সভ্যতা ও সংস্কৃতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রাচীন ইউরােপে যেমন রােমান সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে তেমনি প্রাচীন ভারতের গুপ্ত সাম্রাজ্যেরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। দুটি সাম্রাজ্যেরই পতনের পরেও বহুদিন তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি টিকেছিল। রোমান ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিষয়ে নীচে একটি তুলনামূলক আলােচনা করা হল一
রােমান সাম্রাজ্য
-
বিভিন্ন রােমান সম্রাট প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের ভূখণ্ড দখল করে এক সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। এই সুবিশাল সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
-
প্রাচীন রােমান সাম্রাজ্যে শক্তি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রােমান সম্রাট উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সম্রাট অগাস্টাস সিজার দেশে শান্তিবাদী আইন প্রণয়ন করেন যা প্যাক্স রেমানা (Pox Romand) নামে পরিচিত। সম্রাট নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসম্পন্ন হলেও তিনি বৃহৎ এই সাম্রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিকেন্দ্রীভূত শাসননীতির প্রণয়ন করেছিলেন।
-
রােমের স্থানীয় ভাষা লাতিন হলেও সন্ত্রান্ত ও শিক্ষিত লােকেরা গ্রিক ভাষায় কথা বলত। সাহিত্যও রচিত হত গ্রিক ভাষায়। পরে রােমান সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের ফলে লাতিন ভাষা ইউরােপে ছড়িয়ে পড়ে।
-
রােমান লেখকগণ মহাকাব্য, কবিতা, নাটক প্রভৃতি রচনা করতেন। টেরেন্সের অ্যান্রিয়া’ ও ‘অ্যাডােলফো’, ভার্জিলের ইনিড’, ওভিড-এর ‘মেটামরফোসিস”, রুফাস-এর ‘ডি মটি” ও হােরেসের ওডেস’ প্রভৃতি খুবই জনপ্রিয় ছিল। এ ছাড়া সিসেরাে, সেনেকা, পারসিয়াস, জুভেনাল প্রমুখ ছিলেন। রােমান যুগের উল্লেখযােগ্য সাহিত্যিক।
-
রােমান যুগে দেশের কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে যথেষ্ট অগ্রগতির ফলে আর্থিক সমৃদ্ধি এসেছিল। কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ সহজ হয়েছিল।
-
রােমান সাম্রাজ্যে স্থাপত্যশিল্পের যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছিল।সম্রাট অগাস্টাস সিজার অসংখ্য মন্দির, রাস্তাঘাট, গ্রন্থাগার প্রভৃতি নির্মাণ করেছিলেন। বিশালায়তন অট্টালিকা প্যান্থিয়ন, চারতলা ও ৫০,০০০ আসনবিশিষ্ট অ্যাম্ফিথিয়েটার বা কোলােসিয়াম, জনগণের সমবেত হওয়ার জন্য নির্মিত ফোরাম। প্রভৃতি প্রাচীন রােমের অসাধারণ শিল্পকর্ম।
-
খ্রিস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে রােমান ভাস্কর্যশিল্পে চরম উৎকর্ষ লক্ষ করা যায়।বিভিন্ন মানবমূ্তি, স্তম্ভ প্রভৃতি রােমান ভাস্কর্যের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল। অগাস্টাসের মূর্তি, সম্রাজ্ঞী স্যবিনার মূর্তি প্রভৃতি রােমান ভাস্কর্যের অনন্য নিদর্শন।
-
বিভিন্ন অট্টালিকা বা প্রাচীরের দেওয়াল, ছাদ প্রভৃতি স্থানে চিত্রগুলি আঁকা হত। বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্র, নৈসর্গিক দৃশ্য, অট্টালিকা বা বিভিন্ন বাস্তব বিষয় নিয়ে চিত্রগুলি অঙ্কিত হত।
-
প্রথমদিকে রােমান সাম্রাজ্যে বহুদেবতার আরাধনা করা হলেও খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে সেখানে খ্রিস্টধর্ম ছড়িয়ে পড়ে। সম্রাট প্রথম থিওডােসিয়াস ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে এই ধর্মকে রােমান সাম্রাজ্যের বৈধধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিলে দ্রুত প্রাচীন বহুত্ববাদী ধর্মের পতন এবং খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটে।
-
রােমে কারিগরি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। নিকটবর্তী পার্বত্য এলাকা থেকে জল অনার জন্য কংক্রীটের জল-প্রণালী এবং এর ওপরে তৈরি হত সেতু। সে যুগে রােমে উন্নত শৌচাগার, স্নানাগার প্রভৃতিও নির্মিত হয়।
গুপ্ত সাম্রাজ্য
-
গুপ্তরাজারা বিভিন্ন স্থানে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ভারতে শক্তিশালী রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করেন।
-
সম্রাটগণ সাম্রাজ্যে এক সুদক্ষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তারা শাসনব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীভূত করেন এবং প্রাদেশিক ও জেলার শাসনকর্তাদের প্রভূত ক্ষমতা দান করেন। গুপ্তযুগের করব্যবস্থাও প্রজাদের পক্ষে মােটেই নির্যাতনমূলক ছিল না। এই যুগে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
-
গুপ্তযুগে সংস্কৃত ভাষার যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। এ যুগের সাহিত্যের মাধ্যমও ছিল সংস্কৃত ভাষা। সংস্কৃত ভাষায় বিভিন্ন সাহিত্য রচিত হত। সংস্কৃত ভাষা থেকে ক্রমে বিভিন্ন নতুন নতুন ভাষার উদ্ভব হতে থাকে।
-
গুপ্তযুগে সাহিত্যে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। এযুগে উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলি হল- বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস, শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’, ভারবি-র ‘কিরাতার্জুনীয়ম’, ভট্রি-র ভট্টিকাব্য’, দণ্ডী-র ‘দশকুমারচরিত’, বিষ্ণুশর্মার ‘পঞ্চতন্ত্র’, কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম’, ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম’, ‘মেঘদূতম’, ‘কুমারসম্ভব, হরিষেণের এলাহাবাদ প্রশস্তি প্রভৃতি।
-
গুপ্তযুগে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটেছিল। এই যুগে বস্ত্রশিল্প, লৌহশিল্প, ধাতুশিল্প, চর্মশিল্প, কাষ্ঠশিল্প প্রভৃতি শিল্প এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রভূত বিকাশ ঘটেছিল।
-
স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ক্ষেত্রে গুপ্তযুগে অভূতপূর্ব উৎকর্ষ লক্ষ করা যায়। এযুগে পাথর কেটে বিভিন্ন বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু মন্দির তৈরি করা হত। এ যুগের উল্লেখযােগ্য কয়েকটি স্থাপত্য-নিদর্শন হল মণিনাগের মন্দির, কোটেশ্বর মন্দির, দেওগড়ের দশাবতার মন্দির, সাঁচী ও বুদ্ধগয়ার স্তূপ প্রভৃতি।
-
গুপ্তযুগে ভাস্কর্যশিল্পেও যথেষ্ট উৎকর্ষ লক্ষ করা যায়। ভাস্কর্যের উল্লেখযােগ্য নিদর্শন-গুলি হল সারনাথের অবলােকিতেশ্বর মূর্তি ও বৌদ্ধমূর্তিগুলি, সাঁচির বােধিসত্ত্ব , মথুরার ব্রোঞ্জের বুদ্ধমূর্তি প্রভৃতি।
-
গুপ্তযুগে চিত্রকলার ক্ষেত্রেও প্রভূত অগ্রগতি হয়েছিল। অজন্তা ও ইলােরার গুহাচিত্র, মাতা ও পুত্র’, ‘বােধিসত্ত্ব চক্রপাণি, ‘হরিণ চতুষ্টয়’ প্রভৃতি চিত্রগুলিতে বাস্তব জীবনের কাহিনি ফুটে উঠেছে।
-
গুপ্তযুগে বৌদ্ধধর্মের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে হিন্দুধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে ও তন্ত্রধর্মের প্রচলন হয় এবং ইন্দ্র, বরুপ, মিত্র প্রভৃতি বৈদিক দেবতার গুরুত্ব হ্রাস পেয়ে শিব, বিস্তু, গণেশ, কার্তিক, দূর্গা, লক্ষ্মী, কালী প্রভৃতির উপাসনা বৃদ্ধি পায়।
-
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গুপ্তযুগে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটেছিল। ধন্বন্তরী ও বাণভট্ট তাদের চিকিৎসা-বিষয়ক গ্রন্থ নালন্দায় প্রাপ্ত বুদ্ধের তাম্রমূর্তি, বিভিন্ন স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা নির্মিত দিল্লির নিকটবর্তী মেহেরৌলি গ্রামের লৌহস্তম্ভ গণিতের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যা, শূন্য ও দশমিকের ব্যবহার প্রভৃতি গুপ্তযুগেরই অবদান।
Leave a comment