রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাখ্যা হিসাবে সামাজিক চুক্তি মতবাদ এক সময় গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হত। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে এর গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। প্রকৃত প্রস্তাবে, অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই এই মতবাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচনা শুরু হয়। চুক্তিবাদের সমালোচকদের মধ্যে হিউম, হেনরি মেইন, বার্ক, বোম, পোলক প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
(১) অনৈতিহাসিক: সামাজিক চুক্তি মতবাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হল, মতবাদটি অনৈতিহাসিক। রুশোর Contract Social (1762) প্রকাশিত হওয়ার আগেই ইংরাজ দার্শনিক হিউম মন্তব্য করেছেন যে, চুক্তিবাদ অনৈতিহাসিক। রজার স্ক্রুটন (Roger Scruton) A Dictionary of Political Thought শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Hume attacked the doctrine of social contract, arguing that the criterion of tacit consent is inapplicable, most people being inevitably constrained by cultrural, linguistic and habitual ties to stay where they are, whatever the government that should exert jurisdiction over them.” মানবসভ্যতার সমগ্র ইতিহাস অনুসন্ধান করলেও এরকম কোন চুক্তির উদাহরণ পাওয়া যায় না। আদিম অবস্থায় রাজনীতিক চেতনাশূন্য মানুষের স্বেচ্ছায় রাষ্ট্র গঠনের কোন কাহিনী ইতিহাসে নেই। অনেকে উদাহরণ হিসাবে ১৬২০ সালের ‘মে-ফ্লাওয়ার’ চুক্তির কথা বলে থাকেন। কিন্তু ‘মে-ফ্লাওয়ার’ জাহাজের যাত্রীরা প্রাকৃতিক অবস্থার আদিম মানুষ ছিলেন না। তাঁরা ইংল্যাণ্ডের মত একটি সুসভ্য রাষ্ট্র থেকে তারই বশীভূত একটি উপনিবেশ স্থাপন করতে আমেরিকার জনহীন ভূখণ্ডে হাজির হয়েছিলেন।
(২) অবাস্তব: মতবাদটি অবাস্তব। চুক্তি একটি সামাজিক ধারণা। সমাজে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটলেই চুক্তির সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশের আদিম অবস্থায় বিনিময় প্রথা ছিল। তখন চুক্তি সম্পাদনের উপযোগী ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল না। তাই ইতিহাসের এই পর্যায়ে চুক্তি সৃষ্টি সম্ভবপর ছিল না। সুতরাং মতবাদটি অবাস্তব। গাউবা তাঁর An Introduction to Politicl Theory শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: The idea of contract began with the down of the modern era, when the individual could change his status through a free contract.”
(৩) অযৌক্তিক: মতবাদটি অযৌক্তিক। কারণ চুক্তির ভিত্তি হল রাষ্ট্রনৈতিক আইন। রাষ্ট্র সৃষ্টির আগে প্রাকৃতিক অবস্থায় এরকম কোন আইন ছিল না। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রনৈতিক আইন ছাড়া কোন বৈধ চুক্তি সম্পাদিত হতে পারে না। কিন্তু সামাজিক চুক্তি মতবাদে বলা হয়েছে যে, চুক্তির দ্বারাই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র সৃষ্টির আগে চুক্তি সম্পাদনের কথা অযৌক্তিক। গউবা এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “…a contract, in order to be valid, requires the force or sanction of the state, which exists above and apart from the contracting parties. The so-called social contract had no such sanction behind it, becsuse it proceeds the establishment of the state itself.”
(৪) অবিশ্বাস্য: মতবাদটি অবিশ্বাস্য। প্রাকৃতিক অবস্থায় আদিম মানুষের রাষ্ট্র সম্বন্ধে কোন ধারণা ছিল না। সুতরাং তাদের পক্ষে রাষ্ট্রের উপযোগিতা উপলব্ধি করাও সম্ভব ছিল না। এই অবস্থায় তারা চুক্তির দ্বারা হঠাৎ একদিন রাষ্ট্র গঠন করল, এরকম ভাবনা অবিশ্বাস্য।
(৫) অবৈজ্ঞানিক: মতবাদটি অবৈজ্ঞানিক। চুক্তি সম্পাদনের জন্য দুটি পক্ষের উপস্থিতি দরকার। কিন্তু প্রাকৃতিক অবস্থায় আদিম মানুষদের অভিন্ন স্বার্থ বিবেচনা করে তাদের একটি পক্ষ হিসাবে ধরা হয়েছে। অথচ একটিমাত্র পক্ষের উপস্থিতিতে চুক্তি সম্পাদিত হতে পারে না।
(৬) প্রাকৃতিক অধিকার বা স্বাধীনতার অস্তিত্ব অসম্ভব: সামাজিক চুক্তি মতবাদে প্রাকৃতিক অবস্থায় ‘স্বাভাবিক অধিকার’ ও ‘স্বাভাবিক স্বাধীনতা’র কথা বলা হয়েছে। এ ধারণা ভ্রান্ত। অধিকার হল একটি সামাজিক ধারণা। সভ্য সমাজব্যবস্থার বাইরে অধিকারের কল্পনা করা যায় না। তা ছাড়া রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ ছাড়া অধিকার বা স্বাধীনতার সৃষ্টি হতে পারে না। সাধারণ স্বার্থ সম্পর্কে চেতনা ও অধিকার সম্পর্কে পারস্পরিক স্বীকৃতি ছাড়া অধিকার বাস্তবে রূপায়িত হতে পারে না। গ্রীণ (T. H. Green) মন্তব্য করেছেন: “…without this recognition there can be no right.” সুতরাং প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রকৃতপক্ষে অধিকার বা স্বাধীনতার অস্তিত্ব সম্ভব নয়। গাউবা প্রশ্ন তুলেছেন: “How could natural rights have existed in the earliest stage when political awareness and institutionalized law were totally absent? Edmund Burke (1729-297) argued that the social contract, if it could be said to exist at all, certainly marked the surrender of natural rights.”
(৭) রাষ্ট্রকে অংশীদারী কারবারের পর্যায়ভুক্ত করেছে: সামাজিক চুক্তি মতবাদ রাষ্ট্রকে অংশীদারী কারবারের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। কারণ চুক্তির ভিত্তিতেই উভয়েরই সৃষ্টি হয়। কিন্তু রাষ্ট্র এবং অংশীদারী কারবার কোনক্রমে সমপর্যায়ের সংগঠন নয়। অংশীদারী কারবারের সঙ্গে অংশীদারের সম্পর্কের থেকে রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক অনেক বেশী দৃঢ় এবং অবিচ্ছেদ্য।
(৮) প্রাকৃতিক অবস্থায় মানবজীবন যৌথ ছিল: চুক্তিবাদ অনুসারে আদিম মানুষেরা ব্যক্তি হিসাবে চুক্তি সম্পাদন করেছে। কিন্তু মানব সভ্যতার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষের জীবন ছিল মূলত যৌথ। মানবসভ্যতার আদিম অবস্থায় সমাজের একক ছিল পরিবার, ব্যক্তি নয়। গেটেল বলেছেন: “The family was the unit, property was held in common.” হেনরী মেইন (Henry Maine) -এর মতানুসারে সমাজ-বিকাশের পরে চুক্তি এসেছে, চুক্তি থেকে সমাজের সূত্রপাত হয়নি। স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে ব্যক্তিমানুষ চুক্তি সম্পাদন করছে—এ রকম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সভ্যতার এক উন্নততর পর্যায়ে। গাউবার অভিমত হল : “To shift the modern idea of the contract to the earliest times is….bad logic. The idea of contract is an individualist idea, it makes the will of the individual of the basis for political authority. Primitive man was not at all aware of this idea.”
(৯) রাষ্ট্রের সদস্যপদ ব্যক্তির ইচ্ছা-নির্ভর নয়: রাষ্ট্র যদি চুক্তির ফল হয়, তা হলে রাষ্ট্রের সদস্য হওয়া ব্যক্তির ইচ্ছা-নির্ভর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু রাষ্ট্রের সদস্যপদ বাধ্যতামূলক, ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয়। রাষ্ট্রের এলাকার মধ্যে জন্মগ্রহণ করলেই রাষ্ট্রের সদস্য হতে হয়। গাউবা বলেছেন: “From the Philosohical point of view, it is not fair to treat any contract as eternally binding on all generations. Tom Paine (1737-1809) criticized the theory of the social contract from this viewpoint and declared it a dead weight on the wheel of progress.”
(১০) রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠাই ছিল মুখ্য: চুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। এই উদ্দেশ্যেই তারা যাবতীয় তত্ত্বগত যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছেন। তার ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তির অনুসন্ধান গৌণ হয়ে পড়ে।
(১১) বিপজ্জনক: রাষ্ট্রের উৎপত্তির ভিত্তি হিসাবে মতবাদটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। চুক্তিকে রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসাবে গণ্য করলে চুক্তিসম্পাদনকারী পূর্বপুরুষদের ক্ষেত্রেই তা বাধ্যতামূলক। উত্তরপুরুষগণ খেয়াল খুশীমত এই রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে বা রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটাতে পারে। অর্থাৎ মতবাদটি রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের পক্ষে বিপজ্জনক। বার্ক (Burke)-এর মতানুসারে মতবাদটি হল ‘অরাজকতার সংক্ষিপ্তসার’ (digest of anarchy)।
রাষ্ট্রের উৎপত্তিবাদে সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূল্যায়ন
সামাজিক চুক্তি মতবাদ রাষ্ট্রের উৎপত্তির বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা হিসাবে বিবেচিত হয় না। কিন্তু রাষ্ট্রচিত্তার ইতিহাসে মতবাদটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য।
(ক) চুক্তিবাদই রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করেছে। এই মতবাদের প্রচার ও প্রভাবের ফলে ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের গুরুত্ব ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে এবং অবশেষে তাবলুপ্ত হয়। গিলক্রিস্ট-এর মতানুসারে ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের প্রধান শত্রু হল সামাজিক চুক্তি মতবাদ (“…the chief enemy to the Divine Theory was the Contract Theory.”)।
(খ) চুক্তিবাদ রাজতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করেছে এবং গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। শাসনব্যবস্থাকে শাসিতের সম্মতির উপর স্থাপন করে এই মতবাদ আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনের পথ প্রশস্ত করেছে। চুক্তিবাদ জনগণকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের উৎস হিসাবে নির্দেশ করেছে এবং গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার উৎপত্তি ও বিকাশে সাহায্য করেছে। বাকার-এর মতানুসারে চুক্তিবাদ ‘ন্যায় ও স্বাধীনতা’ এই দুই গণতান্ত্রিক আদর্শের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। তার ফলে জনগণের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সুদৃঢ় হয়েছে।
(গ) ‘রাষ্ট্রের ভিত্তি হল সম্পত্তি, পশুশক্তি নয়’, (Will not force, is the basis of the State) এই সত্যটিকে চুক্তিবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
(ঘ) সর্বপ্রথম চুক্তিবাদেই রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য নির্দেশ করা হয়েছে। লকের আগে কেউ এই পার্থক্য করেন নি।
(ঙ) ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা প্রভৃতি রাষ্ট্রনৈতিক ধারণাসমূহের বিকাশ ও বিবর্তনের ক্ষেত্রে সামাজিক চুক্তি মতবাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান অস্বীকার করা যায় না। চুক্তিবাদের মানবিক অধিকারের ঘোষণা ঐতিহাসিক মর্যাদাযুক্ত।
(চ) চুক্তিবাদের মাধ্যমে মানুষের রাজনীতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রুশোর সাম্য ও সমানাধিকারের তত্ত্ব থেকেই সাম্প্রতিক কালে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ধারণা এসেছে।
(ছ) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণার উৎপত্তি ও বিকাশে চুক্তিবাদ সাহায্য করেছে। লক্ দ্বিতীয় চুক্তি বা সরকারী চুক্তি (Governmental Contract)-র শর্ত হিসাবে জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি সংরক্ষণের কথা বলেছেন। এর মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণা বর্তমান।
(জ) সামাজিক চুক্তি মতবাদ ‘সার্বভৌমিকতা’ (Sovereignty)-র ধারণাকে যথাযথভাবে বিকশিত করেছে। ইংরাজ দার্শনিক হস আইনগত সার্বভৌমিকতা, লক্ রাজনীতিক সার্বভৌমিকতা এবং ফরাসী দার্শনিক রুশো জনগণের সার্বভৌমিকতার ধারণা প্রচার করেছেন।
(ঝ) ‘মানুষের প্রয়োজনেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে’—চুক্তিবাদ এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
(ঞ) পরবর্তীকালের রাষ্ট্রচিন্তায়ও চুক্তিবাদের প্রভাব অপরিসীম। অনেকের মতানুসারে বোম (Bentham)-এর হিতবাদ হল লকের সুখতত্ত্বের সম্প্রসারিত রূপ। আবার কারও কারও মতে লকের মতবাদই হল মন্টেস্কু (Montesquieu)-র ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উৎস।
(ট) সামাজিক চুক্তি মতবাদ ইতিহাসের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত। এই ঘটনা তিনটি হল:
-
(১) ইংল্যাণ্ডের গৌরবময় বিপ্লব (১৬৮৮ খ্রীঃ),
-
(২) আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৭৭৬–১৭৯১ খ্রীঃ) এবং
-
(৩) ফরাসী বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রীঃ)।
এ দিক থেকে চুক্তিবাদের ঐতিহাসিক মূল্য ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
পরিশেষে গাউবার অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “The doctrine of social contract played a historical role by providing for a theoreitical justification for the new pattern of human relations necessitated by the emergency of capitalist society.”
Leave a comment