রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ক মতবাদগুলির মধ্যে ভাববাদী তত্ত্ব হল সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। এই মতবাদের যাবতীয় বক্তব্য কতকগুলি দার্শনিক ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে ভাববাদী তত্ত্বের মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক।

(১) রাষ্ট্রে দেবত্ব আরোপ: ভাববাদী তত্ত্বের প্রবক্তারা রাষ্ট্রের উপর দেবত্ব আরোপ করেছেন। রাষ্ট্র হল আধ্যাত্মিক যুক্তির প্রতীক ও প্রকাশ। এ হল এক স্বর্গীয় সংগঠন। টমাস হিল গ্রীন-এর অভিমত অনুসারে রাষ্ট্র হল এক অনন্ত চেতনা (Eternal conciousness)-র অভিব্যক্তি। এই অনন্ত চেতনা বলতে ঈশ্বরকে বোঝায়। সুতরাং পৃথিবীতে ঈশ্বরের উপলব্ধি রাষ্ট্রের মাধ্যমেই সম্ভব। কান্ট ও হেগেল এই দুই জার্মান দার্শনিকের মতানুসারে রাষ্ট্র হল পৃথিবীতে ঈশ্বরের পদক্ষেপ। এইভাবে রাষ্ট্রের উপর আধ্যাত্মিকতা আরোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রাপ্ত। রাষ্ট্র হল ঐশ্বরিক গুণসম্পন্ন পবিত্র সংগঠন (“The State is the Divine Idea as it exists on earth.”)।

(২) ঈশ্বর রাষ্ট্রের স্রষ্টা: ভাববাদী তত্ত্বের প্রবক্তারা রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত সামাজিক চুক্তি মতবাদকে অস্বীকার করেছেন। তাঁদের মতানুসারে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা। রাষ্ট্র হল ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট এক স্বর্গীয় প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র মানুষের সৃষ্টি নয়। ভাববাদে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি। 

(৩) নৈতিকতার প্রতীক: ভাববাদী রাষ্ট্র-দার্শনিকদের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্র হল একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান। এ হল নৈতিক শক্তির প্রতীক ও নৈতিকতার এক মূর্ত প্রকাশ। রাষ্ট্রনৈতিক শক্তির ভিত্তিতে গঠিত এবং নৈতিক সত্তাসম্পন্ন।

(৪) রাষ্ট্রের উপর ব্যক্তিসত্তা আরোপ: ভাববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে রাষ্ট্র হল একটি প্রকৃত ব্যক্তিত্ব। এবং এই কারণে এর একটি প্রকৃত ইচ্ছা আছে। ভাববাদীদের মতে রাষ্ট্রের ব্যক্তিত্ব, ইচ্ছা ও জীবন আছে। এবং ব্যক্তিবর্গের জীবন, ব্যক্তিত্ব ও ইচ্ছা থেকে রাষ্ট্রের জীবন, ব্যক্তিত্ব ও ইচ্ছা হল আলাদা। জার্মান দার্শনিক হেগেল রাষ্ট্রে স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা আরোপ করেছেন। তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্র হল সচেতন নৈতিক আদর্শসম্পন্ন এক ব্যক্তি। এর আত্মজ্ঞান আছে এবং আত্মোপলব্ধির ক্ষমতা আছে। এ প্রসঙ্গে হেগেলের অভিমত হল “…a self conscious ethical substance and self-knowing and self actualising individual.” জোড-এর মতানুসারে নিজেই রাষ্ট্র হল এক ও অদ্বিতীয়। এ হল বৃহত্তম ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব। রাষ্ট্র নামক ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের বাইরে অন্য কোন ব্যক্তির পৃথক সত্তা বা অস্তিত্ব অসম্ভব। রাষ্ট্রের নিজস্ব অধিকার আছে। এই অধিকার চরম ও অলঙ্ঘনীয়।

(৫) রাষ্ট্র সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রতীক: ভাববাদী রাষ্ট্র-দার্শনিকদের মতানুসারে রাষ্ট্র হল সমষ্টিগত ইচ্ছা (General will)-র প্রতীক। সমষ্টিগত ইচ্ছা হল অভ্রান্ত ও যুক্তিসঙ্গত এবং সামাজিক কল্যাণের প্রতীক। এই সমষ্টিগত ইচ্ছা বলতে ব্যক্তিবর্গের ইচ্ছাসমূহের সমষ্টিকে বোঝায় না। এ হল সকল ব্যক্তির প্রকৃত ইচ্ছা (real will) বা সর্বোৎকৃষ্ট ইচ্ছার সমষ্টি। সমাজের সকলের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে প্রকৃত ইচ্ছাকে নিয়ে গঠিত হয় সমষ্টিগত ইচ্ছা। ল্যাস্কি তাঁর The State in Theory and Practice শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “…the state, is the institutional embodiment of the real wills of all….” জোড তাঁর Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন যে, ব্যক্তির ইচ্ছার সর্বোৎকৃষ্ট উপাদান এই সমষ্টিগত ইচ্ছার মধ্যে নিহিত আছে। সমষ্টিগত ইচ্ছার উদ্দেশ্য হল সমাজের কল্যাণ সাধন করা। একেই বলে অভিন্ন কল্যাণ বা সাধারণের কল্যাণ (common good)। সমাজের অভিন্ন কল্যাণ সাধনের লক্ষ্য সমষ্টিগত ইচ্ছার মধ্যেই বর্তমান থাকে। জোডের মতানুসারে সমষ্টিগত ইচ্ছার মাধ্যমে নিজের ইচ্ছাকে প্রকাশিত করে ব্যক্তির চিন্তার সর্বোচ্চ বিকাশসাধন সম্ভব। ব্যক্তি সমষ্টিগত ইচ্ছার মাধ্যমে নিজের সর্বোৎকৃষ্ট ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে। রাষ্ট্রের সকল কাজকর্ম ও সিদ্ধান্তের উৎস হল সমষ্টিগত ইচ্ছা। এই কারণে রাষ্ট্রের সকল কাজ ও সিদ্ধান্তের পিছনে সমষ্টিগত ইচ্ছার সমর্থন বর্তমান থাকে। সুতরাং রাষ্ট্রের সকল সিদ্ধান্ত ও কাজকর্ম হল যুক্তিসঙ্গত ও অভ্রান্ত।

(৬) স্বাধীনতার ভাববাদী ব্যাখ্যা: ভাববাদী তত্ত্বের প্রবক্তাদের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা পৃথক প্রকৃতির। উদারনীতিবাদ বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবক্তাদের মত ভাববাদীদের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা নেতিবাচক নয়। তাঁরা বিধিনিষেধের অনুপস্থিতিকে স্বাধীনতার সারবস্তু বলে স্বীকার করেন না। স্বাধীনতা উপলব্ধির জন্য উন্নত ও মুক্ত চিন্তার দ্বারা পরিচালিত হওয়া দরকার। ব্যক্তির আত্মোপলব্ধি যার সাহায্যে সম্ভব হয় তাকেই বলে স্বাধীনতা। সুতরাং স্বাধীনতা সম্পর্কিত ভাববাদীদের ধারণা ইতিবাচক। ভাববাদ অনুসারে ব্যক্তির নৈতিক বিকাশ এবং স্বাধীনতা ভোগ একমাত্র রাষ্ট্রের মধ্যেই সম্ভব। হেগেলের মতানুসারে রাষ্ট্র ছাড়া স্বাধীনতা ভোগ করা যায় না। ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতার উৎস হল রাষ্ট্র। তাই একমাত্র রাষ্ট্রের মধ্যেই, রাষ্ট্রের নির্দেশ পালনের মাধ্যমে এবং রাষ্ট্রের ইচ্ছার অনুবর্তী হয়ে ব্যক্তি তার সত্তার বিকাশ সাধন করতে পারে। এইভাবে স্বাধীনতা ভোগ ও ব্যক্তির আত্মোপলব্ধি সম্ভব হয়। হেগেলের অভিমত অনুসারে ব্যক্তি তার প্রকৃত ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত হয়ে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। রাষ্ট্রই হল প্রকৃত ইচ্ছার পরিপূর্ণ প্রকাশ এবং রাষ্ট্রের মধ্যেই প্রকৃত ইচ্ছা বিধৃত থাকে। অতএব রাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে ব্যক্তি প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে (“Nothing short of the state is the actualisation of freedom.”)। রাষ্ট্র হল ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতার সংরক্ষক। ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ও ব্যক্তির আত্মোপলব্ধির পরিস্থিতি রাষ্ট্র প্রস্তুত করে। তাই ব্যক্তি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে ব্যক্তির কল্যাণ সুনিশ্চিত হয়। এবং এইভাবে সার্বজনীন কল্যাণসাধনও সুনিশ্চিত হয়। ভাববাদীদের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রীয় আইন হল বিশুদ্ধ যুক্তির প্রকাশ বা প্রতিফলন। এই রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি ব্যক্তি আনুগত্য প্রকাশ করে স্বাধীনতা ভোগ করে।

(৭) রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির বিরোধ নেই: ভাববাদী রাষ্ট্র-দার্শনিকদের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির কোন বিরোধ নেই। রাষ্ট্র হল ব্যক্তির স্রষ্টা ও সংরক্ষক। রাষ্ট্র-বিরোধী কোন অধিকার ব্যক্তি ভোগ করতে পারে না। ব্যক্তির যাবতীয় অধিকারের উৎস ও অভিভাবক হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত অধিকারই হল যথার্থ অধিকার। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের স্বাধীন ও পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনই হল রাষ্ট্রের মুখ্য উদ্দেশ্য। সুতরাং রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির কোন বিরোধ থাকতে পারে না। একই কারণে রাষ্ট্র-বিরোধী কোন অধিকারের অস্তিত্বও অসম্ভব। আর্নেস্ট বার্কার তাঁর Principles of Social and Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “the idealists starts from a central social system, in which the individual must find his appointed orbit of duty.”

(৮) রাষ্ট্রের স্থায়ী উদ্দেশ্য বর্তমান: ভাববাদী তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতানুসারে রাষ্ট্রের স্থায়ী উদ্দেশ্য আছে। এই সমস্ত স্থায়ী রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্যের মধ্যেই ব্যক্তিবর্গের প্রকৃত ইচ্ছা (real will) বর্তমান থাকে। স্বাধীনতা ভোগ ও আত্মোপলব্ধির জন্য রাষ্ট্রের ঘোষিত স্থায়ী উদ্দেশ্যসমূহের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন অপরিহার্য। এইভাবেই ব্যক্তির পক্ষে স্বাধীনতা ভোগ ও ব্যক্তিসত্তার বিকাশ সম্ভব। স্বাধীনতার উপলব্ধি বা সর্বোৎকৃষ্ট সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের ঘোষিত স্থায়ী উদ্দেশ্যগুলিকে উপেক্ষা করবে না, সম্পূর্ণরূপে মান্য করে চলবে।