ভারতের সংবিধানের চতুর্থ ভাগে ৩৬-৫১ নং ধারায় নির্দেশমূলক নীতি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সেগুলি হল一
[1] আর্থসামাজিক আদর্শ সম্পর্কিত: (i) রাষ্ট্র এমন একটি সমাজব্যবস্থা গঠনে সচেষ্ট হবে যেখানে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে। (ii) রাষ্ট্রীয় নীতি এমনভাবে পরিচালিত হবে যার ফলে一
-
স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিক জীবিকা অর্জনের অধিকার লাভ করবে।
-
স্ত্রী-পুরুষ উভয়ই সমান কাজের জন্য সমান মজুরি পাবে।
-
স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত শ্রমিকের স্বাস্থ্য ও কর্মশক্তি এবং শিশুদের জীবনীশক্তির অপব্যবহার করা হবে না। জনসাধারণের কল্যাণে সম্পদের মালিকানা বণ্টন ও নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
-
সম্পদ ও উৎপাদনের উপাদানগুলি মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকবে না।
(iii) রাষ্ট্র নাগরিকদের জীবনধারণের জন্য উপযুক্ত মজুরি, বিশ্রাম ভােগ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সুযােগসুবিধা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ব্যবস্থা করবে ইত্যাদি।
[2] প্রশাসনিক: (i) স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র গ্রাম পঞ্চায়েত গঠন করে প্রয়ােজনীয় ক্ষমতা অর্পণ করবে। (ii) বিচার বিভাগকে সরকারি প্রশাসন থেকে পৃথক করতে হবে। (iii) সমগ্র ভারতের জনগণের জন্য একইরকম দেওয়ানি আইন প্রবর্তনের চেষ্টা করতে হবে।
[3] উন্নত রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কিত: (i) সংবিধান প্রবর্তিত হওয়ার দশ বছরের মধ্যে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত বালকবালিকাদের অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার জন্য রাষ্ট্র প্রয়াসী হবে। (ii) রাষ্ট্র এমন ব্যবস্থা নেবে যাতে ওষুধের প্রয়ােজন ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে মাদক দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ হয়। (iii) অনুন্নত শ্রেণি, বিশেষ করে তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের অর্থনৈতিক ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিবিধান করার জন্য রাষ্ট্র সচেষ্ট হবে। সামাজিক অন্যায় ও শােষণের হাত থেকে এদের রক্ষা করতে হবে ইত্যাদি। (iv) রাষ্ট্র প্রাকৃতিক পরিবেশের রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নয়নের জন্য সচেষ্ট হবে এবং বন ও বন্যপ্রাণীর রক্ষণাবেক্ষণে উদ্যোগী হবে।
[4] আন্তর্জাতিক: (i) আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার উন্নতি ঘটানাের বিষয়ে রাষ্ট্রকে সচেষ্ট হতে হবে। (ii) জাতিসমূহের মধ্যে ন্যায়সংগত ও সম্মানজনক সম্পর্ক স্থাপনে রাষ্ট্র উদ্যোগী হবে। (ii) আন্তর্জাতিক আইন, সন্ধি ইত্যাদির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করবে। (iv) সালিশির সাহায্যে আন্তর্জাতিক বিরােধের নিষ্পত্তি ঘটানাের বিষয়েও রাষ্ট্র উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণ করবে।
[5] অন্যান্য নীতি: সংবিধানের অন্যান্য অংশে আরও কয়েকটি নির্দেশমূলক নীতি ঘােষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল一
-
(i) ভাষাভিত্তিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করা, সরকার এবং তাদের অধীনস্থ প্রশাসনিক মাধ্যম হিসেবে হিন্দি ভাষা প্রসারে চেষ্টা করা।
-
(ii) যােগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চাকরিতে নিয়ােগের জন্য তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের দাবি বিবেচনা করা ইত্যাদি।
ভারতীয় সংবিধানে ভারতকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ বলে অভিহিত করা হয়েছে। গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য হল জনগণের কল্যাণ সাধন করা। জনসাধারণের কল্যাণের উদ্দেশ্যেই কতকগুলি নির্দেশমূলক নীতিকে ভারতীয় সংবিধানের চতুর্থ অংশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই নীতিপ্ুলিতে শাসনকার্য পরিচালনার সময় শাসকশ্রেণির কর্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এই নির্দেশমূলক নীতিগুলিকে অধিকার বলা হয়। এই নীতিগুলির কতকগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। যেমন一
[1] ইতিবাচক: নির্দেশমূলক নীতিগুলি মৌলিক অধিকারের মতাে রাষ্ট্রের কাজে বাধানিষেধ আরােপ করে না। বরং রাষ্ট্রের কোন্ কোন্ কাজ করা উচিত, সেসম্পর্কে ইতিবাচক নির্দেশ দান করে।
[2] এককভাবে কার্যকর হয় না: নির্দেশমূলক নীতিগুলি নিজে থেকে কার্যকর হতে পারে না। এই নীতিগুলিকে কার্যকর করার জন্য আইন প্রণয়ন করতে হয়। নির্দেশমূলক নীতির জন্য প্রচলিত কোনাে আইনকে উপেক্ষা করা যায় না।
[3] আদালত কর্তৃক বলবযােগ্য নয়: শাসকশ্রেণি এই নীতিগুলিকে অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যায় না। বিভিন্ন মামলায় সুপ্রিমকোর্ট এই রায় দিয়েছে যে নীতিগুলির প্রতি লক্ষ রেখে যাতে আইন প্রণয়ন করা হয় তা দেখা সরকারের কর্তব্য।
[4] নির্দেশমূলক নীতিগুলির জন্য কোনাে আইন প্রণয়ন করা যায় না: সংবিধানে বর্ণিত নির্দেশমূলক নীতিগুলির জন্য কোনাে আইন প্রণয়ন করা যায় না। কারণ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যে তিনটি তালিকা আছে কেন্দ্রীয় তালিকা, রাজ্য তালিকা ও যুগ্ম তালিকা, তার মধ্যে থেকেই আইন প্রণয়ন করতে হয়।
[5] নির্দেশমূলক নীতি বিরােধী আইন বাতিল হয় না: নির্দেশমূলক নীতিগুলি অমান্য করে কোনাে আইন প্রণীত হলেও তা বাতিল হয় না। সুপ্রিমকোর্টের অভিমত হল যে, নির্দেশমূলক নীতিগুলি সরকারের ওপর কোনাে বাধানিষেধ আরােপ করে না। তাই এই নীতিগুলির বিরােধী বলে কোনাে আইনকে বাতিল করা যায় না।
মূল্যায়ন: উপরের আলােচনা থেকে বােঝা যায়, নির্দেশমূলক নীতিগুলিকে নিছক সংবিধানের অলংকার বলেই মনে করা হয়, যা দেখতে ভালাে, কিন্তু কাজের নয়। কারণ রাষ্ট্র কোনােভাবেই কাউকে এগুলি পালনে বাধ্য করতে পারে না।
Leave a comment