ভাববাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে কর্তৃত্ববাদের উদ্ভব ও বিকাশ: কর্তৃত্ববাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি হল রাষ্ট্রের ভাববাদী তত্ত্ব। ভাববাদী রাষ্ট্র-দর্শনের তাত্ত্বিক পরিমণ্ডল কর্তৃত্ববাদের উদ্ভবের উপযুক্ত। কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার সৃষ্টি হয় ভাববাদী রাষ্ট্র-দর্শনের পটভূমিতে। ভাববাদ হল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব সম্পর্কিত চরমবাদ (absolutism)। সমালোচকদের মতানুসারে এ হল স্বৈরবাদ। ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে রাষ্ট্র হল চরম ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্র এই চরম ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এবং রাষ্ট্রের এই চরম ক্ষমতা হল সম্পূর্ণ বৈধ। রাষ্ট্র নাগরিকদের উপর চরম ক্ষমতা বা স্বৈরী ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। রাষ্ট্রের এই স্বৈরাচারী ক্ষমতার বিরুদ্ধে কোন রকম বাধা আসতে পারে না। কারণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদী ক্ষমতার অস্তিত্বকে ভাববাদী তত্ত্বে স্বীকার করা হয়নি।
রাষ্ট্রের ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রশ্ন ওঠে না: হেগেল প্রমুখ ভাববাদীদের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্র হল সার্বজনীন চেতনাযুক্ত। রাষ্ট্র সর্বোচ্চ যুক্তি, নৈতিকতা ও সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রতীক। এবং রাষ্ট্রীয় আইন হল এই সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রকাশ। প্রত্যেক ব্যক্তির প্রকৃত ইচ্ছা এই সমষ্টিগত ইচ্ছার অন্তর্ভুক্ত। এই সমষ্টিগত ইচ্ছা এবং নাগরিকদের প্রকৃত ইচ্ছার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সুতরাং আইনের প্রয়োগকর্তা এবং আইন যাদের উপর প্রযুক্ত হচ্ছে এই দুই পক্ষের প্রকৃত ইচ্ছার মধ্যে পার্থক্য নেই। অতএব রাষ্ট্রের কাজকর্মের বিরুদ্ধে কোন রকম প্রতিবাদের প্রশ্ন উঠে না। জোড় তাঁর Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “… over whom it exercises authority are not different from those who exercise it, and its decress are inspired by the real wills of those who obey them, even when they obey unwillingly.”
বিরোধিতার অধিকার অস্বীকৃত: জার্মান ভাববাদী দার্শনিক হেগেল-এর মতানুসারে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করার অর্থ হল প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তির প্রকৃত ইচ্ছার বিরোধিতা করা। হেগেলের এই বক্তব্যের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী তত্ত্বের ধারণা নিহিত আছে। ইংরেজ ভাববাদী দার্শনিক বোসাংকেত (Bosanquet) ও অনুরূপভাবে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র যে-কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এবং রাষ্ট্র এককভাবে সকল পরিস্থিতির পর্যালোচনা করতে এবং তদনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এই বক্তব্যের মধ্যেও কর্তৃত্ববাদের প্রতিধ্বনি স্পষ্ট।
রাষ্ট্রের সর্বশক্তিমত্তা: যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা প্রয়োগের পথে কোন বাধা থাকে না। রাষ্ট্র যে সর্বশক্তিমান তা জরুরী অবস্থায় স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়। সংকটকালীন অবস্থায় রাষ্ট্রের সর্বশক্তি মত্তা বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তখন অন্য কোন বা কারও মতের কোন রকম গুরুত্ব থাকে না।
কর্তৃত্ববাদের ধারণা
চরম ক্ষমতা এ কর্তৃত্বের উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য: চরম ক্ষমতা করায়ত্ত করা এবং সেই ক্ষমতাকে রক্ষা করা কর্তৃত্ববাদের মূল কথা। চরম ক্ষমতার উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য হল কর্তৃত্ববাদের মূল বিষয়। কর্তৃত্ববাদ অনুসারে চরম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কোন বিশেষ ব্যক্তি, কতিপয় ব্যক্তি বা কোন দলের হাতে থাকতে পারে না। যার বা যাদের হাতে এই চরম রাজনীতিক ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে সে বা তারা হল শাসক। সংশ্লিষ্ট শাসক, শাসকগোষ্ঠী বা শাসকদলের ইচ্ছাই হল আইন। আইন ও শাসন সম্পর্কে শাসক ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দল নিজের মতবাদ গড়ে তোলে। কর্তৃত্ববাদ অনুসারে আইনের বৈধতা সম্পর্কে কোন রকম ক্ষমতা বা অধিকার অস্বীকৃত। আবার ক্ষেত্রবিশেষে এ ব্যাপারে সীমাবদ্ধ ক্ষমতা তত্ত্বগতভাবে স্বীকার করা হলেও, সেই ক্ষমতার প্রয়োগ যোগ্যতা থাকে না। রাজনীতিক বিরোধিতার অধিকার কর্তৃত্ববাদে অস্বীকৃত। কর্তৃত্ববাদ অনুসারে রাজনীতিক বিরোধিতা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসাবে পরিগণিত হয়। এবং এ জাতীয় কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর পীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় এবং দমন করা হয়।
জনগণের ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্ব অস্বীকৃত: কর্তৃত্ববাদ অনুসারে দেশের নাগরিকরা দুটি সুস্পষ্ট ভাগে বিভক্ত থাকে। এই দুটি ভাগ হল শাসক ও শাসিত। এখানে শাসিত জনগণের মতামতকে কোন রকম গুরুত্ব দেওয়া হয় না। জনগণের রাজনীতিক সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়। জনগণের উপর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় শাসক বা গোষ্ঠী নিজেদের রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিপন্ন করে। শাসক বা সরকার ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোন রকম পার্থক্য করা হয় না। ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাজনীতিক ক্ষমতা অর্জনের পথে অন্য কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রচেষ্টার পথে প্রতিরোধ সৃষ্টির জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করে। চরম ক্ষমতা কর্তৃত্বের উপর একচেটিয়া ও নিরঙ্কুশ আধিপত্যকে অব্যাহত রাখার জন্য শাসক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সতত সক্রিয় থাকে।
কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্য: কর্তৃত্ববাদের কতকগুলি নীতি বা বৈশিষ্ট্যের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। কর্তৃত্ববাদ অনুসারে জনগণের উপর শাসক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সামগ্রিক ও নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হয়। চরম রাজনীতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উপর শাসকের অবাধ অধিকারের কথা বলা হয়। শাসকের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন ও আনুগত্যের উপর জোর দেওয়া হয়। শাসকের কর্তৃত্বকে সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনমত রাজনীতিক মতাদর্শ ও তাত্ত্বিক ভিত্তি গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হয়। শাসক সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ স্বার্থের অনুকূলে তাত্ত্বিক সমর্থন সংগঠিত করা হয়। অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, শিক্ষা-দীক্ষা প্রভৃতি সব কিছুকেই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে নিয়ে আসা হয়। গণমাধ্যমসমূহ শাসকের কুক্ষিগত থাকে এবং সরকারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় স্বাধীনভাবে জনগণের মতামত প্রকাশের উপর কঠোর সরকারী নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। শাসক বা শাসকদলের বিরোধী সকল রাজনীতিক শক্তিকে নির্মূল করার ব্যবস্থা করা হয়।
কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার একাধিক রূপ: চরম রাজনীতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্যের দাবি হল কর্তৃত্ববাদের মূল কথা। যে সমস্ত সরকারের মধ্যে এই দাবি বর্তমান থাকে সেই সমস্ত সরকারই হল কর্তৃত্ববাদী সরকার। সুতরাং কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থার মধ্যে থাকতে পারে। অর্থাৎ কতকগুলি শাসনব্যবস্থার এক বর্ণনাম হল কর্তৃত্ববাদ। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থার মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য বড় একটা থাকে না। প্রকৃত প্রস্তাবে কর্তৃত্ববাদ বলতে কোন নির্দিষ্ট বা একক রাজনীতিক ব্যবস্থাকে বোঝায় না। কর্তৃত্ববাদের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থার মধ্যে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা বর্তমান থাকে। যাইহোক নিম্নলিখিত সরকারী ব্যবস্থাসমূহ কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা হিসাবে বিবেচিত হয়। এগুলি হল একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সামগ্রিকতাবাদ প্রভৃতি। আবার উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার সৃষ্টি হতে পারে এবং হয়ও। এই রকম কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাকে শাসনতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র বলে। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন কারণে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার সৃষ্টি হতে পারে এবং শাসনতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হতে পারে। প্রথমেই উল্লেখ করা দরকার যে দেশের আইনসভায় কোন একটি রাজনীতিক দলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে সেই দল নিরঙ্কুশ রাজনীতিক কর্তৃত্বের অধিকারী হয়। এই অবস্থায় বিরোধী দল দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় হলে ক্ষমতাসীন দলের সামনে কোন কার্যকর রাজনীতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে না। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাসীন দল শাসন ও বিচার-বিভাগের যাবতীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগী হয়। জনগণের সামনে একটি মনগড়া রাজনীতিক মতাদর্শের দেওয়াল খাড়া করে ক্ষমতাসীন দলটি অবাধ রাজনীতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়। শাসকদল সব রকম রাজনীতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিরোধী মতামতকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। গণমাধ্যমগুলিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জরুরী অবস্থা সম্পর্কিত সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থার অতিপ্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ করা হয়। ব্যক্তিবর্গের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা পদদলিত হয়। আইনের অনুশাসন অপসারিত হয় এবং ক্ষমতাসীন দলের স্বৈরী শাসন কায়েম হয়। কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার জন্য জনগণের রাজনীতিক দাবি-দাওয়াকে উপেক্ষা করা হয়। চরম রাজনীতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্যকে অব্যাহত রাখার জন্য শাসকদল যে-কোন উপায় ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পিছপা হয় না।
Leave a comment