অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসী দার্শনিক রুশো তাঁর চুক্তিবাদে হবসের বক্তব্যের কাঠামোর মধ্যে লকের সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে রুশোর তত্ত্বে হবস ও লকের মতবাদের সমন্বয় সাধিত হয়েছে। চুক্তিবাদ প্রসঙ্গে এই তিনজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর বক্তব্যের মধ্যেই এই সিদ্ধান্তের সমর্থন আছে। প্রকৃতপক্ষে অষ্টাদশ শতাব্দীর রুশো সপ্তদশ শতাব্দীর হবস ও লক্ উভয়ের দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছেন।

রুশো হবস ও লকের মত প্রাকৃতিক অবস্থা থেকেই সামাজিক চুক্তি মতবাদের আলোচনা আরম্ভ করেছেন। রুশোর প্রাকৃতিক পরিবেশ হল লকের সৌহার্দ্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশের এক চূড়ান্ত অভিপ্রকাশ। এ হল মর্ত্যের স্বর্গ, রোমান্সের রাজত্ব। রুশো বলেছেন যে, আদিম মানুষ সহজ, সরল, স্বাধীন, সাহসী ও সুখী ছিল। তখন হিংসা, হানাহানি, দ্বন্দ্ব, বিবাদ এসব ছিল না। প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল এককথায় সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও সুন্দর। এক্ষেত্রে লকের বক্তব্যের সঙ্গে রুশোর বক্তব্যের সাদৃশ্য দেখা যায়। লক বলেছেন, মানুষ ছিল সামাজিক ও সহানুভূতিসম্পন্ন। মানুষ তখন সুখে-শান্তিতে বসবাস করত। প্রাকৃতিক অবস্থায় শান্তি, শুভেচ্ছা ও পারস্পরিক সহযোগিতা ছিল। রুশো লকের থেকে এক ধাপ উপরে উঠে প্রাকৃতিক অবস্থাকে ‘মর্ত্যের স্বর্গ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

রুশো বলেছেন প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বর্গরাজ্যের এই সুখ-শান্তি বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। কালক্রমে এই প্রাকৃতিক অবস্থা হবস-কল্পিত প্রাকৃতিক অবস্থার মত জটিল, ভয়াবহ ও কদর্য হয়ে দাঁড়ায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যক্তিগত সম্পত্তির সৃষ্টি এবং যুক্তি ও বিচারবুদ্ধির উন্মেষ—মূলত এই তিনটি কারণে অশান্তি, বৈষম্য ও জটিলতার সৃষ্টি হয়। এইভাবে হিংসা, দ্বন্দ্ব, কলহ, বিবাদ প্রভৃতির সৃষ্টি হয়। তার ফলে রুশোর প্রাকৃতিক অবস্থাও কালক্রমে হব্‌সের প্রাকৃতিক অবস্থার মত ভয়াবহ ও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

হবসের মত রুশোও বলেছেন যে, আদিম মানুষ নিজেদের মধ্যে একটি চুক্তি করে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে আদিম মানুষের নিজেদের মধ্যে; প্রত্যেকের সঙ্গে সকলের এবং সকলের সঙ্গে প্রত্যেকের। হবসের মত রুশো জনগণের সকল অধিকার ও ক্ষমতা বিনা শর্তে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের হাতে সমর্পণের কথা বলেছেন। অর্থাৎ সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ হল অবাধ, অভ্রান্ত ও চূড়ান্ত। এ বিষয়ে হবস ও রুশো সমমতাবলম্বী। হব্‌সের মত রুশোও বলেছেন যে, এই চুক্তিতে সরকার কোন পক্ষ নয়।

কিন্তু রুশো হবসের মত কোন বিশেষ ব্যক্তিকে বা রাজাকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী করেননি। তিনি ‘সাধারণ ইচ্ছা’ তত্ত্বের মাধ্যমে গণ-সার্বভৌমত্বের কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে লকের মত রুশোর বক্তব্য হল যে, জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সার্বভৌমত্বের প্রকৃতি প্রসঙ্গে হবস এবং রুশোর বক্তব্য এক। কিন্তু সার্বভৌম ক্ষমতা কার উপর ন্যস্ত আছে—এ প্রসঙ্গে লকের সঙ্গে রুশোর মিল আছে।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এই সহজ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া স্বাভাবিক যে, রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদে হবস ও লকের বক্তব্যের একটা সমন্বয় সাধনের চেষ্টা আছে।