প্রশ্নঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে মতবাদগুলাে কী কী? তােমার মতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক মতবাদ কোনটি আলােচনা কর।

অথবা, রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে মতবাদগুলাে উল্লেখ কর। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সর্বাধিক গ্রহণযােগ্য মতবাদটি আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্য বা দলিল পাওয়া যায় না। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন অতীত ইতিহাস ও রাজনৈতিক ঘটনাবলীর আলােকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ প্রদান করেছেন। যেমন- ঐশ্বরিক মতবাদ, সামাজিক চুক্তি মতবাদ, বলপ্রয়ােগ মতবাদ, জৈব মতবাদ, ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ ইত্যাদি। এসব মতবাদের পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন।

বিধাতার সৃষ্টিমূলক মতবাদঃ একথা সত্য যে, রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্বন্ধে বিধাতার সৃষ্টিমূলক মতবাদই সর্বাপেক্ষা প্রাচীন মতবাদ। এ মতবাদের মূলকথা হচ্ছে যে, বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের অন্যান্য সবকিছুর ন্যায় রাষ্ট্রও বিধাতা কর্তৃক সৃষ্ট। রাজা বা শাসক বিধাতার প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তার মাধ্যমেই বিধাতার ইচ্ছা প্রকাশিত হয়। রাজার আনুগত্য স্বীকার করা প্রত্যেকেরই ধর্মীয় কর্তব্য। তার আদেশ-নির্দেশ অমান্য করা বিধাতাকে অমান্য করার শামিল। বিধাতার প্রতিনিধি হিসেবে রাজা তার কার্যাবলীর জন্য একমাত্র বিধাতার নিকট দায়ী। রাজা শুধু রাষ্ট্রপ্রধানই নন, তিনি ধর্মীয় প্রধানও বটে।

এ মতবাদের সমর্থকদের মধ্যে মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তাবিদ সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট টমাস একুইনাস, রবার্ট ফিলমার ও ফান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ত্রয়ােদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরােপে সৃষ্ট ধর্মগুরু পােপ এবং রাষ্ট্রনায়ক সম্রাট উভয়েই নিজেকে খােদার প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করেন। তা ছাড়া ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস ও প্রথম চার্লস এ মতবাদের সাহায্যে স্বেচ্ছাচারী শাসকের ন্যায় রাজ্য শাসন করতে থাকেন।

সামাজিক চুক্তি মতবাদঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটি জনগণের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করেছে। সামাজিক চুক্তিবাদীদের মতে, আদিম যুগে রাষ্ট্রের কোনাে অস্তিত্ব ছিল না। শাসক বা আইন-কানুন কিছুই ছিল না। মানুষ তখন প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করতাে। তখন সমাজে প্রাকৃতিক আইন নামে এক ধরনের আইনের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু এমন এক সময় এলাে যখন প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠল ও মানুষ বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হল। ফলে সেই অবস্থা হতে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করতে উদ্যোগী হয়। এই চুক্তিকেই ‘সামাজিক চুক্তি মতবাদ’ বলে। সামাজিক, চুক্তি মতবাদের প্রকৃত সমর্থক হলেন বৃটেনের টমাস হবস, জন লক এবং ফরাসি দার্শনিক জ্যা জ্যাক রুশাে। এ ব্যাপারে তিনজনই একমত যে, প্রকৃতির রাজ্যের অবস্থার হাত হতে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে।

বিবর্তনমূলক মতবাদঃ ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদের মূলকথা হলাে, রাষ্ট্র ঐতিহাসিক বিবর্তনের অব্যবহিত ফল। রাষ্ট্র বিধাতা কর্তৃক একদিনে হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি। এটা বলপ্রয়ােগের মাধ্যমেও সৃষ্টি হয়নি। এটা মানুষের চুক্তিরও ফল নয় রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সকল কাল্পনিক মতবাদই বর্তমানে বর্জিত হয়েছে। এ সম্পর্কে অধ্যাপক গার্নার যথার্থই লিখেছেন, রাষ্ট্র বিধাতার অমােঘ সৃষ্টি নয়, এটা দৈহিক বল প্রয়ােগের ফলশ্রুতিও নয়, কোনাে প্রস্তাব বা সম্মেলন হতেও এটার সৃষ্টি হয়নি। এমনকি পরিবারের সম্প্রসারণের মধ্য দিয়েও এটার জন্ম হয়নি। বস্তুত বহু যুগের ও বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণে বহুবিধ স্তর পার হয়ে রাষ্ট্র তার বর্তমান রূপ লাভ করেছে। এটা এক ক্রমবিবর্তনের প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ।

বলপ্রয়ােগ মতবাদঃ বল প্রয়ােগ মতবাদের মূল বক্তব্য হলাে বলই রাষ্ট্রের ভিত্তি ও বল প্রয়ােগের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। এ মতবাদে বলা হয় যে, মানুষের কার্যকলাপ ও আচরণ ক্ষমতালি ও আত্মশক্তির প্রকাশ- এ দু’টি আদিম প্রবৃত্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এ মতবাদের সমর্থকগণের মতে, মানুষ স্বভাবত কলহপ্রিয় এবং ক্ষমতালিপ্সু। মানুষের আদিম জীবনে অবিরত সংঘাত, যুদ্ধ ও আক্রমণ চলেছিল এবং বলবান শ্রেণী দুর্বল শ্রেণীকে বিজিত করে দাসে পরিণত করে। ফলে বংশ ও উপজাতির উদ্ভব হয়। পরে বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। বিজয়ী উপজাতি দলপতি নেতা বলে স্বীকৃত হল। আদিম সমাজে বংশ ও উপজাতির মধ্যে বিবাদ ও লড়াই শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের বিকাশের পথে সহায়তা করেছিল। এরূপ যুদ্ধ-সংঘাতের মাধ্যমে এক উপজাতির নেতা বহু উপজাতিকে পরাজিত করে উল্লেখযােগ্য আয়তনের নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডের ওপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়। আর এভাবেই রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক মতবাদঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক মতবাদ কোনােটি তা বলা খুবই কঠিন। তবে এ পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের প্রদত্ত চুক্তি, আলােচনা, সমালােচনা বিশ্লেষণ অনুসারে বলা যায় যে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত যতগুলি মতবাদ রয়েছে তার মধ্যে ঐতিহাসিক মতবাদ বা বিবর্তনমূলক মতবাদই সর্বাপেক্ষা অধিক গ্রহণযােগ্য। তাই আমি মনে করি, রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদগুলির মধ্যে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদই সঠিক। নিম্নে এ সম্পর্কে যুক্তি ও আলােচনা উপস্থাপন করা হলাে-

(১) রক্তসম্পর্কঃ আদি সমাজে রক্তসম্পর্কই ছিল রাষ্ট্র গঠনের একমাত্র ভিত্তি। সর্বপ্রথম এ রক্তের সম্পর্ক একই পরিবারভুক্ত সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বিবাহ-বন্ধন, সন্তান-সন্ততির লালন-পালন স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের সৃষ্টি করে। পরিবার প্রধানই ছিলেন পরিবারের সর্বময় কর্তা। তাই Maclver পরিবারকে ক্ষুদ্র সরকার বলে অভিহিত করেছেন। কালক্রমে লােকসংখ্যা বৃদ্ধি ও নতুন নতুন সমস্যাদির উদ্ভবের ফলে পরিবারের বিস্তৃতি ঘটে এবং বিভিন্ন গােষ্ঠী, সম্প্রদায় ও উপজাতির সৃষ্টি হয়। এ সকল সম্প্রদায় ও উপজাতি পরবর্তীকালে সম্প্রদায়গত ও জাতিগত ঐক্যের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। এ ঐক্যবােধ থেকেই পরিশেষে রাষ্ট্রের উত্তর ঘটে।

(২) ধর্মীয় বন্ধনঃ কালক্রমে গােষ্ঠীর সংখ্যা সম্প্রসারণের ফলে রক্তের সম্পর্কে শিথিলতা দেখা দেয় এবং ধর্মই সমাজের নববন্ধনের সূত্র হিসাবে গণ্য হয়। আদিম মানুষ ধর্মভয়ে ভীত ছিল। যারা অদৃশ্য শক্তির ব্যাখ্যা দিয়ে ঈশ্বর ও ধর্মের নামে অনুশাসন প্রচার করতেন তারাই ছিলেন রাজা বা শাসক। আর সবাই এই রাজা বা শাসককে মান্য করে চলত।

(৩) অর্থনৈতিক ব্যবস্থাঃ ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা, শ্রেণীবিভাগ, শ্রমবিভাগ, ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্প্রসারণের ফলে জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়, ফলে আইন প্রণয়ন ও শান্তি-শৃঙ্খলার অভাব চরমভাবে অনুভূত হয়। অর্থনৈতিক শােষণের জন্য এক শ্রেণীর ওপর অন্য শ্রেণীর প্রভাব-প্রতিপত্তি ভীষণাকার ধারণ করে। আর সংগঠিত রাষ্ট্রই মানুষের এ অভাব পূরণ করতে পারে। এদিকে পণ্যবিনিময় ব্যবস্থার উন্নতির ফলে বাণিজ্যের প্রসার ঘটে ও বণিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বিরােধ সংযত রাখার জন্য আইন প্রণয়ন ও প্রশাসন যন্ত্রের সৃষ্টি অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

(৪) যুদ্ধঃ আদিম সমাজের ইতিহাস রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের ভূমিকা কম নয়। আদিম সমাজের ইতিহাস মূলত যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস। এখানে যুদ্ধ-বিগ্রহ, কলহ-দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। যে ব্যক্তি যত বেশি পরাক্রমশালী তার আধিপত্য ছিল তত বেশি এভাবে এক বলপ্রয়ােগকারী শক্তির উদ্ভব ঘটে এবং তিনি ক্রমশ সার্বভৌম শক্তিতে পরিণত হন। মানুষ তার আনুগত্য স্বীকার করে ঐক্যবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ হয়। ধীরে ধীরে উপজাতিসমূহের স্থলে এক বৃহত্তর রাষ্ট্রসত্তার সৃষ্টি হয়।

(৫) রাজনৈতিক চেতনাঃ এটা রাষ্ট্র সৃষ্টিতে এক উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছে। যেদিন থেকে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে শুরু করেছে সেদিন থেকে মানুষের মধ্যে এক অপরিণত রাজনৈতিক চেতনা গড়ে উঠেছিল। এই রাজনৈতিক চেতনাই মানুষকে রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করেছে। রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটার সঙ্গে সঙ্গে উপজাতীয় সংহতি সাধিত হয়। আক্রমণ ও প্রতিরক্ষার জন্য উপজাতীয় নেতার প্রতি আনুগত্য বেড়ে যায় এবং নেতার নির্দেশ আইন হিসাবে মেনে চলার প্রবণতা দেখা দেয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের উৎপত্তিসংক্রান্ত উপযুক্ত মতবাদগুলাের আলােচনার শেষে বলা যায় যে, এদের মধ্যে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদই সর্বাপেক্ষা অধিক গ্রহণযােগ্য ও বিজ্ঞানসম্মত। বিবর্তনবাদ অন্যান্য মতবাদের মত এককদর্শী নয়, সমমতবাদগুলির সমন্বয়মাত্র। তাই আমি মনে করি, রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদগুলির মধ্যে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদই সঠিক। অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই এ প্রসঙ্গে একমত প্রদান করেছেন।