মার্কসবাদ অনুযায়ী সমাজের ইচ্ছার অনুবর্তী হিসাবে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় নি। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সমাজের সকল শ্রেণীর স্বার্থে, তাও নয়। সমাজ ও রাষ্ট্র অভিন্ন নয়, ভিন্ন। সমাজ হল একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান; রাষ্ট্র কিন্তু তা নয়। মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী নৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় নি। আবার জনসাধারণের ইচ্ছায়ও রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় নি। সংঘাতের মধ্যেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং প্রাধান্যকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবেই রাষ্ট্র ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে হেনরী লেফেব্রে (Henri Lefebvre) তাঁর The Sociology of Marx শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Marx maintains that the essence of man is not political but social. Man is not a political animal. The social forces that blindly seek a way out of their conflicts become subject to political power, the state.”
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত ঐতিহাসিক মতবাদের বক্তব্যের পিছনে মার্কসীয় চিন্তাধারার সমর্থন দেখা যায়। ঐতিহাসিক মতবাদে রাষ্ট্র সৃষ্টির কারণ হিসাবে কতকগুলি উপাদান বা শক্তির কথা বলা হয়েছে। এই সমস্ত উপাদানগুলি মার্কসীয় ব্যাখ্যার মৌলিক ধারণাগুলিকেই ব্যক্ত করে। মার্কসবাদের অন্যতম রূপকার ও মার্কসের সহযোগী বন্ধু এঙ্গেলস (F. Engels) তাঁর পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্র নামক গ্রন্থে রাষ্ট্র সৃষ্টির এক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিখ্যাত বিপ্লবী ও মার্কসবাদী তাত্ত্বিক লেনিন (V. I. Lenin) তাঁর রাষ্ট্র ও বিপ্লব শীর্ষক গ্রন্থে এবং কিছু বক্তৃতায় রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় ধ্যান ধারণা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন।
মানবসমাজের আদিম অবস্থা অতিক্রম করার পর উৎপাদন-জনিত ক্রিয়াকলাপ বিকাশের এক বিশেষ পর্যায়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আর্থনীতিক বিকাশের ঐ বিশেষ পর্যায়টি হল মানবসমাজে শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রথম পর্যায়। মার্কসীয় ব্যাখ্যা অনুসারে মানবসমাজে যখন শ্রেণীভেদ দেখা দিল তখনই রাষ্ট্রের মত কিছু দমনমূলক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। আদিম সমাজে শ্রেণীভেদ ছিল না। তাই তখন রাষ্ট্র বলতে কিছু ছিল না। আবার ভবিষ্যতে সভ্যতার অতি উন্নত কোন স্তরে মানবসমাজে শ্রেণীভেদ থাকবে না। সেই অবস্থায় রাষ্ট্রও থাকবে না। এই হল মার্কসীয় লেখকদের ধারণা।
শ্রেণী-দ্বন্দ্বের ফলেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি: সমাজ বিবর্তনেরই ধারা অনুযায়ী সামাজিক শ্রেণীভেদের সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক শ্রেণীভেদের অনিবার্য ফল হল সামাজিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। এই দ্বন্দ্ব সংঘাত নিয়ন্ত্রণ করার তাগিদেই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সৃষ্টি। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে রাষ্ট্র হল একটি শক্তি-সমাবেশ। এর উদ্দেশ্য হল সামাজিক দ্বন্দ্বগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে সামাজিক শ্রেণীসমূহের সংঘাত ও সংঘর্ষ দূরপনেয় ও দূরতিক্রম্য হওয়ার জন্য। লেনিন তাঁর রাষ্ট্র ও বিপ্লব শীর্ষক গ্রন্থের শুরুতেই বলেছেন: ‘রাষ্ট্র হল মীমাংসার অসাধ্য শ্রেণী-বৈরিতার প্রকাশ ও ফল’ (“The state is the product and the manifestation of the irreconcilability of class antagonisms.”)। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে মার্কসীয় ব্যাখ্যাটি অনুধাবনের জন্য রাষ্ট্রীয় শক্তি ও ব্যবস্থার সঙ্গে শ্রেণী-সংগ্রামের সম্পর্কটি আলোচনা করা দরকার।
মার্কসবাদীদের মতানুসারে আদিম অবস্থায় মানুষে মানুষে কোন ব্যবধান বা ভেদাভেদবোধ ছিল না। তখন যে সমস্ত স্বাভাবিক বুদ্ধি বা শক্তিগত ব্যবধান ছিল তা কৃত্রিম মর্যাদাগত বা ভোগ-অধিকারগত বৈষম্য করত না। মার্কসবাদীরা এই অবস্থাকেই ‘আদিম সাম্যবাদী অবস্থা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই সমাজ ছিল সমভোগবাদী। এই সমাজে মানুষের মধ্যে সম্পত্তি-সংক্রান্ত কোন ধারণা ছিল না। যা কিছু ভোগ্যদ্রব্য আহরণ, সংগ্রহ বা উৎপাদন করা হত, তা সমাজের স্ত্রী-পুরুষ সকলে মিলেই সমতার নীতিতে গ্রহণ করত। তখন সমাজে শ্রেণীভেদ ও শ্রেণীদ্বন্দ্ব ছিল না। তাই তখন রাষ্ট্রশক্তির মত চরম বা চূড়ান্ত কোন দমন ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল না। এঙ্গেল্স তাই বলেছেন: ‘রাষ্ট্র কোন শাশ্বত অনাদিকালের প্রতিষ্ঠান নয়। অতীতে এক সময়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা রাষ্ট্রশক্তি-সংক্রান্ত কোনরূপ ধারণা ছাড়াই সমাজজীবন অতিবাহিত হয়েছে” (“The State has not existed from all eternity. There have been societies that did without it, that had no conception of state and state power. At a certain stage of economic development, which was necessarily bound up with the split of society into classes, the state became a necessity owing to this split.”)। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভব হয়েছে বিবর্তনের এক উন্নততর পর্যায়ে। যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা এবং উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণজনিত মর্যাদাবোধ ও বিশেষাধিকার বোধ গড়ে উঠেছে তখন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। ওয়েপার (C. L. Wayper) Political Thought শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “When, for instance the most important factor in the forces of production is agriculture, landowners will be the ruling class. The dominant class alone has freedom, and to preserve this must act the part of oppressors. They, therefore, create an executive and repressive instrument by the use of which they hope to maintain their position and which is called the State.”
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, যোগানের আপেক্ষিক অপ্রতুলতা, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা ইত্যাদি নানা কারণে সমাজের আদিম সাম্যবাদী কাঠামোতে এক মৌলিক পরিবর্তন শুরু হয়। কালক্রমে আপন-পর ভেদাভেদ, স্বাতন্ত্র্যকামিতা, ব্যক্তিগত সম্পদ ও সঞ্চয়, উপাদান-প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রবণতা সমাজের মধ্যে গোষ্ঠীগত বা শ্ৰেণীগত ভেদাভেদ সৃষ্টি করল। এরই অনিবার্য পরিণতি হল সামাজিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। নানাভাবে ক্ষমতা ও অধিকারবলে ধনসম্পত্তি অর্জনের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে ব্যবধান বাড়তে লাগল। কালক্রমে এক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর হাতে বিপুল ধনসম্পত্তি কেন্দ্রীভূত হল। ধনসম্পত্তি অর্জন ও উৎপাদন কার্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সমাজে দুটি মূল শ্রেণী-গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। মার্কসবাদী বিশ্লেষণ অনুসারে আজও মানব সমাজ মূলত ঐ দুটি শ্ৰেণী-গোষ্ঠীতেই বিভক্ত। এই দুই গোষ্ঠীর পরিচয় ‘শোষক’ ও ‘শোষিত’ হিসাবে। উৎপাদন কার্য নিয়ন্ত্রণকারী মালিক শ্রেণী হল ‘শোষক’ বা ‘নিপীড়ক’ শ্রেণী (‘exploiter’ or ‘oppressor’)। অপরদিকে সম্পত্তিহীন শ্রমজীবীরাই হল ‘শোষিত’ বা ‘নিপীড়িত’ (‘exploiter’ or ‘oppressed’) শ্রেণী। এই দুই শ্রেণীর স্বার্থ পরস্পর-বিরোধী। তাই এরা সদাই দ্বন্দ্বে লিপ্ত। এবং এই দ্বন্দ্বের কোন রকম শান্তিপূর্ণ মীমাংসা সম্ভব নয়। লেনিন The State and Revolution শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “The state is a product and manifestation of the irreconcilability of class antagonisms. The state arises where, when and insofar as class antagonisms objectively cannot be reconciled. And, conversely, the existence of state proves that the class antagonisms are irreconcilable.”
ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরে এই দুই প্রধান বিবদমান শ্রেণী দাসমালিক ও দাস, ভূস্বামী ও ভূমিদাস, শিল্পপতি বুর্জোয়া ও সর্বহারা শ্রমজীবী প্রভৃতি বিভিন্ন নামে পরিচিত। উৎপাদন ব্যবস্থার প্রকৃতি অনুসারে সকল সমাজ ব্যবস্থাতেই শোষক-শোষিতের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক বর্তমান। এবং এই দ্বন্দ্বমূলক শ্রেণী-সম্পর্কের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রশক্তি।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যা: মার্কসবাদীদের মতানুসারে সমাজ ও ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে হলে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যেই তা করা দরকার। মার্কসীয় বস্তুবাদ হল দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism)। উৎপাদন-প্রক্রিয়ার ক্রিয়াকলাপের অন্তর্গত অর্থাৎ উৎপাদন শক্তি (Forces of Production) এবং উৎপাদন-সম্পর্কের অর্থাৎ সম্পত্তি সম্পর্কের (Relations of Production) মধ্যে মৌলিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত বর্তমান। এই নিয়েই সমাজের মৌল কাঠামো (Basic Structure) গড়ে উঠে। এই মৌল কাঠামোর ভিত্তিতেই সমাজের উপরিতল বা উপরি-কাঠামোগত (Super Structure) রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কার্যকলাপ পরিচালিত হয়। যে-কোন সমাজের রাষ্ট্রব্যবস্থা, ধর্মীয় ব্যবস্থা, সংস্কৃতি ইত্যাদির গতি-প্রকৃতি সেই সমাজের মৌলিক উৎপাদন ব্যবস্থা প্রভৃতি দ্বন্দ্ব সংঘাতের গতি-প্রকৃতি অনুসারে নির্ধারিত হয়। শোষক-শোষিতের মধ্যে মূল দ্বন্দ্বে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে উভয় শ্রেণীই তাদের সুবিধামত উপরি-কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। কিন্তু শোষিতরা হল স্বভাবতই দুর্বল। তাই তাদের তৈরী উপরি-কাঠামোগুলোও দুর্বল হয়। শোষক শ্রেণী শোষণ চালায় বলে সবল থাকে। তাই তাদের তৈরী উপরি কাঠামোগুলোই সমাজে প্রাধান্য পায়। এই কারণে সকল যুগেই রাজনীতি, ধর্ম বা সাংস্কৃতিক প্রধান প্রধান ধারাগুলি মূলত শোষক শ্রেণীরই স্বার্থে ব্যবহৃত হয়। রাজনীতি এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা সভ্যতার শুরু থেকেই শোষক শ্রেণীর স্বার্থেই রচিত হয়েছে এবং অনুরূপভাবে বিবর্তিত হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত শ্রেণীর সম্ভাব্য সব রকম আক্রমণ ও বিরোধিতা থেকে নিজেদের ধনসম্পত্তির ও ব্যক্তিজীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে শোষক শ্রেণী রাষ্ট্র নামক শক্তি সমাবেশটিকে গড়ে তুলেছে। এদিক থেকে রাষ্ট্র হল একটি বলপ্রয়োগমূলক বা দমনমূলক ব্যবস্থা। সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত মানুষকে দমনের উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।
মার্কসবাদীদের মতে কালের বিবর্তনে শ্রেণী-দ্বন্দ্বের এক একটি পর্যায়ে রাষ্ট্রযন্ত্রটি এক-একটি শ্রেণীর হস্তগত হয়েছে। এক-একটি বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের পরিণতি হিসাবে নতুন একটি শ্রেণী উৎপাদন-ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে এবং এক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ামক হয়েছে। মার্কসবাদীদের বিশ্বাস আগামী দিনে বৃহত্তর শ্রমজীবী শ্রেণীর মানুষ ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে মহাবিপ্লবের সামিল হবে। তার ফলে পৃথিবী থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থা চিরতরে বিলুপ্ত হবে।
মূলকথা: রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাপারে মার্কসবাদীদের বক্তব্যের সার কথা হল: (ক) রাষ্ট্র কোন শাশ্বত, চিরন্তন বা অলৌকিক প্রতিষ্ঠান নয়। (খ) মানবসমাজের ক্রমবিবর্তনের ধারায় একটি বিশেষ পর্যায়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। (গ) সমাজে শ্রেণীভেদ এবং শোষক ও শোষিত শ্রেণীর সৃষ্টির ফলেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র হল শ্রেণী-সংঘাতের ফল। (ঘ) যখন এবং যেখানে সমাজে শ্রেণীভেদ এবং শোষক ও শোষিত থাকে, তখন এবং সেখানে রাষ্ট্র থাকে। (ঙ) রাষ্ট্র হল শোষক শ্রেণীর আর্থনীতিক স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার বিশেষ। ব্যক্তিগত সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধানের জন্যই রাষ্ট্রের সৃষ্টি। (চ) সংখ্যালঘু শোষক শাসকের স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত মানুষের বিরুদ্ধে দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহৃত হয়। (ছ) ইতিহাসের এক বিশেষ অধ্যায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত মানুষ রাষ্ট্রযন্ত্রের অধিকারী হবে। (জ) এই অবস্থায় শোষিত মানুষ রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে শোষণের সম্ভাবনাকে চিরতরে শেষ করে দেবে। (ঝ) সমাজে যখন শ্রেণীভেদ ও শ্রেণী-শোষণ থাকবে না, তখন শোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রও থাকবে না। (ঞ) রাষ্ট্র হল সামাজিক অন্যায়ের প্রতীক।
সমালোচনা (Criticism): বিরুদ্ধবাদীরা উপরিউক্ত আলোচনাকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি সংক্রান্ত সঠিক ব্যাখ্যা বলে মনে করেন না। তাঁরা কয়েকটি বিশেষ ত্রুটির উল্লেখ করেন।
(১) সমাজের উৎপাদন-ক্রিয়া জনিত দু’টি মূল শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সর্বজনীনতা স্বীকার করা যায় না; সমালোচকদের মতানুসারে সমাজে বহুবিধ গোষ্ঠী বর্তমান। এই সমস্ত গোষ্ঠীকে নির্দিষ্ট অর্থনীতিক শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় না।
(২) আবার একথাও সঠিক নয় যে, শোষকশ্রেণীর স্বার্থেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।
(৩) সমালোচকদের মতানুসারে সমাজ ও ইতিহাসের মার্কসীয় বস্তুবাদী ব্যাখ্যা একদেশদর্শী আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদের (Economic Determinism) নামান্তর। ক্ষেত্রবিশেষে সমাজের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্ম বিষয়ক উপাদানগুলিই আর্থনীতিক শক্তির উপর প্রাধান্য বিস্তার করে। তাই রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব ও প্রকৃতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন উপাদানকে মূল শক্তি হিসাবে নির্দিষ্ট করা ঠিক নয়।
(৪) মার্কসবাদে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও অস্তিত্বের ব্যাখ্যা হিসাবে শোষণের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সমালোচকদের অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্রের উদ্ভবের পিছনে শোষণের ভূমিকার অস্তিত্বকে অস্বীকার না করেও বলা যায় যে, শোষণ রাষ্ট্রের উৎপত্তির একমাত্র কারণ নয়। সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাকাইভার ও পেজ (R.M. Maclver and C. H. Page) তাঁদের Society- An Introductory Analysis শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এই দুই সমাজতত্ত্ববিদের মতানুসারে শোষণের সঙ্গে সঙ্গে ‘ন্যায় বোধ’ (sense of justice)-ও রাষ্ট্রের বিবর্তনের পিছনে অবদান যুগিয়েছে। তাঁরা বলেছেন: “…to identify political means with exploitation is the simplification of an inadequate psychology. Significant as that motive was, it did not work alone. The authority of the elders over the younger Kin was not exploitation, but it played a part in the making of the state. The tribal sense of justice evoked agencies of juridiction, and they too were conditions of the emerging state. And many factors contributed to create the Kind of political loyalty without which they could never have grown to maturity.”
মূল্যায়ন (Evaluation): সমালোচকগণ মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদকে যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারেন নি। সমালোচকগণ ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে বিকৃত করে ‘আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদ’ বলে উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্র ও রাজনীতি ক্ষেত্রে উৎপাদন-ক্রিয়াজনিত সামাজিক-আর্থনীতিক শক্তিসমূহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বর্তমান। মার্কসবাদীরা তাঁদের তত্ত্বের মাধ্যমে তা উপস্থিত করেছেন এবং রাষ্ট্র চিন্তার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছেন। গাউবা তাঁর An Introduction to Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “The Marxist theory, however, holds that the state came into existence when the bods of Kinship and the tribal sense of justice and authority based on genuine re spect, gave way to a new order based on ‘private property’ which marked the beginning of exploitation.”
Leave a comment