রাজতন্ত্রকে সমর্থনের উদ্দেশ্যে হব্স চুক্তিবাদ প্রচার করেন: হব্‌স-এর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লেভিয়াথান’ (Leviathan) প্রকাশিত হয় ১৬৫১ খ্রীষ্টাব্দে। রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাজগতে ‘লেভিয়াথান’ বিশেষ আলোড়নের সৃষ্টি করে। হব্সের চুক্তিবাদের বিশদ ব্যাখ্যা এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। হব্সের আমলে ইংল্যাণ্ডে রাজা ও পার্লামেন্টের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বর্তমান ছিল। ‘লেভিয়াথান’ প্রকাশিত হওয়ার তিন বছর আগে ১৬৪৮ সালে পিউরিটান বিপ্লবের এক চরম পর্যায়ে রাজা প্রথম চার্লসের শিরচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। হব্‌স ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন ইংল্যাণ্ডের রাজা দ্বিতীয় চালসের গৃহশিক্ষক। রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তিনি এই সূত্রে চরম রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন।

হব্সের আমলে ইংল্যাণ্ডের রাজতন্ত্র ছিল যারপরনাই ভীত-এস্ত। এই রকম অবস্থায় ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্রকে সুদৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য হস ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের পরিবর্তে চুক্তিবাদের সাহায্য নিয়েছেন। অর্থাৎ রাজতন্ত্রকে সমর্থনের উদ্দেশ্যেই হস সামাজিক চুক্তি মতবাদ প্রচার করেছেন। হব্‌স তাঁর সমকালীন সমাজের ধারক ও বাহক হিসাবে ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ছিলেন ঐতিহ্যের সমর্থক। তৎকালীন ইংল্যাণ্ডের সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও প্রজাবিদ্রোহ প্রশমনের উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি চুক্তিবাদকে ব্যবহার করেন। হবস হলেন চুক্তিবাদের আধুনিক ভাষ্যকার। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় নাম।

প্রাকৃতিক অবস্থা: ‘প্রাকৃতিক অবস্থা’-র ব্যাখ্যা থেকেই হব্‌স তাঁর চুক্তিবাদী আলোচনা শুরু করেন। হব্সের মতে প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল প্রাক্-সামাজিক (pre-social)। অর্থাৎ প্রাকৃতিক অবস্থায় কোন সমাজজীবন ছিল না। মানবচরিত্র সম্পর্কে তাঁর সম্পূর্ণ স্বকীয় ব্যাখ্যার মাধ্যমে হব্‌স এই প্রাক্‌-সামাজিক প্রাকৃতিক অবস্থা চিত্রিত করেছেন। তাঁর মতানুসারে মানুষ প্রকৃতিগতভাবে স্বার্থপর, কলহপ্রিয়, লোভী, ধূর্ত, শঠ, নির্দয় ও আক্রমণমুখী। এই কারণে প্রাকৃতিক অবস্থায় যে যাকে পারত মারত এবং যা পেত লুটে নিত (**kill whom you can take what you can.”)। হব্সের মতানুসারে প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রত্যেকে ছিল প্রত্যেকের শত্রু (‘every man is enemy to every man’)। হব্‌স এই অবস্থাকে ‘সকলের সঙ্গে সকলের যুদ্ধ’ (“war of all against all’) হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

স্বাভাবিক আইন ও স্বাভাবিক অধিকার: এই রকম প্রাকৃতিক অবস্থায় স্বাভাবিক আইন বলতে বোঝাত, ‘জোর যার মুলুক তার’ (Might is right)। নিজের ক্ষমতাবলে যে যতটুকু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারত, ততটুকুই ছিল স্বাভাবিক অধিকার। অর্থাৎ স্বাভাবিক অধিকারও ছিল শক্তিনির্ভর। এই অবস্থায় প্রত্যেকে ছিল প্রত্যেকের শত্রু, প্রত্যেকে ছিল প্রতিবেশীর ভয়ে ভীত। স্বার্থ সাধনের জন্য প্রতিবেশীকে হত্যা করতেও কেউ দ্বিধা করত না। তাই প্রতিবেশীকে এড়িয়ে চলাই ছিল কাম্য। তার ফলে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে হত। ফলে প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের জীবন হয়ে উঠল ‘নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, কদর্য, পাশবিক ও ক্ষণস্থায়ী। হব্স বলেছেন: “Conditions in the State of Nature made man’s life solitary, poor, nasty, brutish and short.”

চুক্তির মাধ্যমে আদিম মানুষ রাষ্ট্র সৃষ্টি করল: সুতরাং প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল দুর্বিষহ ও ভয়াবহ। এই অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের জন্য মানুষ উদ্যোগী হল। অনেক চেষ্টার পর মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করল। জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তার জন্য আদিম মানুষ সকলে মিলে নিজেদের মধ্যে এই চুক্তি সম্পাদন করল। চুক্তি হয়েছিল সকলের সঙ্গে প্রত্যেকের বা প্রত্যেকের সঙ্গে সকলের। পারস্পরিক এই চুক্তির মাধ্যমে আদিম মানুষ সকলে নিজেদের সকল ক্ষমতা কোন বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদের হাতে সমর্পণ করল। এই সমৰ্পণ ছিল নিঃশর্ত ও চূড়ান্ত। এইভাবে সমস্ত ক্ষমতা সমর্পিত হওয়ায় এক সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন কর্তৃপক্ষের উদ্ভব হল। চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে এইভাবে : “যেন প্রত্যেকে প্রত্যেককে উদ্দেশ্য করে বলল যে, নিজেকে পরিচালিত করার অধিকার ত্যাগ করে আমি এই ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করলাম এই শর্তে যে তুমিও তোমার অধিকার তাঁকে সমর্পণ করবে এবং তার কার্যক্ষমতাকে এইভাবে স্বীকার করে নেবে (…as if every man should say to every man, I authorise and give up my right of governing myself to this man or to this assembly of men, on this condition, that thou give up thy right to him, and authorise all his actions in like manner.”)। নিঃশর্তভাবে প্রাপ্ত চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদ হল সার্বভৌম। হব্সের মতানুসারে এই ব্যক্তি বা ব্যক্তি-সংসদ হল সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন মর্ত্যের নশ্বর দেবতা (mortal God)। একেই হব্‌স বলেছেন ‘লেভিয়াথান’ (Leviathan ) এইভাবে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের উদ্ভবের ফলে দুর্বিষহ প্রাকৃতিক অবস্থার অবসান হল এবং রাষ্ট্রের সৃষ্টি হল।

রাষ্ট্রের উৎপত্তিবাদে টামাস হব্সের মতবাদের বৈশিষ্ট্য

হব্সের সামাজিক চুক্তি মতবাদ পর্যালোচনা করলে কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের পরিচয়া পাওয়া যায়। 

(১) প্রাকৃতিক অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের জন্যই মানুষ চুক্তি করেছে। 

(২) হব্সের মতে চুক্তি হয়েছিল একটি। 

(৩) এই চুক্তিটি হল একপাক্ষিক। কারণ জনগণ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করেছে। জনগণই ছিল চুক্তির একমাত্র পক্ষ। শাসক বা রাজা চুক্তির কোন পক্ষ নন। 

(৪) প্রাকৃতিক পরিবেশের আদিম মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে। সকল ক্ষমতা রাজার হাতে তুলে দিয়েছে। 

(৫) রাজা চুক্তির ঊর্ধ্বে। চুক্তির কোন শর্ত পালনে রাজার কোন দায়দায়িত্ব নেই। 

(৬) রাজা হলেন সর্বশক্তিমান ও অবাধ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি সার্বভৌম। তাঁর আদেশই হল আইন। 

(৭) সার্বভৌমের আইনের দ্বারা প্রজাসাধারণের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ। 

(৮) মানুষের উপর চুক্তির বন্ধন অনন্তকালব্যাপী বজায় থাকবে। রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার প্রজাদের নেই। রাজার ক্ষমতাকে অস্বীকার করলে মানুষকে আবার প্রাকৃতিক অবস্থার অনিশ্চয়তার মধ্যে ফিরে যেতে হবে। সেবাইন মন্তব্য করেছেন: “For Hobbes there is no choice except between absolute power and complete anarchy, between an omnipotent sovereign and no society whatever.” 

(৯) হব্‌স তাঁর চুক্তিবাদে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য করেন নি। 

(১০) হব্সের মতানুসারে সার্বভৌম রাজাই হলেন প্রজাদের স্বাধীনতার স্রষ্টা ও রক্ষক। 

(১১) হব্সের মতে অবাধ রাজতন্ত্র আইনসঙ্গত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তথাকথিত প্রজাতন্ত্রই হল প্রাক্-রাষ্ট্রীয় অরাজকতার নামমাত্র।

রাষ্ট্রের উৎপত্তিবাদে টামাস হব্সের মতবাদের সমালোচনা

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত হব্সের চুক্তিবাদী তত্ত্ব বিভিন্ন দিক থেকে বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। 

(১) হব্‌স তাঁর চুক্তিবাদে চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতা সমর্পণ করেছেন কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তি-সংসদের হাতে। এইভাবে হস চরম রাজতন্ত্র বা চরম সাধারণতন্ত্রকে স্বীকার ও সমর্থন করেছেন।

(২) হব্সের মতানুসারে সম্পাদিত চুক্তিটি ছিল একপাক্ষিক। কিন্তু একটি পক্ষের উপস্থিতিতে কোন চুক্তি সম্পাদিত হতে পারে না। কারণ চুক্তি হল এক দ্বিপাক্ষিক ব্যবস্থা।

(৩) হব্‌স সার্বভৌমের আদেশকে বলেছেন আইন। কিন্তু কেবল সার্বভৌমের আদেশই আইন নয়। আইন সম্পর্কিত এই ধারণা অসম্পূর্ণ। 

(৪) হব্‌স রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকার এক নয়, আলাদা।

(৫) হব্স সার্বভৌমিকতাকে সরকারের ক্ষমতা হিসাবে দেখিয়েছেন। কিন্তু সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য, সরকারের নয়।

(৬) হব্সের তত্ত্ব গণতন্ত্র-বিরোধী। তাঁর মতে রাজা চুক্তি ও আইনের ঊর্ধ্বে। প্রজাসাধারণ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে না। অর্থাৎ হব্‌স ব্যক্তিকে সার্বভৌম রাজার কাছে বলি দিয়েছেন। 

(৭) হব্‌স সার্বভৌম রাজাকে চুক্তির অংশীদার করেন নি। এইভাবে তিনি রাজার দায়িত্ব ও কর্তব্যের দিকটিকে উপেক্ষা করেছেন।

(৮) হব্সের মতানুস রাজার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যই হল ব্যক্তির অধিকারের ভিত্তি। অধিকার সম্পর্কিত এই ধারণা বর্তমানে অচল।

(৯) হব্সের চিন্তাধারায় পরস্পর বিরোধিতাও আছে। তাঁর রাজনীতিক মতবাদের ভিত্তি ছিল ব্যক্তিস্বার্থের ধারণা। ব্যক্তিস্বার্থের জন্যই তিনি রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা বলেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র সৃষ্টির পর তিনি ব্যক্তিস্বার্থকে উপেক্ষা করেছেন।

রাষ্ট্রের উৎপত্তিবাদে টামাস হব্সের মতবাদের মূল্যায়ন

বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে হব্সের মতবাদ নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাজগতে হব্সের চুক্তিবাদের অবদান নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ।

(১) হব্‌স মানব-প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে সুস্পষ্টভাবে চিত্রিত করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রবৃত্তিকে দমন করার উপায়-পদ্ধতিও নির্দেশ করেছেন। এক্ষেত্রে হব্‌সই হলেন প্রথম রাষ্ট্রদার্শনিক। 

(২) হব্‌স যুক্তিবাদের প্রথম ভাষ্যকার হিসাবে পরিচিত। হারনশ (Hearnshaw)-র মতানুসারে, হব্সের ধারণাগুলি মেনে নিলে তাঁর সিদ্ধান্তসমূহ যুক্তিবিজ্ঞানের সূত্রানুসারে যতদূর সঠিক হওয়া সম্ভব ততদূরই সঠিক।’

(৩) হব্‌স বিশৃঙ্খল সামাজিক পরিস্থিতিতে সামাজিক ও রাজনীতিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নির্দেশ করেছেন। এই কারণে আইভর ব্রাউন (Ivor Brown) তাঁকে ‘নিয়মানুবর্তিতার প্রথম দার্শনিক (first Philoso pher of discipline) হিসাবে অভিহিত করেছেন। তৎকালীন ইংল্যাণ্ডে হব্সের মতবাদ ছিল একান্তই সময়োপযোগী।

(৪) হব্‌স রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসকে ধর্মের জটিল জটাজাল থেকে মুক্ত করেছেন। চুক্তিবাদের মাধ্যমে হব্‌স রাষ্ট্রকে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্র ঈশ্বরের সৃষ্টি কোন কাল্পনিক প্রতিষ্ঠান নয়। মানুষই হল রাষ্ট্রের সৃষ্টিকর্মের রূপকার।

(৫) আইন সম্পর্কে হব্সের ধারণা আইনের বিশ্লেষণাত্মক মতবাদ (Analytical School)-কে প্রতিপন্ন করেছে।

(৬) সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে হব্সের ধারণা রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সার্বভৌমিকতার ধারণাকে আধুনিক রূপ দিয়েছেন এবং সার্বভৌম শক্তির অবস্থান নির্দেশ করেছেন। এইভাবে তিনি রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করেছেন।

(৭) রাষ্ট্র-দার্শনিক হসের কীর্তি সম্পর্কে সেবাইন (G. H. Sabine)-এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। সেবাইনের মতানুসারে ‘রাষ্ট্রদর্শনের ইংরেজী ভাষাভাষী লোকেদের মধ্যে হস সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী’ (‘… Hobbes was probably the greatest writer on political philosophy that the English speaking peoples have produced.”