রাষ্ট্রের উবে যাওয়ার তত্ত্বটি হল মার্কসীয় রাষ্ট্রদর্শনের এক চূড়ান্ত বক্তব্য। এ প্রসঙ্গে ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ এবং ‘অ্যান্টি ডুরিং’শীর্ষক গ্রন্থে আলোচনা আছে। মার্কসবাদ অনুসারে পৃথিবীতে এক সময় আদিম সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত ছিল। তখন শোষণ ছিল না। তাই সেই সময় শোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রও ছিল না। তারপর এক সময় ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধ জাগ্রত হয়। তখনই শোষণের সূত্রপাত ঘটে। সমাজের যে শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হল সেই শ্রেণী নিজেদের ক্ষমতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করল। যাইহোক শেষে এমন একদিন আসবে যখন শোষিত শ্রেণী সংঘবদ্ধ হবে এবং বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। তখন সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব শোষক শ্রেণীকে ধ্বংস করবে এবং শোষণমুক্ত সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে। তখন সমাজে পরস্পর বিরোধী স্বার্থসম্পন্ন শ্রেণী থাকবে না। সমাজ হবে শোষণশূন্য। তাই শোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে এবং স্বাভাবিকভাবেই অবলুপ্ত হবে। এঙ্গেলস বলেছেন: “The state is not abolished. It withers away.”

রাষ্ট্র অপ্রয়োজনীয় হয়ে অবলুপ্ত হয়:

সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে প্রলেতারিয়েতরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। রাজনীতিক ক্ষমতা দখলের ভিত্তিতে প্রলেতারিয়েতরা উৎপাদন শক্তির উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা বা সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করবে। রাজনীতিক আধিপত্য অর্জনের পর প্রলেতারিয়েতের প্রথম কাজ হবে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার উৎসাদন। তখন সামাজিক সম্পর্ক ও সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন প্রতিপন্ন হবে। পুঁজিবাদী ভোগদখল ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটবে। উৎপন্নের নতুন ভোগদখল ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ ভোগদখলের সৃষ্টি হবে। এঙ্গেলসের অভিমত অনুসারে প্রলেতারীয় বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেণী বৈরিতা বিলুপ্ত হবে। শ্রেণী-বৈরিতা ও রাষ্ট্র দুটোরই একসঙ্গে অবসান ঘটবে। সফল প্রলেতারীয় বিপ্লবের পরবর্তী পর্বে সমাজে কোন শ্রেণী থাকবে না। সমাজ হবে শ্রেণীহীন। শ্রেণী থাকবে না বলে শ্রেণী-শোষণও থাকবে না। শ্রেণীহীন ও শোষণশূন্য সমাজে শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রেরও আর কোন প্রয়োজন থাকবে না। বুর্জোয়া সমাজে বা সকল শ্রেণী-সমাজে শ্রেণীশোষণের হাতিয়ার হিসাবে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অব্যাহত ছিল। শ্রেণী-শোষণের প্রয়োজন আর না থাকায় অপ্রয়োজনীয় হয়ে রাষ্ট্র অবলুপ্ত হবে। এক সময় সমাজে শ্রেণী প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থার নৈরাজ্যের পরিস্থিতি থাকে না। এই পরিস্থিতিতে ব্যক্তিমানুষের জীবনধারণের সংগ্রাম থাকে না। এই অবস্থায় নিপীড়ন বলে কিছু থাকে না। স্বভাবতই পীড়নমূলক যন্ত্র রাষ্ট্রেরও আর কোন প্রয়োজন থাকে না। সমাজের কোন ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের আর কোন রকম দরকার থাকে না। রাষ্ট্র স্বাভাবিক নিয়মে অবলুপ্ত হয়। এঙ্গেলস বলেছেন: “As soon as there is no longer any social class to be held in subjection, as soon as class rule and the individual struggle for existence… are removed, nothing more remains to be, repressed, and a special repressive force, a state, is no longer necessary. State interference in social relations becomes, in one domain after another, superfluous and then dies out of itself.”

প্রলেতারিয়েতের বিলুপ্তি:

ক্ষমতাসীন হয়ে প্রলেতারিয়েতরা সমাজ থেকে শ্রেণী-বৈষম্য ও শ্রেণী বৈরিতার বিলোপ সাধন করবে। তবে তার আগেই শ্রেণী হিসাবে প্রলেতারিয়েতদেরই বিলোপ সাধিত হবে। সে সমাজে বুর্জোয়া বলে কোন শ্রেণী থাকবে না। সেই পরিস্থিতিতে প্রলেতারিয়েত শব্দটি অর্থহীন ও অপ্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হবে। শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থায় প্রলেতারিয়েতরা হল উৎপাদন শক্তির মালিক। তাদের শোষিত শ্রেণী বলা যায় না। শ্রেণীবিভেদ ও শ্রেণীবৈরিতা দূর করে প্রলেতারিয়েত হিসাবে তারা একদিন বিলীন হয়ে যাবে।

প্রলেতারিয়েতরা বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অবসান ঘটাবে, প্রলেতারীয় রাষ্ট্র অবলুপ্ত হবে:

প্রলেতারিয়েতরা রাষ্ট্র-ক্ষমতা হাতে পেয়ে ‘রাষ্ট্র হিসাবে রাষ্ট্র’ (state as state)-কে বিলুপ্ত করবে। রাষ্ট্র হিসাবে রাষ্ট্রের বিলোপ সাধন’ কথাটির অর্থ হল বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বিলোপ সাধন। প্রলেতারিয়েতরা বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে বিলুপ্ত করবে। বিপ্লবের মাধ্যমে প্রলেতারিয়েতরা বুর্জোয়া রাষ্ট্রের পীড়নমূলক প্রকৃতির অবসান ঘটাবে। অর্থাৎ প্রলেতারীয় বিপ্লবের পরবর্তী পর্বেও রাষ্ট্রের অবশিষ্টাংশ থেকে যাবে। এ হল আধারাষ্ট্র, রাষ্ট্রের মত বা প্রলেতারীয় রাষ্ট্র। তারপর সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রেরও প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যেতে থাকবে। তখন আপনা থেকেই এই রাষ্ট্র অবলুপ্ত হবে। উৎপাদনের উপাদানসমূহের উপর সামাজিক মালিকানা এবং শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে স্বাভাবিক নিয়মে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে। রাষ্ট্র আপনা থেকেই অবলুপ্ত হবে। এ হল প্রলেতারীয় রাষ্ট্র। সুতরাং প্রলেতারিয়েতরা রাষ্ট্র হিসাবে রাষ্ট্রের বা বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অবসান ঘটাবে এবং প্রলেতারীয় রাষ্ট্র আপনা থেকেই অবলুপ্ত হবে।

সমগ্র সমাজের প্রকৃত প্রতিনিধি হিসাবে রাষ্ট্রের মৃত্যু:

এঙ্গেলসের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের সংগঠন ও সংস্থাসমূহ সমাজের প্রভু হিসাবে যতদিন প্রতিষ্ঠিত থাকবে, রাষ্ট্র হিসাবে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ততদিন অব্যাহত থাকবে। রাষ্ট্রের সংস্থা বলতে এ ক্ষেত্রে সরকার, আমলা, পুলিশ, সৈন্যবাহিনী প্রভৃতিকে বোঝান হয়। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রভুত্বকারী শ্রেণীর সংগঠন হিসাবে রাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল। এই প্রয়োজন শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য। দাস-প্রভু, সামন্ত-প্রভু বা পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার ছিল রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রকে সমকালীন সমাজের আনুষ্ঠানিক প্রতিনিধি হিসাবে প্রতিপন্ন করা। এই রাষ্ট্রকে সমাজের প্রকৃত প্রতিনিধি বলা যায় না। রাষ্ট্র যেদিন সমাজের প্রকৃত প্রতিনিধিতে পরিণত হয়, সেদিন রাষ্ট্রের কোন প্রয়োজন আর থাকে না। সামাজিক সম্পর্কের কোন ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের আর প্রয়োজন থাকে না। এই অবস্থায় রাষ্ট্রের স্বাভাবিক অন্তর্ধান অনিবার্য হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র যখন সমগ্র সমাজের প্রকৃত প্রতিনিধিতে পরিণত হয়, তখন সে উৎপাদনের উপাদানসমূহের মালিকানা সমাজের পক্ষে নিজের হাতে তুলে নেয়। এই রাষ্ট্রের এটাই হল প্রথম কাজ এবং শেষ কাজ। এর পরই রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘটে।

লেনিনের অভিমত:

লেনিনের অভিমত অনুসারে পুঁজিবাদী স্তর থেকে সাম্যবাদী স্তরে উত্তরণের অন্তবর্তী অধ্যায়ে সমগ্র সমাজের মধ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের পরিণামে রাষ্ট্রের অন্তর্ধান আসন্ন হয়। সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতিদের অন্তিম প্রতিরোধও শেষ হয়ে যায়। পুঁজিপতি শ্রেণী শেষ হয়ে যায়। সমাজে আর কোন শ্রেণীই থাকে না। তখন রাষ্ট্রও অন্তর্হিত হয়। মার্কসবাদের উচ্চতম পর্যায়টি হল রাষ্ট্রের অন্তর্হিত হওয়ার আর্থনীতিক ভিত্তি। সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় কোন শ্রেণী থাকে না, শ্রেণী-সংগ্রাম থাকে না, শ্রেণী-শোষণ থাকে না, শোষণ থাকে না বলে শোষণের হাতিয়ার রাষ্ট্রও থাকে না— রাষ্ট্রের অবসান ঘটে না, রাষ্ট্রের দিন ফুরিয়ে যায়, রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘটে। প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্র উরে যায়। এ প্রসঙ্গে লেনিন State and Revolution শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “The state withers away in so far as there are no longer any capitalists, any classes, and consequently, no class can be suppressed.”

তিনটি পূর্বশর্ত:

সমাজতান্ত্রিক স্তর হল সাম্যবাদী সমাজের প্রাথমিক স্তর। এই স্তরে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অবসান ঘটে না। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অবলুপ্ত হয় সাম্যবাদী সমাজের উচ্চস্তরে। রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অবলুপ্তি আপনা-আপনি প্রাকৃতিক নিয়মে হয় না। কোন যান্ত্রিক পদ্ধতিতেও রাষ্ট্রের বিলুপ্তির ঘটনা ঘটে না। রাষ্ট্রের আস্তত্বের অবসানের ক্ষেত্রে মানুষের ইচ্ছা বা উদ্যোগের কোন ভূমিকা নেই, তাও ঠিক নয়। বস্তুত রাষ্ট্রের বিলুপ্তির বিষয়টি হল একটি ক্রমিক প্রক্রিয়ার বিষয়। এই প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদী। তারজন্য প্রয়োজন হল সহায়ক বৈষয়িক ভিত্তির এবং সক্রিয় উদ্যোগের। রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অবলুপ্তি কতকগুলি পূর্বশর্তের উপর নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে মূলত তিনটি পূর্বশর্তের কথা বলা হয়। এই তিনটি পূর্বশর্ত হল: 

  • আর্থনীতিক, 

  • সামাজিক ও 

  • বৌদ্ধিক।

আর্থনীতিক পূর্বশর্ত:

রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অবলুপ্তি ঘটে সাম্যবাদী সমাজের উচ্চস্তরে, অর্থাৎ সম্পূর্ণ সাম্যবাদী সমাজে। এই সমাজে রাষ্ট্রের অবলুপ্তির প্রাথমিক শর্তটিই হল আর্থনীতিক। সাম্যবাদী সমাজে উৎপাদিকা শক্তির উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটে। তারফলে মানুষের ক্রমবর্দ্ধমান বিবিধ বৈষয়িক ও মানসিক অভাব বা চাহিদার পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তি ঘটে। এবং চাহিদাসমূহের এই পরিতৃপ্তি নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটতে থাকে। সাম্যবাদী সমাজে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং সম্পদের প্রাচুর্য সৃষ্টি হয়। সমাজের ক্রমবিকাশের এই স্তরে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় ও সামাজিক সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এর জন্য প্রয়োজন মানুষের ঐকান্তিক আগ্রহ। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও সম্পদের প্রাচুর্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেকে সামর্থ্য অনুসারে পরিশ্রম করে এবং প্রয়োজন অনুসারে সম্পদ ভোগ করার সুযোগ পায়। সাধ্য অনুসারে শ্রম ব্যতিরেকে চাহিদা অনুযায়ী বণ্টনের ব্যবস্থা করা যায় না। এই কারণে সাম্যবাদী সমাজে শ্রম ও বণ্টনের নীতি পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। সাম্যবাদী সমাজের শ্রমের আদর্শ এবং সম্পদ সৃষ্টির বিষয়টি পৃথক প্রকৃতির। এ বিষয়ে সাম্যবাদী সমাজের সকলকে সম্যকভাবে অবহিত করা আবশ্যক। সাম্যবাদী সমাজে শ্রম হল স্বেচ্চা-প্রণোদিত এবং নিয়মের অতিরিক্ত। এই সমাজের শ্রম হল সর্বসাধরণের স্বার্থে মেহনতের অভ্যাসগত শ্রম। এ হল সুস্থ দেহের দাবির ভিত্তিতে শ্রম। সাম্যবাদী সমাজে শ্রমদান করা হয়। সামাজিক স্বার্থে এবং তা করা হয় বিনা পারিশ্রমিকে। সাম্যবাদী সমাজে শ্রমের কোনরকম পারিশ্রমিক বা পারিতোষিকের বিষয় সংযুক্ত থাকে না।

সামাজিক পূর্বশর্ত:

সাম্যবাদী সমাজে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অবলুপ্তির ক্ষেত্রে সামাজিক পূর্বশর্তের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। সমাজের ভিতরে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাজনীতিক প্রকৃতির অবসান আবশ্যক। এবং এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য প্রয়োজন হল সকল রকম শ্রেণীবিভাজনের ও শ্রেণীগত অসাম্যের অবসান। তা ছাড়া সমাজে শারীরিক ও মানসিক শ্রমের মধ্যে পার্থক্য এবং গ্রাম । শহরের মধ্যে পার্থক্য দূর করা দরকার। সাম্যবাদী সমাজের এই সমস্ত সামাজিক শর্ত পূরণ সাপেক্ষে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অবসান ত্বরান্বিত হয়।

বৌদ্ধিক পূর্বশর্ত:

সাম্যবাদী সমাজে রাষ্ট্রের বিলুপ্তির জন্য কিছু বৌদ্ধিক পূর্বশর্তের কথাও বলা হয়। বৌদ্ধিক পূর্বশর্ত বলতে মতাদর্শগত পূর্বশর্তের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। মানুষ নির্ধারণ করবে সমাজের প্রগতির পথ। এই উদ্দেশ্যে প্রাকৃতিক ও সামাজিক শক্তিসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না। মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনের জন্য সামগ্রিক উদ্যোগ আয়োজনের উপর জোর দিতে হবে। এই উদ্দেশ্যে শিক্ষাসংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তার ঘটাতে হবে। সমাজে যাবতীয় বৈষম্যের বিলোপ সাধন এবং সাম্য ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজে সাম্যবাদী নীতিবোধকে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মানুষের জীবনধারা ও চিন্তা-চেতনা থেকে যাবতীয় ধনতান্ত্রিক প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে দূর করতে হবে। সামগ্রিক বিচারে সাম্যবাদী সমাজের সকলের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও চেতনার মান হবে অত্যন্ত উন্নত।

বাহ্যিক পূর্বশর্ত:

সাম্যবাদী সমাজে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অবসান সম্পর্কিত উপরিউক্ত পূর্বশর্তসমূহ আভ্যন্তরীণ প্রকৃতির। কিন্তু এগুলিই সব নয়। এক্ষেত্রে কিছু বাহ্যিক পূর্বশর্তের উপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়। রাষ্ট্রের বিলুপ্তির জন্য কিছু বাহ্যিক পূর্বশর্তও পুরণ হওয়া দরকার। সাম্যবাদী সমাজের চারপাশে কোন ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র থাকা চলবে না। আশেপাশে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সাম্যবাদী সমাজে রাষ্ট্রের বিলুপ্তির পথে প্রতিবন্ধকতা করবে। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের সম্পূর্ণ বিনাশ এবং সমাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত বিজয় বাঞ্ছনীয়।

রাষ্ট্রহীন সমাজের শাসন:

সাম্যবাদী সমাজে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অবসানের পর কিভাবে সমাজব্যবস্থা পরিচালিত হবে সে বিষয়ে আলোচনা করা আবশ্যক। সাম্যবাদী সমাজের রাষ্ট্রহীন অবস্থা হল সামাজিক নিয়ন্ত্রণের অধীন। নির্দিষ্ট সামাজিক কর্মকৌশলের দ্বারা সাম্যবাদী সমাজের কাজকর্ম পরিচালিত হবে। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থার দ্বারা সমাজতান্ত্রিক সমাজের বিবিধ কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হয়। সাম্যবাদী সমাজেও এই সমস্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থা থাকবে। তবে অধিকতর বিকশিত সাম্যবাদী সমাজের পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের পরিপ্রেক্ষিতে এই সমস্ত সংস্থা পুনর্গঠিত হবে। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সাম্যবাদী সমাজেও থাকবে। এই শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে মানুষের জীবনধারা ও শ্রমের স্বেচ্ছামূলক শৃঙ্খলার উপর। এই শাসনের কোন রকম রাজনীতিক চেহারা-চরিত্র থাকবে না। কারণ সাম্যবাদী সমাজে সরকারী ক্ষমতার রাজনীতিক চরিত্র অবলুপ্ত হবে। সাম্যবাদী সমাজ হবে শ্রেণীহীন। এখানে কোন শ্রেণী-পার্থক্য থাকবে না। উৎপাদন-ব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত হবে সমগ্র জাতির একটি কমিটির হাতে। বুর্জোয়া সমাজ ছিল শ্রেণীবিরোধে ক্লিষ্ট। তাই রাজনীতিক শাসন ছিল অপরিহার্য। সাম্যবাদী সমাজে শ্রেণী-পার্থক্য নেই। তাই এখানে আগেকার রাজনীতিক শাসনের ভূমিকা পালন করবে একটি সমিতি। সাম্যবাদী সমাজের রাষ্ট্রহীন অবস্থায় প্রত্যেকের অবাধ বিকাশ প্রতিপন্ন হবে। সকলের অবাধ বিকাশের শর্ত হিসাবে।

রাষ্ট্রের অন্তর্হিত হওয়া সম্পর্কিত মার্কসীয় সমালোচনা:

রাষ্ট্রের অন্তর্হিত হওয়া সম্পর্কিত মার্কসীয় মতবাদ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। এ ক্ষেত্রে মার্কসবাদীদের বক্তব্য বিভিন্ন দিক থেকে বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সমালোচকদের বিভিন্ন যুক্তির মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

(১) রাষ্ট্রের অবলুপ্তি দেখা যায়নি: রাষ্ট্রের অবলুপ্তি সম্পর্কিত মার্কসীয় বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমান দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের সাম্যবাদী সমাজে রাষ্ট্র বিলুপ্ত হয় নি। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দীর্ঘ দিন পরেও রাষ্ট্র বহাল তবিয়তে বিরজমান। বরং সেখানে রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী প্রভাব ক্রমবর্ধমান। সর্বহারার একনায়কত্ব ও শ্রেণীহীন সমাজের কথা বলে রাষ্ট্রের অবলুপ্তির কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে প্রলেতারীয় বিপ্লব ও একনায়কত্ব দেখা গেছে, কিন্তু রাষ্ট্রের অবলুপ্তি দেখা যায় নি।

(২) অলীক: মার্কসীয় রাষ্ট্রদর্শন অনুসারে বলা হয় যে, প্রলেতারীয় বিপ্লব ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অবসানের পর প্রতিষ্ঠিত হবে এক নতুন সমৃদ্ধ জগৎ। সেখানে সমাজ ও সভ্যতা হবে অতি উন্নত মানের। কিন্তু এই মতবাদ বাস্তবে সত্য প্রমাণিত হয়নি। কোন কোন দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও অভিপ্রেত সমাজ-সভ্যতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। এই কারণে কার্ল পপার প্রমুখ অনেক চিন্তাবিদ মার্কসীয় রাষ্ট্রদর্শনকে ইতিহাস-বিরোধী ও অলীক বলে অভিযুক্ত করেছেন। আসিরবাথম (Asirvatham) বলেছেন: “Marx’s theory of classless society is a kind of utopian dream.” কার্ল পপারের আরও অভিযোগ হল সোভিয়েত রাশিয়া (পূর্বতন) এবং ইউরোপের কিছু দেশে সমাজতন্ত্র এসেছে, কিন্তু এই সমস্ত দেশের সমাজতন্ত্র মার্কসীয় দর্শন মোতাবেক প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি। অবশ্য বর্তমানে সংশ্লিষ্ট দেশগুলিতে রাজনীতিক পরিস্থিতির মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে।

(৩) কার্ল পপার: কার্ল পপার রাষ্ট্রের অবলুপ্তি প্রসঙ্গেও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, বুর্জোয়াদের প্রতিরোধের অবসান, সর্বহারার একনায়কত্ব সবই পরিলক্ষিত হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র অন্তর্হিত হওয়ার কোন লক্ষণ সেখানে দেখা যায়নি।

(৪) রাষ্ট্রের কার্যাবলী ক্রমবর্দ্ধমান: সমাজতান্ত্রিক-অ-সমাজতান্ত্রিক নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল দেশেই বর্তমানে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। আধুনিককালের উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকা বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সরকার, আমলাতন্ত্র, পুলিশ বাহিনী, সৈন্য বাহিনী প্রভৃতি বহু ও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে নিয়ে রাষ্ট্রের পরাক্রম ক্রমবর্ধমান। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের কার্যাবলীর এই ক্রমসম্প্রসারণ রাষ্ট্রের অন্তর্হিত হওয়ার লক্ষণ নয়। ধনতান্ত্রিক দেশগুলির জনকল্যাণধর্মী রাষ্ট্র বর্তমানে শ্রমিক শ্রেণীর আর্থনীতিক ও অন্যান্য অবস্থার উন্নতির উদ্দেশ্যে বিবিধ কল্যাণমূলক প্রকল্প প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে। [আধুনিককালে আইনী ব্যবস্থার মাধ্যমে মালিক পক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণে বাধ্য করা হয়। মার্কস এঙ্গেলসের আমলে অবস্থা এ রকম ছিল না।

(৫) অসঙ্গত: সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে প্রলেতারিয়েতরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে এবং রাজনীতিক কর্তৃত্ব লাভ করবে। রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে শ্রমজীবী জনতা নিজেদের অবস্থার সামগ্রিক উন্নতি সাধন করবে। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে, অধিকার ভোগ ও সুযোগ-সুবিধার পরিধি সম্প্রসারিত হবে। এই অবস্থায় প্রলেতারিয়েতরা রাষ্ট্রের অবলুপ্তির পথ প্রশস্ত করবে এমন ভাবনা কতটা সঙ্গত সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।

(৬) রাষ্ট্রের মাধ্যমে এখন শ্রমিক শোষণ হয় না: উনিশ শতকের মেহনতী মানুষের মধ্যে রাজনীতিক সচেতনতা ছিল না বললেই হয়। তারা ছিল অসংগঠিত। ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্যও শ্রমিক সংগ্রাম সংগঠিত হওয়ার সহায়ক পরিবেশ-পরিমণ্ডল ছিল না। এ রকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল শোষণমূলক। মালিক শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণীর উপরে শোষণ কায়েম করার জন্য রাষ্ট্রকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করত। কিন্তু আধুনিককালে শ্রমজীবী জনতা অনেক বেশী রাজনীতি-সচেতন এবং সংগঠিত। স্বভাবতই মালিক পক্ষ এখন রাষ্ট্র-যন্ত্রকে শ্রমিক-শোষণের কাজে তেমনভাবে ব্যবহার করতে পারে না। রাষ্ট্রের মাধ্যমে শ্রমিক শোষণের বিষয়টি বর্তমানে অতীতের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

(৭) সমালোচকদের অভিমত অনুযায়ী সাম্প্রতিককালের শ্রমজীবী জনতা সংসদীয় গণতান্ত্রিক উপায় পদ্ধতির মাধ্যমে নিজেদের দাবি আদায়ে ও স্বার্থে সংরক্ষণে সক্রিয় হয়। শ্রেণী-সংগ্রাম, বিপ্লব, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল প্রভৃতির জন্য উদ্যোগ-আয়োজন তাদের মধ্যে বড় একটা দেখা যায় না।

মূল্যায়ন: মার্কসবাদীদের বক্তব্য যাইহোক না কেন, বিরুদ্ধবাদীদের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের অন্তর্হিত হওয়ার তত্ত্ব অনৈতিহাসিক ও বাস্তবতাবর্জিত। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কোথাও লোপ পায়নি। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব লোপ পাওয়ার নয়। শ্রেণী-স্বার্থ ও শ্রেণী-পীড়নের ধারণা রাষ্ট্রের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এটাই রাষ্ট্রের একমাত্র পরিচয় নয়। বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার ইতিবাচক ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। শ্রেণীহীন সমাজেও রাষ্ট্রের কোন ভূমিকা থাকবে না, এমন কথা বলা যায় না। তবে এ কথাও বলা দরকার যে, মার্কসীয় রাজনীতিক ধ্যান-ধারণায় অনুপ্রাণিত শ্রমিক শ্রেণী সংগঠিত শক্তি ও রাজনীতিক সচেতনতা রাষ্ট্রের শোষণ পীড়নমূলক প্রকৃতিকে পরিবর্তন করতে সক্রিয় ও সদর্থক ভূমিকা পালন করেছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর বর্তমানে সাধারণ মানুষের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।