রাষ্ট্রের বিরোধিতার অধিকার একটি বিতর্কিত বিষয়: রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নাগরিকের কোন অধিকার আছে কিনা বা থাকা উচিত কিনা এ হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি বহু বিতর্কিত বিষয়। রাষ্ট্র সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী। রাষ্ট্র তাই সাধারণত নাগরিকদের স্বভাবজাত আনুগত্য পেয়ে থাকে। রাষ্ট্রাধীন সকল নাগরিকের আচার-আচরণ রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন সরকারের জনস্বার্থ-বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন প্রভৃতি ঘটনার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে। সরকারের অবাঞ্ছিত ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষ বিদ্রোহ বা বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়। এ হল এক ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু সকল রাষ্ট্রের শাসকমাত্রেই নাগরিকদের নিঃশর্ত এবং অথণ্ড আনুগত্য দাবি করে থাকেন। তাই ‘রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের আনুগত্যের ভিত্তি কি’ এ হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। মধ্যযুগের সমাপ্তি এবং গণতন্ত্র ও অধিকার সংক্রান্ত ধ্যান-ধারণার বিকাশ ও প্রসারের ফলে রাষ্ট্রের বিরোধিতার অধিকারের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম, ফরাসী বিপ্লব প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধিতা ও বিদ্রোহের অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে।

প্লেটো-অ্যারিস্টটল এবং কান্ট ও হেগেল: প্রাচীন গ্রীসের সোফিস্ট (Sophist)-রা রাষ্ট্রের বিরোধিতা করার নাগরিক অধিকারকে স্বীকার করেছেন। কিন্তু প্লেটো ও অ্যারিস্টটল তা সমর্থন করেননি। প্লেটোর মতে সংঘবদ্ধ জীবনেই ব্যক্তির সার্থকতা। এর বিরুদ্ধে ব্যক্তির কোন অধিকার থাকতে পারে না। তবে অপেক্ষাকৃত বাস্তববাদী অ্যারিস্টটল (Aristotle) বিপ্লব ও বিদ্রোহের কারণ ও তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। জার্মান আদর্শবাদী দার্শনিক কাণ্ট ও হেগেল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তির অধিকার স্বীকার করেননি। তাঁরা সর্বাত্মক রাষ্ট্রের কথা বলেছেন এবং রাষ্ট্রের বিরোধিতা করাকে অন্যায় ও অযৌক্তিক বলে ঘোষণা করেছেন। এঁরা রাষ্ট্রের উপর দেবত্ব আরোপ করেছেন এবং একমাত্র রাষ্ট্রের মধ্যে এবং রাষ্ট্রের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের মাধ্যমে ব্যক্তিজীবনের চরম সার্থকতার কথা বলেছেন।

হবস ও লক্: চুক্তিবাদী ইংরেজ দার্শনিক হবস তাঁর Leviathan গ্রন্থে চরম রাজতন্ত্রকে সমর্থন করেছেন। আবার আত্মরক্ষা ও জীবনের অধিকারকে সুনিশ্চিত করার স্বার্থে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করার অধিকারও স্বীকার করেছেন। লকের মতানুসারে ব্যক্তির স্বাভাবিক অধিকার রাষ্ট্র সংরক্ষণ করতে না পারলে, রাষ্ট্রের বিরোধিতা করার অধিকার ব্যক্তির আছে।

গ্রীণ: অনেকের মতে রাষ্ট্র সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী বলে নাগরিকগণ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। আবার অনেকের মতে রাষ্ট্র ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ও বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণ সাধন করে বলে ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের অনুগত থাকতে হয়। আদর্শবাদীদের মতানুসারে রাষ্ট্রের মধ্যেই মানুষ জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্দেশ্য উপলব্ধি ও পূর্ণ পরিণতি লাভ করতে পারে। রাষ্ট্রের আদর্শই চরম ও চূড়ান্ত, সেইজন্য তা অবশ্য পালনীয়। আদর্শবাদী ইংরাজ দার্শনিক টমাস হিল গ্রীণের মতে রাষ্ট্র যদি অন্যায় করে তবে কেবল রাষ্ট্রের মঙ্গলের স্বার্থেই ব্যক্তির কর্তব্য হল রাষ্ট্রের কাজে বাধা দেওয়া। এখানে লক্ষণীয় যে, প্রয়োজনে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণকে গ্রীণ কর্তব্য হিসাবে দেখিয়েছেন, অধিকার হিসাবে স্বীকার করেননি। নাগরিকরা প্রথমে শাসনতান্ত্রিক উপায়ে সাধারণ স্বার্থের বিরোধী রাষ্ট্রীয় আইনকে বাতিল করার চেষ্টা করবে। সুযোগ না থাকলে এবং রাষ্ট্র দুর্নীতিপরায়ণ ও আদর্শভ্রষ্ট হলে নাগরিকের কর্তব্য হল রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা।

রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অধিকার অস্বীকৃত: প্রকৃত প্রস্তাবে ভাববাদী গ্রীণ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রচলিত অর্থে কোন অধিকারের অস্তিত্বকে স্বীকার করেননি। এ প্রসঙ্গে অধিকার সম্পর্কে গ্রীণের ধারণার সংক্ষিপ্ত উল্লেখ আবশ্যক। গ্রীণের মতে সমাজের সকলেই স্ব স্ব কল্যাণ সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করে। নিজের কল্যাণ সাধন সম্পর্কিত এই চিন্তাকে কার্যকর করার জন্য সামর্থ্যের প্রয়োজন। তাই প্রত্যেক নাগরিকের এই সামর্থ্য থাকা আবশ্যক। গ্রীণের মতানুসারে অধিকার বলতে এই সামর্থ্যের স্বীকৃতিকেই বোঝায়। সুতরাং অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়াই হল রাষ্ট্রের দায়িত্ব। গ্রীণের মতে সমাজের সকলে যদি স্ব স্ব কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করে, তা হলে সর্বজনীন কল্যাণ সাধিত হবে। তাঁর মতে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কোন মানুষ তার নিজের কল্যাণ সাধনে সক্ষম হবে না। এর কারণ হল ব্যক্তি মানুষের কল্যাণ অন্য সকলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। গ্রীণের মতানুসারে এক বিশেষ পরিস্থিতি বা মানসিক অবস্থা থেকে অধিকারের আবির্ভাব হয়। সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতি বা মানসিকতাটি হল এই রকম: সমাজের সকল নাগরিক পরস্পরকে স্বীকৃতি জানায় এবং সকলে সর্বজনীন কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করে। গ্রীণের মতে এই সমাজের বিরোধিতা করা ব্যক্তির দিক থেকে পুরোপুরি অযৌক্তিক কাজ। কারণ ব্যক্তি হল সমাজের অংশ এবং ব্যক্তির সকল কল্যাণের পিছনে সমাজের অবদান বর্তমান। ব্যক্তি হল রাষ্ট্রের সদস্য। এবং তাই ব্যক্তি অধিকার ভোগ করতে পারে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ অবস্থায় অধিকারের অস্তিত্ব অসম্ভব। এই কারণে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন রকম অধিকার কারুরই নেই। বস্তুত এ রকম অধিকার হতে পারে না।

বিরোধিতার অধিকার অবাধ নয়: তবে গ্রীণ ভিন্নতর অবস্থার কথাও বলেছেন। ‘রাষ্ট্রের আইন সর্বজনীন কল্যাণ সাধনের জন্য প্রণীত হয়নি, বা সরকারের সিদ্ধান্ত সর্বজনীন কল্যাণের বিরোধী’—এই মর্মে নাগরিকদের মনে দৃঢ় বিশ্বাসের সৃষ্টি হতে পারে। অথবা নাগরিকরা মনে করতে পারে যে রাষ্ট্রীয় আইন সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ। গ্রীণের মতানুসারে এ রকম ক্ষেত্রে নাগরিক সংশ্লিষ্ট আইনের বিরোধিতা করবে। তবে এই বিরোধিতার বিষয়টিকেও গ্রীণ বিবিধ বাধা-নিষেধের দ্বারা সীমাবদ্ধ করেছেন। এই বিরোধিতা হবে অত্যন্ত সংযত। রাষ্ট্রের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যাতে অব্যাহত থাকে সেদিকে নজর রাখতে হবে। তা ছাড়া বিরোধিতা করতে গিয়ে বিপ্লবের ডাক দেওয়া চলবে না। তাঁর মতানুসারে দেশের শাসনতন্ত্রেই জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত ও আইন বাতিল করার বিভিন্ন ব্যবস্থা থাকে; যেমন, গ্রেট ব্রিটেনে আছে। আইনের বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যে এই সমস্ত সাংবিধানিক উপায় পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। কোন অবস্থাতেই আইন অমান্য করা যাবে না বা শান্তি শৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে এমন কোন কাজ করা যাবে না। বিরোধিতা করার সময়েও আইন মান্য করে চলতে হবে; আইনের প্রতি আনুগত্যকে অব্যাহত রাখতে হবে।

ল্যাস্কি: ল্যাস্কির মতে রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণ সাধন করে এবং সেই কারণে রাষ্ট্র নাগরিকদের আনুগত্য দাবি করে। তাঁর অভিমত হল, সার্বভৌম শক্তির ভয়ে নয়, রাষ্ট্রীয় আইন জনকল্যাণ সাধন করে বলেই আমরা তা মান্য করে ঢলি। তিনি বলেছেন: “The commands of the state, therefore, must justify themselves on grounds other than their source in the fiat of a state.” রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের আনুগত্য স্বতঃস্ফূর্ত, শক্তি প্রয়োগের ভয়ে নয়। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করতে না পারলে বা নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা নাগরিকের কর্তব্য হিসাবে গণ্য হবে। ল্যাস্কি বলেছেন: “There are circumstances, in which resistance to the state becomes an obligation if claims to right are to be given validity.”

জনস্বার্থবিরোধী কাজের প্রতিবাদ করার অধিকার আছে: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ও জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদ করার অধিকার নাগরিকদের আছে। এ হল তাদের স্বার্থ বিরোধী বা অধিকারের হানিকর আইন বা ক্রিয়াকলাপ প্রতিরোধ করার অধিকার। এই অধিকারের ভিত্তিতেই নাগরিকগণ অন্যায় ও অবিচারের বিরোধিতা করে। কোন কোন দেশের সংবিধানেই এই প্রতিরোধের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার বা চীনের সংবিধানের সংগঠন-সমাবেশ, মিছিল, ধর্মঘট প্রভৃতির অধিকার উল্লেখযোগ্য।

রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অধিকার হল শেষ অস্ত্র: অবাঞ্ছিত ও জনস্বার্থবিরোধী সরকারী কার্যকলাপের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে নাগরিকদের শাসনতান্ত্রিক বা অন্যান্য পন্থা ব্যর্থ হলে তারা সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে পারে। এই সংগ্রামের সর্বশেষ অস্ত্র হল বিদ্রোহ। ল্যাস্কির মতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ হল অন্যায় অবিচার প্রতিরোধের ক্ষেত্রে নাগরিকদের শেষ অস্ত্র। তিনি বলেছেন: “Resistance ought always, form the cost it involves to be a weapon of last instance.”

গান্ধীজী: মহাত্মা গান্ধী নাগরিকদের বিরোধিতার অধিকারকে নৈতিক অধিকার হিসাবে স্বীকার করেছেন। তাঁর মতে রাষ্ট্রযন্ত্র যদি বিকৃত হয় এবং জনসাধারণের অধিকারের পরিপন্থী হয়, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরোধিতা করা হল জনগণের পবিত্র অধিকার। তবে এই আন্দোলন হবে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ও অহিংস।

মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি: মার্কসবাদ অনুসারে শ্রেণীবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রের বিরোধিতা করার অধিকার অপরিহার্য। সমাজের উৎপাদন কাঠামোই হল বনিয়াদ। এর উপর ভিত্তি করে রাজনীতিক ও আইনগত উপরিকাঠামো তথা রাষ্ট্রের চরিত্র গড়ে ওঠে। রাষ্ট্র তার পুলিশ, আইন, আদালত সবকিছুই এক শ্রেণীকে শোষণ করার উদ্দেশ্যে অন্য শ্রেণীর স্বার্থে ব্যবহার করে। এ রকম বৈষম্যমূলক বা শ্ৰেণীবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের স্বার্থ রক্ষা ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করার অধিকারকে অস্বীকার করা যায় না। শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রকে পরাস্ত করার জন্য সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লব দরকার। মার্কসবাদ অনুসারে এই বিপ্লব হল নতুন সৃষ্টির এক মহান উৎসব, একে হিংসাত্মক তাণ্ডব বলা যায় না। শ্রেণী-বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেণীহীন, শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদন উপাদান ও আর্থনীতিক ব্যবস্থার উপর সমষ্টি বা সমাজের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। উৎপাদন-সম্পর্ক হয় সমাজভিত্তিক। এই পরিস্থিতিতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যক্তির পরিপূর্ণ বিকাশের সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলে। তখন বিরোধিতার অধিকারের আর কোন প্রয়োজন থাকে না।