ভূমিকা: রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রসঙ্গে কোন সর্বজনগ্রাহ্য মতবাদ নেই। সেই প্রাচীনকাল থেকে এ নিয়ে চিন্তাবিদদের মধ্যে আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছে। তারফলে এ ক্ষেত্রে বহু ও বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্র-দার্শনিকরা রাষ্ট্রের প্রকৃতি পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেছেন। এ বিষয়ে ভাববাদী ও বস্তুবাদী রাজনীতিক দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আলোচনা পরস্পর-বিরোধী। আইনবিদদের মতানুসারে রাষ্ট্র হল একটি আইনগত সংগঠন। কিন্তু এই আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি হল সংকীর্ণ। আইনানুগ দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রের সকল দিক বিচার-বিশ্লেষণ করা যায় না। রাষ্ট্রের প্রকৃতির যথাযথ পর্যালোচনা কেবল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই সম্ভবপর। এ প্রসঙ্গে হ্যারল্ড ল্যাস্কি-র An Introduction to Politics গ্রন্থে এক মনোজ্ঞ আলোচনা বর্তমান। রাষ্ট্রের প্রকৃতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে ল্যাস্কি সংকীর্ণ আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি বর্জন করেছেন। তিনি ব্যাপক ঐতিহাসিক ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন।

(ক) ‘আইনানুগ অনুজ্ঞা হিসাবে রাষ্ট্র’—তত্ত্বটির ব্যাখ্যা

ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics গ্রন্থে বলেছেন যে, মানবজীবন রাষ্ট্রীয় সংগঠনের পটভূমিতেই সুদৃঢ়ভাবে সংবদ্ধ। এই কারণে সামাজিক সংগঠন সম্পর্কিত আলোচনার আগে রাষ্ট্রের আলোচনা আবশ্যক। রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনার ক্ষেত্রে ল্যাস্কি আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেননি। এই দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেছেন। তবে আইনানুগ প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করলে রাষ্ট্রই অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতীয়মান হয়।

আইন বলবৎকরণের ক্ষমতার মধ্যেই রাষ্ট্রের নির্যাস নিহিত: বর্তমান বিশ্বে প্রত্যেক ব্যক্তি যে-কোন একটি রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীনে বসবাস করে। রাষ্ট্রের এই কর্তৃত্ব কতকগুলি নিয়মকানুনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এই নিয়মকানুনগুলি প্রত্যেক রাষ্ট্রই প্রণয়ন করে। এই সমস্ত রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুনের দ্বারা ব্যক্তির জীবনযাত্রা পরিচালিত হয়। এই সমস্ত নিয়মকানুনকে আইন বলে। ব্যক্তির জীবন আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট আচরণ-বিধির মধ্যে আবদ্ধ। এই সমস্ত আইন সকলের উপরই বাধ্যতামূলকভাবে বলবৎ হয়। আইনগত বিচারে রাষ্ট্রীয় নির্দেশ মান্য করা সকলের পক্ষে বাধ্যতামূলক। আইন অমান্যকারীকে রাষ্ট্র শাস্তি দেয়। অর্থাৎ তার আদেশকে বলবৎ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের আছে। রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে বসবাসকারী ব্যক্তির পক্ষে রাষ্ট্রীয় আদেশ মান্য করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রের এলাকার অন্তর্ভুক্ত সকল অধিবাসীর উপর আইনকে বলবৎকরণের ক্ষমতার মধ্যেই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বা রাষ্ট্রের নির্যাস নিহিত আছে।

সামাজিক সংগঠনসমূহের উপর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রকাশিত হয়: রাষ্ট্রের ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে রাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য সংঘ-সংগঠনও আছে। উদাহরণ হিসাবে শ্রমিক সংঘ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজনীতিক দল প্রভৃতির কথা বলা যায়। রাষ্ট্রের মত এই সমস্ত সংগঠনের নিজস্ব নিয়মকানুন আছে। এরাও তাদের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে এই সমস্ত সংগঠনের পার্থক্য আছে। অন্যান্য সামাজিক সংগঠনগুলি স্বেচ্ছামূলক প্রকৃতির। এই সমস্ত সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ করা বা না করা হল ব্যক্তির ইচ্ছা-নির্ভর বিষয়। অপরদিকে রাষ্ট্রের সদস্যপদ গ্রহণ করা এবং রাষ্ট্রীয় আইন মান্য করা ব্যক্তির কাছে বাধ্যতামূলক। ব্যক্তির কাছে রাষ্ট্রের দাবি এবং অন্যান্য সংগঠনের দাবির মধ্যে বিরোধ বাধলে রাষ্ট্রীয় দাবির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে। বস্তুত ব্যক্তির আনুগত্যের উপর রাষ্ট্রের দাবি হল সর্বাধিক। সকল রকম সামাজিক সংগঠনের ঊর্ধ্বে রাষ্ট্রের স্থান। ল্যাস্কি রাষ্ট্রকে সামাজিক সৌধের মূল প্রস্তরখণ্ড হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেছেন : “The state is the keystone of social arch.” রাষ্ট্রের বিশেষ প্রকৃতি সামাজিক গোষ্ঠীসমূহের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্যেই বর্তমান। তাঁর An Introduction to Politics গ্রন্থে ল্যাস্কি বলেছেন: “The state, so to say is the crowning point of the modern social edifice, and it is in its supremacy over all other forms of social grouping that its special nature is to found.”

রাষ্ট্র চূড়ান্ত পীড়নমূলক ক্ষমতার অধিকারী: এইভাবে রাষ্ট্র হল ‘একটি আইনানুগ অনুজ্ঞার ব্যবস্থা’ (a system of legal imperatives)। এই রাষ্ট্র জীবনযাত্রার নির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেয়। রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত জীবনযাত্রার এই পদ্ধতির সঙ্গে ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনসমূহকে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে হয়। রাষ্ট্র হল চূড়ান্ত পীড়নমূলক ক্ষমতার অধিকারী। এই ক্ষমতা বলে রাষ্ট্র তার এক্তিয়ারের মধ্যে যাবতীয় কাজকর্মের প্রকৃতি নির্ধারণ করতে পারে। রাষ্ট্রের আইনগত পরিকাঠামোর মধ্যে সমাজের সকল সংগঠনকে তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করতে হয়। প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই একটি চূড়ান্ত ইচ্ছা আছে। আইনের দিক থেকে এই ইচ্ছার অবস্থান হল অন্য সকল ইচ্ছার উপরে। রাষ্ট্র যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে তা সকলের উপর বাধ্যতামূলকভাবে প্রযোজ্য। এই সিদ্ধান্ত খারাপ, অন্যায় বা অসঙ্গত হতে পারে, তবুও নাগরিকদের বাধ্যতামূলকভাবে তা মান্য করে চলতে হয়। রাষ্ট্র নিয়মকানুন প্রণয়ন করে ব্যক্তিবর্গের আচার-আচরণ এবং সামাজিক সংগঠনসমূহের কাজকর্মের ধারা নির্দিষ্ট করে দেয়। এই নিয়মকানুনগুলি হল রাষ্ট্রের আইন। প্রকৃত প্রস্তাবে এই রাষ্ট্রীয় আইনই হল সার্বভৌম। অন্যান্য নিয়মকানুন এর অধীন। An Introduction to Politics গ্রন্থে ল্যাস্কি বলেছেন: “The state is thus a society of individuals submitted, if necessary, by compulsion, to a certain way of life.”

সরকার: রাষ্ট্রের আইনগুলি স্বতঃপ্রণীত বা স্বতঃপ্রযুক্ত নয়। এই সমস্ত আইন কতিপয় ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের দ্বারা প্রণীত ও প্রযুক্ত হয়। প্রত্যেক রাষ্ট্রেই মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ আইনের অবশ্য পালনীয় নিয়মকানুন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে এবং বহুসংখ্যক মানুষ এগুলি মান্য করে চলতে বাধ্য থাকে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ যাঁরা নির্দিষ্ট একটি ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত পীড়নমূলক কর্তৃত্বের অধিকারী, যাঁরা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করেন তাঁদের সরকার বলা হয়। আইন প্রয়োগের জন্য সরকার সকল রকম পীড়নমূলক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে।

রাষ্ট্রের সার্বভৌম ইচ্ছা: প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই একটি চূড়ান্ত ইচ্ছা আছে। আইনগত বিচারে এই ইচ্ছা অন্য সকল ইচ্ছার ঊর্ধ্বে অবস্থিত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় এই ইচ্ছাকে সার্বভৌম ইচ্ছা বলা হয়। রাষ্ট্রের এই সার্বভৌম ইচ্ছা অন্য কোন ইচ্ছার আদেশ মান্য করে না। রাষ্ট্র তার এই কর্তৃত্বকে হস্তান্তর করতেও পারে না। এই সার্বভৌম ইচ্ছার উদাহরণ হিসাবে ব্রিটেনের রাজা বা রানীসহ পার্লামেন্টের কথা বলা হয়। ব্রিটেনের সকল ব্যক্তি ও সংগঠনের উপর পার্লামেন্টের যাবতীয় সিদ্ধান্ত বাধ্যতামূলকভাবে প্রযুক্ত হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত কোন আইন অসঙ্গত বা অনৈতিক বিবেচিত হলেও প্রত্যেক ব্রিটিশ নাগরিক তা মেনে চলতে বাধ্য। অন্যথায় আইন অমান্য করার শাস্তি ভোগ করতে হবে।

রাষ্ট্রের আইনানুগ প্রকৃতি: ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে সকল রকম সামাজিক সংগঠনের ঊর্ধ্বে রাষ্ট্রের অবস্থান। রাষ্ট্র হল সামাজিক সৌধের শিখরবিন্দু। এ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের বিশেষ প্রকৃতি বিশেষভাবে প্রতীয়মান হয়। আইনগত দিক থেকে বিচার করলে রাষ্ট্র হল সামাজিক ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে জীবনযাত্রার যে ধারা নির্দিষ্ট করে দেয় তার সঙ্গে ব্যক্তিবর্গ এবং সংগঠনসমূহকে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে হয়। রাষ্ট্রের আইন-নির্দিষ্ট পরিকাঠামোর মধ্যেই অন্যান্য সংগঠনগুলিকে তাদের ভূমিকা পালন করতে হয়। আইনানুগ অনুজ্ঞা হিসাবে দেখলে এই হল রাষ্ট্রের প্রকৃতি। ল্যাস্কির মতানুসারে আধুনিক রাষ্ট্র হল নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে অবস্থিত সমাজ। এই সমাজ শাসক ও প্রজায় বিভক্ত। রাষ্ট্র নির্দিষ্ট একটি ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রাধান্য দাবি করে। তাঁর A Grammar of Politics গ্রন্থে ল্যাস্কি বলেছেন: “The modern state is a territorial society divided into government and subjects claiming, within its allotted physical area, a supremacy over all other institution.” এ প্রসঙ্গে An Introduction to Politics গ্রন্থে ব্যক্ত ল্যাস্কির বক্তব্য আলোচনা করা আবশ্যক। এই গ্রন্থেও তিনি বলেছেন যে রাষ্ট্র মাত্রেই হল নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ একটি সমাজ। সরকার ও প্রজায় এই সমাজ বিভক্ত। কতিপয় ব্যক্তিকে নিয়ে রাষ্ট্রের ভিতরে সরকার গঠিত হয়। রাষ্ট্রের ভিত্তিস্বরূপ যে সমস্ত আইন ও নিয়মকানুনের কথা বলা হয়, সরকার তা প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে।

আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা

ল্যাঙ্কি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত উপরিউক্ত আইনানুগ আলোচনার সমালোচনা করেছেন। রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি আইনানুগ প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

(১) ল্যাস্কির মতানুসারে আইনগত দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রচলিত সামাজিক সম্পর্কসমূহ কিভাবে পরিচালিত হয় কেবলমাত্র তাই-ই ব্যাখ্যা করা হয়। আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে এই মতবাদ থেকে কিছু জানা যায় না। এই কারণে এই মতবাদ যথেষ্ট বা পর্যাপ্ত নয়।

(২) ল্যাস্কির অভিমত মতানুসারে সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের ফল এই রাষ্ট্র। সুতরাং সার্বভৌম সংস্থা হিসাবে রাষ্ট্রের প্রকৃতি পর্যালোচনা করতে হলে তা ইতিহাসের প্রেক্ষাপটেই করা দরকার। কেবলমাত্র ঐতিহাসিক পটভূমিতেই রাষ্ট্রের প্রকৃতি যথাযথভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে। 

(৩) রাষ্ট্র যে সমস্ত লক্ষ্য পূরণ বা উদ্দেশ্য সাধন করে, আইনানুগত মতবাদ তা ব্যাখ্যা করে না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। কোন বিশেষ সময়ে যাঁরা আইনসঙ্গতভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী তাঁরা তাঁদের উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করেন। সময় ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আইনের উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তুরও পরিবর্তন ঘটে। কোন বিশেষ সময়ে রাষ্ট্র কেন কোন বিশেষ লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সাধনে উদ্যোগী হয়, তা এই আইনানুগ মতবাদ থেকে জানা যায় না।

(৪) ল্যাস্কির মতানুসারে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের উন্মেষের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বিকাশ এবং পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন ঘটনা সাহায্য করে থাকে। আইনানুগ মতবাদে এই বিষয়টি ধরা পড়ে না। 

(৫) সমাজে রাষ্ট্রের ভূমিকার মূল্য ও কাজ সম্পর্কে আইনগত মতবাদ থেকে সম্যক ধারণা লাভ করা যায় না। নিজের জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকৃত নয়। তার সদস্যদের জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। অনুরূপভাবে আইনের জন্যই আইন নয়। কোন নির্দিষ্ট সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিবর্গ তাঁদের বিচারে কিছু কল্যাণকর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আইন প্রণয়ন করেন। কিন্তু রাষ্ট্রের সদস্যরা দুটি দিক থেকে রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের ভাল-মন্দ বিচার করে। এই দুটি দিক হল: 

  • (ক) রাষ্ট্র কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চায়। 

  • (খ) কিভাবে তা করতে চায়। 

(৬) ল্যাস্কির মতানুসারে রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে তার সদস্যদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু রাষ্ট্র মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না এবং তা উচিতও নয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল নির্দিষ্ট কতকগুলি ক্ষেত্রে ব্যক্তিবর্গের সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ সুনিশ্চিত করা; সকল ক্ষেত্রে নয়।

(৭) রাষ্ট্র ও তার আইনকে মান্য করার ব্যাপারে আইনানুগ মতবাদের বক্তব্য প্রসঙ্গে ল্যাস্কির অভিমত উল্লেখ করা দরকার। ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Our obligation to obey the State is, law apart, an deligation dependent upon the degree to which the State achieves its purposes.” 

(৮) ল্যাস্কির মতানুসারে রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের সঙ্গে তার সকল সদস্যদের স্বার্থ জড়িত। এই কারণে রাষ্ট্রকে দায়িত্বশীল হতে হবে। রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে স্বীকার করা হয়, কারণ রাষ্ট্রের উপর কিছু কর্তব্য সম্পাদনের দায়িত্ব ন্যস্ত আছে। ব্যক্তির আত্মোপলব্ধির ক্ষেত্রে সাহায্য করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

(৯) ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের তত্ত্ব বলতে প্রকৃতপক্ষে সরকারী কাজকর্মের তত্ত্বকে বোঝায়। রাষ্ট্রের ইচ্ছা বলতে সমগ্র সমাজের ইচ্ছাকে বোঝায় না। রাষ্ট্রের ইচ্ছা হল একটি অংশের ইচ্ছা মাত্র, সমগ্রের নয়। রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের প্রাত্যহিক প্রশাসন পরিচালনায় যে সমস্ত ব্যক্তি অংশগ্রহণ করে তাদের ইচ্ছাই হল বাস্তবে রাষ্ট্রের ইচ্ছা। এই ইচ্ছা বৃহত্তম ইচ্ছা হিসাবে বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু আমাদের জন্য এর কোন নৈতিক দাবি থাকতে পারে না। A Grammer of Politics গ্রন্থে ল্যাস্কি বলেছেন: “I am part of the State, but I am not one with it.”

রাষ্ট্রের আইনানুগ মতবাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ল্যাস্কি উপরিউক্ত বক্তব্য পেশ করেছেন। তারপর রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রসঙ্গে তিনি তাঁর নিজের মতবাদ ব্যাখ্যা করেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রথমে তিনি কোন বিশেষ সময়ে রাষ্ট্র যে সমস্ত আইন বলবৎ করে তার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে কার্য-কারণ বা ক্রিয়াগত দিক (functional terms) থেকে তিনি আইন ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন।

(খ) আইনানুগ অনুজ্ঞার প্রকৃতি

পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুটি ক্রিয়াগত দিক থেকে আইনানুগ অনুজ্ঞার প্রকৃতি সম্পর্কিত ল্যাস্কির ধারণা ব্যাখ্যা করা দরকার। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ক্রিয়াগত দুটি বিষয় হল: 

  • (১) আইনানুগ অনুজ্ঞা হল নাগরিকদের কার্যকর দাবী (effective demand)-র প্রতিফলন এবং 

  • (২) নাগরিকদের কার্যকর দাবী হল আর্থনীতিক ক্ষমতার প্রতিফলন।

(১) আইনানুগ অনুজ্ঞা হল নাগরিকদের কার্যকর দাবির প্রতিফলন- নাগরিকের চাহিদা পূরণের জন্য রাষ্ট্র: ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের পিছনে সমর্থন রাষ্ট্র কর্তৃক ব্যক্তির চাহিদা পূরণের মধ্যেই বর্তমান। নাগরিকরা রাষ্ট্রের কাছে যে সমস্ত দাবি-দাওয়া জানায়, রাষ্ট্র তা পূরণের চেষ্টা করে। এই কারণেই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকৃত। রাষ্ট্রের কিছু কর্তব্য সম্পাদনের দায়িত্ব আছে। তাই রাষ্ট্রের ক্ষমতা আছে। রাষ্ট্র নাগরিকদের সর্বাধিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে তাদের আনুগত্য অর্জন করতে পারে। ল্যাস্কি তাঁর The State in Theory and Practice শীর্ষক রচনায় মন্তব্য করেছেন: “For its citizens a State is what it does; it is not justified merely because it is a State.” রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকরা বিভিন্ন আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা জানায়। এই সমস্ত চাহিদা পূরণের সামর্থ্যের মধ্যেই রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রমাণ নিহিত থাকে। এই সমস্ত চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয়, তা হলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে সংকটের সৃষ্টি হতে পারে।

রাষ্ট্রকে বহু এবং বিভিন্ন রকমের চাহিদার সম্মুখীন হতে হয়। এই সমস্ত চাহিদা ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত, আবার প্রতিযোগিতামূলক বা সহযোগিতামূলক হতে পারে। রাষ্ট্র সকল চাহিদা পূরণ করে না বা করতে পারে না। রাষ্ট্র তার সামনে উপস্থিত চাহিদার কিছু অংশ পূরণ করে থাকে। রাষ্ট্র কেবল নাগরিকদের কার্যকর চাহিদা (effective demand) পূরণের চেষ্টা করে। আইনানুগ অনুজ্ঞা (legal imperative)-র সাহায্যে রাষ্ট্র কার্যকর চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে। অর্থাৎ আইনানুগ অনুজ্ঞার মধ্যে সমাজের কার্যকর চাহিদার প্রতিফলন ঘটে। এই কারণে ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে আইনানুগ অনুজ্ঞা হল নাগরিকদের কার্যকর দাবির প্রতিফলনস্বরূপ। তিনি বলেছেন: “Legal imperatives, that is to say, are a function of effective demand.”

রাষ্ট্র কেবল কার্যকর চাহিদার সন্তুষ্টি বিধানের চেষ্টা করে। যে-কোন রাষ্ট্রের আইন অবশ্যই সাফল্যের সঙ্গে কার্যকর চাহিদা পুরণের চেষ্টা করবে। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট আইনকে কার্যকর করা যাবে না। ল্যাস্কি বলেছেন: “authority of a State is a function of its ability to satisfy the effective demands that are made upon it.” রাষ্ট্রের আইনানুগ অনুজ্ঞা এমনভাবে প্রণীত হবে যাতে নাগরিকদের চাহিদার পরিতৃপ্তি সাধন সম্ভব হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আইনানুগ অনুজ্ঞাগুলিকে অবশ্যই নাগরিকদের কার্যকর চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে হবে। কার্যকর চাহিদা যদি উপেক্ষিত হয়, তাহলে নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি হবে। এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে অধ্যাপক ল্যাস্কি ইতিহাস থেকে উদাহরণের অবতারণা করেছেন। তাঁর মতানুসারে ফ্রান্সে সমকালীন শাসকগোষ্ঠী আইনানুগ অনুজ্ঞার যে ব্যবস্থা পরিচালনা করত তা ফরাসী নাগরিকদের কার্যকর চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। এই কারণে ফরাসী বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে।

যে কোন রাষ্ট্রের আইন নাগরিকদের কার্যকর চাহিদা পূরণের উপযোগী হবে এবং হয়। অর্থাৎ ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের আইনানুগ অনুজ্ঞা রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত সকল মানুষের দাবি পূরণ করে না। রাষ্ট্রের আইনানুগ অনুজ্ঞার মাধ্যমে সমাজের সার্বজনীন স্বার্থ সংরক্ষণের বা সকলের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয় না। রাষ্ট্রের এলাকার মধ্যে বহু, বিভিন্ন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে। রাষ্ট্র সকল আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্ত সাধন করে না। এই সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে বাছাই করা কয়েকটির পরিতৃপ্তি সাধনের ব্যবস্থা করা হয়। সমাজের মধ্যে যারা রাজনীতিক ক্ষমতার অধিকারী, রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত আইনের সঙ্গে তাদের স্বার্থই সংযুক্ত থাকে। ল্যাস্কির মতানুসারে রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে যে শ্রেণী রাজনীতিক ক্ষমতা প্রয়োগের কেন্দ্রে তাদের প্রভাব কায়েম করতে বা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে, সেই শ্রেণীর স্বার্থে রাষ্ট্রীয় আইন প্রণীত হয়। আইন তাদেরই বা রাষ্ট্রের সেই অংশেরই স্বার্থ রক্ষা করে।

রাজনীতিক ক্ষমতার একটি কেন্দ্র আছে। ক্ষমতার এই কেন্দ্রে সকলে পৌঁছতে পারে না বা তাদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। কিন্তু কিছু মানুষ রাজনীতিক ক্ষমতার এই কেন্দ্রে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এই শ্রেণীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবি-দাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে রাষ্ট্রীয় আইন প্রণীত হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় আইনের উদ্দেশ্য হল কেবল তাদেরই স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করা, যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। সমাজের এই শ্রেণীর মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখে রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে। প্রকৃত প্রস্তাবে সমাজের এই বিশেষ শ্রেণীর দাবি ও স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধনের জন্য এবং তা কার্যকর করার উদ্দেশ্যে বিশেষ ধরনের আইন প্রণয়ন করা হয়। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় আইন কতদূর কার্যকর হবে তা নির্ভর করে এই আইন সমাজের এই শ্রেণীর মানুষের স্বার্থ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি কি পরিমাণে সংবেদনশীল। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কির নিজের কথাগুলি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “They (laws) will correspond to the desires of those who know how to make their wishes felt at the centre of political power. The laws of any given state will be an effort to respond to those desires; and their efficacy will depend upon the degree to which that response is successful.”

রাষ্ট্র কোন স্বার্থ সংরক্ষণ বা দাবি পূরণের জন্য কোন্ রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন করবে তা বহুলাংশে স্থান ও কালের উপর নির্ভরশীল। ইতিহাসের সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, কোন এক সময়ে যে ইচ্ছা বা চাহিদা ছিল অকার্যকর, পরবর্তীকালে তা অপ্রতিরোধ্য বা অতিমাত্রায় কার্যকর হয়ে পড়তে পারে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় আইন সামন্তশ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে সংবেদনশীল ছিল। কারণ ভূ-সম্পত্তির এই মালিক শ্রেণীই সেই সময় রাজনীতিক ক্ষমতার অধিকারী ছিল। তারপর পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রাধান্য ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনীতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রভূত ক্ষমতা পুঁজিপতি মালিক শ্রেণীর করায়ত্ত থাকে। এই কারণে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে আইন পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থরক্ষা বা চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করে।

(২) নাগরিকদের কার্যকর দাবি হল আর্থনীতিক ক্ষমতার প্রতিফলন: ল্যাস্কি রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক ভিত্তির পরিপ্রেক্ষিতে আইনের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে স্পষ্টতই মার্কসীয় চিন্তাধারার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন।

ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে আইন এককভাবে সর্বজনীন স্বার্থের প্রতিভূ নয়। রাষ্ট্রের তৈরী আইন সর্বসাধারণের স্বার্থে বা জনগণের কল্যাণ বা ন্যায়ের স্বার্থে রচিত হয় না। বৃহত্তর অর্থে সমাজের প্রভুত্বকারী শ্রেণীর স্বার্থ সাধনের জন্যই রাষ্ট্রীয় আইন প্রণীত হয়। তা না হলে রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আইনের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রত্যেক রাষ্ট্রের লক্ষ্য হল মৌল সামাজিক সম্পর্কগুলিকে রক্ষা করা। সেই সমস্ত সামাজিক সম্পর্কের পিছনে বা সমর্থনে রাষ্ট্র আইনের অনুমোদনকে অব্যাহত রাখে। আর্থিক বিচারে সমাজের শক্তিশালী শ্রেণী আইনের অন্তরালে রাজনীতিক কর্তৃত্বের মাধ্যমে তাদের স্বার্থের অনুকূল সম্পর্ক সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। আর্থনীতিক ভিত্তির উপর আইনের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি নির্ভরশীল। আর্থনীতিক দিক থেকে সমাজের যে শ্রেণী প্রাধান্যকারী বলে প্রতীয়মান হয়, তারাই নিজেদের স্বার্থে রাজনীতিক কাঠামোকে প্রয়োগ করে থাকে।

রাষ্ট্র হল সমাজের ক্ষমতাশালী শ্রেণীর প্রতিভূ। তাই রাষ্ট্র যে সমস্ত আইনানুগ অনুজ্ঞা সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচার করে, সেগুলির আসল উদ্দেশ্য হল সমাজের ক্ষমতাবান শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ। বস্তুত রাষ্ট্রের নামে সংশ্লিষ্ট শ্রেণীই আইনানুগ অনুজ্ঞাগুলি জারি করে থাকে। তাই আইনানুগ অনুজ্ঞা কখনই এই শ্রেণীর স্বার্থের বা এই শ্রেণীর রাষ্ট্রদর্শনের বিরোধী হয় না। প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রের আইনানুগ অনুজ্ঞার উপর শ্রেণী-সমাজের প্রকৃতি প্রতিফলিত হয়। ল্যাস্কি বলেছেন: “The way the economic power is distributed at any given time and place will shape the character of legal imperative which are imposed in that same time and place.”

ল্যাস্কি বিস্তারিত ভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। ল্যাস্কির মতানুসারে আইন কার্যকর চাহিদা পূরণ করে। প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনীতিক ক্ষমতাকেন্দ্রে নিজেদের চাহিদাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জ্ঞান ও প্রয়োজনীয় ক্ষমতা যাদের আছে, রাষ্ট্রের আইন বা আইনানুগ অনুজ্ঞা তাদের দাবি পূরণ করে। কিন্তু সমাজের সকলে নিজেদের ইচ্ছা বা রাজনীতিক ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় না। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে যারা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে তারাই রাজনীতিক ক্ষমতাকেন্দ্রে তাদের দাবি বা চাহিদাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। অর্থাৎ সমাজের এই শ্রেণীর ইচ্ছা বা দাবি কার্যকর চাহিদায় পরিণত হয়। এবং এই কার্যকর চাহিদার সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই আইন প্রণীত হয়। সুতরাং আর্থনীতিক দিক থেকে সমাজের ক্ষমতাশালী শ্রেণীর স্বার্থই রাষ্ট্রের আইনানুগ অনুজ্ঞার মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়। রাষ্ট্রের আইন বা আইনানুগ অনুজ্ঞা আর্থিক বিচারে সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করে।

ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে আর্থনীতিক দিক থেকে যারা ক্ষমতাশালী কেবল তারাই তাদের দাবিকে কার্যকর চাহিদায় পরিণত করতে পারে। যে সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানগুলি ব্যক্তিগত মালিকানার অধীন সেখানে আর্থনীতিক ক্ষমতা অসমভাবে বণ্টিত থাকে। যারা উৎপাদনের উপাদানগুলির মালিক তারাই সমাজের আর্থনীতিক ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তারাই রাজনীতিক কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করার প্রয়োজনীয় ক্ষমতার অধিকারী। এই ক্ষমতাবলে তারা রাজনীতিক কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করে তাদের চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করতে পারে। সম্পত্তির মালিকানা থেকে যারা বঞ্চিত এই ক্ষমতাও তাদের থাকে না। তাই রাষ্ট্রের আইনানুগ অনুজ্ঞার সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত থাকে। ল্যাস্কি বলেছেন: “The nature of the legal imperative in any State corresponds to the effective demands that the State encounters, and that these, in their turn, depend, in a general way, upon the manner in which economic power is distributed in the Society which the State controls.”

আর্থিক বিচারে যারা শক্তিশালী রাষ্ট্র কেবল তাদের দাবি বা চাহিদাকেই পূরণ করে থাকে। আর্থনীতিক দিক থেকে প্রাধান্যকারী শ্ৰেণী বা যে শ্রেণী আর্থনীতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র তাদের দাবিকেই ব্যক্ত করে এবং আইনের মাধ্যমে সেই সমস্ত দাবি বা চাহিদাকে বাস্তবে পূর্ণ করার ব্যবস্থা করে। এই কারণে কোন বিশেষ সময়েও সমাজে যে ভাবে আর্থনীতিক ক্ষমতা বণ্টিত থাকে আইনের প্রকৃতিও তদনুসারে নির্ধারিত হয়ে থাকে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে আর্থনীতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় যে বা যারা আর্থনীতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভ করে তারা তাদের ইচ্ছা বা দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এই রকম পরিস্থিতিতে আইন এক ধরনের সম্পর্কের ব্যবস্থায় পরিণত হয়। এবং এর উদ্দেশ্য হল আর্থনীতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তিবর্গের দাবি বা চাহিদার আইনানুগ অভিব্যক্তির ব্যবস্থা করা। ল্যাস্কি বলেছেন: “Any social system reveals itself as a struggle for the control of economic power, since those who possess this power, are able, in the measure of their possession, to make their wants effective. Law then becomes a system of relations giving the expression of legal form to their want.” যে সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের মৌল উপাদানগুলি ব্যক্তিগত মালিকানার অধীন, সেখানে রাষ্ট্রীয় আইন সম্পত্তিবান শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে থাকে। আইন এ ক্ষেত্রে সমকালীন সম্পত্তি সম্পর্ক (property relations) রক্ষা করে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই আইন আর্থনীতিক দিক থেকে প্রাধান্যকারী শ্রেণীর সর্বাধিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করে। এখানে আইন আর্থিক ক্ষেত্রে প্রাধান্যকারী শ্রেণীর দাবি ও বক্তব্য ব্যক্ত করে।

যে সমাজের আর্থনীতিক সম্পর্ক অসমান, সেই সমাজে আর্থনীতিক ক্ষমতার বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য বর্তমান থাকে। এ ধরনের সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় আইন এক বিশেষ ধরনের সম্পর্ক রক্ষার মাধ্যম হিসাবে কাজ করে। এবং এ ক্ষেত্রে আইনের একমাত্র উদ্দেশ্যও হল অসম আর্থনীতিক সম্পর্ক সংরক্ষণ। অসম আর্থনীতিক সম্পর্কভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় রাজনীতিক উপরি-কাঠামো ও আইন আর্থিক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। এই শ্রেণীর চাহিদা পূরণের উপায় হিসাবে আইন ভূমিকা পালন করে। সকল সমাজব্যবস্থাতেই আইন উৎপাদন-উপাদানের মালিক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ করে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় আইন সামন্ত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। এই সমাজে সামস্ত-প্রভুদের ধারণা অনুসারে সমাজের সাধারণ স্বার্থ বলতে কি বোঝায় তা স্থিরীকৃত হয়। তা ছাড়া সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুক্তিও সামন্ত শ্রেণীর ধারণা অনুসারে নির্ধারিত হয়ে থাকে। আবার পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রয়োজন ও চাহিদা অনুসারে আইন ব্যবস্থা নির্ধারিত হয়। এই ধরনের সমাজব্যবস্থায় আইনের মাধ্যমে পুঁজির মালিক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আইনের উদ্দেশ্য হল শ্রমিক শ্রেণীর চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণ করা। এই ধরনের সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানসমূহের উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ল্যাস্কি বলেছেন: “The way, therefore, in which economic power is distributed at any given time and place, will shape the character of the legal imperatives which are imposed in that same time and place.” আর্থনীতিক ক্ষমতার অসম বণ্টনের উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থায় মালিকানাহীন বা ক্ষমতাহীন মানুষের সংখ্যাই হল বেশি। এই সমস্ত ব্যক্তি রাজনীতিক ক্ষমতাকেন্দ্রে তাদের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। সুতরাং এই ধরনের রাষ্ট্রে আইন সম্পত্তিবান শ্রেণীর স্বার্থেই কাজ করে। ল্যাস্কি এ ক্ষেত্রে একাধিক উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। তিনি উদাহরণ হিসাবে ইংল্যাণ্ডের ট্রেড ইউনিয়ন আইন, আমেরিকার চুক্তির স্বাধীনতা, প্রুসিয়ার কৃষি আইন প্রভৃতির ইতিহাসের কথা বলেছেন। এই সমস্ত উদাহরণের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন: “a dominant class uses the State to make ultimate those legal imperative which best protect is interests.”

আর্থনীতিক ক্ষমতা যদি সমভাবে বণ্টিত থাকে, তাহলে সমাজের সকল ব্যক্তি বা শ্রেণী রাজনীতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে সমানভাবে তাদের দাবি বা চাহিদাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সম নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার জন্য সকলে রাজনীতিক ক্ষেত্রে অভিন্ন নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিকারী হয়। এ রকম ক্ষেত্রে আইন সমাজের সকল অংশ বা শ্রেণীর চাহিদা পূরণের অনুপন্থী হয়। সমানভাবে আর্থনীতিক ক্ষমতা বণ্টিত হলে রাষ্ট্রীয় আইনের আচরণ হয় পক্ষপাতহীন। তখন সকলের দাবি বা চাহিদা সমভাবে কার্যকর করার সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ যত সুষমভাবে আর্থনীতিক ক্ষমতা বণ্টিত থাকবে, রাষ্ট্রের আইনানুগ অনুজ্ঞা ও সমাজের সাধারণ স্বার্থের মধ্যে তত নিবিড় সম্পর্কের সৃষ্টি হবে। ল্যাস্কি বলেছেন: “…the more equally economic power is distributed, the profounder will be the relation between the general interest of the community and the legal imperatives imposed by the state. For obviously, equal reconomic power means equal effective demand.” আর্থনীতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে সমতা কার্যকর চাহিদার ক্ষেত্রে সমতা আনয়ন করে। এবং যে-কোন রাষ্ট্রে আইনের প্রকৃতি সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের কার্যকর চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। সমাজের আর্থনীতিক ক্ষমতা বণ্টনের চরিত্রের উপর কার্যকর চাহিদা নির্ভরশীল। সমাজের আর্থনীতিক ক্ষমতা সুষমভাবে বণ্টিত হলে রাষ্ট্রীয় আইনের সঙ্গে সমাজের সাধারণ স্বার্থের ব্যাপক ও গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হবে।

সুতরাং রাষ্ট্রের ভিতরে কোন নির্দিষ্ট সময়ে যে সকল কার্যকর চাহিদা সৃষ্টি হয়, তার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে রাষ্ট্র আইনানুগ অনুজ্ঞা জারি করে। এবং সমাজে আর্থিক ক্ষমতা যে ভাবে বণ্টিত থাকে তার উপর ভিত্তি করেই এই সামঞ্জস্য সাধিত হয়। কিন্তু সরাসরি এ কথা বলা হয় না। যে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতাশালী শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হল রাষ্ট্রের এই সমস্ত আইনানুগ অনুজ্ঞা। বস্তুত মুখোশ হিসাবে এগুলিকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই মুখোশের আড়ালে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্যকারী শ্রেণীই রাজনীতিক ক্ষমতাকেন্দ্রের সুযোগ-সুবিধা লাভ করে থাকে। ল্যাস্কি বলেছেন: “The legal order is a mask behind which the dominant economic interest secures the benefit of political authority.” আপাত দৃষ্টিতে আইনকে সর্বজনীন স্বার্থের প্রতিভূ এবং স্বার্থ-নিরপেক্ষ বলে প্রতিপন্ন করা হয়। কিন্তু আসলে আইন আর্থনীতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্যকারী শ্রেণীর স্বার্থ ও দাবিকে প্রতিফলিত করে থাকে।

আইন সম্পর্কিত ল্যাস্কির উপরিউক্ত ব্যাখ্যা অবশ্যই মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি-প্রসূত। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। এই ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে বিবিধ বিরূপ সমালোচনার অবকাশ আছে। অধ্যাপক ল্যাস্কি এ বিষয়ে সম্যক সতর্ক ছিলেন। তাই তিনি সম্ভাব্য বিরূপ সমালোচনা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং প্রয়োজনমত জবাব দিয়েছেন।

ল্যাস্কি বলেছেন যে, তিনি এ কথা বলতে চাননি যে শাসকশ্রেণী কখনই যুক্তিসঙ্গত বা ন্যায়সঙ্গতভাবে কাজ করে না। তার অভিমত হল, জীবনধারার পার্থক্যের জন্য মানুষের চিন্তাধারাতেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তিনি বলেছেন: “…men think differently who live differently.” শ্রেণী-সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেক ব্যক্তির একটি বিশেষ অবস্থান আছে। ব্যক্তিমাত্রেই এই অবস্থান থেকে বিচার করে সমাজ ও জনসম্প্রদায়ের স্বার্থে কোন আইন কাম্য এবং কোন আইন কাম্য নয়।

সমালোচকদের মতানুসারে আধুনিক রাষ্ট্রে প্রতিনিধিমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বর্তমান। সুতরাং এ ধরনের শাসনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আইনের আর্থনীতিক ব্যাখ্যা অর্থহীন। অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে আপাত বিচারে উপরিউক্ত যুক্তিটি যতটা সঙ্গত প্রতিপন্ন হয়, আসলে তা নয়। উদারনীতিক গণতন্ত্রে সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার স্বীকার করা হয়। তারফলে এই ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় কেবল রাজনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অবস্থায় আইনের মাধ্যমে সর্বসাধারণের সর্বাধিক স্বার্থ সংরক্ষিত হবে এ রকম কোন নিশ্চয়তা নেই। পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে আর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রগুলিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত থাকে। শিল্প-কারখানা, ভূসম্পত্তি, সংবাদপত্র, বেতার-চলচ্চিত্র টেলিভিশন প্রভৃতির উপর বে-সরকারী মালিকানা বজায় থাকে। এগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন কার্যকর ক্ষমতা জনসাধারণের হাতে থাকে না। আর্থনীতিক ক্ষমতার বণ্টনের ক্ষেত্রে এই বৈষম্যজনিত কারণে সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের অভিপ্রেত সুফল পাওয়া যায় না। এ ধরনের বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় সম্পত্তিবান শ্রেণী সমাজের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের উপর তাদের কর্তৃত্ব কায়েম করে এবং এই সুবাদে সংশ্লিষ্ট জনসাধারণের মতামতকে প্রভাবিত করে তাদের রাজনীতিক ক্ষমতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। সমাজের সাধারণ মানুষ তাদের রাজনীতিক ক্ষমতার তাৎপর্য সম্পর্কে সতর্ক থাকে না। বস্তুত বিত্তবান শ্রেণীই এই ক্ষমতার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। ল্যাস্কির অভিমত হল: “He who commands property commands everything.”

(গ) রাষ্ট্রের প্রকৃতি

দার্শনিক বিশ্লেষণ: কেবলমাত্র আইনের কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের প্রকৃতি পর্যালোচনা করা যায় না। রাষ্ট্রের প্রকৃতি যথাযথভাবে অনুধাবনের ক্ষেত্রে আইনের দৃষ্টিকোণ এককভাবে যথেষ্ট নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আইনের গণ্ডীর বাইরে কোন বিষয়কেই বিচার-বিশ্লেষণ করা যায় না। ল্যাস্কি এ বিষয়ে সম্যকভাবে সতর্ক ছিলেন। এই কারণে তিনি কেবলমাত্র আইনের ব্যবস্থা হিসাবে রাষ্ট্রের প্রকৃতি পর্যালোচনা করেননি। তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের সাধারণ উদ্দেশ্য এবং কোন বিশেষ সময়ে আইনের প্রকৃতি আলোচনা করা প্রয়োজন। তাছাড়া একটি বিশেষ মানদণ্ডের সাহায্যে রাষ্ট্রীয় আইনের প্রকৃতি পর্যালোচনা করা দরকার। অর্থাৎ ল্যাস্কি এ ক্ষেত্রে দার্শনিক বিশ্লেষণের ব্যাপারেও অগ্রসর হয়েছেন। আইনের কাঠামোর বাইরে বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে তিনি রাষ্ট্রের প্রকৃতি অনুসন্ধানের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন।

শ্রেণী-সমাজে রাষ্ট্রের প্রকৃতি: অধ্যাপক ল্যাস্কি রাষ্ট্রের প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি হিসাবে আর্থনীতিক বিষয়াদির উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের প্রকৃতি নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থনীতির মানদণ্ডে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শ্রেণী-সংগ্রাম থাকে। ল্যাস্কি বলেছেন: “Any social system reveals itself as a struggle for control of economic power.” এই সংগ্রামে বিজয়ী শ্রেণীই রাষ্ট্রের শাসন কর্তৃত্ব কায়েম করে। আর্থনীতিক দিক থেকে প্রাধান্যকারী, শ্রেণীই সমাজের শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান করে এবং এই সুবাদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের কলাকৌশলগুলিকে করায়ত্ত করে রাখে। ল্যাস্কি বলেছেন: “It may be taken as a general rule that the character of any particular state will be a function of the economic system which obtains in the society it controls.” রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত তার যথার্থ প্রকৃতি আর্থনীতিক ব্যবস্থার প্রকৃতির দ্বারা নির্ধারিত হয়। একটি বিশেষ আর্থনীতিক ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্যই রাষ্ট্র কাজ করে। এই কারণে সমকালীন সামাজিক শৃঙ্খলা সংরক্ষণের স্বার্থে রাষ্ট্র একটি বিশেষ আইনব্যবস্থা বা ধারণাগত কাঠামো গড়ে তোলে। এইভাবে রাষ্ট্র সমাজের আর্থনীতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্যকারী শ্রেণীর কার্যকর চাহিদার সর্বাধিক পরিতৃপ্তির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। ল্যাস্কি বলেছেন: “The state, as it operates, does not seek general justice or general utility, but the interest in the largest sense of the dominant class in society.” রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যের প্রকৃতি আর্থনীতিক ব্যবস্থার প্রকৃতির দ্বারা স্থিরীকৃত হয়ে থাকে। সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্র অপরিহার্যভাবে একটি আইন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে। সমকালীন সমাজব্যবস্থা সংরক্ষণের মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রচলিত শ্রেণী-সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যবস্থা করে। ল্যাস্কি বলেছেন: “(The state) is the supreme coercive power in any given political society; but it is, in fact, used to protect and promote in that society the interest of those who own its instruments of production.”

সম্পত্তিবান শ্রেণীর স্বার্থে রাষ্ট্র কাজ করে: রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালিত হয় আর্থনীতিক দিক থেকে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর স্বার্থে। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্যকারী শ্রেণীর রাষ্ট্রদর্শন রাষ্ট্রের প্রকৃতি নির্ধারণ করে থাকে। ল্যাস্কির মতানুসারে আর্থনীতিক দিক থেকে প্রভাবশালী শ্রেণীর বাইরে রাষ্ট্রের কোন পৃথক পরিচিতি বা স্বতন্ত্র সত্তা থাকে না। সম্পত্তির অধিকার কায়েম করা গেলে রাষ্ট্র-যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পাওয়া যায়। এই কারণে রাষ্ট্রীয় আইন সমকালীন শ্রেণী-সম্পর্কের ব্যবস্থাকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। যেমন সামস্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণী-সম্পর্ক রক্ষার উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আমলে সম্পত্তিবান শ্রেণীর মৌলিক মূল্যবোধ সমর্থনে রাষ্ট্র তার পীড়নমূলক ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে। এবং তদনুসারে রাষ্ট্রীয় আইন প্রণীত ও প্রযুক্ত হয়। অর্থাৎ যে সমাজে উৎপাদনের উপাদানসমূহ ব্যক্তিগত মালিকানাধীন থাকে সেখানে একটি বিশেষ ধরনের শ্রেণী-সম্পর্কের ব্যবস্থা বজায় রাখতে হয়। এর উদ্দেশ্য হল সম্পত্তির মালিকানার সুবিধা রক্ষা করা। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা বজায় রাখে।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে আর্থনীতিক ক্ষমতার লাগাম যাদের হাতে আছে, তারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। সমাজে যে শ্রেণীর হাতে আর্থনীতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বর্তমান থাকে সেই শ্রেণীই রাষ্ট্র তথা আইনানুগ অনুজ্ঞার প্রকৃতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা গ্রহণ করে। এবং অপরদিকে যারা মালিকানার সুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা তাদের দাবি বা চাহিদাকে কার্যকর করতে পারে না। তাদের সামনে একটি পথই খোলা থাকে, তা হল আর্থনীতিক ক্ষমতার পুনর্বণ্টনের ব্যবস্থা। তা করতে গেলে প্রচলিত শ্রেণী-সম্পর্কের পরিবর্তন প্রয়োজন। এবং যে-কোন শ্রেণী-সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল একটি শ্রেণী চিরস্থায়ীভাবে আর্থনীতিক ক্ষমতার অধিকারী থাকতে পারে না। সমাজে আর্থনীতিক ক্ষমতার অধিকারী শ্রেণীর পরিবর্তন ঘটে। কালক্রমে অন্য একটি শ্রেণী আর্থনীতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়। এই শ্রেণীই তখন রাজনীতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব করায়ত্ত করে। এবং এই শ্রেণীই নিজেদের স্বার্থে আইনানুগ অনুজ্ঞাগুলি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে। এইভাবে রাষ্ট্র ও তার আইনানুগ অনুজ্ঞার প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে।

আইনানুগ অনুজ্ঞার ব্যবস্থা হিসাবে রাষ্ট্রের কোন স্থায়ী ভিত্তি নেই: ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের প্রকৃতি পর্যালোচনার জন্য রাষ্ট্রের ভিতরে আর্থনীতিক দিক থেকে প্রাধান্যকারী শ্রেণীর ভূমিকা অনুধাবন করা আবশ্যক। রাষ্ট্রের মধ্যে একাধিক শ্রেণী আর্থনীতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় সামিল হয়। এইভাবে একটি শ্রেণী আর্থনীতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়। এবং সেই শ্রেণীই নিজেদের শ্রেণী-স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। এইভাবে রাষ্ট্রের ভিতরে বিভিন্ন শক্তির মধ্যে একটি ভারসাম্য অবস্থায় রাষ্ট্রের অবস্থান। কিন্তু এই ভারসাম্য চিরস্থায়ী নয়। আইনানুগ অনুজ্ঞার ব্যবস্থা হিসাবে বিবেচনা করলে রাষ্ট্রের কোন স্থায়ী ভিত্তি নেই। যে সমস্ত শক্তি আইনকে প্রভাবিত করে, তাদের যদি পরিবর্তন ঘটে, তা হলে অপরিহার্যভাবে আইনের উপর প্রতিষ্ঠিত সামন্তরিক স্বরূপ রাষ্ট্রের অবস্থানগত পরিবর্তন সাধিত হয়। আইনের প্রকৃতি নির্ধারণকারী উপাদানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রকৃতিরও পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের ভিত্তিগত শক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে রাষ্ট্রের প্রকৃতিরও পরিবর্তন ঘটে।

অস্থায়ী সামন্তরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের তুলনা: ল্যাস্কির মতানুসারে রাষ্ট্র একটি অস্থায়ী সামন্তরিক (temporary parallelogram)-এর আকার ধারণ করে। আইনানুগ অনুজ্ঞার ব্যবস্থা হিসাবে রাষ্ট্রকে ল্যাস্কি একটি অস্থায়ী সামন্তরিকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যে সকল বাহুকে নিয়ে একটি অস্থায়ী সামন্তরিক ক্ষেত্র গঠিত হয়, সেই বাহুগুলির যদি অবস্থানগত পরিবর্তন ঘটে, তা হলে সামন্তরিক ক্ষেত্রের অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ সামন্তরিক ক্ষেত্রের অস্থায়ী অবস্থান কতকগুলি শক্তির দ্বারা নির্ধারিত হয়। এই সমস্ত শক্তির পরিবর্তন ঘটলে, সামন্তরিক ক্ষেত্রের অবস্থানেরও পরিবর্তন ঘটে। রাষ্ট্রও হল একটি সামন্তরিক ক্ষেত্রের মত। সমাজের আর্থনীতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটলে রাষ্ট্রেরও অবস্থানগত পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের ভিত্তিগত শক্তির যদি পরিবর্তন হয়, তা হলে রাষ্ট্রের প্রকৃতিগত পরিবর্তন অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কির অভিমত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “The State as a system of legal imperatives is a temporary parallelogram of forces the character of which shifts as the forces alter which determine its moment any position.”

রাজনীতিক ক্ষমতার প্রকৃতি: রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা প্রসঙ্গে ল্যাস্কি রাজনীতিক ক্ষমতার প্রকৃতি সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এই ব্যক্তিবর্গকেই সরকার বলে। এই সরকারের ক্ষমতা নিঃশর্ত নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উপর এই সমস্ত ব্যক্তির অধিকার শর্তসাপেক্ষ। সরকারী সিদ্ধান্তসমূহ যাদের উপর প্রযুক্ত হয় তারা ক্ষমতা প্রয়োগকারীদের ভূমিকার পর্যালোচনা করতে পারে। ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন “A working theory of the State must in fact, by conceived in administrative terms.” সরকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের আইনানুগ ক্ষমতা যাদের হাতে ন্যস্ত আছে তাদের সিদ্ধান্তই রাষ্ট্রের ইচ্ছা (Will of the State) হিসাবে প্রতীয়মান হয়। প্রাত্যহিক প্রশাসনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সমস্ত ব্যক্তির ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ইচ্ছায় পরিণত হয়। নাগরিকদের জীবনকে রাষ্ট্রের ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং এ বিষয়ে মতামত প্রকাশের অধিকার নাগরিকদের আছে। ল্যাস্কি রাষ্ট্রকে সমাজের একটি উপাদান বা হাতিয়ার হিসাবে উল্লেখ করেছেন। নাগরিকদের স্বার্থেই রাষ্ট্র নাগরিকদের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে। সমাজের অন্যান্য সংঘ সংগঠনের মধ্যে রাষ্ট্র হল অন্যতম। তবে অন্য সংগঠনের সঙ্গে রাষ্ট্রের পার্থক্য আছে। কিন্তু নৈতিক প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র ও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের মধ্যে পার্থক্য নেই। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কির অভিমত হল: “The State is thus a felloship of men aiming at the enrichment of common life.”

অধিকারই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি: ল্যাস্কি অধিকারকেই রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসাবে অভিহিত করেছেন। এ ক্ষেত্রে ল্যাস্কির বক্তব্য বহুলাংশে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের অনুপন্থী। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের চূড়ান্ত বিকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করা উচিত। তিনি বলেছেন: “(State is) an organisation for enabling the mass of men to realise the social good on the largest scale.” মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে। এই ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের কাজকর্ম একেবারে নির্ভুল বা নির্দোষ এমন দাবি করা যায় না। সুতরাং যে সমস্ত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রযুক্ত হয় তাও সবসময় ত্রুটিমুক্ত নাও হতে পারে। সামাজিক মঙ্গল সম্পর্কে এই সমস্ত ব্যক্তির ধারণা সামাজিক বা মঙ্গলময় নাও হতে পারে। সুতরাং সমাজের কাছে ব্যক্তির দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র সম্পর্কে ব্যক্তি তার ধারণা স্থির করবে। রাষ্ট্রীয় আইনের নিজস্ব কোন নৈতিক ন্যায্যতা নেই। রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক রাষ্ট্রীয় আইনসমূহের নৈতিক প্রকৃতি অনুধাবন করে। সমাজের অন্য সকলের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় অধিকার লাভের হক প্রত্যেক নাগরিকের আছে। এই সমস্ত অধিকার ছাড়া ব্যক্তি আর নাগরিক থাকে না, দাসত্ব প্রাপ্ত হয়। যে রাষ্ট্র এই সমস্ত অধিকার সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করতে পারে না, নাগরিকের কাছে সেই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অর্থহীন। এই সমস্ত অধিকারই রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে একটি নৈতিক প্রকৃতি প্রদান করে। ল্যাস্কি বলেছেন: “Rights in this sense, are the ground work of the State.” তাঁর আরও অভিমত হল: “Every government is thus built upon a contingent moral obligations. Its action are right to the degree that they maintain rights.”

(ঘ) আইনের প্রতি আনুগত্য

আইনের প্রতি আনুগত্যের বিভিন্ন ব্যাখ্যা: অধ্যাপক ল্যাস্কি রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনার প্রাক্কালে আইন ও আইনের প্রতি আনুগত্য এবং আইনের যৌক্তিকতা ও বৈধতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। প্রথমে তিনি প্রচলিত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আইনের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নটি পর্যালোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি মূলত তিনটি মতবাদের কথা বলেছেন। এই তিনটি মতবাদ হল: (১) আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্ব (pure theory of law), (২) আইনের ধর্মীয় ধারণা (theological concept of law) (৩) আইনের বিশ্বসৃষ্টি তত্ত্ব (cosmological concept of law)। উপরিউক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিচার-বিবেচনা করার পর ল্যাস্কি আইনের বৈধতা ও যথার্থতা সম্পর্কে নিজের মতবাদ ব্যাখ্যা করেছেন। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কি তাঁর মতবাদকে দুদিক থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। একটি হল পরমলক্ষ্যবাদ (teleological concept) এবং অন্যটি হল সম্মতি তত্ত্ব (theory of consent)।

আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্ব: আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্ব (pure theory of law) অনুসারে আইনকে মান্য করার কারণ আইনের উৎসের মধ্যেই বর্তমান। রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে। সুতরাং রাষ্ট্র হল আইনের উৎস। রাষ্ট্র সার্বভৌম শক্তিসম্পন্ন। আইনের পিছনে রাষ্ট্রের পীড়নমূলক শক্তি বর্তমান। আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অনুমোদন থাকে। এই কারণে আইন মান্য করা হয়। এই হল আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্বের মূল কথা। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের আদেশ ও অনুমোদন হল আইনের যৌক্তিকতা ও বৈধতার একমাত্র মানদণ্ড। সুতরাং আইন মান্য করা ছাড়া উপায় থাকে না। আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ল্যাস্কি বলেছেন : “A law is still a law whether we deem it just or unjust” আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল এই যে, আইন হল রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং আইনের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য থাকবে। এই তত্ত্ব অনুসারে আইনের যৌক্তিকতা, বৈধতা বা গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপনের অধিকার নাগরিকদের নেই। আইনের প্রতি নাগরিকদের আনুগত্য হল শর্তহীন ও অবাধ।

আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্বের সমালোচনা:

আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্বকে ল্যাস্কি সমর্থন করেননি। আইনের প্রতি আনুগত্যের মৌল কারণ হিসাবে তিনি এই তত্ত্বকে স্বীকার করেননি। আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্বের বিরুদ্ধে ল্যাঙ্কির বক্তব্য ব্যাখ্যা করা দরকার।

  • (১) ল্যাস্কি আইনের প্রতি আনুগত্যের সমস্যাটিকে গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার-বিবেচনা করেছেন। গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপ্রেক্ষিতে আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্বকে সমর্থন করা যায় না।
  • (২) এই মতবাদের উৎস হিসাবে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে স্বীকার করা হয়। এর থেকে আইনের প্রকৃত উৎস এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের পীড়নমূলক ক্ষমতার প্রয়োগ সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু আইনের যৌক্তিকতার উপর এই তত্ত্ব আলোকপাত করে না।
  • (৩) আইনের প্রকৃত চরিত্র এবং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে এই মতবাদ থেকে কিছু জানা যায় না। তা ছাড়া ব্যক্তি আইনের লক্ষ্যকে নিজের লক্ষ্য হিসাবে কেন বিবেচনা করবে তাও এই তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় না।
  • (৪) রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অনুমোদনকে আইন হিসাবে মেনে চলার কোন কারণ নেই। ল্যাস্কি রাজনীতিক আনুগত্য প্রকাশের একমাত্র ভিত্তি হিসাবে আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্বকে স্বীকার করেন নি।
  • (৫) ল্যাস্কির মতানুসারে রাষ্ট্রীয় আইন ব্যক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অনুভবের বিরোধী হতে পারে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নির্দেশের প্রতি আনুগত্য আশা করা অন্যায়।
  • (৬) ল্যাস্কির অভিমত হল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বই আইনের যৌক্তিকতার একমাত্র ভিত্তি হিসাবে বিবেচিত হতে পারে না। আইনের সারবত্তা ও যৌক্তিকতার অন্য ভিত্তি থাকা আবশ্যক। তিনি বলেছেন: “The commands of the state, therefore, must justify themselves on grounds other than their source in the part of the State.” এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কির আর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “The sanction of the rules made by the State is simply force; and force in itself is void of moral content.”

ধর্মগত ব্যাখ্যা: আইনের প্রতি আনুগত্য ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আর একটি ব্যাখ্যা হল ধর্মীয় (theological)। ল্যাস্কি আইনের ধর্মগত ভিত্তি সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। আইনের ভিত্তি এবং উদ্দেশ্য ও আদর্শ সম্পর্কে দেশ ও কালভেদে বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। প্রাচীনকালে ধর্মকে কেন্দ্র করেই আইন সম্পর্কে মানুষের ধ্যান-ধারণা গড়ে ওঠে। আদিম মানুষের অভিজ্ঞতায় আইনের ধারণা ছিল ধর্মগত। এই ধারণা অনুসারে বলা হয় যে মানবসমাজকে শাসন করার উদ্দেশ্যে ঈশ্বর কতকগুলি প্রনিয়ম প্রণয়ন করে পাঠিয়েছিলেন। ভগবানের তৈরী এই নিয়ম বা বিধানগুলি হল আইন। অতএব আইনের উৎস হলেন ভগবান। আইন ভগবৎ-প্রদত্ত। এই আইনের মধ্যে ঈশ্বরীয় ক্ষমতা বর্তমান। সুতরাং আইন মান্য করে চলা উচিত। কেউই আইনকে অমান্য করতে পারে না। আইনকে অমান্য করার অর্থ হল ভগবানের বিধানকে অবজ্ঞা করা। তা করলে দেবতার কোপ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না; দেবতার ক্রোধের শিকার হতে হবে। আইন সম্পর্কিত এই ধারণার সমর্থনে মোসেজ (Moses)-এর আইন এবং হাম্মুরাবি (Hammu rabi)-র আইনের কথা বলা হয়। আইনের এ ধরনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আরও বলা হয় যে, পুরোহিতরা আগেকার আচার-ব্যবহার ও রীতিনীতিগুলিকে আইনে রূপান্তরিত করেছেন। এই কারণে আইন মান্য করে চলা বাধ্যতামূলক।

সমালোচনা: প্রাচীনকালে মানুষ আইন সম্পর্কে ঈশ্বরীয় বিধানের ব্যাখ্যাকে মর্যাদা দিত। পরবর্তীকালে আইনের এই ব্যাখ্যা আর গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। অধ্যাপক ল্যাস্কিও আইনের ধর্মগত ব্যাখ্যাকে স্বীকার করেননি। তাঁর অভিমত অনুসারে আইনের এই ব্যাখ্যা হল আদিম মানুষের প্রাচীন ইতিহাসের বিষয়। আইনের এই ব্যাখ্যাকে স্বীকার করা যায় না। তা ছাড়া ল্যাস্কির আরও অভিমত হল যে, ধর্মীয় অনুমোদনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত আনুগত্যের ধারণা ঐতিহাসিক গবেষণায় সমর্থন করা হয়নি।

বিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বের ভিত্তিতে আইনের ব্যাখ্যা:

আইন সম্পর্কে আর একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান। এক শ্রেণীর দার্শনিক আছেন যাঁরা আইনকে বিশ্বের সৃষ্টি তত্ত্বের প্রতীক হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। রোমান আইনে আইনের উৎস হিসাবে বিশ্বপ্রকৃতির কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে টমাস অ্যাকুইনাস-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অ্যাকুইনাস আইন সম্পর্কিত আলোচনার ক্ষেত্রে বিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তিনি আইনকে একটি দর্পণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বিশ্বপ্রকৃতির নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি ও বিধানসমূহ আইনের দর্পণে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। এই কারণে মানুষের আচার-আচরণ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া আবশ্যক। আইনকে অমান্য করা নাগরিকের দিক থেকে অনুচিত।

কাণ্ট ও হেগেল: কাণ্ট এবং হেগেল এই দুই জার্মান দার্শনিকও আইনের আলোচনায় বিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বের ধারণায় আস্থাশীল ছিলেন। কাণ্ট আইন সম্পর্কে উপরিউক্ত ধারণা পোষণ করতেন। তাঁর মতানুসারে আইন মান্য করার মাধ্যমেই ব্যক্তি তার সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। ব্যক্তিমাত্রেই অন্য সকলের সঙ্গে মিলিতভাবে এই স্বাধীনতা ভোগ করার সুবিধা লাভ করে। আইনকে কাণ্ট কতকগুলি নীতি হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। এই নীতিগুলি মান্য করে চললে ব্যক্তির স্বাধীনতা বিস্তৃত হয়, ব্যাহত হয় না। হেগেলের মতবাদেও বিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। হেগেলের মতানুসারে রাষ্ট্র বা সার্বভৌমের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যই হল সর্বোৎকৃষ্ট স্বাধীনতার ভিত্তি। তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের প্রতিনিধিস্বরূপ নৃপতির প্রতি নাগরিকদের শর্তহীন আনুগত্য প্রদর্শন করতে হবে। এর কোনরকম অন্যথা করার অধিকার নাগরিকদের নেই। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রুশিয়ার রাজার প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য প্রদর্শনের কথা বলেছেন। এবং তাঁর মতানুসারে, এভাবেই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠতর স্বাধীনতার স্বাদ পাবে। হেগেলের অভিমত অনুসারে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে ইতিহাসের বিবর্তন ঘটে। এই বিবর্তনের ধারা চরম পরিণতি লাভ করে রাষ্ট্রের মধ্যে। ইতিহাসের বিবর্তনের এই প্রক্রিয়া বিরতিবিহীনভাবে ঘটে। এই বিবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তি সর্বোৎকৃষ্ট স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হতে পারে।

সমালোচনা: ল্যাস্কি আইন সম্পর্কিত বিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বকে সমর্থন করেননি। ধর্মীয় মতবাদের মতই তিনি এই মতবাদকেও মেনে নেননি। উপরিউক্ত দু’টি মতবাদের বিরুদ্ধেই তিনি কতকগুলি প্রশ্ন তুলেছেন বা যুক্তির অবতারণা করেছেন।

  • (১) এই সমস্ত মতবাদে আইনকে ব্যক্তির যে-কোন রকম নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা হয়েছে। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্যক্তির কোন ভূমিকাকে স্বীকার করা হয়নি। সমাজবদ্ধ মানুষের অভিজ্ঞতা এবং উদ্যোগের স্বাধীনতাকে এ ক্ষেত্রে অস্বীকার করা হয়েছে। অর্থাৎ আইনের ব্যাপারে ব্যক্তির কোন হাত নেই। তাই ল্যাস্কি আইন সম্পর্কিত এই ধরনের তত্ত্বের উপযোগিতাকে উপেক্ষা করেছেন।
  • (২) বিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে আইনের ভিত্তি নির্ধারণের প্রচেষ্টাও সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ এই তত্ত্বে মানবসমাজের বিধিব্যবস্থাকে জড়-জগতের বিধি-নিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ল্যাস্কির মতানুসারে এই ধারণা ভ্রান্ত এবং এই উদ্যোগ অর্থহীন।
  • (৩) ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে আইনসম্পর্কিত আলোচ্য মতবাদগুলি পক্ষপাতদুষ্ট এবং একদেশদর্শী। এই মতবাদগুলির মাধ্যমে অনুমোদনের অপেক্ষা না করে অন্যের অভিজ্ঞতাকে সংখ্যাগুরু মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
  • (৪) আইনের ধর্মগত এবং বিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে এক বিশেষ ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এই সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সংখ্যালঘু ব্যক্তিবর্গের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে কাজ করে যাবে। ল্যাস্কির অভিমত হল : “Most of the theories of law have always justified a social order in which the many have lived for the benefit of the few.” এই ব্যবস্থাকে মেনে নেওয়া যায় না।
  • (৫) ল্যাস্কির আরও অভিমত হল যে মানবসমাজ গতিশীল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। সমাজবদ্ধ মানুষই তার সক্রিয় ইচ্ছা ও উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজের গতিশীলতা ও বৈচিত্র্য বজায় রাখে। এইভাবে মানুষ সমাজের যে-কোন বিষয়কে বজায় রাখতে পারে। আবার প্রয়োজনমত পরিবর্তন করতে পারে। অথচ আইনের প্রচলিত তত্ত্বগুলিতে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের সম্মতির বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
  • (৬) হেগেলীয় মতবাদে প্রুশিয়ার রাজার প্রতি শর্তহীন আনুগত্যের মধ্যেই ব্যক্তির স্বাধীনতার সর্বোচ্চ বিকাশের কথা বলা হয়েছে। ল্যাস্কি এই হেগেলীয় ধারণার বিরূপ সমালোচনা করে বলেছেন: “It is hardly a caricature of Hegel’s theory of the state to say that, for him man found the highest expression of freedom in obedience to the king of Prussia.”

পরমলক্ষ্যবাদ:

আইন সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাগুলি পর্যালোচনা করার পর ল্যাস্কি আইন সম্পর্কে তাঁর নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্যের দু’টো দিক বর্তমান। এই দু’টো দিক হল পরমলক্ষ্যবাদ (technology) এবং সম্মতি তত্ত্ব (theory of consent)। ল্যাস্কির মতানুসারে একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য থাকতে হবে। আইনের এই উদ্দেশ্য হবে জনগণেরই উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যগত বিচার-বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে জনগণ উদ্যোগী ও উদ্বুদ্ধ হবে। আইনের উদ্দেশ্যের সঙ্গে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তা হলে আইনের উপযোগিতা সম্পর্কে জনগণের উপলব্ধি হবে। এবং তখন আইনের প্রতি জনগণের আনুগত্যের সৃষ্টি হবে। ল্যাস্কি আইনের এই ধারণাটিকে পরমলক্ষ্যবাদ (Teleology) বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন: “… we have to add so to say a teleology to law in order to commend it to the acceptance of men.”

সম্মতিতত্ত্ব:

ল্যাস্কি আইনের ভিত্তি সম্পর্কিত আলোচনায় সম্মতি তত্ত্বের উপর জোর দিয়েছেন। সম্মতিই হল আইনের মূল ভিত্তি। প্রতিটি আইনের পিছনে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের সম্মতির অস্তিত্ব অপরিহার্য। আইনের মৌলিক নীতির পিছনে মানুষের সম্মতি থাকা একান্তভাবে প্রয়োজন। এই সম্মতির অস্তিত্বই আইনের যথার্থতা ও বৈধতাকে প্রতিষ্ঠিত করে। আইনের প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন না করলে, তা মেনে চলতে নাগরিক বাধ্য নয়। ল্যাস্কি বলেছেন: “Laws cannot be binding upon men unless they consent to make it so.” ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে নাগরিকদের কাছে আইনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য আইনের পিছনে সম্মতির অস্তিত্ব একান্তভাবে অপরিহার্য। তাদের সম্মতিক্রমে আইন প্রণীত হওয়ার জন্যই মানুষ আইন মান্য করে চলতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে নিজেদের সম্মতির মাধ্যমে মানুষ তাদের আনুগত্যের বিষয়টিকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন করে। এই তত্ত্ব অনুসারে বলা হয় যে তারাই আইনের বিষয়বস্তু প্রণয়ন করে, তাই মানুষ রাষ্ট্রীয় আইন মেনে চলে। প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম এক বিরতিবিহীন গণভোট-ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। An Introduction to Politics শীর্ষক গ্রন্থে ল্যাস্কি বলেছেন: “The State is conducted by permanent referendum, and its law which binds its members because they are themselves making its substance.”

সম্মতি তত্ত্ব ও চুক্তিবাদ:

আইন সম্পর্কে ল্যাস্কির সম্মতি তত্ত্বের পক্ষে সমর্থনসূচক কিছু বক্তব্য সামাজিক চুক্তি মতবাদের মধ্যে পাওয়া যায়। এই মতবাদের মাধ্যমে সম্মতি তত্ত্বের এক অসম্পূর্ণ রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। ল্যাস্কি চুক্তিবাদের সম্মতির দিকটিকে সমর্থন করেছেন। তাঁর মতানুসারে আইনের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করার জন্য আইনের পিছনে জনগণের সম্মতি থাকা দরকার। বলা হয় যে চুক্তিবাদ সম্মতি তত্ত্বের ভিত্তি হিসাবে বর্তমান। ইংরাজ দার্শনিক হস-এর মতানুসারে প্রাকৃতিক পরিবেশের চরম নৈরাজ্য থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে মানুষ অসীম ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে সার্বভৌমের হাতে। আবার চুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন লক্-এর অভিমত অনুসারে জনগণ শর্তসাপেক্ষে চুক্তির মাধ্যমে সীমাবদ্ধ ক্ষমতা শাসকদের হাতে প্রদান করেছে। ফরাসী দার্শনিক রুশোর মতানুসারে সাধারণের ইচ্ছা (General Will) হল সর্বশক্তিমান বা সার্বভৌম। তাঁর অভিমত অনুসারে রাষ্ট্র চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট এবং জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত।

চুক্তিবাদের সমালোচনা:

আইনের সম্মতি তত্ত্বের সমর্থনে চুক্তিবাদের অবদান অনস্বীকার্য। এতদ্সত্ত্বেও ল্যাস্কি চুক্তিবাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। তিনি চুক্তিবাদের কতকগুলি ত্রুটির কথা বলেছেন: (১) ল্যাস্কি চুক্তিবাদকে অনৈতিহাসিক বলে অভিযুক্ত করেছেন। চুক্তির ফলে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাসে এমন কোন নজির নেই। বস্তুত ধীরে ধীরে রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। ল্যাস্কি বলেছেন: “The State has not been made, but has grown.” (২) রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল বিষয়ে ঐক্যমতের আশা করা যায় না। অনেক সময় সংখ্যালঘুদের মতামতকে উপেক্ষা করা হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত অনুসারে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পরিচালিত হয়ে থাকে। (৩) বর্তমানে বাস্তবে প্রশাসন পরিচালনার প্রয়োজনে এবং সরকারের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কিছু মানুষের উপর বলপ্রয়োগ করতে হয়। তবে ল্যাস্কির মতানুসারে, ন্যূনতম শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আইনের প্রতি আনুগত্য আদায় করা বাঞ্ছনীয়। (৪) আইনের পিছনে সম্মতি প্রদানের পর ফলাফলের ভিত্তিতে এই সম্মতি প্রত্যাহৃত হলে সংকটের সৃষ্টি হয়।

রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের ভিত্তি সম্পর্কে ল্যাস্কির মত:

আইন মান্য করার কারণ সম্পর্কে আলোচনার প্রাক্কালে অধ্যাপক ল্যাস্কি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও তার ভিত্তি সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। ল্যাস্কি রাষ্ট্রের নিঃশর্ত কর্তৃত্বকে স্বীকার করেননি। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব নিঃশর্ত হতে পারে না এবং এই কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনও নিঃশর্ত হতে পারে না। তিনি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের ভিত্তির বিষয়টি পর্যালোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্যের ব্যাপারে রাষ্ট্র কর্তৃত্বের কোন দাবি থাকতে পারে না। নাগরিকরা রাষ্ট্রের কাছে কার্যকর । পেশ করে থাকে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের ভিত্তি এই সমস্ত দাবি পূরণের সামর্থ্যের উপর নির্ভরশীল। ল্যাস্কি বলেছেন: “The authority of the State is a function of its ability to satisfy the effective demands that are made upon it.”

রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্যের শর্ত:

রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের লক্ষ্য এবং রাষ্ট্রীয় আদেশ-নির্দেশের উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিকরা তাদের আনুগত্য প্রকাশের বিষয়টি বিচার-বিবেচনা করে এবং তদনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাদের জন্য রাষ্ট্র কি করতে চায় তা পর্যালোচনার পরই নাগরিকরা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে মেনে চলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। ল্যাস্কি বলেছেন: “The power of the State can be justified only in terms of what it seeks to do. Its law must be capable of justification in terms of the demand it seeks to satisfy.” নাগরিকরা যখন দেখবে যে আইন তাদের স্বার্থ সাধন করছে এবং তাদের উপকারে আসছে, তখনই তারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের আদেশ ও নির্দেশকে মেনে চলবে। তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দাবি পূরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সামর্থ্যের উপর নাগরিকদের আনুগত্য প্রকাশের বিষয়টি নির্ভরশীল। তবে রাষ্ট্র নাগরিকদের সর্বাধিক দাবি পূরণ করবে অত্যল্প ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে। তা হলেই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের যথার্থতা প্রতিষ্ঠিত হবে। ল্যাস্কি বলেছেন: “…the power of the State is justified to the degree that secures, at the best possible sacrifice, the maximum satisfaction of human wants….” অর্থাৎ ল্যাস্কি রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে নিঃশর্তভাবে স্বীকার করেননি। রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের অনুগত্য প্রকাশ শর্তসাপেক্ষ। এই শর্তটি হল রাষ্ট্র কর্তৃক সামাজিক দাবি পূরণের ক্ষমতা। এই দাবি যত বেশী পরিমাণে রাষ্ট্র পূরণ করতে পারবে তার প্রতি নাগরিকদের আনুগত্য হবে তত গভীর ও ব্যাপক। ল্যাস্কি বলেছেন: “Its (States) claim to allegiance must obviously be built upon its power to make the response to social demand maximal in character.”

উপসংহার: রাষ্ট্র ও আইনের প্রকৃতি এবং রাষ্ট্র ও আইনের প্রতি আনুগত্যের বিষয়টিকে ল্যাস্কি গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি এক ব্যাপক ও বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে তিনি রাজনীতিক আনুগত্যের আলোচনা করেছেন। আবার মার্কসীয় দর্শনের মূল বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে তাঁর রাষ্ট্র ও আইনের প্রকৃতি সম্পর্কিত আলোচনার ইমারত রচিত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, ল্যাস্কির উপরিউক্ত আলোচনায় ভাববাদ বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কোন প্রভাব পড়েনি; অধ্যাপক ল্যাস্কি সম্মতি তত্ত্বের উপর রাষ্ট্র ও আইনের আলোচনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং এইভাবে তিনি উপযোগবাদ বা হিতবাদী তত্ত্বের ধারণাকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে অধ্যাপক ল্যাস্কি এক ব্যাপক ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র ও আইনের প্রকৃতি সম্পর্কিত সমগ্র আলোচনাটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন।