মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্ব বাস্তব-ভিত্তিক ও তাৎপর্যপূর্ণ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় কেন্দ্রীয় বিষয় হল ‘রাষ্ট্র’। রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে মানুষের চিন্তা-ভাবনার অন্ত নেই। এই সূত্রে রাষ্ট্রের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ও প্রকৃতি প্রসঙ্গে বহু ও বিভিন্ন মতবাদের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে মার্কসীয় তত্ত্বকেই সর্বব্যাপক ও বিজ্ঞানসম্মত বলে দাবি করা হয়। রাষ্ট্রের মত অন্য কোন রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান মার্কসীয় রাজনীতির আলোচনায় এত গুরুত্ব পায়নি। প্রকৃত প্রস্তাবে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্র সম্পর্কিত আলোচনায় মার্কসীয় রাষ্ট্রদর্শন এক বৈপ্লবিক অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। ভাববাদী রাষ্ট্রতত্ত্বকে মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বে অস্বীকার করা হয়েছে। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে রাষ্ট্র হল সমাজের আভ্যন্তরীণ বৈপ্লবিক রূপান্তরের ফলস্বরূপ। সমাজের বাইরে থেকে আরোপিত একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্রকে প্রতিপন্ন করা বিভ্রান্তিকর। বস্তুত মার্কসবাদে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের উদ্ভব, ক্রমবিকাশ ও প্রকৃতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্ব বাস্তবভিত্তিক এবং বিজ্ঞানসম্মত। এই কারণে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্ব বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছে এবং তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

মার্কস কিন্তু নির্দিষ্ট কোন গ্রন্থে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন নি। মার্কসের বিভিন্ন রচনায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে আলোচনা পাওয়া যায়। রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে মার্কসীয় ধারণার পরিচয় পাওয়া যায় যে সমস্ত রচনায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: Critique of Hegal’s Doctrine of the State, The German Ideology, The Gotha Programme, Paris Manuscripts, The Eighteenth Brumaire of Louis Bonaparte, The Class-struggles in France প্রভৃতি। পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি শীর্ষক রচনায় ফ্রেডারিক এঙ্গেলস মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বের এক মনোজ্ঞ পরিচয় দিয়েছেন। ঐতিহাসিক এবং রাজনীতিক বিচারে গ্রন্থটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট গ্রন্থে এঙ্গেলস রাষ্ট্রসৃষ্টির এক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত বিপ্লবী ও মার্কসবাদী তাত্ত্বিক লেনিনের রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র ও বিপ্লব শীর্ষক রচনা দু’টিও তাৎপর্যপূর্ণ। তা ছাড়া কার্ল মার্কসের কালজয়ী রচনাগুলিও এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবার মার্কস-এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-র গুরুত্বও এ ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য।


এঙ্গেলসের অভিমত: ফ্রেডরিক এঙ্গেলস তাঁর The Origin of Family Private Property and State শীর্ষক গ্রন্থে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিস্তারিতভাবেই আলোচনা করেছেন। মার্কসের সহযোগী বন্ধু এঙ্গেলসের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় একটি বিশেষ স্তরে। এবং সমাজের ভিতর থেকেই রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে। সমাজ এক সময় সমাধানের অতীত এক সবিরোধের আবর্তে জড়িয়ে পড়ে। সামঞ্জস্যহীন, আপসহীন বিরোধে সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরই অভিব্যক্তি হল রাষ্ট্র। এই সমস্ত অন্তর্দ্বন্দ্ব ও পরস্পর-বিরোধী আর্থনীতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শ্রেণীসমূহের সংঘাত নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বিশেষ শক্তির প্রয়োজন দেখা দেয়। এই শক্তি বা ক্ষমতা আপাতদৃষ্টিতে সমাজের ঊর্ধ্বে থাকবে এবং সংশ্লিষ্ট সংঘাতকে শৃঙ্খলার পরিধির মধ্যে সংযত রাখবে। এঙ্গেলসের মতানুসারে সমাজ থেকেই এই শক্তি বা ক্ষমতার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সমাজের ঊর্ধ্বে তা সুপ্রতিষ্ঠিত এবং তা নিজেকে সমাজ থেকে ক্রমশ বিযুক্ত করে। একেই বলা হয় রাষ্ট্র। সুতরাং এঙ্গেলসের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্র হল একটি বিশেষ শক্তি বা ক্ষমতা। অকস্মাৎ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় নি। আবার বাইরে থেকেও রাষ্ট্রকে চাপিয়ে দেওয়া হয় নি। রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে সমাজ থেকেই। রাষ্ট্র হল মীমাংসার অতীত শ্রেণী-বিরোধের ফল। এঙ্গেলস বলেছেন: “The state is, by no means, of power foced on society from without…. Rather it is a product at a certain stage of development, it is the admission that this society has become entangled in an insoluble contradiction with itself.” এঙ্গেলসের অভিমত অনুযায়ী সমাধানের অতীত শ্রেণী-বিরোধেরই ফলশ্রুতি হল রাষ্ট্র। শ্রেণী-বিরোধ যখন বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়, তখন বিরোধীতার সম্পর্ককে সংযুক্ত করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতাশালী শ্রেণী নিজেদের শ্রেণী-স্বার্থ সামগ্রিকভাবে সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে। বস্তুত রাষ্ট্র প্রাধান্যকারী শ্রেণীর স্বার্থকে সুরক্ষিত করার যন্ত্র হিসাবে প্রতীয়মান হয়। রাষ্ট্র দাস-যুগে দাস মালিকদের, সামস্ত যুগে সামন্তপ্রভুদের এবং শিল্পযুগে বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এঙ্গেলস আরও বলেছেন যে, এথেন্সে শ্রেণীবিরোধিতা থেকে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। এই রাষ্ট্র হল শ্রেণী-রাষ্ট্র। পরবর্তীকালে তৈরী হয়েছে রোমের রাষ্ট্রব্যবস্থা। সে সময় প্রাধান্যকারী অভিজাত শ্রেণী অন্যান্য শ্রেণীর মানুষকে অধীনে রাখার জন্য রাষ্ট্রকে নিযুক্ত করত। পরবর্তী পর্যায়ে সৃষ্টি হয়েছে বৃহদায়তন রাষ্ট্রের। যুদ্ধবিগ্রহের পরিণামে বিজিত দলের উপর বিজয়ী দলের শাসন কায়েম করার জন্যই এই রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে রোমান সাম্রাজ্যের কথা বলা হয়েছে।

লেনিনের অভিমত: লেনিনের মতানুসারে রাষ্ট্র সম্পর্কে সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য আলোচনার উপায় হল সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ইতিহাসের উপর নজর দেওয়া। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা দরকার যে রাষ্ট্র সব সময় ছিল না। সমাজে শ্রেণীবিভাগ — শোষক ও শোষিত শ্রেণী, যখন ও যেখানেই দেখা দেয়, তখনই এবং সেখানেই রাষ্ট্রও দেখা দেয়। লেনিন তাঁর The State শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “When classes appeared every where and always, as the division grew and took fimer hold, there also appeared a special institutions – the state.” আদিম সাম্যবাদী ধরনের সমাজে কোন রাষ্ট্র ছিল না। তখন নিয়মিতভাবে বলপ্রয়োগের এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে কোন বিশেষ যন্ত্রের ব্যবস্থা ছিল না। বলপ্রয়োগের এই যন্ত্রটিই হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র শীর্ষক রচনায় লেনিন বলেছেন যে, একটি শ্রেণীর উপর অন্য একটি শ্রেণীর আধিপত্য অব্যাহত রাখার যন্ত্রই হল রাষ্ট্র। আবার রাষ্ট্র ও বিপ্লব শীর্ষক রচনায় লেনিন বলেছেন যে, সামজ্ঞস্যহীন শ্রেণীবিরোধের অভিব্যক্তি ও শ্রেণী-সংগ্রাম থেকে সৃষ্ট সংগঠনটি হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয় তখনই, যখন শ্রেণী-সংগ্রামের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য বিধান অসম্ভব প্রতিপন্ন হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, শ্রেণী সংঘাতের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য সাধন অসম্ভব। বিখ্যাত বিপ্লবী ও মার্কসবাদী তাত্ত্বিক লেনিন তার রাষ্ট্র ও বিপ্লব শীর্ষক গ্রন্থে এবং কিছু বক্তৃতায় রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় ধ্যান-ধারণা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। মানবসমাজের আদিম অবস্থা অতিক্রম করার পর উৎপাদনজনিত ক্রিয়াকলাপ বিকাশের এক বিশেষ পর্যায়ে রাষ্ট্রব্যস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আর্থনীতিক বিকাশের ঐ বিশেষ পর্যায়টি হল মানবসমাজে শ্রেণী-দ্বন্দ্বের প্রথম পর্যায়। মার্কসীয় ব্যাখ্যা অনুসারে মানবসমাজে যখন শ্রেণীভেদ দেখা দিল তখনই রাষ্ট্রের মত কিছু দমনমূলক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। আদিম সমাজে শ্রেণীভেদ ছিল না। তাই তখন রাষ্ট্র বলতে কিছু ছিল না। আবার ভবিষ্যতে সভ্যতার অতি উন্নত কোন স্তরে মানবসমাজে শ্রেণীভেদ থাকবে না। সেই অবস্থায় রাষ্ট্রও থাকবে না। এই হল মার্কসীয় লেখকদের ধারণা।

শ্রেণী-দ্বন্দ্বের ফলেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি: সমাজ বিবর্তনেরই ধারা অনুযায়ী সামাজিক শ্রেণীভেদের সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক শ্রেণীভেদের অনিবার্য ফল হল সামাজিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়ন্ত্রণ করার তাগিদেই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সৃষ্টি। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে রাষ্ট্র হল একটি শক্তি-সমাবেশ। এর উদ্দেশ্য হল সামাজিক দ্বন্দ্বগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে সামাজিক শ্রেণীসমূহের সংঘাত ও সংঘর্ষ দূরপনেয় ও দূরতিক্রম্য হওয়ার জন্য। লেনিন তাঁর রাষ্ট্র ও বিপ্লব শীর্ষক গ্রন্থের শুরুতেই বলেছেন: ‘রাষ্ট্র হল মীমাংসার অসাধ্য শ্রেণী-বৈরিতার প্রকাশ ও ফল’ (“The state is the product and the manifestation of the irreconcilability of class-antagonisms.”)। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে মার্কসীয় ব্যাখ্যাটি অনুধাবনের জন্য রাষ্ট্রীয় শক্তি ও ব্যবস্থার সঙ্গে শ্রেণী-সংগ্রামের সম্পর্কটি আলোচনা করা দরকার।

রাষ্ট্র শাশ্বত নয়: মার্কসবাদীদের মতানুসারে আদিম অবস্থায় মানুষে মানুষে কোন ব্যবধান বা ভেদাভেদবোধ ছিল না। তখন যে সমস্ত স্বাভাবিক বুদ্ধি বা শক্তিগত ব্যবধান ছিল তা কৃত্রিম মর্যাদাগত বা ভোগ-অধিকারগত বৈষম্য করতে না। মার্কসবাদীরা এই অবস্থাকেই ‘আদিম সাম্যবাদী অবস্থা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই সমাজ ছিল সমভোগবাদী। এই সমাজে মানুষের মধ্যে সম্পত্তি-সংক্রান্ত কোন ধারণা ছিল না। যা কিছু ভোগ্যদ্রব্য আহরণ, সংগ্রহ বা উৎপাদন করা হত, তা সমাজের স্ত্রী পুরুষ সকলে মিলেই সমতার নীতিতে গ্রহণ করত। তখন সমাজে শ্রেণীভেদ ও শ্রেণী-দ্বন্দ্ব ছিল না। তাই তখন রাষ্ট্রশক্তির মত চরম বা চূড়ান্ত কোন দমন ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল না। এঙ্গেলস তাই বলেছেন: ‘রাষ্ট্র কোন শাশ্বত অনাদিকালের প্রতিষ্ঠান নয়। অতীতে এক সময়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা বা রাষ্ট্রশক্তি-সংক্রান্ত কোনরূপ ধারণা ছাড়াই সমাজজীবন অতিবাহিত হয়েছে’ (“The state has not existed from all eternity. There have been societies that did without it, that had no conception of state and state power.”)। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভব হয়েছে বিবর্তনের এক উন্নততর পর্যায়ে। যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা এবং উৎপাদন-ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণজনিত মর্যাদাবোধ ও বিশেষাধিকার বোধ গড়ে উঠেছে তখন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি, যোগানের আপেক্ষিক অপ্রতুলতা, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা ইত্যাদি নানা কারণে সমাজের আদিম সাম্যবাদী কাঠামোতে এক মৌলিক পরিবর্তন শুরু হয়। কালক্রমে মানবসমাজের আপন-পর ভেদাভেদ, স্বাতন্ত্র্যকামিতা, ব্যক্তিগত সম্পদ ও সঞ্চয়, উৎপাদনপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রবণতা সমাজের মধ্যে গোষ্ঠীগত বা শ্রেণীগত ভেদাভেদ সৃষ্টি করল। এরই অনিবার্য পরিণতি হল সামাজিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। নানাভাবে ক্ষমতা ও অধিকারবলে ধনসম্পত্তি অর্জনের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে ব্যবধান বাড়তে লাগল। কালক্রমে এক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর হাতে বিপুল ধনসম্পত্তি কেন্দ্রীভূত হল। ধনসম্পত্তি অর্জন ও উৎপাদন কার্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সমাজে দু’টি মূল শ্রেণী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। মার্কসবাদী বিশ্লেষণ অনুসারে আজও মানবসমাজ মূলত ঐ দু’টি শ্রেণী-গোষ্ঠীতেই বিভক্ত। এই দুই গোষ্ঠীর পরিচয় ‘শোষক’ ও ‘শোষিত’ হিসাবে। উৎপাদন কার্য নিয়ন্ত্রণকারী মালিক শ্রেণী হল ‘শোষক’ বা ‘নিপীড়ক শ্রেণী’ (‘exploiter or ‘oppressor’)। অপরদিকে সম্পত্তিহীন শ্রমজীবীরাই হল ‘শোষিত’ বা ‘নিপীড়িত শ্ৰেণী’ (‘exploited or ‘oppressed’)। এই দুই শ্রেণীর স্বার্থ পরস্পর-বিরোধী। তাই এরা সদাই দ্বন্দ্বে লিপ্ত। এবং এই দ্বন্দ্বের কোন রকম শান্তিপূর্ণ মীমাংসা সম্ভব নয়।

ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরে এই দুই প্রধান বিবদমান শ্রেণী দাসমালিক ও দাস, ভূস্বামী ও ভূমিদাস, শিল্পপতি বুর্জোয়া ও সর্বহারা শ্রমজীবী প্রভৃতি বিভিন্ন নামে পরিচিত। উৎপাদন ব্যবস্থার প্রকৃতি অনুসারে সকল সমাজব্যবস্থাতেই শোষক-শোষিতের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক বর্তমান। এবং এই দ্বন্দ্বমূলক শ্রেণী-সম্পর্কের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্রশক্তি।

ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যা: মার্কসবাদীদের মতানুসারে সমাজ ও ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে হলে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যেই তা করা দরকার। মার্কসীয় বস্তুবাদ হল দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism)। উৎপাদন প্রক্রিয়ার কার্যকলাপের অন্তর্গত অর্থাৎ উৎপাদন শক্তি (Forces of Production) এবং উৎপাদন-সম্পর্কের অর্থাৎ সম্পত্তি সম্পর্কের (Relations of Production) মধ্যে মৌলিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত বর্তমান। এই নিয়েই সমাজের মৌল কাঠামো (Basic Structure) গড়ে উঠে। এই মৌল কাঠামোর ভিত্তিতেই সমাজের উপরিতল বা উপরি-কাঠামোগত ( Super Structure) রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কার্যকলাপ পরিচালিত হয়। যে-কোন সমাজের রাষ্ট্রব্যবস্থা, ধর্মীয় ব্যবস্থা, সংস্কৃতি ইত্যাদির গতি-প্রকৃতি সেই সমাজের মৌলিক উৎপাদন ব্যবস্থা প্রভৃতি দ্বন্দ্ব-সংঘাতের গতি-প্রকৃতি অনুসারে নির্ধারিত হয়। শোষক-শোষিতের মধ্যে মূল দ্বন্দ্বে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে উভয় শ্রেণীই তাদের সুবিধাতে উপরি কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। কিন্তু শোষিতেরা হল স্বভাবতই দুর্বল। তাই তাদের তৈরি উপরি-কাঠামোগুলোও দুর্বল হয়। শোষকশ্রেণী শোষণ চালায় বলে সবল থাকে। তাই তাদের তৈরি উপরি কাঠামোগুলোই সমাজে প্রাধান্য পায়। এই কারণে সকল যুগেই রাজনীতি, ধর্ম বা সাংস্কৃতিক প্রধান প্রধান ধারাগুলি মূলত শোষকশ্রেণীর স্বার্থেই রচিত হয়েছে এবং অনুরূপভাবে বিবর্তিত হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিতশ্রেণীর সম্ভাব্য সব রকম আক্রমণ ও বিরোধিতা থেকে নিজেদের ধনসম্পত্তির ও ব্যক্তিজীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে শোষক শ্রেণী রাষ্ট্র নামক শক্তি সমাবেশটিকে গড়ে তুলেছে। এ দিক থেকে রাষ্ট্র হল একটি বলপ্রয়োগমূলক বা দমনমূলক ব্যবস্থা। সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত মানুষকে দমনের উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।

রাষ্ট্রের ধারণা: রাষ্ট্র সম্পর্কিত বুর্জোয়া ধারণা এবং মার্কসীয় ধারণা স্বতন্ত্র। মার্কস বিভিন্ন রচনায় রাষ্ট্রের ধারণা ব্যক্ত করেছেন। Grundrisse-এ ব্যক্ত ধারণা অনুসারে রাষ্ট্র হল একটি জটিল সংশ্লেষ। বহু সংখ্যক নির্ধারণকারীর সমন্বয়ে এই সংশ্লেষের সৃষ্টি হয় (“complex synthesis of multiple determinations”)। আবার ‘The Civil War in France’ শীর্ষক রচনায় রাষ্ট্রের ধারণা ব্যক্ত করতে গিয়ে সামরিক বাহিনী ও আমলাতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে আত্মরক্ষা বাহিনী ও বিচার বিভাগকে। আবার ‘The Eighteenth Brumaire of Louis Bonaparte’ শীর্ষক রচনায় মার্কস রাষ্ট্রকে একটি প্রশাসনিক ক্ষমতা হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। এই প্রশাসনিক ক্ষমতার সৃষ্টি হয় সামরিক বাহিনী ও আমলাতন্ত্রকে নিয়ে। গোড়ার দিকে মার্কস রাষ্ট্রকে সংজ্ঞায়িত করেছেন বিচ্ছিন্ন একটি সামাজিক ক্ষমতা হিসাবে। তবে তিনি পরবর্তী কালে সমাজের একটি অংশ হিসাবে রাষ্ট্রের ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন যে, রাষ্ট্র হল সমাজের একটি সংগঠন (“The State of the organisation of society.”)। সমাজের সকল সংগঠনকে রাষ্ট্র একটি রাজনীতিক চরিত্র প্রদান করে। মার্কসের মতানুসারে একটি নির্দিষ্ট সময়ের সামাজিক জীবনধারার অভিব্যক্তি ঘটে রাষ্ট্রের মাধ্যমে। তিনি রাষ্ট্রকে একটি নির্দিষ্ট ধরন হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। শাসকশ্রেণীর সদস্যরা এর মাধ্যমেই নিজেদের শ্রেণীর সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট হয়।

মার্কসবাদীদের মতে কালের বিবর্তনে শ্রেণী-দ্বন্দ্বের এক একটি পর্যায়ে রাষ্ট্রযন্ত্রটি এক একটি শ্রেণীর হস্তগত হয়েছে। এক একটি বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের পরিণতি হিসাবে নতুন একটি শ্রেণী উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে এবং এক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ামক হয়েছে। মার্কসবাদীদের বিশ্বাস আগামী দিনে বৃহত্তর শ্রমজীবী শ্রেণীর মানুষ ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে মহাবিপ্লবের সামিল হবে। তার ফলে পৃথিবী থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থা চিরতরে বিলুপ্ত হবে।

মূলকথা: রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাপারে মার্কসবাদীদের বক্তব্যের সার কথা হল: (ক) রাষ্ট্র কোন শাশ্বত, চিরন্তন বা অলৌকিক প্রতিষ্ঠান নয়। (খ) মানবসমাজের ক্রমবিবর্তনের ধারায় একটি বিশেষ পর্যায়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। (গ) সমাজে শ্রেণীভেদ এবং শোষক ও শোষিত শ্রেণীর সৃষ্টির ফলেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। (ঘ) যখন এবং যেখানে সমাজে শ্রেণীভেদ এবং শোষক ও শোষিত থাকে, তখন এবং সেখানে রাষ্ট্র থাকে। (ঙ) রাষ্ট্র হল শোষকশ্রেণীর আর্থনীতিক স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার বিশেষ। (চ) সংখ্যালঘু শোষক শাসকের স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত মানুষের বিরুদ্ধে দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহৃত হয়। (ছ) ইতিহাসের এক বিশেষ অধ্যায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষণের সম্ভাবনাকে চিরতরে শেষ করে দেবে। (জ) সমাজে যখন শ্রেণীভেদ ও শ্রেণী-শোষণ থাকবে না, তখন শোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রও থাকবে না।