রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মতপার্থক্য: রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্যের অন্ত নেই। সেই প্রাচীন গ্রীস থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন মতৈক্য গড়ে ওঠেনি। বস্তুত রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য তার প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। আর রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রসঙ্গেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্তহীন বাদানুবাদ বর্তমান। স্বভাবতই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য সম্পর্কে কোন মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

গ্রীক, রোমান ও মধ্যযুগ: প্রাচীনকালে গ্রীসের প্লেটো (Plato) ও অ্যারিস্টটল (Aristotle)-এর কাছে রাষ্ট্র ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। এর মধ্যেই ব্যক্তিজীবনের পূর্ণতার সন্ধান সম্ভব। এই গ্রীক দার্শনিকদের মতানুসারে ‘সুন্দর ও মঙ্গলময় জীবন প্রতিষ্ঠার জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বর্তমান। রোমান দার্শনিকরা সাম্রাজ্য স্থাপন, আইন প্রণয়ন ও শাসনকার্য পরিচালনার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। মধ্যযুগে রাষ্ট্রকে চার্চের স্বার্থ রক্ষার একটি মাধ্যম হিসাবে দেখা হয়েছে। খ্রীষ্টান ধর্মযাজকদের মতানুসারে রাষ্ট্র ধর্মীয় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার কাজ করে। অর্থাৎ খ্রীষ্টান চিন্তাবিদ্‌গণ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্রের ভূমিকা পর্যালোচনা করেছেন।

হবস, লক ও রুশো: মধ্যযুগের পর রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কিত আলোচনায় উদারনীতিক চিন্তা চেতনার প্রাধান্য শুরু হয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা রাষ্ট্রকে একটি ক্ষতিকর কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখেছেন। চুক্তিবাদী ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস (Thomas Hobbes)-ও অনুরূপ মত পোষণ করেন। তাঁর মতে রাষ্ট্রের কাজ হল শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করা। চুক্তিবাদী জন লক (John Locke) এক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। তাঁর মতে রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য হল মানবসমাজের মঙ্গল সাধন, কিন্তু চরমতম লক্ষ্য হল সংঘবদ্ধ জীবনে সম্পত্তির সংরক্ষণ। ফরাসী দার্শনিক চুক্তিবাদী রুশো (Rousseau)-র মতানুসারে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মঙ্গলময় জীবন সম্ভব করার জন্য।

অ্যাডাম স্মিথ: অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। তিনি রাষ্ট্রের তিনটি মুখ্য উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন: (ক) আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে সমাজকে রক্ষা করা; (খ) সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিকে অন্যায়-অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করা ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করা, এবং (গ) ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় অসম্ভব এমন সব কাজকর্ম সম্পাদন করা এবং জনগণের প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ গঠন ও সংরক্ষণ করা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদিগণের মতানুসারে রাষ্ট্রের মুখ্য উদ্দেশ্য হল শান্তি-শৃঙ্খলা (order) প্রতিষ্ঠা।

বেন্থাম: হিতবাদী বেন্থাম (Jeremy Bentham) ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বলেছেন রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হল ‘সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক মঙ্গলসাধন’ (greatest good of the greatest number)। সমাজসেবা, ন্যায়বিচার প্রভৃতিও রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বলে অনেকে মনে করেন।

বুন্টসলি: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক আলোচনায় রাষ্ট্রকে জনকল্যাণের মাধ্যম হিসাবে মনে করা হয়। জার্মান দার্শনিক ব্লুণ্টস্‌লি (Bluntschli) রাষ্ট্রের দ্বিবিধ উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন: প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। জাতীয় জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ ও জাতীয় সম্প্রসারণ হল রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য। এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা রক্ষা হল রাষ্ট্রের পরোক্ষ উদ্দেশ্য।

উইলোবি, বার্জেস ও গার্ণার: মার্কিন চিন্তাবিদ উইলোবি (Willougby) তিন ভাগে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যকে বিভক্ত করেছেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও চরম। শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা সংরক্ষণ হল প্রাথমিক উদ্দেশ্য; ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপক বিস্তার হল মাধ্যমিক উদ্দেশ্য এবং আর্থনীতিক, মানসিক ও নৈতিক কল্যাণ সাধন হল চরম উদ্দেশ্য। মার্কিন লেখক বার্জেস (Burgess)-এর মতানুসারে রাষ্ট্রের বিবিধ লক্ষ্য হল সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় জীবনের বিস্তার ও মানবজীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ। বার্জেস বলেছেন: “The establishment of good government, the development of national life and the perfection of humanity-these are the triple ends of the state.” অধ্যাপক গার্ণার (Garner) ও রাষ্ট্রের ত্রিবিধ উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন। তাঁর মতে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হল প্রথম উদ্দেশ্য; সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ সাধন ও জাতীয় অগ্রগতি হল দ্বিতীয় উদ্দেশ্য এবং মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে সাহায্য করে বিশ্বজনীন সমৃদ্ধি সাধন হল তৃতীয় উদ্দেশ্য।

ল্যাস্কি ও লিপসন: রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বিচারের ক্ষেত্রে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। ল্যাস্কির মতানুসারে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব জনগণের সর্বাধিক সামাজিক কল্যাণ সাধনের জন্য। মানুষের আচার-আচরণের ঐক্যসাধনের মধ্যে রাষ্ট্রের কার্যাবলী সীমাবদ্ধ। পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও অভিজ্ঞতার উপর রাষ্ট্রের কাজকর্মের পরিধি নির্ভরশীল। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও তার যৌক্তিকতা তার কার্যাবলীর ফলাফলের উপর নির্ভরশীল। ল্যাস্কি বলেছেন: “For citizens, a state is what it does it is not justified merely because it is a state.” লিপসন (Leslie Lipson) রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা রক্ষা, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: “Protection grows into order and order seeks to blossom into justice.”

মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি: মার্কসীয় দর্শন অনুসারে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে। বলা হয় যে, মানবসমাজের ক্রমবিকাশের একটি বিশেষ স্তরে সমাজের শ্রেণী স্বার্থ সংরক্ষণ ও শ্রেণী-শোষণ কায়েম করার জন্য রাষ্ট্রের উদ্ভব। বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রের যৌক্তিকতা নিহিত আছে সমাজের প্রচলিত শ্রেণী-সম্পর্ক বা সম্পত্তি-সম্পর্ক সংরক্ষণের উদ্দেশ্যের মধ্যেই। রাষ্ট্র দাস সমাজে দাসপ্রভুদের, সামস্ত-সমাজে সামস্তপ্রভুদের, ধনতান্ত্রিক সমাজে ধনিক-বণিক শ্রেণীর স্বার্থ সাধনের উদ্দেশ্যে কাজ করেছে। বস্তুত যে-কোন ধনবৈষম্যমূলক শ্রেণীবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হল প্রচলিত শ্রেণী-সম্পর্ক সংরক্ষণ। একমাত্র শ্রেণীহীন, শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল জনগণের ব্যাপক কল্যাণ সাধন। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল সামাজিক স্বার্থের বিরোধী পুঁজিপতি শ্রেণীর পুনরুত্থান প্রতিরোধ এবং সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের অগ্রগতিকে অব্যাহত রাখা।

কাণ্ট (Kant), হেগেল (Hegel) প্রমুখ আদর্শবাদী জার্মান দার্শনিকগণ রাষ্ট্রকেই মূল লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তাঁদের মতে ব্যক্তি হল রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্যের মাধ্যম। এঁদের ধারণা অনুসারে রাষ্ট্রের সার্থকতা তার নিজের মধ্যেই নিহিত আছে। এঁদের আরও অভিমত হল ‘রাষ্ট্রের জন্যই ব্যক্তি, ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয়’ আদর্শবাদী ধারণার সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে ফ্যাসিবাদী চিন্তাবিদ্‌গণ সর্বাত্মক রাষ্ট্রের ধারণা ঘোষণা করেছেন।