হেরোডোটাস ও অ্যারিস্টটল: রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার ক্ষেত্রে অন্যতম দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রাচীনকালেই তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিশ্লেষণের ধারার সূত্রপাত ঘটে। ম্যাকেঞ্জীর মতানুসারে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তক হলেন হেরোডোটাস (Herodotous)। এশীয় সাম্রাজ্যের সঙ্গে হেরোডোটাস গ্রীসের নগর-রাষ্ট্রসমূহের (City-states) তুলনা করেছেন। এই তুলনামূলক আলোচনার ভিত্তিতে তিনি কতকগুলি সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এই সমস্ত সিদ্ধান্তের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা আজও অস্বীকার করা যায় না। হেরোডোটাস বিভিন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে তুলনার জন্য আইন, স্বাধীনতা ও সরকারকে ভিত্তি হিসাবে ব্যবহার করেছেন। এ প্রসঙ্গে গ্রীক পণ্ডিত অ্যারিস্টটলের নামও উল্লেখযোগ্য। তিনিও প্রাচীনকালের গ্রীস দেশের নগর-রাষ্ট্রগুলির সংবিধানসমূহের মধ্যে তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। অ্যারিস্টটলের এই আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা।
সাম্প্রতিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞান: হেরোডোটাস এবং অ্যারিস্টটল ছাড়াও অপেক্ষাকৃত আধুনিককালের অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করেছেন। এঁদের মধ্যে ফরাসী দার্শনিক বঁদা (Bodin) ও মতেঁস্কু (Charles Louis de Montesquieu)-র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বস্তুত বর্তমানে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিশ্লেষণ করার পক্ষপাতী। এই কারণে অনেকে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সংযোগসাধনের ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করেছে। বল-এর অভিমত অনুসারে তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি সাবেকী দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মাঝামাঝি অবস্থিত। অধ্যাপক বল বলেছেন: Comparative government and politics was to provide the link between the traditional approaches to Political Science and the more recent development in the discipline.” রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি হল একটি উৎকৃষ্ট উপায়। তথ্যাদি সংগ্রহ এবং সংগৃহীত তথ্যাদির মধ্যে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। ম্যাকেঞ্জী (Mackenzie) পরীক্ষামূলক পদ্ধতির পরিবর্তে তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করেছেন। ম্যাকিয়াভেলী, ব্রাইস, এবং মিল (J.S. Mill)-ও এই দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বকে স্বীকার করেছেন। তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ, অনুসন্ধান, বর্জন প্রভৃতির মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৌলিক সূত্রগুলির উপযোগিতা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায় এবং সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়।
তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির এই মধ্যবর্তী অবস্থানের জন্য এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে দুটি ধারা পরিলক্ষিত হয়। এই দুটি ধারার একটি হল ঐতিহ্যগত (Traditional) এবং অন্যটি হল আধুনিক (Modern)।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ঐতিহ্যগত তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি
ঐতিহ্যগত তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি (Traditional Comparative Approach) বলতে সাধারণত বৈদেশিক সরকারের পর্যালোচনাকে বোঝায়। ব্লনডেল (Jean Blondel) সম্পাদিত Comparative Government গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ম্যারিডেস (R. C. Macrides)-এর A Survey of the field of Comparative Politics শীর্ষক রচনায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। তাঁর মতানুসারে ঐতিহ্যগত তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিদেশী সরকারের পর্যালোচনা বলতে বাস্তবে ব্রিটেন ও ডোমিনিয়ন এবং পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির রাজনীতিক ব্যবস্থার পর্যালোচনাকে বোঝানো হয়। রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সার্বভৌমত্বের অবস্থান, রাজনীতিক দল, নির্বাচন ব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয় এ ধরনের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। তা ছাড়া রাজনীতিক ক্ষমতার সংগঠন ও প্রয়োগ, সংবিধানের ভিত্তি প্রভৃতি বিষয় এই আলোচনায় স্থান পায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে একটি দেশের সমস্ত রাজনীতিক সংগঠন নিয়ে বা কয়েকটি দেশের একই ধরনের রাজনীতিক সংগঠন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি কেবলমাত্র বিভিন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিতরে তুলনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। একই দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন এককসমূহের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা সম্ভব। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশটি অঙ্গ-রাজ্যের সরকারের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি পর্যালোচনা করা যেতে পারে। অধ্যাপক বলের মতানুসারে দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা।
সমালোচনা (Criticism): ঐতিহ্যগত তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক। ম্যারিডেস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এই দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। যাইহোক এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত যুক্তিসমূহের অবতারণা করা হয়।
(১) ঐতিহ্যগত তুলনামূলক আলোচনায় নির্দিষ্ট রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের তুলনামূলক আলোচনা কদাচিৎ পরিলক্ষিত হয়। ম্যােিডস-এর মতানুসারে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তাদের রচনায় রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বর্ণনা আছে; কিন্তু তুলনামূলক আলোচনা অনুপস্থিত।
(২) ঐতিহ্যগত তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণনামূলক পদ্ধতি ছাড়া বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্যমূলক পর্যালোচনার জন্য সুবিন্যস্ত কোন পন্থা-পদ্ধতি পরিলক্ষিত হয় না।
(৩) এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সংকীর্ণতার অভিযোগ উপস্থাপিত হয়। এই পদ্ধতির প্রয়োগ কেবলমাত্র পশ্চিম ইউরোপের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এশিয়া ও আফ্রিকার দেশসমূহের রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয় না। ম্যারিডেসের মতানুসারে সংকীর্ণতাবাদ হল এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান ত্রুটি।
(৪) বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থার এককসমূহ অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির। অনেক ক্ষেত্রে এগুলি বিশেষভাবে পরিবর্তনশীল। এই অবস্থায় তুলনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে কোন গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কঠিন ব্যাপার।
(৫) অনেকে ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম অংশ হিসাবে একে গ্রহণ করার পক্ষপাতী নন। কারণ বিশেষ কোন ধরনের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান বা কার্যাবলীর গড়ে ওঠার বা সংগঠিত হওয়ার হেতু সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছু জানা যায় না।
(৬) এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। কারণ কতকগুলি উদাহরণের সাহায্যে কোন সিদ্ধান্ত বা সাধারণ সূত্রকে অভ্রান্ত প্রতিপন্ন করা যায় না।
(৭) রাজনীতিক ব্যবস্থার বিকাশ ও পরিবর্তন কতকগুলি গতিশীল উপাদানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ঐতিহ্যগত তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই উপাদানগুলিকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
(৮) এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা কোন রাজনীতিক ব্যবস্থার অন্তর্গত যাবতীয় রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান বা কোন একটি ব্যবস্থার বিশেষ একটি প্রতিষ্ঠানের উপর সীমাবদ্ধ রাখা হয়।
(৯) ম্যারিডেসের অভিমত অনুসারে ঐতিহ্যগত তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে আনুষ্ঠানিকতার উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়। রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের আনুষ্ঠানিক আচার-আচরণ ও নিয়মকানুনই মুখ্য আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই কারণে তা সার্থক ও সফল হতে পারেনি।
(১০) তা ছাড়া ম্যারিডেসের আরও অভিমত হল যে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থার কেবল বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
(১১) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আদিগুরু অ্যারিস্টটল থেকে আরম্ভ করে লর্ড ব্রাইস পর্যন্ত ঐতিহ্যগত তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে কোন সুসংবদ্ধ (Systematic) কৌশল অবলম্বন করা হয় নি। এই অসংবদ্ধতার কারণে আলোচ্য দৃষ্টিভঙ্গির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দ্বন্দ্ব দূর করা যায় নি।
মূল্যায়ন: বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করা যায় না। এতদ্সত্ত্বেও এই দৃষ্টিভঙ্গিকে একেবারে বর্জন করার প্রস্তাবও অবাত্তর। যে কোন রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বরূপ সম্যকভাবে অবহিত হওয়ার ক্ষেত্রে আলোচ্য দৃষ্টিভঙ্গির অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এই দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব সম্পর্কে বল-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর Modern Politics and Government গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “It may be the most rewarding means of discovering information about the politics of one particular state.”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আধুনিক তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি
উদ্ভব: আধুনিক তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে। এই সময়ে তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলনামূলক পদ্ধতিকে প্রয়োগ করার ব্যাপারে কোন কোন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রয়াসী হন। এঁদের মধ্যে অ্যালমণ্ড (G. A. Almond), পাওয়েল (G. B. A Powell), আপ্টার (D. E. Apter), ম্যাকরিডেস (R. C. Macrides), কোলম্যান (J. S. Coleman) প্রমুখ চিন্তাবিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অধিকাংশই হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী। বস্তুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই পঞ্চাশের দশক থেকে তুলনামূলক রাজনীতির এক নতুন ধারার সূত্রপাত ঘটে। এদের আলোচনায় বৈদেশিক রাজনীতিক ব্যবস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে এই আলোচনায় অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব গঠনের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতি: সাবেকী তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অসম্পূর্ণ ও অপর্যাপ্ত। আগেকার সেই সংকীর্ণ তুলনামূলক পদ্ধতিতে পরিবর্তিত নতুন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রব্যবস্থার যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণ দুরূহ হয়ে পড়ে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি বলতে কতকগুলি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকায় ক্ষুদ্রাকৃতির অনেকগুলি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। সদ্যজাত এই রাষ্ট্রগুলির আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক অবস্থা ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলির থেকে স্বতন্ত্র প্রকৃতির ছিল। চলে আসা ঔপনিবেশিকতাবাদের অবসানের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুটিকয়েক শক্তিধর রাষ্ট্রের আধিপত্যের অবসান ঘটে। বিশ্বরাজনীতিতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিকেন্দ্রীভবন ঘটে। কারণ সদ্যোজাত এই রাষ্ট্রগুলি আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে নীতি নির্ধারণ ও তা প্রয়োগ করতে শুরু করে। তা ছাড়া পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের শক্তি সঞ্চয়ও বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্রে ভারসাম্যের পরিবর্তন সূচীত করে। অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল তাঁদের Comparative Politics : A Developmental Approach গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, নৃতত্ত্ববিজ্ঞানী ও সমাজতত্ত্ববিদ্গণ ঐতিহ্যগত তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করেন। তাঁরা রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করতে শুরু করে।
ঐতিহ্যগত তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আধুনিক তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বর্তমান। এ প্রসঙ্গে আধুনিক তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি আলোচনা করা দরকার।
(১) সাবেকী তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট ছিল। কেবল পশ্চিম ইউরোপের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের পর্যালোচনার মধ্যে এই আলোচনা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু নতুন তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকতর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের আলোচনাকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারী কাঠামো ও রাজনীতিক প্রক্রিয়া পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। অ্যালমণ্ড ও তাঁর অনুগামীরা রাজনীতির তুলনামূলক আলোচনাকে পাশ্চাত্তের গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁরা অনগ্রসর ও উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থাকেও এই আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
(২) সাবেকী আলোচনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তুলনামূলক সরকারের আলোচনার উপর জোর দিতেন। কিন্তু এই আলোচনা ছিল অসম্পূর্ণ ও অপর্যাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তিশীল। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বর্তমানে তুলনামূলক রাজনীতির (Comperative Politics) আলোচনার উপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন।
(৩) তুলনামূলক আলোচনায় সাবেকী দৃষ্টিভঙ্গিটি আনুষ্ঠানিকতার (Formalism) বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল। এই আলোচনা আইনানুমোদিত প্রতিষ্ঠানের আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে রাজনীতিক ব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনায় রাজনীতিক ক্ষমতা ও কার্যাবলী ও রাজনীতিক প্রক্রিয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কতকগুলি কার্য-কাঠামোগত শ্রেণীর (Category) ভিত্তিতে বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করা হয়। আইনানুমোদিত প্রতিষ্ঠানসমূহের বাইরে রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সংস্থা, আচার-আচরণ, কার্যকলাপ প্রভৃতির উপর জোর দেওয়া হয়।
(৪) বাস্তবতার অনুসন্ধানের উপর আধুনিক তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে জোর দেওয়া হয়। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বর্তমানে রাজনীতিক প্রক্রিয়ার প্রকৃতি ও নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে ব্যাপক গবেষণার উপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। বাস্তব রাজনীতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার উপর জোর দেওয়া হয়। রাজনীতিক দল, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রভৃতি বিষয়কে এই আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
(৫) সাম্প্রতিককালে তুলনামূলক রাজনীতির আলোচনায় এক ধরনের বৌদ্ধিক বিন্যাসের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। বৈজ্ঞানিক উপায়ে রাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষণকে সুসংহত ও অর্থবহ করে তোলার চেষ্টা করা হয়। রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রে পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলার উদ্দেশ্যে নতুন নতুন কলা-কৌশল অবলম্বন করা হয়। অ্যালমণ্ড কৌশল (Technique) ও তত্ত্ব গঠন (Theory Building)-এর উপর জোর দিয়েছেন। পশ্চিমী রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অন্যান্য রাজনীতিক ব্যবস্থার পর্যালোচনার প্রয়াসী হয়েছেন। সরকার বা সরকারের কোন অংশ নয়, সমগ্র রাজনীতিক ব্যবস্থাকেই তিনি তুলনামূলক আলোচনার ক্ষেত্রে একক হিসাবে বিবেচনা করেছেন। আধুনিক এই আলোচনায় তথ্যাদি সংগ্রহ, সংগৃহীত তথ্যাদির প্রক্রিয়াবদ্ধকরণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে গণকযন্ত্রের ব্যবহার এবং অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের উন্নত কলা-কৌশল প্রয়োগ করা হয়। তার ফলে আধুনিক তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহারিক কার্যকারিতা ও উপযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির কতকগুলি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা দরকার।
- (ক) তুলনামূলক রাজনীতির আধুনিক আলোচনা সরকারের কাঠামোগত সাবেকী আনুষ্ঠানিক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রাজনীতিক দল, স্বার্থগোষ্ঠী, রাজনীতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক প্রভৃতি এই আলোচনার অন্তর্ভুক্ত হয়।
- (খ) এই আলোচনা বর্তমানে অভিজ্ঞতাবাদী ও বিশ্লেষণাত্মক প্রকৃতির।
- (গ) তুলনামূলক রাজনীতির পর্যালোচনাকে মূল্যমান নিরপেক্ষ (Value free) করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
- (ঘ) এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক সংস্কৃতি, রাজনীতিক আধুনিক রাজনীতিক ভূমিকা, রাজনীতিক উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ে আগ্রহ দেখান।
- (ঙ) আন্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
- (চ) অনগ্রসর ও উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থার আলোচনা আধুনিক তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ভুক্ত হয়।
সীমাবদ্ধতা: আধুনিক তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার। বনডেল (Jean Bondel) তাঁর Comparative Politics গ্রন্থে এই দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যাদির কথা উল্লেখ করেছেন। আলোচ্য দৃষ্টিভঙ্গিটির বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা বলা হয়।
- (১) সাম্প্রতিককালে তুলনামূলক রাজনীতির ধারণা যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। এর কোন সুস্পষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। তা ছাড়া এর বিষয়বস্তুও বিশেষভাবে অনির্দিষ্ট।
- (২) বর্তমানে রাজনীতিক প্রক্রিয়া ও সরকারী সংগঠনসমূহ অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির। তাই তুলনামূলক রাজনীতিক পর্যালোচনায় এই সমস্ত বিষয়ে যে সকল তথ্য ও পরিসংখ্যান সংগৃহীত হয়। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়।
- (৩) বর্তমানে তুলনামূলক রাজনীতির পর্যালোচনাকে অভিজ্ঞতাবাদী ও বিশ্লেষণাত্মক করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে অনুসৃত পন্থা-পদ্ধতি যথেষ্ট অর্থবহ নয়। পরিমাপ, সংখ্যায়ন প্রভৃতি পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে এ সবের প্রয়োগ সব সময় সমর্থন করা যায় না।
- (৪) অনগ্রসর ও উন্নয়নশীল দেশগুলিরও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মূল্যমান নিরপেক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
- (৫) তুলনামূলক রাজনীতির বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে উপাদানের প্রাচুর্য পরিলক্ষিত হয়। এই কারণে সব সময় এদের তুলনামূলক পদ্ধতিতে পর্যালোচনা করা যায় না।
Leave a comment