সীমাবদ্ধ রাজতন্ত্রের সমর্থক: ইংল্যাণ্ডের গৌরবময় বিপ্লবের গণতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে লকের রাষ্ট্রচিন্তা সংযুক্ত। ১৬৮৮ সালে ইংল্যাণ্ডে গৌরবময় বিপ্লব (Glorious Revolution, 1688) সংঘটিত হয়। এই বিপ্লবের মধ্যে রাজা ও পার্লামেন্টের অধিকারের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠে। পরিণতিতে পার্লামেন্ট বা গণশক্তির জয় হয়। জন লক্ ছিলেন এর তাত্ত্বিক প্রবক্তা। লকের রাষ্ট্রচিন্তায় সমকালীন সমাজের চাহিদা ও গতি-প্রকৃতি স্থান পেয়েছে। লক্ রাজার অবাধ ক্ষমতা ও রাজার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের ধারণাকে সমর্থন করেননি। লক্ সীমাবদ্ধ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র (Limited Monarchy)-এর সমর্থক ছিলেন। তিনি সামাজিক চুক্তি মতবাদকে সমকালীন রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এক নতুন রূপে হাজির করলেন। ১৬৯০ সালে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Two Trea tises of Government প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে চুক্তিবাদ সম্পর্কে লকের ধ্যান-ধারণার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায়।
প্রাকৃতিক অবস্থা: প্রাকৃতিক অবস্থার বর্ণনা থেকেই লও তাঁর চুক্তিবাদের বক্তব্য শুরু করেছেন। লকের মতানুসারে প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল প্রাক্-রাষ্ট্রীয় (pre-political); থাক্-সামাজিক নয়। অর্থাৎ প্রাকৃতিক পরিবেশে এক ধরনের সহজ সমাজজীবন ছিল। মানুষ হল সামাজিক ও সহানুভূতিসম্পন্ন। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে অসামাজিক ও আত্মসর্বস্ব বা আক্রমণমুখী নয়। লক্-কল্পিত প্রাকৃতিক অবস্থা হসের প্রাকৃতিক অবস্থার মত ভয়াবহ ছিল না। লকের মতে প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল শান্তি, শুভেচ্ছা ও পারস্পরিক সহযোগিতার রাজ্য। প্রাকৃতিক অবস্থায় আদিম মানুষ মোটামুটি সুখেই ছিল। প্রাকৃতিক অবস্থায় শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজ করত।
স্বাভাবিক আইন ও স্বাভাবিক অধিকার: প্রাকৃতিক অবস্থায় ন্যায়, বিবেক ও যুক্তির অনুশাসন ছিল। এই ছিল তখনকার স্বাভাবিক আইন (Natural Law)। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। তার ফলে তখন সকলে ছিল স্বাধীন ও সমানাধিকারসম্পন্ন। লক্ এইভাবে সাম্যের উপর স্বাভাবিক অধিকার (Natural Rights)-কে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি: প্রাকৃতিক অবস্থায় সুখ-শাস্তি ছিল, তেমনি আবার কিছু অসুবিধাও ছিল। লকের মতানুসারে প্রাকৃতিক পরিবেশের আদিম মানুষ মূলত তিনটি কারণের জন্য রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে। এই তিনটি কারণ হল: (১) স্বাভাবিক আইন স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট ছিল না। (২) এই আইনকে বলবৎ করার কোন কর্তৃপক্ষ ছিল না; এবং (৩) এই আইনকে ব্যাখ্যা ও রক্ষা করার কোন ব্যবস্থা ছিল না। প্রকৃত প্রস্তাবে এক্ষেত্রে আইন, শাসন ও বিচার-বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের অভাবের কথাই ব্যক্ত হয়েছে। এই অসম্পূর্ণতার জন্য প্রাকৃতিক অবস্থায় জীবন নিরাপদ ও নিশ্চিত ছিল না। প্রাকৃতিক অবস্থায় আদিম মানুষ স্বাভাবিক স্বাধীনতা নিরবচ্ছিন্নভাবে ভোগ করার জন্য এবং জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে।
চুক্তি সম্পর্কে ধারণা: লকের মতানুসারে চুক্তি হয়েছিল একটি নয়, দুটি। প্রথম চুক্তিটি হয়েছে আদিম মানুষের নিজেদের মধ্যে। তার ফলে সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রের। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারকে বাহ্যিক বিপদ থেকে নিরাপদ করা। দ্বিতীয় চুক্তিটি হয়েছে সমগ্র সম্প্রদায়ের সঙ্গে শাসকের। তার ফলে সৃষ্টি হয়েছে সরকারের। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারকে সরকারের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা। প্রথমটি হল সামাজিক চুক্তি (social contract) এবং দ্বিতীয়টি হল সরকারী চুক্তি (Governmental contract)। সরকারী চুক্তির মাধ্যমে মানুষ রাজাকে কিছু পরিমাণ স্বাভাবিক অধিকার প্রদান করেছে। তবে নিঃশর্তভাবে রাজাকে ক্ষমতা প্রদান করা হয় নি। রাজাকে শর্তসাপেক্ষে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। শর্ত হল এই যে, রাজা প্রজাদের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করবেন। চুক্তির এই শর্ত রাজা পালন না করলে, তিনি চুক্তি লঙ্ঘন করবেন। তখন চুক্তিভঙ্গকারী রাজাকে অপসারিত করার অধিকার প্রজাদের থাকবে। প্রজাদের এই অধিকার আইনসঙ্গত।
সার্বভৌমিকতার ধারণা: লকের মতানুসারে জনগণ দ্বিতীয় চুক্তির মাধ্যমে কিছু স্বাভাবিক অধিকার সরকারের হাতে ন্যস্ত করেছে। তাঁর মতে সরকার হল এক রকম জিম্মাদার (Trustee)। সরকার চুক্তির একটি পক্ষ। জনগণ ও সরকার উভয়ের উপর চুক্তির শর্ত সমভাবে প্রযোজ্য। সরকার জিম্মাদারের দায়িত্ব পালন করতে না পারলে জনগণ আইনসঙ্গতভাবে সরকারকে অপসারণ করতে পারে। লক এইভাবে সরকারের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করেছেন এবং জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। লকের অনুসারে জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সরকার তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন সাধন করতে পারে। লকের মতানুসারে সার্বভৌমিকতা অবাধ ও অসীম নয়। সরকার ও জনগণের মধ্যে সার্বভৌমিকতা বিভক্ত।
রাষ্ট্রের উৎপত্তিবাদে জন লকের মতবাদের বৈশিষ্ট্য
লকের চুক্তিবাদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে কতকগুলি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।
(১) লকের মতানুসারে প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল প্রাক্-রাষ্ট্রীয়। এই অবস্থা ছিল শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল।
(২) জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারকে নিরাপদ করাই হল চুক্তি সম্পাদনের উদ্দেশ্য।
(৩) লকের মতনুসারে দু’টি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। প্রথম চুক্তিটি হয়েছে জনগণের নিজেদের মধ্যে। এই চুক্তির ফলে সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রের। দ্বিতীয় চুক্তিটি হয়েছে জনসাধারণের সঙ্গে রাজার। তার ফলে গঠিত হয়েছে সরকার।
(৪) শাসক বা রাজাও চুক্তির একটি পক্ষ। তিনি চুক্তির ঊর্ধ্বে নন।
(৫) জনগণ শর্তসাপেক্ষ রাজার হাতে ক্ষমতা প্রদান করেছে। রাজা প্রজাদের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করবেন এবং পরিবর্তে জনগণ আনুগত্য প্রদর্শন করবে।
(৬) রাজা চুক্তিভঙ্গ করলে বা চুক্তির শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে, জনগণ রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে।
(৭) লক গণ-সার্বভৌমিকতার কথা বলেছেন এবং সরকারের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার ধারণা প্রচার করেছেন।
(৮) লক সাধারণতান্ত্রিক বা সীমাবদ্ধ সরকারের কথা বলেছেন।
(৯) জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সরকারের বিরোধিতা করার অধিকারকে লক স্বীকার ও সমর্থন করেছেন।
(১০) লক্ রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন।
রাষ্ট্রের উৎপত্তিবাদে জন লকের মতবাদের সমালোচনা
লকের চুক্তিবাদী তত্ত্ব পর্যালোচনা করলে কতকগুলি ক্ষেত্রে দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়।
(১) লক সার্বভৌমিকতার রাজনীতিক দিকটির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু সার্বভৌমিকতার আইনগত দিকটিকে তিনি উপেক্ষা করেছেন। গিলক্রিস্ট-এর মতানুসারে, ‘হস আইনগত সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব প্রচার করলেও রাজনীতিক সার্বভৌমের অস্তিত্ব ও ক্ষমতাকে স্বীকার করেননি; লক রাজনীতিক সার্বভৌমের ক্ষমতাকে স্বীকার করলেও, আইনগত সার্বভৌমিকতাকে যথেষ্ট স্বীকৃতি দেননি।
(২) সার্বভৌমিকতার অবস্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রেও লক তেমন সফল নন। সার্বভৌম শক্তির উৎস হিসাবে জনমতকে নির্দেশ করা যথার্থ নয়। কারণ জনমতের স্বরূপ নির্ধারণ করা দুরূহ ব্যাপার।
(৩) লকের স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বও সমালোচনাযোগ্য। রাষ্ট্রীয় আইন হল অধিকারের ভিত্তি। প্রাকৃতিক অবস্থায় রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় আইন ছিল না। তাই তখন অধিকারের অস্তিত্ব অবান্তর।
(৪) সমালোচকদের অনেকের মতে লক আর্থনীতিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ও ধনতান্ত্রিক তত্ত্বও প্রচার করেছেন।
(৫) ম্যাক্সি (Maxey)-র মতানুসারে লকের রাষ্ট্রচিন্তায় নতুনত্বের অভাব আছে। লকের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত সকল বিষয়ই তাঁর পূর্বসূরীদের দ্বারা আলোচিত হয়েছে। প্রাকৃতিক রাজ্য সম্পর্কিত লকের ধারণার উপর স্টোইকদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
রাষ্ট্রের উৎপত্তিবাদে জন লকের মতবাদের মূল্যায়ন
বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও লকের মতবাদের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যাবে না। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে লকের তত্ত্ব নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ।
(ক) ‘সরকারের ভিত্তি জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত—লক এই ধারণা প্রচার করেছেন। তাই বলা হয় যে লকই প্রথম গণতন্ত্রের মৌলিক অর্থ অনুধাবন করেছেন।
(খ) লকের উদ্দেশ্য ছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মানুষের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা। তাই তিনি বলেছেন আইনসঙ্গতভাবে সরকার পরিবর্তনের অধিকার জনগণের আছে।
(গ) লক সীমাবদ্ধ সার্বভৌমিকতার ধারণা প্রচার করেছেন।
(ঘ) ‘স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব’ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে লকের এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। লক জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারকে ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন।
(ঙ) রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে লক্ সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে এই পার্থক্যমূলক আলোচনা নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের ভিত্তি রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
(চ) পরবর্তীকালের হিতবাদী দর্শনে লকের উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন ঘটেছে। অনেকের মতে বোম-এর সুখবাদের উপর লকের সুখতত্ত্বের প্রভাব পড়েছে। আবার আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও লকের মতবাদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া লকেল তত্ত্বকেই মন্টেস্কু (Montesquieu)-র ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উৎস হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
Leave a comment