‘শব্দাযৌ সাহিত্যম্ কাব্যম্’’ ও ‘কাব্যম্ গ্রাহ্যমলংকারাৎ”—মত দুটি বিরুদ্ধ মনীষীগণের সমালোচনায় বিপর্যস্ত হলে অলংকারবাদকে শুধরে নিতে এগিয়ে এলেন একদল আলংকারিক। তাঁরা মত পোষণ করলেন— অলংকৃত কাব্য মাত্রেই কাব্য নয় এবং অলংকারশূন্য কাব্যও কাব্য বলে গণ্য হতে পারে। তাঁদের মতে—“রীতিরাত্মা কাব্যস্য,” অর্থাৎ স্টাইল বা রীতিই হচ্ছে কাব্যের আত্মা।
এই রীতিবাদ সমর্থকগণের পুরোভাগে আমরা কাব্যাদর্শ রচয়িতা আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর ‘দণ্ডী’ ও খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দীর আলংকারিক বামনকে স্থাপন করতে পারি। বামন তাঁর কাব্যালংকার সূত্রে লিখলেন—’রীতিরাত্মা কাব্যস্য’। (রীতি আত্মা কাব্যস্য)। আচার্য বামন এই রীতির ব্যাখ্যা করে লিখলেন : ‘বিশিষ্ট পদ রচনা রীতি’ অর্থাৎ পদরচনার বিশিষ্ট ভঙ্গিই হল রীতি।
রীতি হচ্ছে ‘স্টাইল’ স্টাইলকে প্রাধান্য দিয়ে রীতিবাদীদের বক্তব্য হল স্টাইলের গুণেই কাব্য বা সন্দর্ভ কাব্য হয়ে ওঠে। আর স্টাইল না থাকলে বক্তব্য বস্তুর সমতা থাকলেও অন্য বাক্যে কাব্য হয় না। বামনের মতে রীতির তিনটি প্রকারভেদ : বৈদভী, গৌড়ী ও পাঞ্চালী। এর পরে আরও তিনটি রীতির পরিচয় পাওয়া যায়—লাটী, অবন্তী ও মাগধী।
স্টাইল বা রীতির জন্য বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য রচয়িতা ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। ইউরোপীয় সাহিত্যে পদ্য গদ্য লেখক অনেক সাহিত্যিক দেখা যায় যারা স্টাইলের গুণে আর্টিষ্ট বা কবি খ্যাতি পেয়েছেন। অলংকারকে স্টাইল বা রীতির আনুষঙ্গিক বস্তু বলে মনে করা হয়। আর রীতি হচ্ছে অবয়ব সংস্থান।
“রীতয়ঃ অবয়ব সংস্থান বিশেষ বং।”
অবয়ব সংস্থান যদি নির্দোষ না হয় তবে অলংকার পরলে বাস্তবজগতে মানুষকেও সুন্দর দেখায় না।
যাঁরা রীতিবাদের সমর্থন করেন তাঁদের মতকে এই বলে নিরস্ত করা যায় যে, রীতি নিপুণ বা স্টাইলিষ্ট কবি ভারতচন্দ্রকে শ্রেষ্ঠ আসন দিতে হয়; কিন্তু ভারতচন্দ্রকে সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি বলে গণ্য করা যায় না। রীতিবাদের দোষ দেখিয়ে খ্রিস্টীয় ৯ম শতকের ধ্বনিবাদ প্রবক্ত শ্রীমদানন্দবধনাচার্য তাঁর ‘যুগঞ্জীব’ গ্রন্থ ‘ধ্বন্যালোক’-এ লিখলেন—
“প্রতীয়মানং পুনরণ্যদেব বস্তুস্তি বাণীষু মহাকবিনাম্
যওৎ প্রসিদ্ধাবয় বাতিরিক্তং বিভাতি লাবণ্যমিবাঙ্গনাসু।”
অর্থাৎ, “রমণী দেহের লাবণ্য যেমন অবয়ব সংস্থানের অতিরিক্ত অন্য জিনিস, তেমনি মহাকবিদের বাণীতে এমন বস্তু আছে যা শব্দ, অর্থ, রচনাভঙ্গি (রীতি বা স্টাইল) এ সবার অতিরিক্ত অন্য কিছু। এই অতিরিক্ত বস্তুই কাব্যের আত্মা।
এ বস্তু কী? উত্তরে বাস্তববাদী আলংকারিকরা বললেন—এ জিনিসটি হচ্ছে কাব্যের বাচ্য বা বক্তব্য। অন্য বাক্যের মতো কাব্যও পদসমুচ্চয় দিয়ে, শব্দের সঙ্গে শব্দ সাজিয়ে, কোনো বস্তু বা ভাবকে প্রকাশ করে। কাব্যের কাব্যত্ব নির্ভর করে ওই বস্তু বা ভাবের বিশিষ্টতার উপর। বিশেষ বিশেষ প্রকারের বস্তু ও বিশেষ বিশেষ রকমের ভাবকে প্রকাশ করলেই তবে বাক্য কাব্য হয়। তাই ভাব, বস্তু, রীতি ও অলংকার এদের যথাযথ সমবায়েই কাব্যের সৃষ্টি। এ সবের অতিরিক্ত কাব্যের আত্মা বলে অন্য কোনো ধর্মান্তর নেই।
Leave a comment