা রচনার কাল সম্বন্ধে আমরা সঠিকভাবে অবহিত নই। তবু গবেষকরা প্রত্যয়ী এই ব্যাপারে যে রূপকথার জন্ম আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার দৃঢ়ীকরণের পর। সমস্ত বর্ণনা-বাহুল্যের অন্তরালে বাংলার পরিবারের ও সমাজের নিখুঁত চিত্র এর মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। বাঙালি সমাজের বহুদিক রূপকথার বর্ণনায় ফুটে উঠেছে। আমাদের সমাজের বহুবিবাহ, গৃহের সপত্নীবিরোধ, সপত্নীপুত্রের প্রতি বিমাতার অত্যাচার, রূপসী প্রণয়িনীর মোহ ও অবশেষে সেই মোহভঙ্গ। আমাদের জীবনের নানা হঠকারিতা, শঠতা ও পারিবারিক চক্রান্তের ছবি রুপকথার এইসব চিত্রে ও বর্ণনায় ধরা পড়েছে। এগুলি উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে কল্পনার স্পর্শে। রাজপুত্র শ্বেতবসন্তের কাহিনী যখন কথকের কণ্ঠে উদ্গীত হয়, তখন শিশু তো বটেই, অনেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষও করুণায় বিগলিত না হয়ে পারে না। শ্বেতবসন্ত গল্পের ওপর হয়তো রামায়ণ কাহিনীর ছায়া পড়েছে। তবু এর নিজস্ব সৌন্দর্য মাধুর্য অটুট আছে। এই কাহিনীর ভিতর লুকিয়ে আছে করুণ রস, গভীর ও সরল, এর ভাষা কৃত্রিমতা-বর্জিত, হৃদয়কে তা স্পর্শ করে সহজে। রূপকথার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে পারিবারিক বৈষম্য ও সমস্যার রূপায়ণে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় শান্তিপূর্ণ সমাধানে। এই সমাধান বাস্তব জীবনে দুর্লভ। এর অভাবে জীবনে জাগে করুণ মর্মর। এইভাবে রূপকথায় বাস্তবজীবনের সর্ববিধ অসম্পূর্ণতা দূর করে দেয়, কঠিন দৈবের বিচার উল্টিয়ে দেয় এবং মানবজীবনের সংগ্রাম শেষে মানুষ আবিষ্কার করে যে সে নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা। মানবজীবনের অসঙ্গতির সমাধানের মধ্যে দিয়ে মানুষের এই যে জয়ঘোষণা তা প্রমাণ করে রূপকথার কল্পনারডীন অবাস্তবতার পাশে বাস্তবতার বিজয়গৌরব কতখানি সার্থক। এইসব দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় রুপকথার বিরুদ্ধে অলীকতা ও অবাস্তবতার অভিযোগ কতখানি অসার। এই অভিযোগ সত্যই ভিত্তিহীন। রূপকথার স্বরুপকে যথার্থভাবে বিচার করা গেলে এই অভিযোগের অসারতা উপলব্ধি করা যায়।
Leave a comment