মূল প্রতিপাদ্য বিষয়: জৈব মতবাদ হল রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ক একটি প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। এই মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্র মানুষের তৈরী একটি কৃত্রিম সংস্থা নয়। জীববিজ্ঞানমূলক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে একটি প্রাণবন্ত সামাজিক জীব হিসাবে কল্পনা করা হয়। রাষ্ট্র একটি নিষ্প্রাণ যন্ত্রমাত্র নয়, সচেতন জীবন্ত দেহবিশেষ। সুতরাং রাষ্ট্রের প্রকৃতি জীবদেহের প্রকৃতির অনুরূপ। এই হল এই মতবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। রাষ্ট্রকে একটি জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করে জৈব মতবাদ উভয়ের মধ্যে কতকগুলি প্রকৃতিগত ও গঠনগত সাদৃশ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করে। এই মতবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে প্লেটো, অ্যারিস্টটল, সিসেরো, হস, রুশো প্রমুখ একদল চিন্তাবিদ সাদৃশ্যমূলক আলোচনার মাধ্যমে জীবদেহের সঙ্গে রাষ্ট্রের তুলনা করেছেন। আবার ব্লুণ্টসলি প্রমুখ দার্শনিকগণ রাষ্ট্রকে স্বাধীন সত্তাসম্পন্ন ‘মানবের প্রতিমূর্তি’ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত জৈব মতবাদের সাদৃশ্যমূলক আলোচনা:
জৈব মতবাদের প্রবক্তাগণ বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে জীবদেহ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সাদৃশ্য প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন। (১) জীবদেহের মত রাষ্ট্রেরও পরিবর্তন ঘটে স্বাভাবিকভাবে প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে। জীবদেহের যেমন জন্ম, বৃদ্ধি ও মৃত্যু আছে, অনুরূপভাবে রাষ্ট্রের উৎপত্তি, বিবর্তন ও বিনাশ আছে। (২) রাষ্ট্র জীবদেহের মত বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমন্বয়ে গঠিত। আবার জীবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলির ন্যায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন শাখা পরস্পরের পরিপূরক এবং পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। দেহের কোষগুলি যেমন পরস্পরের উপর এবং সামগ্রিকভাবে দেহের উপর নির্ভরশীল, তেমনি রাষ্ট্রাধীন ব্যক্তিবর্গ পরস্পরের উপর এবং সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। (৩) জীবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলির প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র কার্য সম্পাদন করে, তেমনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ নির্দিষ্ট কার্য সমাধা করে। জীবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলির নিজের নিজের কার্য সম্পাদনের উপর জীবদেহের অস্তিত্ব ও স্বাস্থ্য যেমন নির্ভরশীল, রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগগুলির সুষ্ঠু পরিচালনার উপর তেমনি রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ও সাফল্য নির্ভরশীল। (৪) অসংখ্য কোষের (Cell) সমন্বয়ে জীবদেহের সৃষ্টি, রাষ্ট্রও বহুসংখ্যক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত। জীবদেহ থেকে দেহের কোন অঙ্গ, যেমন হাত বা পা বিচ্ছিন্ন করলে তার অস্তিত্ব বিনষ্ট হয়, তেমনি রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ব্যক্তিরও ব্যক্তিত্ব লোপ পায়। বৃক্ষের সঙ্গে বৃক্ষ-পত্রের এবং মস্তিষ্কের সঙ্গে সমগ্র দেহের যে রকম সম্পর্ক, মানুষের সঙ্গে সমাজের সম্পর্কও অনুরূপ। লীকক বলেছেন : “…as is the relation of the head to the body, or the leaf to the tree, so is the relation of man to society.” জীবদেহের মতই রাষ্ট্রেরও একটি নিজস্ব সত্তা বর্তমান। (৬) স্পেনসার-এর মতানুসারে প্রাণিদেহের সংরক্ষণকারী ব্যবস্থা হল পাকস্থলী, খাদ্যনালী প্রভৃতি, তেমনি রাষ্ট্রের সংরক্ষণকারী ব্যবস্থা হল কৃষি, বাণিজ্য প্রভৃতি। শিরা-উপশিরার মাধ্যমে প্রাণিদেহের সংযোগ সাধিত হয়, তেমনি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যম হিসাবে কাজ করে রেল, বেতার, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ প্রভৃতি। প্রাণিদেহ পরিচালিত হয় মস্তিষ্কের নির্দেশে এবং রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সরকারের নির্দেশে।
মূল উদ্দেশ্য: এই সাদৃশ্যমূলক আলোচনার মাধ্যমে এটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয় যে, জীবদেহের মত কেবল রাষ্ট্রেরই একটি সামগ্রিকতা ও একটি নিজস্ব সত্তা আছে। ব্যক্তির কোন স্বতন্ত্র সত্তা নেই। ব্যক্তি রাষ্ট্রেরই সেই সামগ্রিক সত্তার অঙ্গীভূত।
রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত আঙ্গিক মতবাদের প্রবক্তাগণ:
জৈব মতবাদ একটি অতি প্রাচীন রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্ব। গ্রীক দার্শনিক প্লেটো ও অ্যারিস্টটল মানবদেহের সঙ্গে রাষ্ট্রের তুলনা করেছেন। প্লেটো ব্যক্তির কার্যকলাপ ও রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীর মধ্যে সাদৃশ্যের কথা বলেছেন। তিনি প্রজ্ঞা, সাহস ও ক্ষুধা মানুষের এই তিনটি প্রবৃত্তির ভিত্তিতে সমাজকে যথাক্রমে শাসক, যোদ্ধা ও শ্রমিক এই তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। রোমান দার্শনিক সিসেরো (Cicero) এবং মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রনীতিবিদ টমাস অ্যাকুইনাস ( Thomas Acquinas), সেলিসবারির জন (John of Salisbury) এবং পড়ুয়ার মার্সিগলিও (Marsiglio of Padua) রাষ্ট্র ও জীবদেহের মধ্যে সাদৃশ্যমূলক আলোচনা করেছেন। হব্স রাষ্ট্রকে একটি অতিকায় সামুদ্রিক জীবের (Leviathan) সঙ্গে তুলনা করেছেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে টমাস হব্স বলেছেন: “The state was the great Leviathan which is but an artificial man though of great strength than the natural.” রুশোর মতে রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক হল সরকার। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই রাষ্ট্র সম্পর্কিত এই জীবনভিত্তিক ব্যাখ্যা পরিপূর্ণতা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ডারউইন (Charles Darwin) এর বিবর্তনবাদ প্রচারিত হয়। এর পর জৈব মতবাদ বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে জার্মান দার্শনিক রুন্টসলি (Bluntschli) এবং ইংরাজ চিন্তানায়ক স্পেন্সারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বুন্টসলি: ১৮৫২ থেকে ১৮৮৪ সালের মধ্যে ব্লুণ্টসলির হাতে জৈব মতবাদ চরম রূপ ধারণ করে। ব্লণ্টস্লির মতানুসারে রাষ্ট্র কেবল জীবদেহের সঙ্গে তুলনীয় নয়, রাষ্ট্র নিজেই একটি জীবন্ত প্রাণী। তাঁর মতে রাষ্ট্র কোন কৃত্রিম, নিষ্প্রাণ যন্ত্রমাত্র নয়, রাষ্ট্র হল একটি প্রাণবন্ত জীব। তিনি বলেছেন: “No mere artificial lifeless machine, a living spiritual organic being.” রাষ্ট্র নিয়মশৃঙ্খলার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রাণিদেহের মত এর চেতনা, ঐক্য ও ব্যক্তিত্ব আছে। তাঁর মতে রাষ্ট্র পুরুষ ও চার্চ স্ত্রী। ব্লণ্টস্লি রাষ্ট্রকে স্বাধীন সত্তাযুক্ত একটি সামাজিক জীব বা ‘মানুষের প্রতিমূর্তি’ (image of human organism) হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতানুসারে একটি তৈলচিত্র যেমন কয়েক ফোঁটা তেলের সমষ্টি ছাড়া আরও কিছু, একটি মর্মর মূর্তি যেমন কয়েক টুকরো পাথরের সমষ্টি ছাড়া আরও কিছু মানুষ যেমন কিছু কোষ ও রক্তবিন্দুর সমষ্টি ছাড়া আরও কিছু, তেমনি জাতি ও রাষ্ট্র কিছু বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণের সমষ্টি ছাড়া আরও অধিক কিছু।
স্পেন্সার: স্পেন্সার ডারউইনের বিবর্তনবাদের ভিত্তিতে জৈব মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। বস্তুত তাঁর মূল উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রতিষ্ঠা। তিনি জীবদেহ ও সমাজদেহের গঠনগত ও কার্যাবলীর সাদৃশ্য ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে জীব ও রাষ্ট্র উভয়ে ক্ষুদ্র কোষ থেকে জীবন শুরু করে একই ধারায় পরিবর্ধিত হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে। জীবদেহের কোষসমূহের মত বহুসংখ্যক ব্যক্তির সমন্বয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয়। আবার জীবদেহের কোষগুলির প্রকৃতির ন্যায় রাষ্ট্রের ব্যক্তিগণও পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। স্পেন্সার বলেছেন : “just as the hand depends on the arm and the arm upon the body and the head, so do the parts of the social organism depend on each other.” জীবদেহের শিরা-উপশিরার ন্যায় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আছে পরিবহণ ব্যবস্থা। স্নায়ু-ব্যবস্থা যেমন জীবদেহকে নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সরকারের উপর ন্যস্ত থাকে। রাষ্ট্র ও জীবদেহের মধ্যে মৌলিক সাদৃশ্যের কথা বললেও স্পেন্সার সমাজদেহ ও জীবদেহের মধ্যে পার্থক্যও লক্ষ্য করেছেন। তাঁর মতানুসারে জীবদেহের কোষসমূহ দেহের ভিতরে সুদৃঢ়ভাবে সংবদ্ধ থাকে; কিন্তু সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ পরস্পরের সঙ্গে তেমনভাবে সম্পর্কযুক্ত নয়। মানুষের সমগ্র চেতনা একটি ক্ষুদ্র অংশে কেন্দ্রীভূত থাকে; কিন্তু রাষ্ট্রের কোন বিশেষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রাজনীতিক চেতনা গড়ে ওঠে না। স্পেন্সার এইভাবে রাষ্ট্রের উপর ব্যক্তির নির্ভরশীলতার পরিবর্তে ব্যক্তির পৃথক সত্তা ও স্বাতন্ত্র্যের কথা বলেছেন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রচারই হল তাঁর মূল উদ্দেশ্য।
রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত জৈব মতবাদের সমালোচনা
রাষ্ট্র ও জীবদেহের মধ্যে আপাত সাদৃশ্যের উপর ভিত্তি করে জৈব মতবাদ যেভাবে উভয়ের প্রকৃতি ও গঠনগত অভিন্নতা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন তা তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।
(ক) কিছু সাদৃশ্য সত্ত্বেও রাষ্ট্র ও জীবদেহের অভিন্নতা প্রতিপন্ন করা ঠিক নয়। বার্কার (Ernest Barker) বলেছেন: “The State is not an organism, but it is like an organism.”
- (১) জীবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্বতন্ত্র কোন ইচ্ছা থাকতে পারে না। কিন্তু রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিমাত্রেই চেতনাশীল, স্বতন্ত্র ইচ্ছাসম্পন্ন এবং স্বাধীন সত্তাযুক্ত।
- (২) প্রাণিদেহের কোন অংশকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করলে উক্ত অংশের এমনকি সমগ্র দেহেরও মৃত্যু ঘটতে পারে। কিন্তু কোন রাষ্ট্রের কিছু নাগরিককে রাষ্ট্র থেকে বহিষ্কৃত করলে অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করে তারা পরিপূর্ণ জীবন-যাপন করতে সমর্থ হয়। আবার রাষ্ট্রেরও অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশংকা থাকে না।
- (৩) জীবদেহ থেকেই কেবল জীবদেহের জন্ম সম্ভব এবং জীবদেহের মৃত্যুও অনিবার্য। রাষ্ট্রের উৎপত্তির ক্ষেত্রে একথা খাটে না এবং জীবদেহের জীবনের মেয়াদ যেভাবে সীমিত, রাষ্ট্রের বেলায় সে নিয়মও অচল।
- (৪) জীবদেহের চেতনাশক্তি কেবলমাত্র মস্তিষ্কেই কেন্দ্রীভূত থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রের চেতনাশক্তি প্রকৃতপক্ষে তার নাগরিকদের মধ্যে প্রসারিত থাকে।
- (৫) প্রাণিদেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকলাপ সম্পূর্ণভাবে দেহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের কার্যকলাপ রাষ্ট্রাভ্যন্তরেই নিঃশেষিত হয় না।
- (৬) জীবদেহের কোষগুলি দেহের অভ্যন্তরে সুদৃঢ়ভাবে গ্রথিত থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গ বা প্রতিষ্ঠানসমূহ জীবদেহের কোষসমূহের মত মোটেই সুসংবদ্ধ নয়।
- (৭) জীবদেহের বৃদ্ধি ঘটে। এই বৃদ্ধি সংশ্লিষ্ট জীবটির পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক ও জৈব নিয়মের উপর নির্ভরশীল। অপরদিকে গার্নারকে অনুসরণ করে বলা হয় যে রাষ্ট্র বৃদ্ধি পায় না, পরিবর্তিত হয়।
- (৮) একজন ব্যক্তি একই সঙ্গে একাধিক সংঘের সদস্য হতে পারে। কিন্তু একটি জীবকোষ একই সঙ্গে একাধিক জীবদেহের অঙ্গীভূত হতে পারে না।
(খ) ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী: জৈব মতবাদের বিরুদ্ধে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ হল, এই মতবাদ স্বাধীনতার পরিপন্থী। এই মতবাদে ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের অংশ হিসাবে গণ্য করে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্র সত্তাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। সুতরাং মতবাদটি অগণতান্ত্রিকও বটে।
(গ) রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি প্রসঙ্গে জৈব মতবাদের বক্তব্য স্পষ্ট নয়। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ থেকে সমাজতন্ত্রবাদের সমর্থনে এই মতবাদকে ব্যবহার করেছেন। স্পেনসার মতবাদটিকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সমর্থনে ব্যবহার করেছেন। তাঁর মতে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্র হবে সীমাবদ্ধ। ব্লণ্টস্লি আবার রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ করার বিরোধী। তিনি সর্বাত্মক রাষ্ট্র ও সমাজতন্ত্রবাদকে সমর্থন করেছেন।
(ঘ) শ্রেণীসমন্বয়ের ধারণা: অবৈজ্ঞানিক: এই মতবাদ অনুসারে সমাজদেহ জীবদেহের অনুরূপ। তাই সমাজের শ্রেণী-বিভাজন স্বাভাবিক। সেইজন্য সমাজের ভিতরে শ্রেণী-সংগ্রাম এবং রাষ্ট্রের মৌলিক পরিবর্তন সাধনের চেষ্টা স্বাভাবিক নয়। কিন্তু মার্কসবাদে ভিন্ন কথা বলা হয়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুসারে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব এবং শ্রেণী-সংগ্রামের অস্তিত্ব উভয়ই স্বাভাবিক।
সমালোচনামূলক মন্তব্য: গেটেল যথার্থই বলেছেন যে, ‘জৈব মতবাদ রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা বা রাষ্ট্রের কার্যকলাপ সম্পর্কে কোন নির্ভরযোগ্য নির্দেশ দিতে পারে না।’ তিনি বলেছেন: “… the organismic theory is neither a satisfactory explanation of the nature of the state nor a trustworty guide to state activity.” লীককও এই মতবাদকে একটি বিপজ্জনক তত্ত্ব হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: “Too great amalgamation of the individual and the state is as dangerous an ideal as too great emancipation of the individual will.” হবহাউস মনে করেন রাষ্ট্রকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করা সঙ্গত নয়।
মূল্যায়ন: উপরিউক্ত বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে জৈব মতবাদের ঐতিহাসিক মূল্যকে অস্বীকার করা যায় না। (১) রাষ্ট্রের অন্তর্গত ব্যক্তিসমূহের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং সমাজ ও ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বলে এই মতবাদ সামাজিক সহযোগিতার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। (২) গার্ণারের মতানুসারে, অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত রাষ্ট্রকে একটি কৃত্রিম প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিপন্ন করার যে প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় এই মতবাদ তার বিরোধিতা করে রাষ্ট্রকে ক্রমবিকাশের ফল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরোধিতা করেছে। (৩) রাষ্ট্র ও জীবদেহ অভিন্ন নয়; কিন্তু উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। (৪) সর্বোপরি হেগেলের দর্শনে মতবাদটির অস্তিত্ব এখনও বর্তমান। বস্তুত মতবাদটি বুন্টসলি প্রমুখ জার্মান দার্শনিকদের হাতে চরম রূপ ধারণ করে। তাই তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়।
Leave a comment