কাব্যের আত্মার সন্ধান করতে গিয়ে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে ‘অলঙ্কার শাস্ত্রে’র উদ্ভব ঘটেছিল। এর স্রষ্টারূপে কীর্তি হয়ে থাকে ‘নাট্যশাস্ত্র’-প্রণেতা আচার্য ভরতের নাম। তিনিই প্রথম কাব্যের মূল-রূপে রস-বীজের সন্ধান দিয়েছিলেন, তবে ভাব-অলঙ্কারাদিতে যে রসের স্ফূর্তি, তা-ও স্বীকার করেছিলেন। পরবর্তীকালের আলঙ্কারিকগণ প্রথমে কাব্যদেহেই আত্মার সন্ধান করেছিলেন বলে তাঁদের দৃষ্টি প্রধানতঃ দেহের সীমাতেই আবদ্ধ ছিল। সপ্তম শতাব্দীর আলঙ্কারিক আচার্য ভামহ বলেন, ‘শব্দার্থেী সহিতৌ কাব্যম্’—এখানে শব্দার্থময় বাক্যকেই কাব্য বলে অভিহিত করায় বাক্যের শব্দগত এবং অর্থগত অলঙ্কারই প্রাধান্য লাভ করে এবং এ থেকে অলঙ্কার-শাস্ত্রে ‘অলঙ্কারবাদে’র প্রবর্তন ঘটে। আচার্য ভামহ কাব্যের অলঙ্কার প্রাধান্য বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘ন কাস্তমপি নিভৃষং বিভাতি বনিতামুখম্’ অর্থাৎ বনিতা-মুখও অনলঙ্কৃত হলে সুন্দর মনে হয় না। এই উক্তি দ্বারা সৌন্দর্য-বিধায়করূপে প্রসাধনের উপযোগিতার অর্থাৎ কাব্যদেহের অলঙ্কৃতির প্রয়োজন স্বীকৃত হয়েছে। পরবর্তী আলঙ্কারিক আচার্য দণ্ডীও অলঙ্কারকে কাব্যের শোভাকর ধর্ম বলে উল্লেখ করেছেন (‘কাব্যশেভাকরান্ ধর্মান্ অলঙ্কারান্ প্রচক্ষতে’)। আচার্য-মন্মথভট্ট তাঁর ‘কাব্যপ্রকাশে’ অলঙ্কারকে বলেছেন কাব্যের অনিত্য বস্তু—এখানে বস্তুতঃ অলঙ্কারের উপযোগিতা স্বীকৃত হলেও তার একচ্ছত্রাধিপত্য ক্ষুণ্ন হয়েছে। আবার কবিরাজ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘সাহিত্য দর্পণে’ রসকেই কাব্যের আত্মা-রূপে স্বীকার করলেও (‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্’) অলঙ্কারকে একেবারে বর্জন করেন নি। তিনি অলঙ্কারকে শব্দার্থের শোভাতিশায়ক অস্থির ধর্ম (“শব্দার্থয়োরস্থিরা যে ধর্মাঃ শোভাতিশায়িনঃ ) বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যত্র অলঙ্কারকে তিনি রসের উৎকর্ষ-বিধায়ক বলে অভিহিত করেন (‘উৎকর্ষহেতবঃ প্রোপ্তাঃ গুণালঙ্কাররীতয়ঃ’)। আবার কোনো কোনো আলঙ্কারিক অলঙ্কারকে কাব্যদেহের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত বলেও মনে করেন না অলঙ্কার যে কটককুণ্ডলাদিবৎ একান্তই বাইরের বস্তু এবং প্রয়োজনে কাব্যদেহে তা আরোপিত হয় (‘অলঙ্কারঃ কটককুণ্ডলাদিবৎ’)—এই অভিমতও যথেষ্ট মান্যতা লাভ করেছে। এই অবস্থায় মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলঙ্কারিক আচার্য বামন এই অলঙ্কার-প্রস্থানকে কিঞ্চিৎ সংশোধিত আকারে উপস্থাপিত করলেন। তিনি ‘কাব্যালঙ্কারসূত্র’ নামক গ্রন্থে ‘কাব্যং গ্রাহামলঙ্কারাৎ’ বলে কাব্য যে অলঙ্কার-হেতুই গ্রহণযোগ্য, এই অভিমত স্বীকার করেও অলঙ্কারকে ব্যাখ্যা করেছেন একটু ভিন্নভাবে। তিনি বলেন ‘সৌন্দর্যম্ অলঙ্কারঃ’—অর্থাৎ সৌন্দর্যই অলঙ্কার। এতদ্বারা তিনি ‘অলঙ্কার’ শব্দটিকে বিশেষিত করলেন; অলঙ্কারবাদিগণ কাব্যের মূল বস্তুৰূপে অনুপ্ৰাস-উপমাদি যে সকল শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কারকে গ্রহণ করেছিলেন, আচার্য বামন সেই উপমাদি অলঙ্কারকে স্বীকৃতি দান করেন নি; নামতঃ তিনি ‘অলঙ্কার’ এর কথা বললেও কার্যতঃ তিনি সৌন্দর্যকেই কাব্যের গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি রূপে গ্রহণ করতে চেয়েছেন। আচার্য বামন কাব্যের আত্মা-সন্ধান করতে গিয়ে বলেন—‘রীতিরাত্মা কাব্যস্য। বিশিষ্টা পদরচনা রীতিঃ। বিশেষো গুণাত্মা।’ অর্থাৎ গুণাত্মক যে বিশিষ্ট পদ রচনা, তাকেই বলে রীতি এবং এই রীতিকেই এখানে কাব্যের আত্মা-রূপে কীর্তন করা হয়েছে। উক্তিটি বিশ্লেষণযোগ্য।
আচার্য বামন রীতিকেই আত্মার স্বীকৃতি দিয়েছেন, কিন্তু স্বীকৃতিটি একটি শর্তসাপেক্ষ। শর্তটি হলো—রীতি হবে গুণাত্মক। ‘গুণ’ শব্দটি সাধারণভাবে দোষের বিরোধী ভাবকে ব্যক্ত করলেও এখানে ‘গুণ’ শব্দটি বিশিষ্ট পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যে বিশেষ জাতীয় রচনায় কবির বক্তব্য উত্তম স্ফূর্তি লাভ করে, ‘অলঙ্কার শাস্ত্রে’ তাকেই ‘গুণ’ নামে অভিহিত করা হয়। ‘কাব্যাদর্শ প্রণেতা দশটি গুণের নাম উল্লেখ করেছেন—শ্লেষ, প্রসাদ, সমতা, মাধুর্য, সুকুমারতা, অর্থব্যক্তি, উদারতা, ওজঃ, কান্তি ও সমাধি। তবে এদের মধ্যে ওজঃ, প্রসাদ এবং মাধুর্যগুণই সমধিক উল্লেখযোগ্য। রসবাদিগণ শুধু এই তিনটি গুণকেই স্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং তাঁরাও কাব্যের সঙ্গে গুণের নিয়ত সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন—’অচলস্থিতয়ো গুণাঃ।’ অনেকে কাব্যের এই ‘গুণ’কৈ পারিভাষিক অর্থে একালের poetic diction বা ‘কাব্যভাষা’ বলেই মনে করেন। এই অর্থে ‘কাব্যভাষা’ বা poetic diction রীতির অন্তর্ভুক্ত বলেই গৃহীত হবে।
বামন এই গুণাত্মকবিশিষ্ট পদ-রচনাকেই ‘রীতি’ বলে অভিহিত করে তাকেই ‘কাব্যের আত্মা’-রূপে স্বীকৃতি জানিয়েছেন। আধুনিক বিচারে এই রীতিকেই বলা হয় ‘style’ (স্টাইল)। আধুনিক কালের কাব্য-সাহিত্যে এই স্টাইলের অসাধারণ মূল্য অবধারিত হয়। ওয়াল্টার পেটার স্টাইলের সংজ্ঞার্থ-নিরূপণে বলেছেন, ‘style is the man’—অর্থাৎ স্টাইল বা রীতিই ব্যক্তি তথা তার ব্যক্তিত্ব অর্থাৎ স্টাইলের মধ্য দিয়েই কবির ব্যক্তি পুরুষের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে। এই রীতির গুণেই কোনো বাকা বা রচনা কাব্যরূপে সমাদৃত হয় অন্যথায় অর্থাৎ এর অভাবে বিষয়ের সমতা সত্ত্বেও সেই বাক্য বা রচনাকে কাব্যরূপে স্বীকার করা হয় না। পৃথিবীর কৃতী এবং শ্রেষ্ঠ লেখকদের রচনায় যে বিশেষ ভঙ্গিটির জন্য এগুলি তত্তৎ ব্যক্তির রচনা বলে স্বীকৃতি লাভ করে, তা এই ‘রীতি’ বা স্টাইল। অতএব সাহিত্যে দেশকাল-নিরপেক্ষভাবেই রীতির অপরিহার্যত্ব স্বীকৃত।
প্রাচীন ভারতীয় আলঙ্কারিকগণ ভৌগোলিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রীতির শ্রেণিবিভাগ করে ‘বৈদভী রীতি, পাঞ্চালী রীতি, গৌড়ী রীতি’ প্রভৃতি নামকরণ করেছেন। ‘বৈদভী রীতি’তে তাঁরা দশবিধ গুণেরই মিশ্রণ লক্ষ্য করেছিলেন ; ‘পাঞ্চালী রীতিতেও ঘটেছিল অধিকাংশ গুণের সমন্বয়, কিন্তু ‘গৌড়ী রীতি’ এদের প্রতি তুলনায় নিকৃষ্টই বিবেচিত হতো-এতে অল্প কটি গুণেরই মাত্র সমাবেশ ঘটেছিল; বিশেষভাবে বলা হতো—গৌড়েষু অক্ষর-ডম্বরম্’ অর্থাৎ গৌড়ীরীতিতে অক্ষরের আড়ম্বরই বেশি—ক্ষেত্র বিশেষে এটি দোষ বলেই গণ্য হতো। আধুনিক বিচারে এই প্রাচীন ভৌগোলিক রীতিবাদ একেবারেই বর্জিত হয়েছে। একালের রীতি বা স্টাইল ব্যক্তিস্বভাব-চিহ্নিত—তাই আমরা অনায়াসে বলে থাকি, মাইকেলী, বঙ্কিমী বা রাবীন্দ্রিক স্টাইল। তাদের অনুসরণকারীরা পূর্বসূরীদের বিষয়বস্তুর অনুসরণ করেন না, তারা এদের রচনারীতি বা স্টাইলই অনুকরণ করতে চেষ্টা করতে থাকেন।
‘সাহিত্যদর্পণ’কার বিশ্বনাথ একটি উক্তি উদ্ধার করে বলেছেন, ‘রীতয়ঃ অবয়ব-সংস্থান বিশেষবৎ অলঙ্কারাশ্চ কটককৃণ্ডলাদিবৎ’—অর্থাৎ রীতি যেন অবয়ব সংস্থান বিশেষ এবং অলংকার তার কটককৃগুলাদির মতো সজ্জা উপকরণ। দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-সংস্থান যদি নির্দোষ হয়, তবেই সেই দেহের শোভা বৃদ্ধি করতে পারে অলংকার। স্টাইল বা রীতি হচ্ছে সেই অঙ্গ-সংস্থান।
অলঙ্কার শাস্ত্রে যাঁরা রীতি বাদী নন, তাঁরা কিন্তু অবয়ব-সংস্থানকে কোনো বিশেষ মূল্য-দানে স্বীকৃত নন ‘ধ্বন্যালোক’ গ্রন্থে রয়েছে–’রমণীদেহের লাবণ্য যেমন অবয়ব-সংস্থানের অতিরিক্ত অন্য জিনিষ, তেমনি মহাকবিদের বাণীতে এমন বস্তু আছে যা শব্দ, অর্থ, রচনাভঙ্গি, এ সবার অতিরিক্ত আরও কিছু।’ এই অতিরিক্ত বস্তুই কাব্যের আত্মা। অতএব, ওঁদের মতে, ‘রীতিরাত্মা কাব্যস্য’ কিংবা ‘কাব্যের আত্মা হল স্টাইল’— শেষ পর্যন্ত এই মতবাদ অস্বীকৃত হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধে রচনা-বিষয়ে যা বলেছেন, তা উল্লেখ করা চলে। তিনি বলেন, “রচনার মধ্যেই লেখক যথার্থরূপে বাঁচিয়া থাকে, ভাবের মধ্যে নহে, বিষয়ের মধ্যে নহে।” এখানে তিনি ‘রচনা’ বলতে রচনা-রীতি তথা স্টাইলের কথাই বলেছেন। ভাব বা বিষয় সার্বজনীন, লেখক শুধু তাকে নিজের মতো করে প্রকাশ করেন—এই যে নিজের মতো করে প্রকাশ করা, যার মধ্য দিয়ে লেখকের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হতে পারে, তাকে যদি ‘রীতি’ বা ‘স্টাইল’ আখ্যা দেওয়া যায়, তবে সাহিত্য রচনায় তার গুরুত্ব এবং উপযোগিতা স্বীকার করতেই হয়। কিন্তু রীতিকে ‘কাব্যের আত্মা’ বলে মানা যায় না : কাব্যের আত্মা অবশ্যই রস এবং রীতিকে তার উৎকর্ষের হেতুরুপেই গ্রহণ করা চলে, তদতিরিক্ত কিছু নয়; কবিরাজ বিশ্বনাথের কথায়–’উৎকর্ষহেতবঃ প্রোত্তাঃ গুণালঙ্কারয়ীতয়ঃ।
Leave a comment