রাষ্ট্র শ্রেণী-শোষণের হাতিয়ার – রাষ্ট্রের উৎপত্তি:

মার্কসীয় চিন্তাধারা অনুসারে রাষ্ট্র হল বল বা শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি কৃত্রিম প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের উদ্ভব, প্রকৃতি ও ভূমিকা শ্রেণী ও শ্রেণী-সংগ্রামের মধ্যে নিহিত আছে। রাষ্ট্র কোন চিরন্তন প্রতিষ্ঠান নয়। আদিম অবস্থায় সমাজব্যবস্থা ছিল রাষ্ট্রহীন। পরবর্তীকালে ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধ, পরস্পর-বিরোধী স্বার্থসম্পন্ন শ্রেণী ও শ্রেণী-সংগ্রাম সৃষ্টি হওয়ায় প্রয়োজনবোধের তাগিদে রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়েছে। মার্কস সমগ্র বিষয়টি আর্থনীতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করেছেন। বিত্তবান বা ক্ষমতাবান শ্রেণী নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে পশুশক্তির ভিত্তিতে রাষ্ট্র নামক সংগঠন সৃষ্টি করেছে। সুতরাং রাষ্ট্র হল শ্রেণীস্বার্থের ধারক ও বাহক এবং কেন্দ্রীভূত পশুশক্তির প্রকাশ। মার্কসীয় ধারণা অনুসারে রাষ্ট্র হল শ্রেণী-শাসনের প্রতীক এবং একটি শ্রেণী কর্তৃক অন্য শ্রেণীকে শোষণ করার যন্ত্রবিশেষ। লেনিনের কথায়: “…the state is an organ of class rule, an organ for the oppression of one class by another.” রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে এঙ্গেলসের অভিমতও প্রণিধানযোগ্য। তাঁর কথায়: “The means of subduing and exploiting the oppressed masses.”

মার্কসবাদ অনুসারে পৃথিবীতে যখন আদিম সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত ছিল তখন শোষণ ছিল না; তাই শোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রও ছিল না। ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধ জাগ্রত হওয়ার ফলেই শোষণের সূত্রপাত ঘটে। সমাজের যে শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হল সেই শ্রেণী স্বীয় ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য এবং শোষণ অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের সৃষ্টি করল। এঙ্গেলস্ বলেছেন: “The state has not existed from all eternity. There has been societies which have managed without it…. At a definite stage of economic development which necessarily involved the cleavage of society into classes. the state became a necessity because of this cleavage.” মার্কসের মতানুসারে রাষ্ট্রের প্রকৃতি সমাজের আর্থনীতিক কাঠামোর উপর নির্ভরশীল।

শ্রেণী-সমাজে রাষ্ট্রের প্রকৃতি পীড়নমূলক ॥ ‘রাষ্ট্র শ্রেণী-শোষণের হাতিয়ার’ মার্কসীয় দর্শনের এই ধারণার পরিচয় পাওয়া যায় The German Ideology এবং Communist Manifesto শীর্ষক গ্রন্থ দুটি থেকে। বুর্জোয়া দার্শনিকদের বক্তব্য হল রাষ্ট্র সমগ্র সমাজের ‘অছি’ (trustee) বা প্রতিনিধি। মার্কস এঙ্গেলস এই বক্তব্যকে বাতিল করে দিয়েছেন। শ্রেণী-সমাজে সমগ্র সমাজের ট্রাস্টি হিসাবে রাষ্ট্রের কথা বলা নিতান্তই অর্থহীন। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্র সকল শ্রেণীর আস্থাভাজন ট্রাস্টি হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে না। রাষ্ট্র হল শ্রেণীশোষণের একটি হাতিয়ার মাত্র। এর অধিক কোন মর্যাদা রাষ্ট্রের থাকতে পারে না। সম্পত্তিবান শ্রেণী তাদের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তুলেছে। এই প্রতিষ্ঠানটির মূল কাজ হল বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থকে নিরাপদ করা। সার্বভৌম একটি সংগঠন হিসাবে রাষ্ট্রের কোন স্বতন্ত্র সত্তা নেই। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব শ্রেণীসংগ্রামের ঊর্ধ্বে নয়, বা রাষ্ট্রের ভূমিকা পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে নয়। রাষ্ট্র শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র। প্রধানত আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্স—এই তিনটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের পীড়নমূলক প্রকৃতির কথা বলা হয়েছে। শ্রেণী-সমাজে রাষ্ট্রের প্রকৃতি পীড়নমূলক।

ত্রিবিধ যুক্তি:

রাষ্ট্রের এই পীড়নমূলক প্রকৃতির বিষয়টি তিনটি দিক থেকে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। (১) শ্রেণীবিভক্ত সমাজে উৎপাদনের উপাদানসমূহ পুঁজিপতিদের মালিকানাধীন। তারাই এগুলিকে প্রয়োজনমত ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করে। পুঁজিপতিরাই দেশের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিদ্যমান আর্থনীতিক ব্যবস্থার উপর পুঁজিপতিদের এই নিয়ন্ত্রণ নিশ্ছিদ্র। আর্থনীতিক ক্ষমতা সূত্রে বুর্জোয়ারাই রাষ্ট্র যন্ত্রটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং নিজেদের স্বার্থেই ব্যবহার করে। (২) দেশের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগীয় কাজকর্মে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে সরকার গঠিত হয়। এই সমস্ত সরকারী ব্যক্তিবর্গ সাধারণত অভিন্ন একটি আর্থ-সামাজিক অবস্থা থেকে আসেন। তাঁদের আর্থ-সামাজিক পটভূমি ও দৃষ্টিভঙ্গি মোটামুটি অভিন্ন। পরিণত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শাসক শ্রেণীর মানুষেরাই হলেন পুঁজিবাদের পৃষ্ঠপোষক। স্বভাবতই তাঁরা রাষ্ট্রকে শ্রেণী-স্বার্থের সংরক্ষণ ও শোষণ-পীড়নের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন। (৩) আবার ভিত্তি উপরিসৌধের ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রকে উপরিসৌধ হিসাবে গণ্য করা যায়। পুঁজিবাদী আর্থনীতিক ব্যবস্থা হল ভিত্তি। রাষ্ট্রব্যবস্থা তার ভিত্তির প্রভাব বা বাধ্যবাধকতাকে উপেক্ষা করতে পারে না। এ হল কাঠামোগত বাধ্যবাধকতা। স্বভাবতই রাষ্ট্রকে বুর্জোয়াদের স্বার্থের সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হয়।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্কস-এঙ্গেলস সমাজবিকাশের চারটি স্তরের কথা বলেছেন 

  • (১) আদিম সাম্যবাদী সমাজ, 

  • (২) দাস-সমাজ, 

  • (৩) সামন্ততান্ত্রিক সমাজ এবং 

  • (৪) ধনতান্ত্রিক সমাজ।

আদিম সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, তাই কোন শ্রেণী বা শ্রেণী-শোষণ ছিল না। শোষণ ছিল না বলেই শোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রও ছিল না।

দাস-সমাজের রাষ্ট্র:

উৎপাদন ক্ষেত্রের প্রসার, উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতি, উদ্বৃত্ত উৎপাদন, সঞ্চয়, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, আর্থনীতিক অসাম্য, শোষণ প্রভৃতিকে অনুসরণ করেছে দাস-ব্যবস্থা। দাস-সমাজে দাস সমেত সকল উৎপাদন উপাদান এবং উৎপন্ন সামগ্রীর মালিক হল পরশ্রমভোগী দাস-প্রভুরা। দাস-সমাজ দাস-মালিক ও দাস বা শোষক ও শোষিত এই দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত। সমাজবিকাশের এই স্তরেই শ্রেণী শাসন ও শ্রেণী-শোষণের সূত্রপাত হয় এবং শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস শুরু হয়। তার ফলে এই স্তরেই শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। এই রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হল দাস-সমাজের উৎপাদন সম্পর্ককে বজায় রাখা। রাষ্ট্র তার কর্তৃক বজায় রাখার জন্য সৃষ্টি করে এক শ্রেণীর সশস্ত্র বাহিনী।

সামন্ত সমাজের রাষ্ট্র:

দাস-ব্যবস্থার পরিণতি হিসাবেই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটেছে। সামন্ত সমাজ ভূ-স্বামী ও ভূমিদাস— এই দুই পরস্পর বিরোধী শ্রেণীতে বিভক্ত। মুষ্টিমেয় ভূ-স্বামী বা সামন্তপ্রভুরা হল পরশ্রমভোগী বিলাসী শোষক। এরা বিপুল সংখ্যক কৃষক ভূমিদাসকে শোষণ করে। উৎপাদন-উপাদান এবং উৎপন্ন সামগ্রীর মালিকানা সামন্তপ্রভুদের হাতেই থাকে। তবে কৃষক ভূমিদাসদের উপর সম্পূর্ণ মালিকানা ছিল না এবং উৎপাদনের উপরও কৃষকদের আংশিক অধিকার স্বীকৃত ছিল। এই সময় শ্রেণীসংগ্রামের তীব্রতা ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। কৃষক ভূমিদাসদের উপর আধিপত্য বজায় রাখা এবং শোষণ কায়েম করার যন্ত্র হিসাবে সামন্তপ্রভুরা রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে।

পুঁজিবাদী সমাজের রাষ্ট্র:

শিল্প বিপ্লবের পরই ধনতন্ত্রের সাড়ম্বর আবির্ভাব ঘটে। ধনতন্ত্রে উৎপাদনের উপকরণগুলির মালিকানা পুঁজিপতিদের হাতে থাকে। উৎপাদনের সকল কার উপাদান থেকে শ্রমিক শ্রেণী বঞ্চিত। আপাতদৃষ্টিতে শ্রমিক সম্প্রদায় মুক্ত ও স্বাধীন হলেও, সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় জীবনধারণের জন্য তারা পুঁজিপতিদের কাছে শ্রম-শক্তি বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। মালিক শ্রেণী শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে এবং উদ্বৃত্ত ভোগ ও শ্রমিকশোষণ কায়েম করে। সমাজবিকাশের এই স্তরে সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর উপর পুঁজিপতিদের শোষণকে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র-যন্ত্র ব্যবহৃত হয়।

সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র:

ক্রমাগ্রসরমান ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা এক সময় অতি-উৎপাদনের সংকটের মধ্যে পড়ে। শোষক পুঁজিপতির এবং শোষিত শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে শ্রেণী-সংগ্রাম ক্রমশ তীব্রতর হতে থাকে এবং এক সময় বিপ্লবের মাধ্যমে ধনতন্ত্রের পতন ও সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে। সমাজতন্ত্র হল ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় উত্তরণের একটি মধ্যবর্তী পর্যায়। এই পর্যায়ে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতা এই সর্বহারা শ্রেণীর দখলে থাকে। সমাজতান্ত্রিক আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ, তাদের সমাজতান্ত্রিক চেতনা বৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক জীবনের উন্নয়ন, গণ-শিক্ষা প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচী বাস্তবায়নে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রযুক্ত হয়। এই পর্যায়ে উৎপাদনের উপাদানগুলির উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ করে সমাজের সম্পদ সামগ্রীর ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের মাধ্যমে সমষ্টির সামগ্রিক কল্যাণ সাধনই হল সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য। সমষ্টির স্বার্থেই উৎপাদন-ব্যবস্থা ও শিল্প-বাণিজ্য রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত হয়। এখানে কোন পরশ্রমভোগী শোষক শ্রেণী থাকে না। তাই ব্যক্তিগত মুনাফার প্রশ্ন এখানে নেই। তবে এই পর্যায়েও শ্রেণী-সংঘর্ষের পরিপূর্ণ অবসান ঘটেনি। ক্ষমতাচ্যুত শোষকশ্রেণী প্রতি-বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা পুনর্দখলের চেষ্টা করতে থাকে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই প্রতি-বিপ্লব দমন করে শ্রমিক শ্রেণীর অর্জিত সুনামগুলিকে সংরক্ষণের চেষ্টা করে। তাই এই পর্বেও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রয়োজন আছে। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রক্ষমতা সর্বহারা শ্রেণীর করায়ত্ত থাকে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বুর্জোয়া শ্রেণীর ধ্বংস এবং সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যে নিযুক্ত থাকে। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি ও প্রাধান্য অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। সর্বপ্রকার শোষণের অবলুপ্তি এবং সামগ্রিক আর্থনীতিক উন্নয়ন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সাম্যবাদী সমাজে পূর্ণ পরিণতি লাভ করে। সাম্যবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদন, বিজ্ঞান প্রযুক্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রভৃতির সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধিত হয়। তার ফলে উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। প্রত্যেকে প্রয়োজনমত ভোগ করার সুযোগ পাবে। প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুসারে কাজ করবে এবং প্রয়োজন অনুসারে ভোগ করবে। এখানে কোন রকম শ্রেণী-বৈষম্য থাকবে না। সম্পূর্ণ সাম্যবাদী ব্যবস্থায় সমাজ হবে শ্রেণীহীন এবং শোষণশূন্য। সুতরাং এই পর্যায়ে শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র হিসাবে পরিচিত রাষ্ট্রের আর কোন প্রয়োজন থাকবে না। ফলে রাষ্ট্র আপনা থেকেই উবে যাবে।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসীয় সমালোচনা:

মার্কসীয় রাষ্ট্রদর্শন যেমন অভূতপূর্ব আলোড়নের সৃষ্টি করেছে, তেমনি তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদের সমালোচনা করা হয়।

(১) জড়বাদী ব্যাখ্যার সমালোচনা: ইতিহাসের জড়বাদী ব্যাখ্যা সর্বাংশে সত্য নয়। মার্কস সমাজ বিবর্তনের ক্ষেত্রে আর্থনীতিক উপাদানসমূহের উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করেছেন। লয়েড মন্তব্য করেছেন: “Economics certainly determined part of the movement of history, but man does not live by bread alone.” আর্থনীতিক প্রভাব ছাড়াও সমাজ বিবর্তনের ক্ষেত্রে ধর্ম, আদর্শ, ন্যায়-নীতি, কলা-কৃষ্টি, মানুষের প্রবৃত্তি প্রভৃতির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি সবসময়েই আর্থনীতিক বিষয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। বস্তুত মার্কস মানুষের আর্থনীতিক দিকটি ছাড়া অন্যান্য ভূমিকাকে লঘু করে দেখেছেন। ল্যাস্কির অভিমত হল: “The insistence upon an economic background as the whole explanation is radically false.”

(২) শ্রেণী-সংগ্রামের ধারণার সমালোচনা: মার্কসের শ্রেণী-সংগ্রামের তত্ত্বও বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সামাজিক প্রগতি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে শ্রেণী-সংগ্রামের তত্ত্বই সব নয়। শ্রেণী-সংগ্রামের উদাহরণের মত বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার দৃষ্টান্তও ইতিহাসে বিরল নয়। তা ছাড়া, সমাজ বিবর্তনের কোন নির্দিষ্ট পর্যায়ে কোন দেশের মানুষ দু’টি স্পষ্ট পরস্পর-বিরোধী শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল ইতিহাস এমন কোন সাক্ষ্য দেয় না। আবার আধুনিক সমাজকেও পুঁজিবাদ ও সর্বহারা— এই দুই দ্বন্দ্ব-শীল শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় না। সমাজে আরও বহু শ্রেণী ও উপশ্রেণী আছে।

(৩) উদ্বৃত্ত মূল্যের সমালোচনা: ধনবিজ্ঞানিগণ মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বটিকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন। মার্কস শুধু শ্রমকেই উৎপাদনের একমাত্র উপাদান হিসাবে গণ্য করেছেন। তিনি উৎপাদনের অন্যান্য স্বীকৃত উপাদানগুলির গুরুত্বকে উপেক্ষা করেছেন। তা ছাড়া শ্রম বিভিন্ন পর্যায়ের হয়, তাই সকল শ্রমের মূল্য এক মাপকাঠিতে নির্ধারণ করা যায় না। আবার দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ যোগানের প্রভাবকেও উপেক্ষা করা যায় না।

(৪) মার্কসবাদ চিরন্তন নয়: সমালোচকগণের মতে, মার্কসীয় তত্ত্বকে মার্কসবাদিগণ যে শাশ্বত, অভ্রান্ত ও চিরন্তন বলে প্রচার করেন তা সত্য নয়। জগতের নিত্যনূতন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মতাদর্শেরও পরিবর্তন ঘটে।

(৫) দু’টি ভবিষ্যদ্ববাণী সত্য হয়নি: মার্কসের দু’টি ভবিষ্যদ্ববাণী সত্য হয়নি। (ক) শিল্পোন্নত দেশগুলিতে মালিক শ্রেণী অধিকতর ধনী হলেও দরিদ্ররা দরিদ্রতর হয়নি। শিল্পায়নের ফলে সকল ধনতান্ত্রিক দেশে শ্রমিক শ্রেণীর আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। (খ) আবার শিল্পোন্নত ইংল্যাণ্ড বা জার্মানীতে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়নি। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছে কৃষিপ্রধান রাশিয়া ও চীন দেশে।

(৬) সংগ্রামের পথে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা অসম্ভব: মার্কস বিপ্লব ও সংগ্রামের মাধ্যমে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কিন্তু বিরুদ্ধবাদিগণের অভিযোগ হল হিংসা ও শ্রেণী-সংঘর্ষের পথে শান্তি ও সহযোগিতার রাজত্ব, প্রীতিবন্ধনে যুক্ত আদর্শ সাম্যবাদী সমাজে উপনীত হওয়া অসম্ভব।

(৭) রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক হতে পারে: মার্কস রাষ্ট্রকে শ্রেণীস্বার্থের ধারক ও বাহক এবং একান্তভাবেই শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র হিসাবে দেখেছেন। কিন্তু মানবীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্র যে সমাজকল্যাণকর হতে পারে মার্কস একথা ভাবতে পারেননি। বর্তমান শতাব্দীর বহু দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাই জনকল্যাণধর্মী হিসাবে সুবিদিত। হান্ট (Carew Hunt)-এর অভিমত অনুসারে মার্কসীয় রাষ্ট্রদর্শনে রাষ্ট্রের পীড়নমূলক ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এবং রাষ্ট্রে সকল কাজের সঙ্গে শ্রেণী-স্বার্থের ধারণাকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক এবং নিরপেক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে ও হয়। মার্কসবাদে এ বিষয়টিকে বিবেচনা করা হয়নি।

(৮) ম্যাকাইভারের মত: মার্কসের মতানুসারে রাষ্ট্র বলপ্রয়োগের এক বিশেষ প্রতিষ্ঠান। ম্যাকাইভার (Maclver)- এর মতে বল বা শক্তি রাষ্ট্রের প্রকৃত ভিত্তি হতে পারে না। তিনি বলেছেন: “Coercive power is a criterion of the state, but not its essence.”

(৯) মানবচরিত্রের ত্রুটি: অনেকের মতে, জাতীয়তা ও গোষ্ঠী আনুগত্য কত শক্তিশালী হতে পারে। মার্কস তা অনুধাবন করতে পারেননি। তাছাড়া, ক্ষমতালিপ্সা, লোভ, হিংসা, দ্বেষ, মানবচরিত্রের দোষ-ত্রুটি কম্যুনিস্ট ও অ-কম্যুনিস্ট নির্বিশেষে সকলকে সমানভাবে প্রভাবিত করে।

মূল্যায়ন: বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও রাষ্ট্রচিত্তার ক্ষেত্রে মার্কসবাদের ব্যাপক প্রভাব বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে। (১) সামাজিক প্রগতির ক্ষেত্রে আর্থনীতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে আজ আর অস্বীকার করা যায় না। (২) মার্কসের শ্রেণী-সংগ্রামের তত্ত্বও বর্তমানে ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করেছে। (৩) মার্কসই প্রথম দরিদ্র ও শোষিত মানুষের দুঃখ যন্ত্রণাকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন এবং মানবজাতির শোষণমুক্তির কামনায় এই অভূতপূর্ব তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। (৪) পৃথিবীর যেখানেই মানুষ সমাজোন্নয়নের জন্য সচেষ্ট হয়েছে মার্কসীয় দর্শন তাদের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে। ল্যাস্কি বলেছেন: “In every country of the world where men have set themselves to the task of social improvement, Marx has been always the source of inspiration and prophecy.” (5) জগতের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ আজ মার্কসবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রকৃতপক্ষে মার্কসবাদ বস্তুনিষ্ঠ, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং মানবিক মতবাদ হিসাবে রাষ্ট্রনীতিক চিন্তাজগতে বিশিষ্ট মর্যাদা লাভ করেছে। মার্কসের অভিন্নহৃদয় বন্ধু এঙ্গেলস মার্কসের সমাধির কাছে দাঁড়িয়ে মন্তব্য করেছেন: “His name will endure through the ages, so also his work. “