ইংরাজ দার্শনিক হবস ও লক এবং ফরাসী দার্শনিক রুশো—এই ত্রয়ী চুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সকল বিষয়ে সমমত পোষণ করেন নি। তাঁদের বক্তব্যের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য দেখা যায়। হবস, লক্ ও রুশোর চুক্তিবাদী বক্তব্যের মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের সাদৃশ্য দেখা যায়।
রাষ্ট্রের উৎপত্তিবাদে হব্স, লক্ ও রুশোর মধ্যে সাদৃশ্য
(ক) তিনজনেই বলেছেন যে, রাষ্ট্র গঠনের আগে মানুষ ‘প্রাকৃতিক অবস্থায় বসবাস করত।
(খ) তিনজনেরই অভিমত হল যে, সামাজিক চুক্তির ফলেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।
(গ) তিনজনেই রাষ্ট্রের উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক এবং সার্বভৌমিকতা ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন।
(ঘ) তিনজনেই বিশ্বাস করতেন যে, জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির নিরাপত্তার জন্য মানুষ ‘প্রাকৃতিক অবস্থা পরিত্যাগ করে রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য উদ্যোগী হয়েছে।
রাষ্ট্রের উৎপত্তিবাদে হব্স, লক্ ও রুশোর মধ্যে বৈসাদৃশ্য
উপরিউক্ত সাদৃশ্য সত্ত্বেও এঁদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
(১) উদ্দেশ্যগত পার্থক্য: চুক্তিবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তিনজন চুক্তিবাদী দার্শনিকের মধ্যে উদ্দেশ্যগত পার্থক্য আছে। হবস চরম রাজতন্ত্র (Absolute Monarchy) এবং লক্ সীমাবদ্ধ রাজতন্ত্র ( Limited Monarchy)-কে সমর্থনের উদ্দেশ্যে চুক্তিবাদকে ব্যবহার করেছেন। হস ছিলেন ইংল্যাণ্ডের স্টুয়ার্ট রাজপরিবারের সঙ্গে যুক্ত। এই কারণে তিনি রাজতন্ত্রকে দৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেছেন ইংল্যাণ্ডের ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লবের সমর্থক হিসাবে লক নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রকে সমর্থন করেছেন। রুশো ছিলেন গণতান্ত্রিক আদর্শের সমর্থক। তাই তিনি ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেছেন।
(২) প্রাকৃতিক অবস্থা সম্পর্কে মতানৈক্য: প্ৰাকৃতিক অবস্থার প্রকৃতি সম্পর্কে হবস, লক্ ও রুশোর মধ্যে মতপার্থক্য বর্তমান। হর্ৎসের মতে ‘প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল প্রাক্-সামাজিক (pre-social)। এই অবস্থা হল কদর্য, কুৎসিত ও ভয়াবহ। যাকে পার মার, যা পার লুটে নাও’, ‘জোর যার মূলুক তার’—এই ছিল প্রাকৃতিক অবস্থার প্রকৃতি। এই কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষের জীবন হয়ে উঠল “নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, কদর্য, পাশবিক ও ক্ষণস্থায়ী”। লকের ‘প্রাকৃতিক অবস্থা’ হবসের প্রাকৃতিক অবস্থার মত ভয়াবহ নয়। লকের মতানুসারে প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল প্রাক্-রাষ্ট্রীয় (pre-political)—প্রাক্-সামাজিক নয়। তখন ন্যায়, যুক্তি ও বিবেকের অনুশাসন ছিল। সকলে ছিল স্বাধীন ও সমানাধিকারসম্পন্ন। রুশো বর্ণিত প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল মর্ত্যের স্বর্গ, রোমান্সের রাজত্ব। প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বিদ্বেষ, হিংসা, হানাহানি, স্বার্থপরতা প্রভৃতি ছিল না। প্রত্যেকে ছিল সুখী ও স্বাধীন। কালক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যক্তিগত সম্পত্তির সৃষ্টি এবং যুক্তি ও বিচার-বুদ্ধির উন্মেষের ফলে অশান্তি, বৈষম্য ও জটিলতার সৃষ্টি হয়।
(৩) মানব চরিত্র সম্পর্কে মতানৈক্য: হব্স বলেছেন মানুষ চরিত্রগতভাবে স্বার্থপর, লোভী, ধূর্ত, শঠ, নির্দয়, কলহপ্রিয় ও আক্রমণমুখী। লক্ কিন্তু ভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁর মতানুসারে মানুষ প্রকৃতিগতভাবে অসামাজিক বা আত্মসর্বস্ব নয়। প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ ছিল সামাজিক এবং অপরের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। তখন মানুষ বিবেক ও যুক্তির অনুশাসনের দ্বারা পরিচালিত হত। রুশোর মতানুসারে প্রাকৃতিক পরিবেশে আদিম মানুষ ছিল স্বাধীন, সরল, সুস্থ, সুখী ও সাহসী। তখন মানুষের মধ্যে সরলতা, সৌহার্দ্য ও সৌভ্রাতৃত্ব ছিল।
(৪) চুক্তির সংখ্যা সম্পর্কে মতানৈক্য: চুক্তির সংখ্যা সম্পর্কে চুক্তিবাদীদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হবসের মতে চুক্তি হয়েছে একটি। কিন্তু লকের মতানুসারে চুক্তি হয়েছে দুটি : প্রথমটি সামাজিক চুক্তি (Social contract) এবং দ্বিতীয়টি সরকারী চুক্তি (Governmental contract)। রুশো কিন্তু হবসের মত একটি চুক্তির কথা বলেছেন।
(৫) চুক্তির প্রয়োজন সম্পর্কে মতানৈক্য: চুক্তির মাধ্যমে কেন রাষ্ট্র সৃষ্টি করার দরকার এ বিষয়ে চুক্তিবাদী এই তিনজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। হবস বলেছেন, ভয়াবহ ও দুর্বিষহ প্রাকৃতিক অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের জন্যই মানুষ অনেক চেষ্টার পর চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। লকের মতানুসারে প্রাকৃতিক অবস্থার অপূর্ণতার জন্য মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। প্রাকৃতিক অবস্থা অপূর্ণতার তিনটি কারণ ছিল। এগুলি হল: (ক) প্রাকৃতিক আইন স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট ছিল না; (খ) এই আইন বলবৎ করার কোন কর্তৃপক্ষ ছিল না এবং এই আইন ব্যাখ্যা ও রক্ষা করার কোন ব্যবস্থা ছিল না। রুশোর মতানুসারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যক্তিগত সম্পত্তির সৃষ্টি এবং যুক্তি ও বিচারবুদ্ধির উন্মেষ—এই ত্রিবিধ কারণের জন্য অশান্তি, বৈষম্য ও জটিলতার সৃষ্টি হয়। এই অশান্ত ও অসহ্য অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের জন্য প্রাকৃতিক অবস্থার পরিবর্তে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সৃষ্টি দরকার হয়ে পড়ে।
(৬) চুক্তির প্রকৃতি সম্পর্কে মত-পার্থক্য: চুক্তিবাদীদের মধ্যে চুক্তির প্রকৃতি সম্পর্কেও ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা যায়। হবসের মতে আদিম মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করেছে। এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে প্রত্যেকের সঙ্গে সকলের এবং সকলের সঙ্গে প্রত্যেকের। এই চুক্তিটি একপাক্ষিক। রাজা চুক্তির কোন পক্ষ নন। তিনি হলেন চুক্তির ঊর্ধ্বে। চুক্তির শর্তের দ্বারা রাজা আবদ্ধ নন। লক্ কিন্তু ভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁর মতানুসারে আদিম মানুষ আগে নিজেদের মধ্যে একটি চুক্তি করেছে। এই চুক্তিটি হল সামাজিক চুক্তি। তার ফলে সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রের। তারপর জনগণের সঙ্গে রাজার একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এই চুক্তিটি হল সরকারী চুক্তি। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে সরকারের। রুশোর মতে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশের আদিম মানুষের নিজেদের মধ্যে বা প্রত্যেকের সঙ্গে সকলের। এই চুক্তির ফলে সৃষ্টি হয়েছে ‘সাধারণ ইচ্ছা।
(৭) সার্বভৌমের ক্ষমতার স্বরূপ সম্পর্কে মতানৈক্য: সার্বভৌমের ক্ষমতার প্রকৃতি প্রসঙ্গেও এই তিন চুক্তিবাদীর মধ্যে মতপার্থক্য আছে। হবসের মতানুসারে রাজা হলেন চরম ক্ষমতার অধিকারী। তিনিই সার্বভৌম এবং তাঁর বিরুদ্ধে জনগণের বিদ্রোহের অধিকার নেই। প্রাকৃতিক অবস্থায় আদিম মানুষ সকলে মিলে নিজেদের মধ্যে চুক্তি করেছে এবং তাদের সকল ক্ষমতা নিঃশর্ত ও চূড়ান্তভাবে এবং চিরতরে রাজার হাতে অর্পণ করেছে। অর্থাৎ আইনগত বিচারে রাজা হলেন সর্বশক্তিমান ও অবাধ ক্ষমতার অধিকারী। লকের মতানুসারে রাজা হলেন চুক্তির একটি পক্ষ। তাই তিনি চুক্তির শর্ত মেনে চলতে বাধ্য। রাজা চুক্তির শর্ত অমান্য করলে বা শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে প্রজাসাধারণ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে এবং তাঁকে পদচ্যুত করতে পারে। অক্ষম ও অত্যাচারী রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার জনগণের আছে। রুশো কিন্তু জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, জনগণ তাদের সকল ক্ষমতা নিঃশর্ত ও চূড়ান্তভাবে অর্পণ করেছে ‘সমষ্টিগত ইচ্ছা’ বা ‘সাধারণের ইচ্ছা’ (General Will)-র উপর। এই সাধারণের ইচ্ছাই হল সার্বভৌম। এই সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন হলে সরকারের পরিবর্তন সাধন করতে পারে।
(৮) সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে মতানৈক্য: হবস বলেছেন আইনগত সার্বভৌমিকতার কথা। তিনি রাজনীতিক বা গণসার্বভৌমত্বকে উপেক্ষা করেছেন। লক্ রাজনীতিক সার্বভৌমিকতার কথা বলেছেন। রুশো বলেছেন জনগণের সার্বভৌমিকতার কথা। রুশোর মতে সাধারণ ইচ্ছাই হল সার্বভৌম। সকলেই হল এই সাধারণের ইচ্ছার সমান অংশীদার। অর্থাৎ জনগণই হল সমষ্টিগতভাবে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। রুশো আইনগত সার্বভৌমিকতার কথা বলেননি।
(৯) আইন সম্পর্কে মতানৈক্য: হবস বলেছেন রাজা হলেন সর্বশক্তিমান। তাঁর নির্দেশই হল আইন। এই আইন হল অমোঘ, অভ্রান্ত ও অলঙ্ঘনীয়। এর বিরোধিতা করা যাবে না। লকের মতানুসারে রাজা আইনের সাহায্যে জনসাধারণের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি রক্ষার ব্যবস্থা করবেন। তিনি যদি কর্তব্য পালন করতে না পারেন তাহলে প্রজাসাধারণ বিদ্রোহ করতে পারে বা আইন অমান্য করতে পারে। রুশোর মতে আইন হল ‘সাধারণ ইচ্ছার প্রকাশ। তবে আইনের বিরোধিতা করা উচিত নয়। আইনের বিরোধিতার অর্থ স্ববিরোধিতা।
(১০) রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য প্রসঙ্গে মতানৈক্য: হবস রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য করেননি। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বজায় রেখে সরকারের পরিবর্তন করা যায়—এ কথা হবস ভাবতে পারেননি। কিন্তু লক্ এবং রুশো রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন।
Leave a comment