বলের অভিমত: বল (Ball) ঐতিহ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বলতে সেইসব দৃষ্টিকোণকে বুঝিয়েছেন যেগুলি ১৯০০ খ্রীস্টাব্দের আগে রাজনীতিক আলোচনার জগতে প্রভাবশালী ছিল। ঐগুলি হল দর্শন, ইতিহাস এবং আইনকেন্দ্রিক আলোচনা। কিন্তু তিনি ঐতিহ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বলতে রাজনীতিক আলোচনার জগতে অপ্রচলিত বা বাতিল হয়ে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গিসমূহকে বোঝাতে চাননি। তিনি বলেছেন: “To use the label ‘traditional’ is neither a critism nor a refutation of the obvious fact that they still play important roles in modern studies, although no longer monopolising the avenues of approach.” বর্তমান যুগের রাজনীতির ছাত্র প্লেটো অথবা হেগেলের মত দার্শনিকদের রচনার দ্বারাও প্রভাবিত হন। কিন্তু এসব দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতিক আলোচনার ক্ষেত্রে আর গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় না। সুতরাং দর্শন, ইতিহাস ও আইনের প্রাধান্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি হল ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি। ঐতিহ্যগত বলার তাৎপর্য হল পরম্পরাগত আলোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এখনও অর্থবহ। তবে এই সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গির একচেটিয়া প্রভাব এখন আর নেই। বলের অভিমত অনুসারে রাজনীতির সনাতন বা ঐতিহ্যগত বিশ্লেষণ ধারা ঊনবিংশ শতাব্দী অবধি প্রাধান্যকারী দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল।
ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃতি:
ঐতিহ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হল আদর্শমুখী। এই দৃষ্টিভঙ্গি-প্রসূত আলোচনায় ভাল-মন্দের বিচার বিশেষ স্থান লাভ করে। বিষয়বস্তুর নৈতিক দিকের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখার ফলে এই ধরনের আলোচনা বহুলাংশে দর্শনকেন্দ্রিক। আবার ঐতিহ্যবাদী আলোচনায় রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের ও ঘটনাবলীর ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের প্রবণতা দেখা যায়। তা ছাড়া, এইসব আলোচনা সংবিধান ও আইনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। ন্যায়, স্বাধীনতা, সাম্য, আনুগত্য প্রভৃতি চিরায়ত রাজনীতিক ধারণাসমূহ ঐতিহ্যবাদী বিশ্লেষণ ধারায় প্রাধান্য লাভ করে। উচিত-অনুচিত ও ভালমন্দের মানদণ্ডে এ ক্ষেত্রে রাজনীতিক বিষয়াদির বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। রাজনীতির পরম্পরাগত বিশ্লেষণ ধারায় প্রচলিত রাজনীতিক ধ্যান-ধারণা, বিষয়াদি ও পদ্ধতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির আলোচনা করা হয়। রাজনীতির আলোচনার ক্ষেত্রে গতানুগতিক ধ্যান-ধারণা ও আনুষ্ঠানিক কাঠামোকে অনুসরণ করা হয় বলে এই বিশ্লেষণধারা বা দৃষ্টিভঙ্গি সচেতন, সাবেকি বা ঐতিহ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে পরিচিত। এই সব কারণে ঐতিহ্যবাদী আলোচনায় মূল দৃষ্টিভঙ্গি হল দার্শনিক, ঐতিহাসিক এবং আইনগত।
ঐতিহ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর বৈশিষ্ট্য:
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির ঐতিহ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে নিম্নলিখিতভাবে বিন্যস্ত করা যায়। (১) ঐতিহ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির তাত্ত্বিক অনুপ্রেরণার উৎস হল দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও আইনগত আলোচনা। (২) ঐতিহ্যবাদী বিশ্লেষণ ধারায় রাজনীতিক বিষয়াদির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয় নৈতিক মান, আদর্শ ও মূল্যবোধকে অনুসরণ করে। (৩) পরম্পরাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনীতিক বিষয়াদি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সরকারী প্রতিষ্ঠান ও আনুষ্ঠানিক কাঠামোর আশ্রয় গ্রহণ করা হয়। (৪) এ ধরনের রাজনীতিক আলোচনায় রাজনীতিক সমস্যা ও সংস্কার প্রসঙ্গে বাঞ্ছিত উপায় নির্দেশের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। (৫) ঐতিহ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে গতানুগতিক রাজনীতিক মতবাদ ও ধ্যান-ধারণার প্রতি আনুগত্য দেখা যায়। রাজনীতির চিরায়িত বিশ্লেষণ ধারা রক্ষণশীল।
Leave a comment