অর্থনীতিবিদ শ্রীঅশোক মিত্র “কৃষিসমস্যা ও আমরা”—প্রবন্ধে ভারতের কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে রাশিয়া ও চিনের কৃষিসমস্যার একটি দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। চিন দেশে সাত লক্ষ গ্রাম জুড়ে কৃষিভূমি বিস্তৃত, চল্লিশ কোটি লোকের কৃষিকার্যই একমাত্র জীবিকা। সুতরাং কৃষি-বর্গ চিনে বিরাট। সোভিয়েট দেশে পরিকল্পনা খাতে বিনিয়োগের টাকার অধিকাংশ যন্ত্রপাতি তথা শিল্পোপযোগী যন্ত্র ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে। সেই টাকার সদ্ব্যবহার তারা করেছে অধিকতর যন্ত্রপাতি কিনে যা দিয়ে তারা শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে এই অগ্রাধিকার তারা দেয়নি। অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে যাচাই করে সোভিয়েট দেশের মানুষ যেমন সুদিনের স্বাদ পেয়েছে, তেমনি কৃষিক্ষেত্রে অবহেলার দরুন তারা অর্থনীতিকে মজবুত ভিত্তিতে দাঁড় করাতে পারেনি। কৃষিকর্মের বাইরে সোভিয়েট দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বিগত পঁয়ত্রিশ বছরে কুড়িগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, অথচ কৃষি উৎপাদন দ্বিগুণও বাড়েনি। কৃষির উৎপাদন যতটুকু বেড়েছে তার সমগ্রাংশ নতুন জমি আবাদ করার ফলে, গড়ে জমির উৎপাদনশক্তি কিছুমাত্র বাড়েনি। এর ফলে সম্প্রতি সোভিয়েট দেশের আর্থিক উন্নতির হারও কমে এসেছে।

এর কারণস্বরূপ বলা যায়, সোভিয়েট কর্তৃপক্ষ ভুল করেছিল কৃষির জন্য প্রয়োজনানুগ বিনিয়োগের হিসেবে। কৃষিকর্মের মোড় ফেরাতে তারা ট্রাক্টর তৈরিতে জোর দিয়েছিল। বিদ্যুৎ সরবরাহে নজর দিয়েছিল। যে পরিমাণ টাকা ট্রাক্টর শিল্পে ব্যয় হয়েছিল, সে পরিমাণ টাকা সার কেনায় ব্যয় করা হয়নি। কীটনাশক ঔষধের ব্যবহারেও অবহেলা দেখানো হয়েছে।

উন্নত বীজশস্যের উপকারিতা নিয়েও মাথাব্যথা দেখা যায়নি। সব মিলিয়ে, ১৯৫৩-৫৪ সালে সোভিয়েট দেশে কৃষিখাতে নির্দিষ্ট বিনিয়োগের মোট অঙ্ক অনুপাতে কমে গেছে। বরাদ্দ অর্থের বণ্টনেও সেরকম একপেশে চিত্তার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। কৃষিসমস্যা শিল্পসমস্যা থেকে পৃথক। শিল্পে যন্ত্র উৎপাদনের প্রক্রিয়া আবেগহীন ব্যাপার। বাণিজ্যে নামতে গেলে, বা কারখানা বসাতে উৎসাহী হলে, উদ্যোক্তা সরলরেখায় এগোতে পারেন। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপারটা এত সহজ নয়। কৃষিকার্য সমস্ত দেশ জুড়ে, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ পরিগ্রামে। একই গ্রামে হয়তো দু-তিনশো কৃষিজীবী, তারা প্রত্যেকেই মনের দিক থেকে সার্বভৌম, ইচ্ছের দিক থেকে স্বতন্ত্র। উৎপাদন বৃদ্ধির মন্ত্র এদের মধ্যে বিদ্যুৎ চালনার মতো চালিত করতে হবে। সকলকে সমমন্ত্রে দীক্ষিত করতে হবে। একই চেতনার বিদ্যুৎ সকলের মনে এক সঙ্গে প্রবাহিত হলে তবেই ফসল উৎপাদন বাড়বে। কিন্তু এই ব্যাপারে অসুবিধের দিকটাও কম নয়। কারণ সব কৃষকই রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যে গদগদ-চিত্তে উৎপাদনে এগিয়ে আসবে না। জমির প্রতি প্রত্যেকের দুর্বলতা স্বতন্ত্র। কোনো কোনো কৃষিজীবীর মনে থাকে “অনেক নিবিড় হয়ে জড়ো হওয়া আবেগের ব্যাপ্তি।” জমি রাষ্ট্রের সম্পত্তি। অথচ সে জমিতে কৃষকের অধিকার আছে। এই ধরনের দূরাগত যুক্তিতে মন সায় দেয় না। চাষিদের মন হয়েছে অসেতুসম্ভব তাতে মনের আদান প্রদানও অবরুদ্ধ থেকেছে। এই হার্দ্য-বিনিময়ের অভাবে সোভিয়েট দেশের কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ে নি। গ্রামের প্রয়োজনের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার মধ্যে ব্যবধান এসে গিয়েছে। যে গ্রামে সার পৌঁছানো দরকার সে গ্রামে হয়তো চকচকে ট্যাক্টর পৌঁছেছে, যেখানে সেচের জল দরকার সেখানে হয়তো পৌঁছেছে সার। এই গরমিল সোভিয়েট দেশে একটু বেশি পরিমাণে হয়েছে বলে উৎপাদন এত ব্যাহত হয়েছে।

চিনদেশেও অনুরূপ অবস্থা সক্রিয়। সোভিয়েট দেশের অভিজ্ঞতা থেকে চিনেরা ঠেকে শিখেছে। “কৃষি উৎপাদনে সোভিয়েট অসাফল্যের দৃষ্টান্ত চিনেদের সাবধানতা শিখিয়েছে।” তারা বুঝেছে যে কেবলমাত্র বিদ্যুৎ পরিবহন-যন্ত্রের প্রসারের দিকে নজর দিলে চলবে না, চাই কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি। “নইলে সোভিয়েট দেশের দশা হবে।” চিনে, ১৯৫৯-৬০ সালে প্রচণ্ড খাদ্যাভাব হয়েছিল। তারই ফলে চিনা পরিকল্পনায় গোঁড়ামি কিছুটা কেটেছে। চিন এবার মনোযোগী হয়েছে সার, কীটনাশক ঔষধ, উন্নত বীজশস্য, উন্নত রোপণ-প্রণালী এ-সবে তাদের মনোযোগ বাড়ছে। এ-সব দেখে মনে হয়, কৃষি উন্নয়ন-প্রণালীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে চিনেদের বিনিয়োগ ব্যবস্থা আবর্তিত হচ্ছে। ‘ভারী শিল্প’-র দিকে আগের মতো আর জোর দেওয়া হচ্ছে না। কৃষিক্ষেত্রে ট্র্যাক্টর ছাড়াও অন্য ধরনের বিনিয়োগ সম্ভব। সেই স্বীকৃতি এসেছে। চিনের আসল সমস্যা চিনের কৃষকদের সঙ্গে হার্দ্যবিনিময়ের। এইখানে কৃষি-উন্নয়নের বাধা। সোভিয়েট ইউনিয়নের মতো চিনদেশেরও কৃষিসমস্যার প্রধান কারণ এই কৃষকদের অন্তরের সাড়ার অভাব। চিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কৃষকদের মনের সায় যদি সুসংগত না হয়, তাহলে উৎপাদন ব্যাহত হতে বাধ্য। সাত লক্ষ গ্রামের দেশ চিন। চল্লিশ কোটি মানুষের মুখ্য জীবিকা কৃষিকর্ম। যদি এত লক্ষ লোককে বশংবদ করতে পারে, তাহলেই উৎপাদন বৃদ্ধির যজ্ঞ পূর্ণ হবে। কমিউনিস্ট রাষ্ট্র বলেই যে একনায়কতন্ত্রী শাসনব্যবস্থায় এই বাধ্যতামূলক কৃষি উৎপাদন সম্ভব হবে, এমন আশা দুরাশা। কারণ আইন ও দণ্ডের ভয় দেখিয়ে চল্লিশ কোটি লোককে বশে আনা যায় না। তিরিশ দশকে সোভিয়েট রাষ্ট্রের গ্রামাঞ্চলে সোভিয়েট রাষ্ট্রের তথা কমিউনিষ্ট পার্টির প্রভাব ছিল, হয়ত এর তুলনায় চিনের গ্রামাঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব অনেক বেশি। তবু একথা বলা চলে যে কমিউনিস্ট প্রতিভার মধ্যস্থতা পেরিয়ে বেশি কিছু করার প্রয়োজনীয়তা চিন কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করেছেন এবং সেজন্যই গ্রামাঞ্চলে ‘কমিউন’ গড়ার তোড়জোড়। ‘কমিউনের’ স্বজ্ঞান যথেষ্ট পরিমাণে আছে। কারণ গ্রামের কৃষক-কন্যারা উপার্জনের জন্য বাইরে বেরোতে পারছে। পরিবারের গড় উপার্জনই বাড়ছে। গ্রামাঞ্চলে সন্তুষ্টির মাত্রাও বাড়ছে। এই মানসিক সন্তোষ কৃষি উৎপাদনে সহায়ক হবে। চিনে যেমন এদেশেও তেমনি কৃষকের মন বোঝা বা মন পাওয়ার সমস্যাই প্রধান। “কৃষি-উৎপাদন স্রোতস্বিনী না হলে আমাদের মুক্তির আশা পরাহত।”