ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ দরকার: আগেকার দিনের রাষ্ট্র ছিল পুলিশী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বের পরিধি ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। তাই তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। কিন্তু বর্তমানে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব ও ক্ষমতা এখন সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সম্প্রসারিত। তা ছাড়া অধিকাংশ আধুনিক রাষ্ট্রের আয়তনও বিশাল। আয়তনের ব্যাপ্তি এবং দায়িত্ব ও কার্যাবলীর ব্যাপকতার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এখন অপরিহার্য বিবেচিত হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সুষ্ঠু প্রয়োগকে সম্ভব করে তোলার জন্য এই বিকেন্দ্রীকরণই হল একমাত্র উপায়। বিকেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ সুনিশ্চিত হবে। ল্যাস্কি বৃহৎ সমাজের যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতির কথা বলেছেন। এই যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতি সংরক্ষণের স্বার্থে বিকেন্দ্রীকরণ আবশ্যক।

বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলতে গিয়ে ল্যাস্কি কতকগুলি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। 

  • (ক) ল্যাস্কির মতানুসারে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যদি অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত অবস্থায় থাকে তা হলে জনগণের দায়িত্বপূর্ণ সহযোগিতা পাওয়া যায় না এবং আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে আগ্রহের অভাব দেখা দেয়। অপরদিকে আইন প্রণয়নের পদ্ধতিতে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ যদি বৃদ্ধি পায়, তা হলে আইনের ব্যাপারে জনগণের আগ্রহ ও দায়িত্ব বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। 

  • (খ) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যখন কেন্দ্রীভূত অবস্থায় থাকে, সরকারকে তখন বহু ও বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অথচ এখনকার প্রতিনিধিমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভা এবং মন্ত্রিসভার কার্যকালের মেয়াদ আইনানুসারে সীমাবদ্ধ। এই অবস্থায় সময়ের স্বল্পতা সরকারের কার্যপরিচালনার ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে তোলে। অনেক ক্ষেত্রেই সরকার অসহায় বোধ করে। কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। 

  • (গ) ক্ষমতা যদি কেন্দ্রীভূতভাবে থাকে, তা হলে রাষ্ট্রের কাজকর্ম অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে। আর একদিক থেকেও অসুবিধা দেখা দেয়। রাষ্ট্রের মধ্যে অঞ্চল ও কালভেদে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত অবস্থায় সরকারী কাজকর্মে বৈচিত্র্যসাধন সম্ভব হয় না।

আইন প্রণয়ন ক্ষমতার বিভাজন: আইন প্রণয়নের ক্ষমতাকে কিভাবে বিকেন্দ্রীভূত করা যায় সে বিষয়েও অধ্যাপক ল্যাস্কি আলোচনা করেছেন। তিনি স্থানীয় নির্বাচিত সংস্থার হাতে আঞ্চলিক বিষয়গুলিকে ন্যস্ত করার পক্ষপাতী। এই সমস্ত আঞ্চলিক সংস্থা স্থানীয় বিষয়াদি সুবিধামত পরিচালনা করতে পারবে। তবে সকল অঞ্চলের সাধারণ স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে ল্যাস্কি যৌথ দায়িত্ব পালনের কথা বলেছেন। এই সকল বিষয়ে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে স্থানীয় সংস্থাসমূহের সম্পর্ক ও সহযোগিতার কথা বলেছেন। তবে সামগ্রিকভাবে কেন্দ্রীয় তদারকির কথা তিনি স্বীকার করেছেন। তা ছাড়া তিনি বলেছেন যে প্রতিটি শিল্পের ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে অধীনস্থ আইনসভা থাকবে। কতকগুলি ন্যূনতম শর্তের কাঠামোর মধ্যে থেকে অধীনস্থ সংস্থাগুলি আইন প্রণয়ন করবে। এই সব শর্তাবলীর কাঠামো নির্ধারণ করবে কেন্দ্রীয় আইনসভা। তবে এই সকল ক্ষেত্রে প্রণীত আইন পর্যালোচনা করার ও সে বিষয়ে প্রয়োজনমত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় আইনসভার হাতে। তবে ল্যাস্কি কেন্দ্রীয় আইনসভার এই নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতাকে মেনে নিলেও এই ক্ষমতার অবাধ প্রয়োগকে অস্বীকার করেছেন।

অঞ্চলগত ও কার্যগত বিকেন্দ্রীকরণ: ল্যাস্কি ক্ষমতার দ্বিবিধ বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছেন। এই দ্বিবিধ বিকেন্দ্রীকরণ হল: 

  • (১) অঞ্চলগত বিকেন্দ্রীকরণ (Territorial Decentralisation) এবং 

  • (২) কার্যগত বিকেন্দ্রীকরণ (Functional Decentralisation)। 

আঞ্চলিক বা ভৌগোলিক প্রয়োজন পূরণের জন্য পৃথকভাবে বিচার-বিবেচনা করা এবং তদনুসারে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ব্যবস্থা থাকা দরকার। আঞ্চলিক স্বার্থ ছাড়াও সমাজে অন্যান্য স্বার্থও থাকে। এই সমস্ত স্বার্থ সংরক্ষণের কথাও বিচার-বিবেচনা করা দরকার। তা ছাড়া আইনকে যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্য তাকে প্রাধান্যকারী সংগঠনসমূহের সঙ্গে সংযুক্ত করা দরকার। এই কারণে ল্যাস্কি কার্যগত বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছেন। বিশেষ বিশেষ কাজকর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সংগঠনসমূহের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। সমাজে বিভিন্ন বৃত্তির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংঘ-সমিতি থাকে। এদের নিজেদের স্বার্থ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা এদের হাতেই ন্যস্ত করা আবশ্যক। এই সকল সংস্থার যথার্থ পরিচালন ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। এ হল পেশাগত বা বৃত্তিগত বিকেন্দ্রীকরণ।