মার্কসীয় তত্ত্বের অংশবিশেষ: রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কিত ধারণা হল মার্কসীয় দর্শনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপেক্ষিক স্বাধীনতার আলোচনা রাষ্ট্র সম্পর্কিত মার্কসীয় মতবাদকে সুস্পষ্ট ও সম্পূর্ণ করে তোলে। রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতহ্যের ধারণাটি মার্কসবাদী ব্যবস্থার কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। মার্কস The Eighteenth Brumaire শীর্ষক রচনায় রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। মার্কস-এঙ্গেলস রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রের এই স্বাতন্ত্রের বিষয়টি সব সময় সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয়, তা নয়। মিলিবান্ডের মতানুসারে রাষ্ট্রে আপেক্ষিক স্বাতন্ত্রের ধারণাটি হল গৌণ এবং মুখ্য হল রাষ্ট্রের হাতিয়ারগত (instrumentalist) ধারণা।
রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্রের ধারণা
মিলিবাও তাঁর Marxism and Politics শীর্ষক গ্রন্থে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্যের ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন। রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাঠামোগত সংকট, আর্থনীতিক বিচারে প্রাধান্যকারী শ্রেণীর চাপ প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে মিলিবাও রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধীনতার বিষয়টি আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধিকার একটি বিশেষ ক্ষেত্রে স্বাধীনতার মাত্রার উপর নির্ভরশীল। এই বিশেষ ক্ষেত্রটি হল জাতীয় স্বার্থে ক্ষমতার অধিকারীদের বা প্রয়োগকারীদের স্বার্থ কী উপায়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব বা করা হয়। এবং প্রধানত শাসকশ্রেণীকেই জাতীয় স্বার্থের ক্ষমতাধিকারী বলে মনে করা হয়। মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী রাষ্ট্র হল শাসকশ্রেণীর হাতের একটি শোষণমূলক হাতিয়ার বিশেষ। রাষ্ট্র বলতে শ্রেণী-রাষ্ট্রকেই বোঝায়। তবে এ কথার অর্থ এই নয় যে, রাষ্ট্র সব সময়েই শাসক-শ্রেণীর নির্দেশ ক্রমেই পরিচালিত হয় এবং এর কোন রকম বা কিছুমাত্র স্বাতন্ত্র্য নেই। কার্যক্ষেত্রে অনেক সময়েই আইন, শাসন ও বিচার বিষয়ক কার্যাবলী সম্পাদনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র অনেকাংশে স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালন করে। মিলিবাণ্ডের মতানুসারে রাষ্ট্রের হাতিয়ারমূলক (instrumental) ধারণার সঙ্গে স্বাধিকারমূলক ধারণা সর্বাংশে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ বিষয়ে মিলিবাগু বলেছেন: “The nation of the state as an instrument does not fit this fact, and tends to obscure what has come to be seen as an crucial property of the state.”
রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কিত বিষয়টি মোটামুটি তিনটি দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আলোচিত হতে দেখা যায়। এই তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি হল :
-
হেগেলীয় মার্কসীয় ঐতিহ্য (Hegelian (Marxian Tradition),
-
হাতিয়ারগত (instrumentalist) এবং
-
কাঠামোগত (structuralist)।
হেগেলীয়-মার্কসীয় ঐতিহ্যের ধারণা অনুযায়ী জোর দেওয়া হয় মতাদর্শ ও সচেতনতার উপর। হাতিয়ারমূলক ধারণায় রাষ্ট্রকে শ্রেণীশাসনের যন্ত্র হিসাবে দেখা হয়। হাতিয়ারগত দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্র ও শাসকশ্রেণীর মধ্যে সম্পর্ক পর্যালোচনা করা হয়। সংশ্লিষ্ট সম্পর্ক যে কাঠামোর মধ্যে গড়ে উঠে, এই আলোচনায় তা অগ্রাহ্য করা হয়। কাঠামোবাদীরা আলোচনা করেন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার মধ্যে নীতি নির্ধারণের উপায়-পদ্ধতি। কাঠামোগত আলোচনায় রাষ্ট্রের হাতিয়ারমূলক প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা হয়।
রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র সম্পর্কে হাতিয়ারবাদী ও আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্যের দৃষ্টিকোণ:
সাম্প্রতিককালের মার্কসবাদী চিন্তাবিদদের অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণার মধ্যে মূলত দুটি দৃষ্টিকোণের পরিচয় পাওয়া যায়। একটি দৃষ্টিকোণ অনুসারে রাষ্ট্রকে শ্রেণী শাসনের হাতিয়ার হিসাবে দেখান হয়েছে। এটিকেই বলা হয় হাতিয়ারগত দৃষ্টিকোণ। এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী বুর্জোয়া শ্রেণী বা আর্থিক বিচারে প্রাধান্যকারী শ্রেণী নিজেদের শ্রেণী-স্বার্থ সংরক্ষণে রাষ্ট্র যন্ত্রকে ব্যবহার করে। হাতিয়ারগত ধারণা অনুযায়ী রাষ্ট্র হল শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী-শোষণের যন্ত্রমাত্র। The German Ideology, The Communist Manifesto প্রভৃতি রচনায় রাষ্ট্রের এই হাতিয়ারমূলক ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়। রাষ্ট্র সম্পর্কিত মার্কসীয় দ্বিতীয় দৃষ্টিকোণ অনুসারে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধিকারের কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে The Eighteenth Brumaire of Louis Bonaparte শীর্ষক রচনায় আলোচনা আছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী পাশাপাশি বসবাস করে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে একই শ্রেণীর মধ্যে একাধিক গোষ্ঠীর অস্তিত্বও পরিলক্ষিত হয়। এদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সব সময় থাকে না। অনেক সময়েই সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। আবার অনেক সময় এই বিবাদ-বিরোধ থেকেই ভারসাম্য অবস্থার উদ্ভব হয়। এ রকম অবস্থায় রাষ্ট্র অনেকাংশে স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার সঙ্গে ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রের এই পরিচয় রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্য হিসাবে প্রতিপন্ন হয়।
রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র সম্পর্কে হাতিয়ারবাদী ধারণা:
রাষ্ট্রের হাতিয়ারগত ধারণার আলোচনা The German Ideology. The Communist Manifesto প্রভৃতি রচনায় পাওয়া যায়। The German Ideology শীর্ষক গ্রন্থে রাষ্ট্রকে শ্রেণীশোষণের হাতিয়ার হিসাবে দেখান হয়েছে। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্যকারী বা বুর্জোয়া শ্রেণী নিজেদের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই একটি সংগঠন হিসাবে রাষ্ট্রকে গড়ে তুলেছে। স্বভাবতই এই রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য হল বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ। The German Ideology গ্রন্থে বলা হয়েছে “…it is nothing more than the form of organisation which the bourgeois are compelled to adopt both for internal and external purposes, for the mutual guarantee of their property and interests.” কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারেও রাষ্ট্র সম্পর্কে একই কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্র হল শ্রেণীশোষণের হাতিয়ার বিশেষ। সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে রাষ্ট্র হল একটি যন্ত্রমাত্র। মার্কস-এঙ্গেলস রাষ্ট্রকে শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে আধুনিক রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীকে সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণীর সাধারণ কাজকর্ম সম্পাদনের ও ব্যবস্থাপনার একট কমিটি হিসাবে অভিহিত করেছেন। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুযায়ী পুঁজিবাদী সমাজের শাসকশ্রেণী হল পুঁজিপতিরা। এই পুঁজিপতি শ্রেণী আর্থনীতিক ক্ষমতায় ক্ষমতান্বিত। তাঁরা সমাজের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্য রাষ্ট্রকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। মার্কসীয় দর্শনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ভিত্তি ও উপরি কাঠামোর তত্ত্ব। বলা হয় যে রাষ্ট্রের প্রকৃতি আর্থ-সামাজিক ভিত্তির উপর নির্ভরশীল। উপরি-কাঠামো এই ভিত্তির দ্বারা চূড়ান্তভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। রাষ্ট্র হল রাজনীতিক উপরি কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। আর্থনীতিক বিচারে প্রাধান্যকারী শ্রেণী রাজনীতিক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী শ্রেণী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এবং এই শ্রেণী রাষ্ট্রের মাধ্যমে মেহনতী মানুষের উপর শাসন-শোষণ কায়েম করে। রাষ্ট্র হল আর্থনীতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্যকারী ও সাধারণভাবে শক্তিশালী শ্রেণীর রাষ্ট্র। উৎপাদনের উপাদানসমূহের উপর শাসকশ্রেণীর মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ কায়েমও থাকে। তাই তারা রাষ্ট্রকে নিজেদের শ্রেণী-স্বার্থে প্রয়োগ বা ব্যবহার করে। অর্থাৎ রাষ্ট্র হল শাসকশ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার বিশেষ।
রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধীনতা-স্বাতন্ত্র্য:
রাষ্ট্রের হাতিয়ারমূলক ধারণার সীমাবদ্ধতা আছে। রাষ্ট্র হল আর্থিক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী শ্রেণীর হাতিয়ার ও শ্রেণী-শাসনের যন্ত্র এই ধারণা সর্বাংশে স্বীকার্য নয়। হাতিয়ারমূলক ধারণার সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতেই রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের আলোচনা করা হয়। পুঁজিপতিরাই হল প্রাধান্যকারী শ্রেণী। রাষ্ট্রের উপর পুঁজিপতিদের প্রভাবেই সর্বাধিক। এতদসত্বেও এ কথা বলা যায় না যে, এই সমাজে রাষ্ট্র পুঁজিপতি শ্রেণীর হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। পুঁজিপতিরা রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এ কথা ঠিক। কিন্তু এ কথার অর্থ এই নয় যে, রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজকর্ম ও নীতি নির্ধারিত হয় কেবলমাত্র পুঁজিপতিদের দ্বারা। পুঁজিবাদী সমাজে বুর্জোয়াদের আদেশ-নির্দেশ অনুসারেই যদি রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী কাজ করে, তা হলে রাষ্ট্রের স্বাধিকার বা স্বাতন্ত্র্য থাকতে পারে না। এ কথা ঠিক। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী বুর্জোয়া শ্রেণীর পক্ষ অবলম্বন করে রাষ্ট্রীয় কার্য সম্পাদন করতে পারে। সেক্ষেত্রে নিজস্ব বিচার বিবেচনা অনুসারে পরিচালিত হওয়ার বা স্বাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ-সম্ভাবনা শাসক গোষ্ঠীর সামনে থাকে। বস্তুত রাষ্ট্রের পক্ষে আপেক্ষিক স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্য ভোগ করার সুযোগ-সম্ভাবনা তখনই থাকে যখন দেশের জনগণের নির্দিষ্ট একটি অংশ অন্যান্য অংশের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারে না। যেখানে সমাজের প্রাধান্যকারী শ্রেণীর প্রভাব-প্রতিপত্তি সর্বাঙ্গীন ও চূড়ান্ত নয়, সেখানে রাষ্ট্র ও প্রশাসন অল্পবিস্তর স্বাধিকার স্বাতন্ত্র্য ভোগ করার সুযোগ পায়।
রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র সম্পর্কে মিলিবান্ডের মত:
মিলিবাও তাঁর Marxism and Politics শীর্ষক গ্রন্থে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্র সম্পর্কিত মার্কসীয় মতবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্যের ধারণা। এ বিষয়ে মিলিবাণ্ড বলেছেন যে, সকল ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র শাসকশ্রেণীর আদেশ অনুযায়ী চলে না বা শাসকশ্রেণীর পক্ষেই সব কাজ করে না। রাষ্ট্র হল একটি শ্রেণী-রাষ্ট্র বা শাসকশ্রেণীর রাষ্ট্র। কিন্তু অধিকমাত্রায় আপেক্ষিক স্বাধীনতা স্বাতন্ত্র্য ব্যতিরেকে শ্রেণী-শাসিত রাষ্ট্র কাজ করতে পারে না। এই কারণে এ ধরনের রাষ্ট্রের অধিক মাত্রায় আপেক্ষিক স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্য থাকে। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক রাষ্ট্রই সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণীসহ অপরাপর শ্রেণীর থেকে অল্পবিস্তর আপেক্ষিক স্বাধীনতা-স্বাতন্ত্র্য্য ভোগ করে থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রে মাত্রাগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মিলিবাণ্ডের মতানুসারে পুঁজিবাদী সমাজে রাষ্ট্র সর্বদাই বুর্জোয়া শ্রেণীর আদেশ-নির্দেশ অনুসারে করে না। আবার এ ধারণাও ঠিক যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগকারী ব্যক্তিবর্গের সামাজিক পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের শ্রেণী-চরিত্র নির্ধারিত হয়।
সাধারণভাবে বলা হয় যে, শাসকগোষ্ঠীর ব্যক্তিবর্গ সমাজের প্রাধান্যকারী শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত। পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তিগত উদ্যোগের সঙ্গে সংযুক্ত ব্যক্তিবর্গ সমাজের আর্থনীতিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এবং বুর্জোয়া রাষ্ট্র পরিচালনায় এরাই সরাসরি ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এ হল শাসকশ্রেণী ও শাসন ক্ষমতা প্রয়োগকারী গোষ্ঠীর মধ্যে শ্রেণীভিত্তিক সম্পর্ক বিষয়ক একটি মত। কিন্তু অনেকেই এ বিষয়ে এই মত স্বীকার ও সমর্থন করেন না। শাসন ক্ষমতা প্রয়োগকারী ব্যক্তিবর্গের সংখ্যা কম। এই শাসক-গোষ্ঠীর সঙ্গে সমাজের প্রাধান্যকারী শ্রেণীর সম্পর্কের সমস্যা উপরিউক্ত অভিমতের মধ্যে ধরা পড়েনি। শাসন ক্ষমতা প্রয়োগকারী গোষ্ঠী বা মুষ্টিমেয় ব্যক্তি কিছু পরিমাণে স্বাধীনতা-স্বাতন্ত্র্য ভোগ করে থাকেন। এই শাসকগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র বিচার-বিবেচনার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। পুঁজিবাদী দেশেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে পেটি বুর্জোয়া ও শ্রমিকশ্রেণীর ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। আবার নির্দিষ্ট কোন একটি শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করলে, সমাজের অন্য সকল শ্রেণীর মানুষের বিকাশ ব্যাহত হবে এমন নয়।
রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র সম্পর্কে এঙ্গেলসের মতামত:
The Origin of the Family, Private Property and State শীর্ষক গ্রন্থে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার সম্পর্কে এঙ্গেলসের মতামতের পরিচয় পাওয়া যায়। এঙ্গেলস বলেছেন যে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে শ্রেণী-বিরোধকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে। প্রকৃতিগত বিচারে রাষ্ট্র সমাজের প্রাধ্যানকারী শ্রেণীর হাতের হাতিয়ার বিশেষ। অর্থাৎ এঙ্গেলস রাষ্ট্রের হাতিয়ারমূলক ধারণার কথা বলেছেন। তবে তিনি এও বলেছেন যে, মানবসমাজের ইতিহাসে এর ব্যতিক্রমমূলক পরিস্থিতিও পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় বিবাদবান শ্রেণীগুলি নিজেদের শক্তির মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্যের সৃষ্টি করে। এই সময় রাষ্ট্র মধ্যস্থতাকারীর অবস্থান গ্রহণ করে। এই সময় রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কারণ এ রকম অবস্থায় রাষ্ট্র পরস্পরবিরোধী উভয় শ্রেণীর কাছ থেকেই অধিকতর স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ পায়। মানবসমাজে এ রকম ঘটনা ঘটে। এঙ্গেলস বলেছেন: “By way of exception, however, periods occur in which warring classes balance each other so nearly that the state power, as ostensible mediator, acquires for the moment, a certain degree of independence of both.” অর্থাৎ এঙ্গেলস রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধীনতার বিষয়টিকে ইতিহাসের বিশেষ অধ্যায়ের ব্যতিক্রম বলে উল্লেখ করেছেন। সমাজের প্রাধান্যকারী শ্রেণীর থেকে স্বাতন্ত্র্যের কারণে রাষ্ট্রের শ্রেণী-চরিত্রের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতার সৃষ্টি হয়। এঙ্গেলসের অভিমত অনুযায়ী সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে অর্থনীতিক শক্তি শোষণ-পীড়নমূলক কাজকর্ম অব্যাহত রাখতে পারে না। ক্ষেত্রবিশেষে এই শক্তিকে রাষ্ট্রশক্তির কাছে মাথা নত করতে হয়। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধীনতা-স্বাতন্ত্র্য্য সম্পর্কিত এঙ্গেলসের ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়।
রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র সম্পর্কে মার্কসের ধারণা:
The Eighteenth Brumaire of Louis Bonaparte, The Class Struggles in France প্রভৃতি রচনা সূত্রে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র সম্পর্কিত মার্কসের ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়। মার্কস-এঙ্গেলস উভয়েই বলেছেন যে বিশেষ পরিস্থিতিতে ব্যতিক্রম হিসাবে রাষ্ট্র আপেক্ষিক স্বাধিকার স্বাতন্ত্র্য ভোগ করতে পারে। চরম ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বোনাপার্টীয় ও বিসমার্কীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। ফ্রান্সে দ্বিতীয় বোনাপার্টির আমলে রাষ্ট্রের স্বাধীন সত্তা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। সমকালীন রাষ্ট্র সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ ও পরিচালনায় সক্ষম ছিল। রাষ্ট্রশক্তি সমাজের বিরুদ্ধে নিজের ক্ষমতা সম্পূর্ণ সুসংহত করতে সক্ষম হয়। তার ফলে রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাষ্ট্র আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করে। এ প্রসঙ্গে মিলিবাগু মন্তব্য করেছেন: “This would appear to suggest the complete independence of the state power from all social forces in civil society.” মার্কস The Eighteenth Brumaire শীর্ষক রচনায় এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্যের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি ঘটে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যক্তিগত শাসনাধীনে। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্রান্সে লুই বোনাপার্টির হাতে আসন ও শাসনবিভাগীয় যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বোনাপার্টির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সমগ্র প্রশাসন যন্ত্র তাঁর নির্দেশে পরিচালিত হয়। এইভাবে ফ্রান্সে বিশেষ একটি শ্রেণীর স্বৈরাচারের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় একজন ব্যক্তির স্বৈরাচার। মার্কসের মতানুসারে লুই বোনাপার্টির আমলে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; কিন্তু একথা বলা যায় না যে, সমকালীন রাষ্ট্রশক্তি সম্পূর্ণরূপে শ্রেণী-নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে ছিল। এ প্রসঙ্গে মার্কস মন্তব্য করেছেন যে, সমকালীন রাষ্ট্রশক্তি শূন্যে অবস্থিত ছিল না। বস্তুত দ্বিতীয় বোনাপার্টি ছিলেন ফ্রান্সের দীন-দরিদ্র কৃষকদের বিরাট শ্রেণীর প্রতিনিধি। কিন্তু এই কৃষকদের কোন রাজনীতিক সংগঠন ছিল। না। তাদের শ্রেণী-স্বার্থ সুসংহত বা সুসংগঠিত ছিল না। বস্তুত স্বতন্ত্র শ্রেণী হিসাবে এই দরিদ্র কৃষকরা আত্মপ্রকাশ করতে পারে নি। মার্কস এ বিষয়ে আরও বলেছেন যে, যে সমস্ত অনগ্রসর দেশে সম্যকভাবে শ্রেণী সংগঠিত হয় নি সেই সমস্ত দেশে রাষ্ট্রের পক্ষে স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয়। মার্কস আরও বলেছেন যে, সব সময় রাষ্ট্র সমগ্র একটি শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে, এমন দাবি করা যায় না। সংশ্লিষ্ট শ্রেণীর একটি অংশেরও প্রতিনিধিত্ব রাষ্ট্র করতে পারে। তেমনি আবার কোন একটি শ্রেণী সব সময়েই নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে, এমন কথাও বলা যায় না। অন্য কোন শ্রেণীর স্বার্থেও রাষ্ট্র ক্ষমতাকে কোন শ্রেণী প্রয়োগ করতে পারে। এ বিষয়ে উদাহরণ দিতে গিয়ে ইংল্যাণ্ডে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থে হুইগগণ কর্তৃক রাষ্ট্রকে ব্যবহারের কথা বলা হয়।
রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র সম্পর্কিত ভিত্তি ও উপরিসৌধের তত্ত্ব:
মার্কসীয় দর্শনে বনিয়াদ ও উপর কাঠামোর তত্ত্বটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মার্কসবাদের বক্তব্য অনুযায়ী আর্থনীতিক বনিয়াদের দ্বারা চূড়ান্তভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় উপরি-কাঠামো। রাষ্ট্র হল রাজনীতিক উপরি-কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। তবে মার্কসীয় তত্ত্বে এ কথা বলা হয় নি যে কোন অবস্থাতেই উপরি-কাঠামো আপেক্ষিক স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্য্য ভোগ করে না। আবার এ কথাও বলা হয়নি যে, বনিয়াদকে উপরিকাঠামো প্রভাবিত করে না। বস্তুত রাষ্ট্রসমেত উপরিকাঠামোর অন্যান্য উপাদানের স্বাধিকার ও স্বাতহ্যের বিষয়টি মার্কসীয় দর্শনে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর্থনীতিক বনিয়াদ সব সময় রাষ্ট্র বা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে না। এ ক্ষেত্রে শ্রেণীসংগ্রামের মাধ্যমে শোষিত সমাজে উপরি-কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন আংশিক হতে পারে, আবার সামগ্রিকও হতে পারে। আর্থনীতিক বনিয়াদের উপর উপরি-কাঠামো নির্ভরশীল। এ কথা ঠিক। কিন্তু উপরি-কাঠামো একটি সক্রিয় শক্তিও বটে। আবার উপরি-কাঠামোর বিকাশের নিজস্ব ধারার অস্তিত্বও অস্বীকার করা যায় না। বলা হয় যে, বনিয়াদ থেকে উপরি-কাঠামো আপেক্ষিকভাবে স্বাধীন। মার্কস আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য এবং আভ্যন্তরীণ নির্ভরশীলতা ও বাহ্যিক স্বাধীনতার কথা বলেছেন। উপরি কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত কোন কোন উপাদান নির্দিষ্ট সামাজিক বনিয়াদের মধ্যে সৃষ্ট হয়েছে, অথচ পরবর্তীকালের সামাজিক বনিয়াদের মধ্যেও তার অস্তিত্বকে স্থায়ীভাবে বজায় রেখেছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ধর্মীয় উপরি-কাঠামোর কথা বলা যায়। তেমনি আবার বনিয়াদ থেকে সৃষ্ট এমন সব উপাদান উপরি-কাঠামোর মধ্যে থাকে যা বনিয়াদের সঙ্গে বিরোধিতার সম্পর্কযুক্ত। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানসমূহের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত। এই আর্থনীতিক বনিয়াদের থেকেই সৃষ্টি হয় পরস্পর বিরোধী রাজনীতিক ও মতাদর্শগত উপরি-কাঠামোর। পুঁজিবাদী সমাজের আর্থনীতিক বনিয়াদের উপর গড়ে উঠে বুর্জোয়া রাষ্ট্র, বুর্জোয়া মতাদর্শ ও অন্যান্য বুর্জোয়া উপরি-কাঠামো এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রলেতারীয় মতাদর্শ, প্রলেতারীয় রাজনীতিক সংগঠন প্রভৃতিও গড়ে উঠে।
রাষ্ট্রের মধ্যস্থতামূলক ভূমিকা:
রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার স্বাতন্ত্র্যের ধারণাকে মিলিবাগু আর এক দিক থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। মিলিবাণ্ডের মতানুসারে বুর্জোয়া শ্রেণী পরস্পর-বিরোধী বিবিধ উপাদান নিয়ে গঠিত। বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে বিভিন্ন অংশ থাকে। এই সমস্ত অংশের স্বার্থ ও বিষয় সব সময় অভিন্ন প্রকৃতির নয়। বুর্জোয়া শ্রেণীর এই সমস্ত অংশের সঙ্গে সাধারণ বিষয় যেমন থাকে, তেমনি আবার প্রত্যেক অংশের স্বতন্ত্র্য বিষয় বা নির্দিষ্ট বিষয় থাকে। এ রকম ক্ষেত্রে মধ্যস্থতামূলক ভূমিকা এবং সামঞ্জস্য সাধনের দায়িত্ব পালন করে রাষ্ট্র। বুর্জোয়া শ্রেণীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে এই ভূমিকা পালন রাষ্ট্রকে সক্ষম করে তোলার জন্য শাসকশ্রেণীর বা প্রাধান্যকারী শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ থেকে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকারের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য।
রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র সম্পর্কে পউলানটাসের অভিমত:
কাঠামোবাদী (Structuralist) দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে পউলানটাস (Poulantzas)-এর Political Power and Social Classes শীর্ষক রচনায় আলোচনা আছে। কাঠামোগত দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বুর্জোয়া শ্রেণীর নির্দিষ্ট সদস্য ও স্বার্থের নিয়ন্ত্রণ থেকে রাষ্ট্রের স্বাধীন অবস্থানই হল রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধিকার। পউলানটাস বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী বুর্জোয়াদের মধ্যেই বিভিন্ন রকমের আর্থ-রাজনীতিক স্বার্থের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ বুর্জোয়ারা অভিন্ন প্রকৃতির বা সমজাতীয় শ্রেণী হিসাবে পরিগণিত হতে পারে না। বুর্জোয়াশ্রেণীর মধ্যে বিভিন্ন অংশ থাকে। এর যে কোন একটির নেতৃত্বাধীনে ক্ষমতা-জোটের সৃষ্টি হতে পারে। এবং এই ক্ষমতা জোটের মধ্যেই একাধিক শ্রেণী-চক্র থাকতে পারে এবং বাস্তবে থাকে। এই শক্তি জোটের মূল উদ্দেশ্য হল বুর্জোয়াশ্রেণীর দীর্ঘকালীন স্বার্থ সংরক্ষণ। তবে শ্রমিকশ্রেণীর মানুষকে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়। এ বিষয়ে উল্লিখিত শক্তি জোটের সামর্থ্য যথেষ্ট নয়, সীমাবদ্ধ। এ রকম পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট স্বার্থ সংরক্ষণে একমাত্র রাষ্ট্রই সক্ষম। আপেক্ষিক স্বাধীনতা-স্বাতন্ত্র্যের মাধ্যমে রাষ্ট্র এই উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে।
রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র সম্পর্কে বুরলাস্কির অভিমত:
রাষ্ট্রের স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি নিম্নে আধুনিককালের মার্কসবাদীরাও আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে ফাইওডোর বুরলাস্কি (Fyodor Burtalsky) তাঁর The Modern State and Politics শীর্ষক গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচনা তাঁর অভিমত অনুযায়ী সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য্য উল্লেখযোগ্যভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্য বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিককালে আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ক্ষেত্রে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব ও কার্যাবলী ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিষয়ে রাষ্ট্রকে প্রায়শই হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায়। আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলী বৃদ্ধি পেয়েছে। বুরলাস্কির মতানুসারে বুর্জোয়া রাষ্ট্রসমূহের শ্রেণী-চরিত্র বিশেষ ধরনের। এই শ্রেণীচরিত্রের মধ্যেই নিহিত আছে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি প্রসারিত হওয়ার মূল কারণ। রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিকাশ; উৎপাদনের সামর্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি; সামাজিক ক্ষেত্রে জটিলতা বৃদ্ধি প্রভৃতিও রাষ্ট্রের কাজকর্মের এলাকাকে সম্প্রসারিত করেছে। এই সমস্ত কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের স্বার্থে রাষ্ট্রের স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্য সম্প্রসারিত হয়েছে। রাষ্ট্র বা সরকার সব সময় সমাজের প্রাধান্যকারী শ্রেণীর নির্দেশক্রমে পরিচালিত হতে পারে না। কারণ কার্যক্ষেত্রে এটা সম্ভব নয়। সাম্প্রতিককালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে বহু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এই সমস্ত ক্ষেত্রে সমাজের প্রাধান্যকারী শ্রেণীর প্রভাব থাকে। এতদসত্ত্বেও রাষ্ট্রকে অনেকাংশে স্বাধীনভাবে সক্রিয় হতে হয়। তা ছাড়া আধুনিককালের সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বিশেষভাবে জটিল প্রকৃতির। বিশেষজ্ঞ ব্যতিরেকে যে কোন ব্যক্তির পক্ষে এই প্রক্রিয়ার সামিল হওয়া সম্ভব নয়। স্বভাবতই বিদ্যমান সমাজ বহুলাংশে স্থিতিশীল প্রতিপন্ন হয়। তবে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্য এতে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাম্প্রতিককালের অবস্থা: বুরলাস্কির অভিমত অনুযায়ী বর্তমানে বুর্জোয়া রাষ্ট্র শাসকশ্রেণীর কাছ থেকেও স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধিকারের সুযোগ পেয়ে থাকে। সাম্প্রতিককালে সমাজবিরোধী বিবিধ কাজকর্মে জনসাধারণের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বভাবতই সমাজ পরিচালনা সম্পর্কিত কাজকর্ম অনেক ক্ষেত্রেই অতিমাত্রায় জটিল হয়ে পড়েছে। এ রকম পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শাসকশ্রেণীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা গ্রহণ করতে হয়। এভাবেও রাষ্ট্রের স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্য সম্প্রসারিত হয়। সাম্প্রতিককালে জনপ্রশাসন ও সরকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জটিলতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারী কাজকর্ম থেকে বুর্জোয়া শ্রেণী বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বুরলাস্কি সংখ্যাতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিপন্ন করেছেন যে, বর্তমানে মার্কিন প্রশাসন ও প্রতিরক্ষায় সরকারী কর্মচারীর সংযোগ বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তার ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশেও একই প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এই প্রবণতার পরিণামে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু পশ্চিমী বর্ধিষ্ণু পুঁজিবাদী দেশগুলিতেই নয়। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলিতেও অভিন্ন প্রবণতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই সমস্ত বিকাশশীল দেশগুলির সমাজব্যবস্থায় কোন বিশেষ একটি শ্রেণীকে প্রাধান্যকারী শ্রেণী হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না। এ রকম পরিস্থিতিতে একাধিক শ্রেণীকে ক্ষমতা দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সামিল হতে দেখা যায়। তার ফলে শ্রেণীসমূহের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি হতে দেখা যায়। এ রকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রযন্ত্র অধিকতর আপেক্ষিক স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্য ভোগ করার সুযোগ পায়।
রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র সম্পর্কিত মূল্যায়ন:
মার্কসীয় তত্ত্বের রাষ্ট্রের হাতিয়ারগত ধারণা এবং রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকারের ধারণা একবারে বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। সমালোচকরা এ বিষয়ে বিবিধ সীমাবদ্ধতার কথা বলেন। এ বিষয়ে মার্কস-এঙ্গেলসের বক্তব্যগত অবস্থান সর্বাংশে সন্তোষজনক প্রতিপন্ন হয় নি। যাইহোক এ প্রসঙ্গে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক।
(১) রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার-স্বাতন্ত্রের তত্ত্ব স্বীকার করে নিলে রাষ্ট্রের হাতিয়ারমূলক ধারণা দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধীনতা-স্বাধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের শ্রেণী-চরিত্রের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতার সৃষ্টি হয়। এই কারণে মিলিবাও এক সময় বলেছেন যে, রাষ্ট্রের হাতিয়ারমূলক তত্ত্ব এবং আপেক্ষিক স্বাধিকারের তত্ত্ব সম্পর্কিত মার্কস-এঙ্গেলসের আলোচনা অল্পবিস্তর অস্বচ্ছতার সৃষ্টি করেছে। কারণ রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকারের স্বীকৃতি রাষ্ট্রের শ্রেণী-চরিত্রের ধারণাকে ভোঁতা করে দেয়।
(২) মার্কস-এঙ্গেলসের অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্র আপেক্ষিক স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্য ভোগ করার সুযোগ পায় বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকারের বিষয়টি বুর্জোয়া রাষ্ট্রের কোন স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হিসাবে পরিগণিত হতে পারে না। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে বুর্জোয়াদের সামগ্রিক প্রাধান্যের ব্যবস্থা এক সময় অবক্ষয়ের সম্মুখীন হয়। সে রকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্রের চরম অভিব্যক্তি ঘটে। রাষ্ট্র তখন প্রাধান্যকারী বুর্জোয়াদের হাতে শ্রেণী-শাসনের হাতিয়ার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। অর্থাৎ তখন বুর্জোয়া রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্রের ধারণা অর্থহীন হয়ে পড়ে। সুতরাং চূড়ান্ত বিচারে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্যের ধারণা বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অলীক প্রতিপন্ন হয়।
(৩) মিলিবাও চূড়ান্তভাবে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, রাষ্ট্রের হাতিয়ারমূলক ধারণা এবং রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্যের ধারণার মধ্যে তেমন কোন স্ব-বিরোধিতা নেই। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, সরকার প্রশাসক গোষ্ঠী গঠিত হয় প্রাধান্যকারী শ্রেণীর প্রতিনিধিদের নিয়ে। শাসক গোষ্ঠীকে প্রাধান্যকারী শ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থারও স্বার্থ সংরক্ষণের সচেষ্ট হতে হয়। এই কারণে শাসক গোষ্ঠীর আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্য থাকা আবশ্যক।
Leave a comment