পিতৃতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রিক মতবাদ রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ক একটি মানববৈজ্ঞানিক (Anthropological) মতবাদ। এই মতবাদের মূল কথা হল পরিবার সম্প্রসারিত হয়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত এই মতবাদের দুটি ব্যাখ্যা আছে: একটি হল পিতৃতান্ত্রিক এবং আর একটি হল মাতৃতান্ত্রিক।

রাষ্ট্রের উৎপত্তিবাদে পিতৃতান্ত্রিক মতবাদ

পিতৃতান্ত্রিক মতবাদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে পরিবার সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে পরিবার হল প্রাচীনতম। কালক্রমে পরিবার সম্প্রসারিত হয়েছে এবং তার ফলে সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রের।

মূল বক্তব্য: স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পরিবার গঠিত হয়। পিতাই হলেন পরিবারের কর্তা। পরিবারের সদস্যদের উপর সর্ববিষয়ে কর্তার কর্তৃত্ব কায়েম হয়। পিতার নামানুসারেই পরিবারের সন্তানেরা পরিচিতি পায়। সাবালক সন্তানদের বিবাহ হয়। তাদের নিজেদের পরিবার গড়ে উঠে। এইভাবে ধীরে ধীরে পরিবারের পরিধি প্রসারিত হয়। রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে নবগঠিত পরিবারগুলি মাতাপিতার পরিবারের সঙ্গে গভীর সংযোগ-সম্পর্ক বজায় রাখে। পরিবারের কর্তাকেই তারা তাদের কর্তা হিসাবে স্বীকার ও মান্যগণ্য করে। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে পিতাই হলেন পরিবারের কর্তা। বংশ পরিচয়, সম্পত্তির মালিকানা প্রভৃতি নির্ধারিত হয় পিতৃপুরুষের দিক থেকে। পিতার পরিচয়েই পরিবারের সদস্যদের পরিচয় পাওয়া যায়। পরিবারের প্রবীণতম পুরুষই হলেন সকলের প্রভু। তাঁর আদেশ সকলে মান্য করে চলে। সকলে পরিচালিত হয় বয়োজ্যেষ্ঠের নির্দেশ অনুসারে। এই পিতৃতান্ত্রিক পরিবার সম্প্রসারিত হতে থাকে। এইভাবে সম্প্রসারিত হয়ে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের সৃষ্টি হয়। এই পিতৃতান্ত্রিক পরিবার এক সময় একটি গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। কালক্রমে গোষ্ঠী একটি উপজাতিতে পরিণত হয়। অভিন্ন প্রয়োজন, রক্তের সম্পর্ক, আত্মীয়তার চেতনা এবং সর্বোপরি পরিবারের কর্তার কর্তৃত্ব একযোগে উপজাতির অন্তর্ভুক্ত সকলের মধ্যে ঐক্যের বন্ধনকে অব্যাহত রাখে, এই ঐক্যের বন্ধন সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীকে অন্য বিরোধী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করে। আরো পরে একটি অঞ্চল জুড়ে উপজাতিটি স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। এই সময় উপজাতিটির প্রধান সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের উপর তার কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করে। এইভাবে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।

মতবাদটির ইতিহাস: এটি একটি প্রাচীন মতবাদ। অনেকের অভিমত অনুযায়ী পিতৃতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রিক মতবাদের প্রবক্তা হিসাবে প্রথমেই গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁর মতানুসারে পরিবার বিবর্তিত হয়ে গ্রামের সৃষ্টি হয়েছে এবং গ্রাম থেকে সৃষ্টি হয়েছে সম্প্রদায়ের। এই ভাবেই রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। অ্যারিস্টটলের মতানুসারে রাষ্ট্র হল বিভিন্ন পরিবার ও গ্রামসমূহের ইউনিয়ন বিশেষ। এই ইউনিয়নের উদ্দেশ্য হল সুখী ও সমৃদ্ধ জীবন যাপনকে সুনিশ্চিত করে এবং একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম গড়ে তোলা। পরবর্তীকালের চিন্তাবিদদের মধ্যে স্যার হেনরি মেইন রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত পিতৃতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রিক মতবাদের দৃঢ় সমর্থক-প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে স্যার হেনরী মেইনের Ancient Law ( 1861) এবং Early History of Institution (1874) শীর্ষক গ্রন্থ দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মেইন এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, পিতৃতান্ত্রিক পরিবার সম্প্রসারিত হয়েই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর মতানুসারে প্রাথমিক গোষ্ঠী হল পরিবার।

সর্বোচ্চ পুরুষ কর্তার প্রতি সকলের সাধারণ আনুগত্যের ভিত্তিতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সংযোগ সম্পর্ক বজায় থাকে। পরিবারসমূহের সমাহারের সুবাদে বসতি গড়ে উঠে। বসতিগুলি একত্রিত অবস্থানের কারণে উপজাতির সৃষ্টি হয়। অতঃপর উপজাতিসমূহের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রের। হেনরি মেইন তাঁর এই মতবাদের সমর্থনে ইহুদি, গ্রীক্, রোমান ও ভারতীয় পরিবারের ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। সুতরাং পিতৃতান্ত্রিক মতবাদ অনুযায়ী পিতৃতান্ত্রিক পরিবার সম্প্রসারিত হয়েই সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রের।

সমালোচনা: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত পিতৃতান্ত্রিক মতবাদ বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সমালোচকরা এই মতবাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেন।

এক: সমালোচকদের মতানুসারে আগেকার দিনের পরিবার ছিল মাতৃতান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক নয়। কারণ তখন মাতৃ-পরিচয় জানা যেত, পিতৃ-পরিচয় ছিল অজ্ঞাত। স্বভাবতই মাতার পরিচয়েই সন্তানের পরিচয় নির্ধারিত হত। 

দুই: কেবলমাত্র পরিবার সম্প্রসারিত হয়েই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে, এ ধারণা ঠিক নয়। রাষ্ট্রের উদ্ভবের পিছনে ধর্ম, নীতিবোধ, বলপ্রয়োগ, আর্থনীতিক প্রয়োজন প্রভৃতি অন্যান্য উপপাদের সহায়ক ভূমিকার কথা অস্বীকার করা যায় না।

তিন: রাষ্ট্র এবং পরিবার পৃথক উপাদান ও মূল্যবোধের উপর নির্ভরশীল। আত্মীয়তার বন্ধন, স্নেহ-মমতা, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং বিশেষত প্রয়োজনের তাগিদ প্রভৃতির ভিত্তিতে পরিবার প্রতিষ্ঠিত। রাষ্ট্রের ভিত্তিতে আছে রাজনীতিক সচেতনতা, আর্থনীতিক প্রয়োজন, সহযোগিতা, দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা প্রভৃতি। চার: পিতৃতান্ত্রিক মতবাদ হল রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত এক অতি সরলীকৃত ব্যাখ্যা। এই মতবাদের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের উদ্ভব সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া যায় না।

মূল্যায়ন: রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাখ্যা হিসাবে পিতৃতান্ত্রিক মতবাদ গ্রহণযোগ্য মতবাদ হিসাবে বিবেচিত হয় না। এই মতবাদের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটিবিচ্যুতি বর্তমান। তা ছাড়া মাতৃতান্ত্রিক মতবাদে এই মতবাদের মূল ভিত্তিকে আক্রমণ করা হয়েছে। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের উৎপত্তির পিছনে পরিবার ব্যবস্থার অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।

রাষ্ট্রের উৎপত্তিবাদে মাতৃতান্ত্রিক মতবাদ

মাতৃতান্ত্রিক মতবাদটিও রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ক একটি নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য। এই মতবাদের বক্তব্য অনুযায়ী মানব সমাজের আদিম অবস্থায় স্থায়ী বিবাহের সুনির্দিষ্ট কোন ব্যবস্থা ছিল না; তেমনি আবার পুরুষদের নেতৃত্বেরও কোন প্রচলন ছিল না। সমকালীন সমাজে বহুগামিতা প্রচলিত ছিল। একজন মহিলার বহু পতি গ্রহণের রীতি প্রচলিত ছিল। বহুপতিত্ব প্রথার কারণে একজন মহিলার সঙ্গে বহু পুরুষ মানুষের সম্পর্ক প্রচলিত ছিল। এই অবস্থায় সন্তানের পিতৃপরিচয় চিহ্নিত করা সম্ভব ছিল না। স্বভাবতই মাতৃপরিচয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সন্তানের পরিচয় নির্ধারিত হত। পরিবারের কোন সাধারণ পুরুষ প্রধান ছিল না। আত্মীয়তার বন্ধন নির্ধারিত হত মাতৃসূত্রে। মাতাই ছিলেন নেতৃ। পরিবার ছিল একটি বড় দল বা প্রতীক-প্রধান গোষ্ঠী (totem group)-র মত। এ রকম পরিবারে মায়েরাই পরিবারের কর্ত্রী। বংশধারা নির্ধারিত হয় মায়ের দিক থেকে। স্বভাবতই সমাজে মাতার স্থানই প্রধান হয়। মাতাকে কেন্দ্র করেই সমাজ ও রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।

প্রবক্তাগণ: মাতৃতান্ত্রিক মতবাদের প্রবক্তা হিসাবে ম্যাক্‌লিনান মরগ্যান ও জেঙ্কস প্রমুখ চিন্তাবিদের নাম উল্লেখযোগ্য। এই সমস্ত সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত অনুযায়ী প্রাচীনকালের পরিবার ব্যবস্থা ছিল। মাতৃতান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক নয়। মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ছিল একটি বড় দল বা প্রতীক-প্রধান গোষ্ঠী। এ রকম পরিবার ব্যবস্থায় বংশ পরিচয় বা আত্মীয়তার বন্ধন নির্ধারিত হত মাতৃ সূত্রে। মাতৃতান্ত্রিক মতবাদ অনুযায়ী প্রাচীনকালের সমাজব্যবস্থা ছিল মাতৃতান্ত্রিক পরিবার-ভিত্তিক সমাজ। প্রতীক-গোষ্ঠীমূলক (totem groups) উপজাতিরাই এই সমাজে বসবাস করত। এই উপজাতিসমূহ বিভিন্ন গোষ্ঠীতে (class) বিভক্ত হয়। গোষ্ঠীসমূহের জায়গায় আসে পরিজনবর্গ (households)। পরিজনবর্গের সংসার থেকে সৃষ্টি হল পরিবার (Family)—মাতৃতান্ত্রিক পরিবার। এই পরিবারই সম্প্রসারিত হয়েছে এবং রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের উৎপত্তির প্রক্রিয়ার মূলে আছে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা।

মূল্যায়ন (Evaluation): প্রাচীনকালের অধিকাংশ সমাজব্যবস্থায় স্থায়ী প্রকৃতির বিবাহব্যবস্থা ছিল না। স্বভাবতই মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ও সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। পিতৃতান্ত্রিক মতবাদের অন্যতম মুখ্য প্রবক্তা হেনরি মেইনও এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন। সমকালীন সমাজে বহুগামিতার কারণে মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের সৃষ্টি হয়। কালক্রমে এই মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থার জায়গায় এসেছে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা। অতঃপর সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রের। সুতরাং মতবাদ হিসাবে মাতৃতান্ত্রিক মতবাদ পিতৃতান্ত্রিক মতবাদকে একেবারে সরিয়ে দিতে পারেনি। তা ছাড়া প্রাচীনকালের সকল অঞ্চলের মানবসভ্যতার ইতিহাসে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থার অস্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় না। বরং পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থার ব্যাপক অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। সুতরাং সুনিশ্চিতভাবে বলা কঠিন যে, প্রাচীনকালের মানবসমাজে পরিবার ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক ছিল, না কি মাতৃতান্ত্রিক ছিল।

সমালোচকদের অভিমত হিসাবে পরিবার সম্প্রসারিত হয়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে, এ কথা মেনে নেওয়া যায় না। পরিবার ছাড়া আরো অনেক প্রতিষ্ঠান এবং উপাদান রাষ্ট্রের উৎপত্তির পিছনে অবদান যুগিয়েছে। এই সমস্ত উপাদানের মধ্যে ধর্ম, আর্থনীতিক প্রয়োজন, রাজনীতিক চেতনা, নীতিবোধ প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা দরকার। বস্তুত রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিবর্তনের পিছনে বহু ও বিভিন্ন উপাদানের সক্রিয় উপস্থিতি অনস্বীকার্য। পরিবার, রক্তের সম্পর্ক, আত্মীয়তার বন্ধন প্রভৃতি উপাদান রাষ্ট্রের আবির্ভাবের প্রক্রিয়ায় অর্থবহ আবেদন যুগিয়েছে। কিন্তু উপাদানগুলির কোনোটাই এককভাবে রাষ্ট্রের সৃষ্টিকে সম্ভব করেনি।