রুশোর চুক্তিবাদ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়: অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসী দার্শনিক রুশো রাষ্ট্রচিস্তার ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট নাম। সমকালীন ফ্রান্সে অপশাসন ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধে ফরাসী জনগণ প্রতিবাদে মুখর হয়। এই প্রতিবাদের পিছনে রুশো তত্ত্বগত সমর্থন যুগিয়েছেন। ফরাসী বিপ্লবের পিছনেও রুশোর তাত্ত্বিক অবদান অপরিসীম। স্যাবাইন-এর মতানুসারে, ‘পশ্চিমী রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে রুশোর সময় থেকে সাবেকী চিন্তাধারার প্রভাবের এক নতুন যুগ শুরু হয়’ (“With Rousseau begins a new era of classical influence on Western political thought.”)। রুশোর রাষ্ট্রচিন্তা ইউরোপের রাজনীতিতে রেনেসাঁর প্রকাশকে প্রভাবিত করেছে। ফরাসী দার্শনিক রুশোর ‘সামাজিক চুক্তি’ গ্রন্থে কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের পরিবর্তে, অভিজ্ঞতা ও আত্মদর্শনের সংঘাত সঞ্জাত এক অভূতপূর্ব সার্বভৌমত্বের ধারণা ব্যক্ত হয়েছে।

সামাজিক চুক্তি সম্পর্কে রুশোর মতবাদের পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Contract Social-এ। গ্রন্থটি ১৭৬২ সালে প্রকাশিত হয়। কোল-এর মতানুসারে ‘সামাজিক চুক্তি হল রুশোর সব থেকে বিখ্যাত আলোচনা, এক অবিস্মরণীয় কাজ।’ তিনি বলেছেন: “It is one of the greatest books dealing with political philosophy.”

প্রাকৃতিক অবস্থা: ‘প্রাকৃতিক অবস্থা’র ব্যাখ্যা থেকে রুশোও তাঁর আলোচনা শুরু করেছেন। রুশোর প্রথম নিবন্ধ হল Discourse on the Origin of Inequality Among Men। এই নিবন্ধে তিনি প্রাকৃতিক অবস্থার এক কল্যাণকর রূপের পরিচয় দিয়েছেন। রুশোর মতে মানব চরিত্র হল মূলত ভাল। প্রাকৃতিক পরিবেশের আদিম মানুষ ছিল সহজ, সরল, স্বাধীন ও সাহসী। এই সময় কৃত্রিমতা ছিল না, ছিল না হানাহানি, হিংসা, দ্বন্দ্ব, নিষ্ঠুরতা বা জটিলতা। তখন ছিল সরলতা, সহযোগিতা ও সৌভ্রাতৃত্বের রাজত্ব। সংক্ষেপে রুশো যে প্রাকৃতিক অবস্থার কথা বলেছেন, তা ছিল মর্তের স্বর্গ বা রোমান্সের রাজত্ব।

প্রাকৃতিক অবস্থা কালক্রমে জটিল হয়ে পড়ল: রুশোর মতানুসারে প্রাকৃতিক অবস্থার স্বর্গরাজ্যের আদিম সুখ, সমৃদ্ধি, সাম্য বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশের এই সুখ-শান্তি থেকে কালক্রমে বঞ্চিত হল। এর পিছনে প্রধানত তিনটি কারণ কাজ করেছে। এই তিনটি কারণ হল : জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যক্তিগত সম্পত্তির সৃষ্টি এবং যুক্তি ও বিচারবুদ্ধির উন্মেষ। এই ত্রিবিধ কারণে সৃষ্টি হল অশান্তি, বৈষম্য ও জটিলতার। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে প্রগতিমূলক নানা রকম পরিবর্তন সূচিত হল। এবং এইভাবে অশান্তির সূত্রপাত হল। ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধ দেখা দিল। তার ফলে আর্থনীতিক বৈষম্য সমাজের সুস্থ চেহারাকে বদলে দিল। তারপর যুক্তি ও বিচার-বুদ্ধির উন্মেষ ঘটল। তখন মানুষের সহজ সরল প্রকৃতি হয়ে পড়লো জটিল-কুটিল। এই সমস্ত কিছুর ফলে প্রাকৃতিক অবস্থার আদিম স্বর্গ সুখ অন্তর্হিত হল। তার জায়গায় হিংসা, দ্বন্দ্ব, কলহ প্রভৃতির সৃষ্টি হল। এইভাবে রুশোর প্রাকৃতিক অবস্থাও কালক্রমে হবসের প্রাকৃতিক অবস্থার মতই প্রায় দুর্বিষহ হয়ে উঠল। এই অশান্ত ও অসহ্য অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য প্রাকৃতিক অবস্থা পরিত্যাগ করে রাষ্ট্র সৃষ্টি জরুরী হয়ে পড়ল।

সাধারণের ইচ্ছা-র হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত হয়েছে: রুশোর মতানুসারে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে। এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল প্রাকৃতিক পরিবেশের মানুষের নিজেদের মধ্যেই। চুক্তিটি হয়েছে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের, সকলের সঙ্গে সকলের। জনগণ চুক্তি করে তাদের সকল অধিকার নিঃশর্ত ও চূড়ান্তভাবে সমর্পণ করেছে। তবে সকল ক্ষমতার এই নিঃশর্ত সমর্পণ কোন ব্যক্তি বিশেষের কাছে করা হয় নি। জনগণ তাদের ক্ষমতা সমর্পণ করেছে তাদেরই যৌথ ব্যক্তিত্বের কাছে। জনগণের এই সামগ্রিক বা যৌথ ব্যক্তিত্বকে রুশো বলেছেন ‘সমষ্টিগত ইচ্ছা’ বা ‘সাধারণের ইচ্ছা’ ‘General will)। এই ‘সাধারণের ইচ্ছা’ই হল চরম, চূড়ান্ত, অবাধ ও সর্বাত্মক ক্ষমতার অধিকারী। এই ‘সাধারণের ইচ্ছা’ই হল সার্বভৌম।

হবস ও লকের চিন্তাধারার সমন্বয়: রুশো সামাজিক চুক্তির ক্ষেত্রে হবস ও লকের মতবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন। তিনি হবসের পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন, কিন্তু লকের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। রুশো হবসের মতই একটি চুক্তির কথা বলেছেন। এই চুক্তিটি প্রত্যেক ব্যক্তির পারস্পরিক চুক্তি হিসাবে সম্পাদিত হয়েছে। তবে এই চুক্তির ফলে রাজার সৃষ্টি হয় নি। কোন রাজার হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। মানুষ চুক্তির মাধ্যমে ‘সাধারণের ইচ্ছা’ (General Will)-এর উপর ক্ষমতা অর্পণ করেছেন। অর্থাৎ রুশো লকের সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করে জনগণের ইচ্ছা ও সম্মতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ডানিং মন্তব্য করেছেন : (“…the Hobbesian precision in defining the terms of pact obviously appealed to him and his own treatment of the subject is but the substance of Locke developed by the method of Hobbes.

গণ-সার্বভৌমত্বের ধারণা: এই ‘সাধারণের ইচ্ছা’ সকলের ইচ্ছার যোগফল মাত্র নয়। তা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতও নয়। একে প্রত্যেকের প্রকৃত ইচ্ছার (Real will) সমন্বয় হিসাবে ধরতে হবে। প্রত্যেকের প্রকৃত ইচ্ছা সাধারণের মঙ্গল কামনা করে। অর্থাৎ প্রত্যেকের কল্যাণ কামনা করে। সুতরাং সকলেই হল এই সাধারণের ইচ্ছার সমান অংশীদার। প্রত্যেকে সাধারণের ইচ্ছার অংশীদার এই কারণে যৌথভাবে তারা যা সমর্পণ করেছিল, আবার তা তারা ফিরে পেল। অর্থাৎ সকল মানুষই যৌথভাবে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হল। সমষ্টিগতভাবে জনগণই হল সার্বভৌম। এইভাবে রুশো গণ-সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব প্রচার করেছেন। রুশোর মতানুসারে ‘জনগণের ইচ্ছাই হল ঈশ্বরের ইচ্ছা” (“Vox Populi, Vox Dei” – “Voice of the people is the voice of God.”) I

সাধারণের ইচ্ছা: রুশোর চুক্তিবাদের মূল স্তম্ভ হল সাধারণের ইচ্ছা তত্ত্ব। তাই রুশোর চিন্তাধারা যথাযথভাবে অনুধাবনের জন্য তাঁর সাধারণের ইচ্ছাতত্ত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা দরকার। সমষ্টিগত স্বার্থ বা সাধারণের কল্যাণ (common interest) যে ইচ্ছার মধ্যে বর্তমান তারই সমন্বয়ে ‘সাধারণের ইচ্ছা’ (General will)-র সৃষ্টি হয়। মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে দু’ধরনের ইচ্ছা থাকে। একটিকে বলে ‘প্রকৃত ইচ্ছা’ (Real will) এবং আর একটিকে বলে ‘অপকৃত ইচ্ছা’ (Unreal will)। ব্যক্তিগত স্বার্থ সম্পর্কিত ইচ্ছাটি হল অপ্রকৃত ইচ্ছা। এবং সাধারণের স্বার্থ বা কল্যাণ সম্পর্কিত ইচ্ছাটি হল প্রকৃত ইচ্ছা। প্রত্যেকের প্রকৃত ইচ্ছার সমন্বয়েই সৃষ্টি হয় সাধারণের ইচ্ছা। রুশোর মতে, “…the organisation and synthesis of the real wills of the individuals in the society.”

রাষ্ট্রের উৎপত্তিবাদে জাঁ জ্যাক রুশোর মতবাদের বৈশিষ্ট্য

রুশোর চুক্তিবাদী বক্তব্যের পর্যালোচনা থেকে কতকগুলি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। 

(১) রুশোর মতানুসারে প্রাকৃতিক অবস্থায় সকলেই ছিল স্বাধীন ও সমানাধিকারসম্পন্ন। এ ছিল মর্ত্যের স্বর্গ, রোমান্সের রাজত্ব। 

(২) জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যক্তিগত সম্পত্তির সৃষ্টি এবং যুক্তি ও বিচারবুদ্ধির উন্মেষের ফলে প্রাকৃতিক অবস্থা কালক্রমে জটিল ও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।

(৩) মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্রনৈতিক সমাজ সৃষ্টি করেছে।

(৪) মানুষ চুক্তি করে তাদের সকল ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে অর্পণ করেছে তাদের যৌথ ব্যক্তিত্ব বা সাধারণের ইচ্ছার উপর।

(৫) সাধারণের ইচ্ছাই হল সার্বভৌম। রুশো গণ-সার্বভৌমত্বের কথা বলেছেন।

(৬) সাধারণের ইচ্ছার মধ্যে স্বাধীনতা ও কর্তৃত্বের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক বর্তমান। 

(৭) সাধারণের ইচ্ছার দ্বারা সরকারের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয়।

রাষ্ট্রের উৎপত্তিবাদে জাঁ জ্যাক রুশোর মতবাদের সমালোচনা

বিরুদ্ধবাদীরা বিভিন্ন দিক থেকে রুশোর মতবাদের বিরূপ সমালোচনা করেছেন।

(১) হারণশ-এর মতানুসারে রুশোর সাধারণের ইচ্ছা হল ছিন্ন মস্তক লেভিয়াথান। রুশোর সাধারণের ইচ্ছা, হসের লেভিয়াথানের মতই অসীম ক্ষমতার অধিকারী। হস ব্যক্তিগত স্বৈরাচারিতাকে সমর্থন করেছেন। অপরদিকে রুশো সাধারণের বা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারিতাকে সমর্থন করেছেন। উভয়ই সমর্থনযোগ্য নয়। 

(২) সাধারণের ইচ্ছার ধারণাটি অস্পষ্ট। রুশোর মতানুসারে প্রত্যেকের প্রকৃত ইচ্ছার সমন্বয়ই হল সাধারণের ইচ্ছা। সকলের প্রকৃত ইচ্ছার সমন্বয়ের ধারণাটি পরিষ্কার নয়। মানুষের কোন্‌টি প্রকৃত ইচ্ছা এবং কোন্‌টি অপ্রকৃত ইচ্ছা তা নির্ধারণ করা মুশকিল।

(৩) রুশো গণতন্ত্রের মৌল নীতিকে মর্যাদা দেন নি। কারণ তিনি সাধারণের ইচ্ছার নির্দেশের কাছে ব্যক্তিকে আত্মসমর্পণ করতে বলেছেন। রাসেল (Bertrand Russel)-এর মতানুসারে রুশোর মতবাদের মধ্যে সামগ্রিক রাষ্ট্রের প্রতি প্রবণতা বর্তমান। তিনি বলেছেন: “Rousseau’s doctrine though it pays ‘lip service’ to democracy, tends to the justification of totalitarian state.”

(৪) সাধারণের ইচ্ছাতত্ত্ব আদর্শবাদ প্রতিষ্ঠার সহায়ক হতে পারে, কিন্তু বাস্তব বিচারে এর গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দেয়। ওয়েপার (C. L. Wayper) মন্তব্য করেছেন: “There can be little doubt that ultimately it is the organic view of the state that Rousseau embraces.” 

(৫) আপাতবিচারে ব্যক্তি-স্বাধীনতা সম্পর্কিত রুশোর ধারণা উদারনীতিক বলে মনে হয়; কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে রুশো রাষ্ট্রের যূপকাষ্ঠে বলি দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে লয়েড-এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “Rousseau was equally the father of the Declaration of Rights and of the Authoritarian State.”

(৬) রুশোর সাধারণের ইচ্ছা ছোট রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে, কিন্তু বৃহৎ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নয়। আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাধারণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব অসম্ভব।

রাষ্ট্রের উৎপত্তিবাদে জাঁ জ্যাক রুশোর মতবাদের মূল্যায়ন

বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও রুশোর মতবাদ নানা কারণে মূল্যবান। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে রুশোর মতবাদের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।

(ক) রুশোর মতবাদের ঐতিহাসিক মূল্যকে অস্বীকার করা যায় না। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাসে এই মতবাদ গভীর আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রচিন্তা বিশেষতঃ ইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে এই মতবাদ সাহায্য করেছে। 

(খ) ‘জনগণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি, পশুশক্তি নয়’—এই মূল্যবান সত্যটি হল রুশোর সাধারণের ইচ্ছাতত্ত্বের অবদান।

(গ) গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধকে রুশো সর্বাধিক মূল্য দিয়েছেন। ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও সাম্য তাঁর মতবাদে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে। টমসন বলেছেন: “Rousseau was per excellence, the philosopher of that great ‘democratic revolution’ which began in the eighteenth century and went on gaining sporadic victories….”

(ঘ) সাধারণের ইচ্ছাতত্ত্বের মাধ্যমে রুশো গণ-সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব প্রচার করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এ হল এক গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় তত্ত্ব।

(ঙ) রুশোর মতবাদের হসের চরমতন্ত্রের সঙ্গে লকের সাধারণতন্ত্রের সমন্বয় সাধিত হয়েছে।

(চ) রুশো তাঁর সাধারণের ইচ্ছাতত্ত্বের মাধ্যমে সার্বভৌমিকতা ও জনগণের স্বাধীনতার মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন।