সাধারণভাবে বিজ্ঞান বলতে এক সুসংবদ্ধ বিশেষ জ্ঞানকে বােঝায়। ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ শব্দটির মধ্যে ‘বিজ্ঞান’ শব্দটি থাকায় অনেকদিন আগেই একটি বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যেও এই নিয়ে সংশয় ও মতবিরােধ রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা যায় কি না, তার পক্ষে ও বিপক্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যে মতামত প্রকাশ করেছেন, তা নীচে আলােচনা করা হল一

রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলার পক্ষে যুক্তি

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান কি না সে বিষয়ে মতামত দিতে গেলে বিজ্ঞান বলতে কী বােঝায়, সে সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার। বিজ্ঞান হল কোনাে বিষয়ে সুসংবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জ্ঞান, যা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে লাভ করা যায়।

[1] সুসংবদ্ধ জ্ঞান: যে-কোনাে সুসংবদ্ধ জ্ঞানকে বিজ্ঞান আখ্যা দেওয়া হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানও একটি বিজ্ঞান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষপ, শ্রেণি বিভক্তিকরণ, কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের মধ্য দিয়ে নাগরিকদের আচার-আচরণ, রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি প্রভৃতি সম্পর্কে সুসংবদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব।

[2] পর্যবেক্ষণ সম্ভব: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ও অ্যারিস্টটল। সেই সময় থেকেই রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু হয়, যা আজও চলছে। যেমন, মতেস্কুর ক্ষমতাম্বন্ত্রীকরণ নীতি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলি পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার ফল।

[3] পরীক্ষণ সম্ভব: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান আলােচ্য বিষয় হল মানুষ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ মানুষকে নিয়েই নিরন্তর পরীক্ষানিরীক্ষা করে চলেছেন। এই পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ আদর্শ ও জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের ছবি তুলে ধরেছেন।

[4] সাধারণ সূত্র প্রতিষ্ঠা: বিজ্ঞানের মতাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও আহরিত জ্ঞান থেকে একটি সাধারণ সূত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। সেই সূত্র অনেক সময়ই রাজনৈতিক সমস্যাসমাধানের পথ নির্দেশ করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।

[5] সর্বজনীন বিধি প্রণয়ন: অ্যারিস্টটল, ফাইনার, বােদা, ব্রাইস‌ প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক জীবন পর্যালােচনা করে। কয়েকটি সর্বজনীন বিধি ও পদ্ধতি প্রণয়নে প্রয়াসী হয়েছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনাে নির্দিষ্ট গবেষণাগার না থাকলেও বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক জীবনের বিবর্তন, উত্থানপতনের ইতিবৃত্ত, রাজনৈতিক কাঠামাের পরিবর্তন ইত্যাদির গবেষণা সর্বজনীন বিধি প্রণয়নে সাহায্য করে।

[6] তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানে শুধু তত্ত্বের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় না, বিজ্ঞানের মতাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও তথ্যের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্তে পোঁছােতে হয়। মানব ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ের তথ্যগুলি বিশ্লেষণের মাধ্যমে মার্কস ও এঙ্গে সমাজবিকাশের ধারার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

[7] মূল্যমান-নিরপেক্ষ আলােচনা: আধুনিক কালের আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গণিত ও পরিসংখ্যানের মাধ্যমে প্রয়ােজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল্যমান-নিরপেক্ষ আলােচনা গড়ে তােলেন। এইভাবে তাঁরা ভৌতবিজ্ঞানের মতাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি রূপায়ণে সচেষ্ট হন।

[8] ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব: রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও পদার্থবিদ্যা বা রসায়নবিদ্যার‌ মতাে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। যেমন, বর্তমানে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনের আগেই জনমত সমীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। এই ভবিষ্যদ্বাণী পুরােপুরি না মিললেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিলে যায়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলার বিপক্ষে যুক্তি

[1] অনিশ্চিত প্রকৃতিবিশিষ্ট: রাষ্ট্রবিজ্ঞান যেসব বিষয় নিয়ে আলােচনা করে তাদের প্রকৃতি অনিশ্চিত, জটিল ও পরিবর্তনশীল। পদার্থবিদ্যা বা রসায়নশাস্ত্রের মতাে এখানে নিখুঁত পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও‌ তত্ত্ব গঠন সম্ভব নয়।

[2] গবেষণাগারে পরীক্ষার অযােগ্য: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচিত বিষয়গুলি কোনাে নির্দিষ্ট গবেষণাগারে পরীক্ষা করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে সমগ্র মানবসমাজই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর গবেষণাগার। এই গবেষণাগার রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর ইচ্ছা অনুসারে নির্মিত হয় না। একজন ভৌতবিজ্ঞানী গবেষণাগারে যেভাবে গবেষণার অনুকূল পরিবেশ কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করতে পারেন, একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর পক্ষে তা সম্ভব নয়।

[3] তথ্য অপেক্ষা তত্ত্বের প্রাধান্য: বিজ্ঞানীরা যেভাবে তত্ত্ব ও তথ্যের ওপর সমান গুরুত্ব দিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুশীলন করে থাকেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তা দেখা যায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তথ্যের চেয়ে তত্ত্ব বেশি প্রাধান্য পায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের পরিবর্তে দার্শনিক চিন্তার ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

[4] সর্বসম্মত পদ্ধতির অনুপস্থিতি: বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতাে সর্বসম্মত পদ্ধতি বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কিছু দেখা যায় না। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকেন।

[5] মূল্যমান-নিরপেক্ষ নয়: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনাকে কখনও ভৌতবিজ্ঞানের মতাে সম্পূর্ণ মূল্যমান-নিরপেক্ষ করে গড়ে তোলা যায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর এইপ্রকার গবেষণাসমূহ তাঁর রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়।

[6] সংখ্যায়নের প্রয়ােগ অফলপ্রসূ: ভৌতবিজ্ঞানের গবেষণায় যেভাবে সংখ্যায়নের (Quantification) সাহায্যে গবেষণার ফলাফলকে প্রকাশ করা যায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তা অসম্ভব। সংখ্যায়নের সাহায্যে মানুষের রাজনৈতিক আচরণের যথার্থ স্বরূপ উদঘাটন কোনােভাবেই সম্ভব নয়।

[7] সর্বজনীনতার অভাব: ভৌতবিজ্ঞানের পরীক্ষিত ফলাফলগুলি যে-কোনাে দেশেই প্রয়ােগ করা যায়, যার ফলে একটা সর্বজনীনতা দেখা যায়। অন্যদিকে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গবেষণার ফলাফল সব দেশে সার্বিকভাবে প্রয়ােগ করা যায় না।

[8] সূত্রের প্রতিষ্ঠা অসম্ভব: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৌল আলােচ্য বিষয় হল, মানুষের রাজনৈতিক আচার-আচরণ। রাজনৈতিক আচার-আচরণের সঙ্গে জড়িত মানুষের অনুভূতি ও আবেগ বহু ধরনের উপাদানের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এজন্য ভৌতবিজ্ঞানের মতো কোনাে সাধারণ নিয়ম বা সূত্র রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গড়ে তােলা যায় না৷

[9] ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা-নিরপেক্ষ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পৃথকভাবে ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তাভাবনা, কাজকর্ম ইত্যাদিকে ফলিত গবেষণার অন্তর্ভুক্ত করা যায় না| মরিস কর্নফোর্থের মতে, কোনাে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে যেমন ব্যক্তিমানুষের সামাজিক সম্পর্ককে পরীক্ষা করা যায় না, ঠিক তেমনই কোনাে রাসায়নিক পদার্থের সাহায্যে তার প্রকৃতিকে আবিষ্কার করাও সম্ভবপর নয়।

উপসংহার: পরিশেষে উল্লেখ্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে পদার্থবিদ্যা বা গণিতশাস্ত্রের মতাে বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বলা না গেলেও এটি যে একটি সুসংহত সামাজিক বিজ্ঞান, তা নিয়ে কোনাে দ্বিমত নেই। লর্ড ব্রাইসের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল একটি প্রগতিশীল বিজ্ঞান (Political science is a progressive science.)।